ঢাকা , মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আমাদের প্রতিক্রিয়াধর্মী নগরায়ণ হয়েছে ড. আদনান মোরশেদ

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ এমআইটির স্থাপত্য বিভাগ থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন। ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্ট থেকে প্রি-ডক্টরাল ফেলোশিপ ও স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশন থেকে পোস্ট-ডক্টরাল সম্পন্ন। বর্তমানে কাজ করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের চেয়ারপারসন হিসেবে। তিনি সোসাইটি অব আর্কিটেকচারাল হিস্টোরিয়ানসের বোর্ড অব ডিরেক্টরসের সদস্য, ন্যাশনাল এনডোমেন্ট ফর দ্য হিউম্যানিটিজ গ্রান্টের বিচারক এবং ২০১৫ অ্যালিস ডেভিস হিচকক বুক অ্যাওয়ার্ডের জন্য সোসাইটি অব আর্কিটেকচারাল হিস্টোরিয়ানস কমিটির প্রধান ছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আধুনিক স্থাপত্য, নগরায়ণের ইতিহাস ও তত্ত্ব, বৈশ্বিক ইতিহাস, শহুরে পরিবেশবিদ্যা এবং উন্নয়নশীল দেশের টেকসই নগরায়ণ প্রকল্প নিয়ে অসংখ্য বক্তব্য রেখেছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের নগরায়ণ, বর্তমান প্রেক্ষাপট, রাজধানী ঢাকার উন্নয়ন, মানবিক নগর তৈরিসহ বিভিন্ন বিষয়ে একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে কথা বলেন। তা হুবহু তুলে ধারা হলো
বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়ণ ঘটছে। এটা কি সঠিক পথে হচ্ছে?
কয়েক দশক ধরেই বিশ্বে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা অর্থাত্ পাশ্চাত্য বিশ্বের বলয়ের বাইরে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রথম নগরসভ্যতার ইতিহাস তৈরি হয় একুশ শতকে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের বেশি এখন নগরে বসবাস করে। ২০৫০ সালের মধ্যেই এ সংখ্যা ৭৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। আর সবচেয়ে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে এশিয়ায়। দক্ষিণ এশিয়ায় ছয়-সাতটি মেগা বা মেট্রোপলিস রয়েছে, যেগুলোয় এক কোটির বেশি মানুষ বাস করে। বাংলাদেশের নগরায়ণের মৌলিক কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ ছিল শাশ্বত সবুজের গ্রামীণ সভ্যতার দেশ। ১৯৭১ সালে আমাদের নগরগুলোয় জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৭ শতাংশ। অর্থাত্ আমরা যখন স্বাধীন হলাম তখনো মোটামুটি গ্রামীণ আবহ ছিল। আশির দশকে অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি ও বৈশ্বিক ধারার প্রেক্ষাপটে নগরায়ণ শুরু হয়। আশির দশক থেকে নগরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে এবং নব্বইয়ের দশকে জোরালোভাবে নগরায়ণ হয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও নগরায়ণ হলো একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। কিন্তু কৃষিভিত্তিক সমাজের কিছু মৌলিক সীমাবদ্ধতা থাকে। কৃষিভিত্তিক সমাজে নগরায়ণের ক্ষেত্রে ভবিষ্যত্ দেখার সুযোগ কম থাকে। আমরা যেহেতু শাশ্বতভাবে গ্রামীণ সমাজ, তাই আমাদের জাতীয় চরিত্রে ভবিষ্যত্ দেখার প্রবণতা কম। আমরা ভবিষ্যত্ দেখতে চাই না। এখানে নগরায়ণ অনেকটা ‘ফেইটালিজম’-এর মতো। অর্থাত্ ভাগ্যবাদের মতো করে বিবর্তিত হতে থাকবে। নগরের ভবিষ্যত্ কী হবে তা আমরা ভাবি না বা দেখার চেষ্টা করি না। অথবা ভাবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি। ফলে আমাদের এখানে প্রতিক্রিয়াধর্মী নগরায়ণ হয়েছে। যেমন— আবাসন লাগবে, জমি ভরাট করে বাসা তৈরি করা হলো। একে আমি বলছি প্রতিক্রিয়াধর্মী নগরায়ণ। অর্থাত্ সমস্যার উত্তরে একটা সমাধান দেয়া। কিন্তু আমরা যদি কোনো বিশ্বমানের নগর দেখি যেমন— নিউইয়র্ক বা লন্ডন, তাহলে দেখব, ওদের পরিকল্পনা ভবিষ্যত্ দেখার একটা পদ্ধতি হিসেবে কাজ করেছে। নিউইয়র্কের যারা নগর প্রশাসক, তারা আগে থেকেই ভাবতে চেষ্টা করছেন যে, আগামীতে কী ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হবে। নিউইয়র্কের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই, উনিশ শতকের শেষদিকে যখন এখানে জোরকদমে নগরায়ণ হচ্ছিল, নগর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তখন তত্কালীন নগর প্রশাসকরা সক্রিয়ভাবে ভবিষ্যতের কথা ভেবে পরিকল্পনা করলেন এবং সেভাবে নগর তৈরি হলো। কিন্তু আমাদের এখানে পরিকল্পনা সবসময় প্রতিক্রিয়াভিত্তিক। এ কারণেই জলবদ্ধতা, আবাসিক সমস্যার মতো সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা শহরেই ৩০ লাখের মতো পোশাক কর্মী রয়েছেন। আমরা এদের নিয়ে ভবিষ্যত্ ভাবতে পারিনি। পোশাক খাতের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে যে স্রোতের মতো মানুষ আসবে তা আমরা ভাবিনি। তাদের আবাসন সংকট দেখা দেবে, সেটা ভাবিনি। এজন্য মানুষ এসে পড়ার পর খাল ভরাট করে আবাসন তৈরি করে ফেলা হলো। মানুষের চাপে নদী-নালা, খাল-বিল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকার পূর্বাঞ্চলের নিম্ন  জলাভূমিগুলো— যেগুলো ‘ইকোলজিক্যাল রিজার্ভ ওয়্যার’ হিসেবে কাজ করে, যেখানে বৃষ্টির, নদী-নালা, খাল-বিলের পানি গিয়ে জমা হবে এবং শহরকে জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা করবে— সেগুলো ভরাট করা হচ্ছে। অথচ ঢাকা যদি পাশ্চাত্য বিশ্বের নগরী হতো তাহলে শহরের পরিধি ও জনসংখ্যা বাড়তে শুরু করার সময়ই সরকার আশপাশের জলাভূমিগুলো সংরক্ষণ করত। এগুলো সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দিয়ে কাউকে তা দখল করতে দিত না। আমেরিকায় একে বলা হয় ‘ইমিনেন্ট ডোমেইন’। এ ধারণা অনুযায়ী, রাষ্ট্র যদি মনে করে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে এবং জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে কোনো স্থান সংরক্ষিত করা উচিত তাহলে রাষ্ট্র এর অধিগ্রহণ করবে, সংরক্ষণ করবে। আমরা প্রতিক্রয়াধর্মী হওয়ায় এগুলো আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। কীভাবে ‘ইকোলজিক্যালি সেনসেটিভ’ জলাভূমিগুলো কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়? কোনো সচেতন নগর প্রশাসন কোনো দিনই এগুলোকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হতে দিত না। তারা এগুলো সংরক্ষণ করত। নিউইয়র্ক, প্যারিসের কথা বাদ দিলাম, কলকাতাও আমাদের থেকে বেশি সচেতন। ওরা এ ধরনের সেনসেটিভ ইকোলজিক্যাল এরিয়াগুলো সংরক্ষণ করেছে। আমাদের নগরায়ণ হয়েছে সাময়িক সমাধানের নগরায়ণ। ঢাকা শহরের জলভূমিগুলো সংরক্ষণ না করতে পারার ব্যর্থতায় আজ জলাবদ্ধতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অন্যদিকে উন্নয়নের ধারণাটাও অনেক সময় দেখা যায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক। আমাদের ডেভেলপাররা নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট করে যদি বিল্ডিং ওঠাতে পারে তাহলে সেটাকে মনে করা হয় উন্নয়নের প্রতীক। একে আমরা বলি মধ্যবিত্তায়ন। অন্যদিকে আমাদের উন্নয়নের ধারণাটা প্রতীকনির্ভর। একটি খাল সংরক্ষণ করলে যেহেতু এর প্রতীকী ব্যঞ্জনা নেই, তাই আমরা কিছু দেখতে পাই না। আমাদের মানসিকতা সেভাবে তৈরি হয়নি।
এ ধারা পরিবর্তনের জন্য কী করা যেতে পারে?
শহরে সমস্যা হবেই। উন্নত, উন্নয়নশীল সব দেশেই হচ্ছে। নগর প্রশাসনের একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা গঠন করতে হবে। ঢাকা শহরে ৫০টির ওপর নগরসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এদের এক ছাতার নিচে আনতে হবে। তবে শুধু নগরসেবা বা পরিকল্পনাকে একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আনলে পরিবর্তন আসবে না। কাউকে না কাউকে রাতে ঘুমানোর আগে ভাবতে হবে শহরের সমস্যার কথা, সকালে ঘুম থেকে উঠে এগুলো সমাধানের জন্য নিরন্তরভাবে কাজ করতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ঢাকা শহর নিয়ে কেউই এ দায়িত্ব নিচ্ছে না।
চট্টগ্রামেও প্রতীকী উন্নতি বেশি হচ্ছে। যেমন— আকতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভার। এটি একটি অশুভ অজগরের মতো পুরো শহরে সবার কাঁধে চেপে রয়েছে। এতে কেউ উঠছে না, কাজ হয়েছে নিম্নমানের। আরেকটি বিষয় হলো, এটির ড্রেনেজ সিস্টেম। একটি ভালো ফ্লাইওভারে ড্রেনেজ সিস্টেমটা কনস্ট্রাকশনের ভেতরেই থাকে, বৃষ্টির পানি জমা হয়ে ড্রেনের ভেতর দিয়ে মাটির নিচে চলে যায়। আমি কোথাও দেখিনি ফ্লাইওভারে পাইপ দিয়ে ২০ ফুট পরপর পানি ফেলা হচ্ছে জলপ্রপাতের মতো। প্রথমত. যেখানে পানিটা পড়বে, সেখানে ধীরে ধীরে বিশাল গর্ত হয়ে যাবে, নিচের রাস্তা কোনোভাবেই ঠিক থাকবে না। এছাড়া ওই পাইপ দিয়ে পাথর পড়লে মানুষ আহত হবে, যানবাহনের ক্ষতি হবে। পরিকল্পনা করতে হবে সমস্যার আলোকে এবং আগামীতে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে, তা বোঝার প্রবণতা তৈরি করতে হবে।
কেমন নগর প্রশাসন দরকার?
নগর প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। মেয়র নির্বাচনের ক্ষেত্রে, যিনি নগরের সমস্যা বোঝেন, তাকে নির্বাচিত করতে হবে। মেয়রের মধ্যে রাজনীতির পাশাপাশি প্রযুক্তিগত গুণের সমন্বয় থাকতে হবে। যোগ্য ব্যক্তিকে মেয়র পদে আনতে হবে। আর রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব যোগ্য ব্যক্তিকে সামনে নিয়ে আসা। ক্ষমতায় এলে দলগুলো কিছু প্রতীকী উন্নয়ন করে। আমাদের প্রতীকী নগরায়ণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, দেশে অবকাঠামো নির্মাণ প্রতিযোগিতা চলছে। এতে কি সমাধান আসবে?
এটা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, উন্নয়নশীল অন্য দেশগুলোয়ও অবকাঠামো নির্মাণ, যেমন— ফ্লাইওভার, চার লেন সড়ক, টানেল ইত্যাদি তৈরি করার প্রতিযোগিতা চলছে। কারণ বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতা সংস্থা ও দাতা দেশগুলো এগুলোয় বিনিয়োগ করার জন্য এগিয়ে আসে। আবার যেমন ধরুন, ফ্লাইওভার বানালে গাড়ির সংখ্যা বাড়বে। এতে গাড়ি বিক্রি বাড়বে। সুতরাং এখানে একটা অর্থনৈতিক সমীকরণও কাজ করে। অর্থনৈতিক ব্যাপারও কাজ করে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসেছিল। তারা পূর্ব ঢাকা নিয়ে একটা প্রোগ্রাম করল— ঢাকা ২০৩৫। অকল্পনীয় প্রস্তাব। একটা স্পর্শকাতর জলাভূমির জায়গায় ২০৩৫ সালের মধ্যে আরেকটা ঢাকা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। বিশ্বব্যাংক কিন্তু লন্ডন বা নিউইয়র্কে গিয়ে এ ধরনের প্রস্তাব দেয়ার সাহস পাবে না। এ ধরনের বৃহত্ দাতাগোষ্ঠী আসেই এমন জায়গায় বিনিয়োগ করতে যেন সেখানে গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়নের একটা অংশ থাকে। যেমন— গাড়ি বিক্রি। নগরের ১৫ শতাংশকে লক্ষ করে (যাদের পকেট ভারী) আমরা নগরায়ণ করছি। আমরা এত ফ্লাইওভার কেন করব?
যেখানে প্রয়োজন সেখানে দু-একটা ফ্লাইওভার বানানো যেতে পারে। আমাদের মতো দেশে যেখানে ৭০ শতাংশ লোক পায়ে হেঁটে কর্মক্ষেত্রে যায়, সেখানে আমাদের প্রয়োজন ফুটপাত বাড়ানো। আমাদের বিনিয়োগ হওয়া উচিত ফুটপাতের ওপর। আমাদের লক্ষ্য হবে পথিককেন্দ্রিক নগরায়ণের দিকে। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত কীভাবে গাড়ির চাহিদা কমিয়ে আনা যায়। যেমন— যাদের পরিবার উত্তরায় থাকে, সেখানেই স্বয়ংসম্পূর্ণ নগরায়ণ করতে হবে, যাতে তাদের বাইরে আসতে না হয়। বাসার কাছাকাছি যদি স্কুল, হাসপাতাল ইত্যাদি থাকে তাহলে আমাদের গাড়ি ব্যবহার করতে হবে না। পথ চলাচলের জন্য সুন্দর ফুটপাত থাকলে গাড়ির প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে। বিশ্বের সব মানসম্পন্ন শহরে ব্যক্তিগত গাড়ি কেনাকে নিরুত্সাহিত করা হচ্ছে। গাড়ির বদলে মেট্রো বা বাস ব্যবহারের সদিচ্ছা তৈরিতে সামাজিক ক্যাম্পেইন চালানো হচ্ছে। এজন্য এসব শহরের নতুন প্রজন্ম গাড়ি কিনতে চায় না। তারা সাইকেল ব্যবহারে বেশি উত্সাহী। সাইকেল ও বাস ব্যবহার এখন বাসযোগ্য নগরায়ণের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের উন্নয়নশীল অনেক দেশের শহরগুলোয় অবকাঠামোর ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। কেননা এগুলো সবচেয়ে চাক্ষুষ প্রতীক এবং আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণী এগুলো নিয়ে খুব গর্ববোধ করে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, আমাদের নিউইয়র্ক বা লন্ডন হওয়ার দরকার নেই, আমাদের ঢাকার মতোই নগরায়ণ করতে হবে। আত্মবিশ্বাস আসতে পারে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব থেকে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুস্থ নগরায়ণের জন্য অনেক কিছু চিন্তা করেন। তিনি নদীরক্ষা, সুস্থ নগরায়ণের বিষয়ে অনেক সচেতন। কিন্তু একজন সচেতন হলে হবে না। সচেতনতার সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে। আমলাতান্ত্রিকতায় যদি আমরা সুস্থ নগরায়ণের সংস্কৃতি ও আত্মবিশ্বাস না আনতে পারি তাহলে মানসম্পন্ন শহর তৈরি করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী কিংবা দু-একজন মন্ত্রীর সদিচ্ছা দিয়ে দেশের সার্বিক উন্নতি হবে না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সুস্থ নগরায়ণে নাগরিক দায়িত্ব গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, ৫০ গজ দূরে বাজার, সেখানে তো গাড়ি নিয়ে যাওয়ার কোনো দরকার নেই; হেঁটেই যাওয়া যায়। আবার সন্তানদের স্কুলের বাসে পাঠানো। কিন্তু এক ধরনের আভিজাত্যের কারণে এগুলো করা হয় না। মধ্যবিত্তায়ন মানেই হচ্ছে প্রতীক নির্ভরতা।
কিছু অর্থ হলেই গাড়ি কেনা হচ্ছে। এ ধরনের অসুস্থ মানসিকতা থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে থাকলে তৃণমূল পর্যায়ে ভালো নগরায়ণ হবে। এজন্য আমার মনে হয়, এক ধরনের সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজন রয়েছে। নাটক, গান ইত্যাদি জনপ্রিয় সংস্কৃতির মাধ্যমে সুস্থ নগরায়ণের বার্তা দিতে হবে। নদীদূষণের মতো বিষয়গুলো শুধু আইন করে ঠেকানো যাবে না। এগুলোর জন্য সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। তবে সুস্থ নগরায়ণের জন্য পরিবর্তনের তাত্ক্ষণিক কোনো সমাধান নেই এবং এর কোনো প্রযুক্তিগত সমাধানও নেই। আমাদের দেশে এখনো ৭০ ভাগ লোক গ্রামে এবং ৩০ ভাগ লোক শহরে বাস করে। আমাদের সাংস্কৃতিকভাবে পরিবর্তন আনতে হবে। ঢাকার যানজটের প্রযুক্তিগত সমাধান রয়েছে— এই অলীক ধারণার বাইরে না যেতে পারলে এ সমস্যার সমাধান আসবে না। বুঝতে হবে আমাদের স্থানিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা এখানে অফুরন্ত রাস্তাঘাট বানাতে পারব না।
শহরের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা তো ভালো না…
এ জন্য আমরা গাড়ি কেনার ইচ্ছাটাকেও দোষারোপ করতে পারি না। আমরা চাইতেই পারি যে, আমাদের সন্তানরা একটু নিরাপদে যাতায়াত করুক। এটা দোষের নয়। কিন্তু আমরা যদি আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা ও গণপরিবহন ব্যবস্থায় উন্নতি করতে পারি তাহলে মানুষ কিন্তু আস্তে আস্তে এগুলো ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। এছাড়া স্বাস্থ্যের একটা ব্যাপার রয়েছে। আজকে উন্নত বিশ্বে বিশ্বমানের যেসব শহর রয়েছে, সেখানে নগর পরিকল্পনার মাধ্যমে মানুষকে হাঁটানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এতে স্বাস্থ্যচর্চা হচ্ছে, অনেক রোগ থেকে মুক্ত থাকা যাচ্ছে।
অনেক উপকারী প্রকল্প নেয়া হয়েছিল কিন্তু বাস্তবায়ন করা যায়নি…
বাস্তবায়ন করতে না পারার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। একটা বিষয় হলো, রাজউক পরিকল্পনা করে, উন্নয়ন করে, আবার তা মনিটর করে। এটা কিছুটা স্ববিরোধী অবস্থান। রাজউক পরিকল্পনা করে কিন্তু এটির জন্য যে গবেষণার প্রয়োজন, তার জন্য কি তাদের জনবল রয়েছে? এছাড়া অনুমাননির্ভর এক ধরনের পরিকল্পনা করার মানসিকতা আমাদের রয়েছে।
গবেষণা ও তথ্য ছাড়া শুধু অনুমাননির্ভর জগতে থাকলে কখনই সুস্থ নগরায়ণ হবে না। লেক করা হচ্ছে কিন্তু তা হচ্ছে নান্দনিক, কার্যকর নয়। দেখা যাচ্ছে লেকে পানি নেই, অথচ রাস্তা পানিতে ডুবে রয়েছে। আমাদের নগরায়ণ হচ্ছে, শহরের বিস্তৃতি ঘটছে। ইট আর কংক্রিটের চাদরে মুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে কিন্তু বৃষ্টির পানিটা কীভাবে নিচে যাবে তা নিয়ে চিন্তা করা হচ্ছে না। আমাদের ওয়াটার টেবিল নেমে যাচ্ছে। কারণ কংক্রিটের সারফেসের কারণে পানি মাটিতে যেতে পারছে না। আজকের বিশ্বমানের সব শহরে ‘পারমিয়েবল সারফেস’ থাকে; অর্থাত্ কিছু অংশ ঘাস, কিছু অংশ কংক্রিট, যাতে পানি নিচে যেতে পারে। এগুলো আমাদের এখানে হচ্ছে না। কারণ রাজউকের গবেষণা সেল নেই। আমাদের নদী-নালা, খাল-বিল ড্রেনের কী অবস্থা হচ্ছে, তার জন্য টপোগ্রাফিক ম্যাপ থাকতে হবে। অন্যদিকে আমাদের দেশে মধ্যবিত্তায়ন মানে গাড়ি কিনতে হবে, সবাইকে দেখাতে হবে। এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এটা এক প্রজন্মে হবে না। আমাদের যুব জনসংখ্যার ওপর বিনিয়োগ করতে হবে। তাদের সাইকেল চালাতে, গাছ রোপণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকার কথাও অনেকে বলেন…
অনেক উন্নয়নশীল অর্থনীতিতেই এমন সমন্ব্বয়হীনতা রয়েছে। এর সমাধান হলো, নগর প্রশাসনকে কিছুটা পিরামিডাল আকৃতির ব্যবস্থায় আনতে হবে। কিন্তু এরও একটি সমস্যা রয়েছে। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে এর অপব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।
আমরা নগর পরিকল্পনায় পরিবেশকে তেমন গুরুত্ব দেইনি, এখন আবার এ কথা বলা হচ্ছে…
সঠিক পরিকল্পনার কারণে আমরা অনেক ক্ষতি করে ফেলেছি। শহরের ভৌগোলিক পরিবর্তন করে ফেলেছি। তবে এখন হা-হুতাশ করা বাদ দিয়ে প্রো-অ্যাক্টিভ হতে হবে। আমাদের কিছু সাময়িক সমাধানের দিকে আবার কিছু দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের দিকে যেতে হবে। দীর্ঘমেয়াদির মধ্যে রয়েছে যুবসমাজের ওপর বিনিয়োগ করা, তাদের বোঝাতে হবে পরিবেশ সংরক্ষণ একটি নৈতিক দায়িত্ব। ঢাকা শহরের জন্য ৫০টির ওপর নগরসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে কিন্তু কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না। দায়িত্ব নেয়ার একটা ‘কনসলিডেটেড অর্গানাইজেশন’ দরকার। একটি মানবিক শহরের যেসব গুণাবলি থাকা দরকার, তা কি ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে রয়েছে? অবশ্যই নেই। আমার দৃষ্টিতে মানবিক শহরের অন্যতম সংজ্ঞা হলো, শহরের প্রতি সহজাত দরদ থাকতে হবে। এ দরদ না থাকলে কখনই মানসম্পন্ন শহর গড়ে তোলা যাবে না। এ দরদ এমন, কলার খোসা যেখানে সেখানে ফেলব না। কারণ যেখানে সেখানে ফেললে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। মাইক্রো লেবেলে নগরবাসীর চিন্তা-চেতনায় যদি এটা না আসে যে, নগরকে রক্ষা করা, পরিষ্কার রাখা, সংরক্ষণ করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব, ততদিন মানবিক শহর গড়ে উঠবে না। আরো যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে হবে। নিরাপত্তার যদি মৌলিক অনুভূতি না থাকে, তাহলে সেটি কখনো মানবিক শহর হবে না। ভালো শিক্ষা ব্যবস্থা, ভালো আবাসন ব্যবস্থা থাকতে হবে। নাগরিকদের শহরের মৌলিক বিষয়গুলো জানতে হবে। যেমন— যারা উত্তরায় থাকে, তাদের মধ্যে অনেকে বড় হবে অথচ সারা জীবনে বুড়িগঙ্গা দেখবে না— এটা মানবিক শহরের লক্ষণ নয়। শহরের সঙ্গে নাগরিকদের একাত্ম হতে হবে। আমাদের জাতীয় সংসদের স্থপতি লুই কান মানবিক শহরের একটা সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যে শহর একটি ছোট শিশুকে স্বপ্ন দেখায়, সে শহর একটি মানবিক শহর।
সবকিছু শহরকেন্দ্রিক না করে বিকেন্দ্রীকরণ করা যায় কিনা?
অবশ্যই বিকেন্দ্রীকরণ করা উচিত। বিকেন্দ্রীকরণ করতে হলে কিছু মৌলিক স্থাপনাকে সরাতে হবে। রাজধানীর বাইরে যারা থাকেন, তাদের একটি সাধারণ ধারণা— যদি উন্নতি করতে হয়, মধ্যবিত্তায়ন হতে হয়, তবে ঢাকায় যেতেই হবে। এ ভুল ধারণাকে একেবারে ভাঙতে হবে। এজন্য বিভিন্ন এলাকায় উন্নত মানের বিশ্ববিদ্যালয় করতে হবে, বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে ঢাকার মানুষ যাবে। সরকারের উচিত হবে একটি-দুটি মন্ত্রণালয় অন্য শহরে নিয়ে যাওয়া। এমনকি রাজধানীকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ঢাকাকে বাণিজ্যিক রাজধানী করে আরেকটি শহরকে প্রশাসনিক রাজধানী করা যেতে পারে।
পুরো দেশকে নিয়ে পরিকল্পনা কীভাবে করা যাবে?
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ। এজন্য আমাদের দেশের প্রতিটি বর্গ ইঞ্চি পরিকল্পনার আওতায় আনতে হবে। পরিকল্পনা আমাদের বিলাসিতা বা দৃষ্টিনন্দন চর্চা নয়। পরিকল্পনা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন এজন্য যে, আমাদের দেশ ছোট কিন্তু জনসংখ্যা বেশি। তবে পরিকল্পনার সর্বজনীন কোনো সংজ্ঞা নেই। পরিকল্পনা করতে হলে অঞ্চলভিত্তিক ভৌগোলিক চরিত্র বুঝতে হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের পরিকল্পনা এক হবে না। আমাদের পরিকল্পনা হতে হবে স্থানকেন্দ্রিক। (বণিক বার্তা)
Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

আমাদের প্রতিক্রিয়াধর্মী নগরায়ণ হয়েছে ড. আদনান মোরশেদ

আপডেট টাইম : ১১:৫৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৫ অক্টোবর ২০১৭
বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ এমআইটির স্থাপত্য বিভাগ থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন। ওয়াশিংটনের ন্যাশনাল গ্যালারি অব আর্ট থেকে প্রি-ডক্টরাল ফেলোশিপ ও স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশন থেকে পোস্ট-ডক্টরাল সম্পন্ন। বর্তমানে কাজ করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের চেয়ারপারসন হিসেবে। তিনি সোসাইটি অব আর্কিটেকচারাল হিস্টোরিয়ানসের বোর্ড অব ডিরেক্টরসের সদস্য, ন্যাশনাল এনডোমেন্ট ফর দ্য হিউম্যানিটিজ গ্রান্টের বিচারক এবং ২০১৫ অ্যালিস ডেভিস হিচকক বুক অ্যাওয়ার্ডের জন্য সোসাইটি অব আর্কিটেকচারাল হিস্টোরিয়ানস কমিটির প্রধান ছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আধুনিক স্থাপত্য, নগরায়ণের ইতিহাস ও তত্ত্ব, বৈশ্বিক ইতিহাস, শহুরে পরিবেশবিদ্যা এবং উন্নয়নশীল দেশের টেকসই নগরায়ণ প্রকল্প নিয়ে অসংখ্য বক্তব্য রেখেছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের নগরায়ণ, বর্তমান প্রেক্ষাপট, রাজধানী ঢাকার উন্নয়ন, মানবিক নগর তৈরিসহ বিভিন্ন বিষয়ে একটি জাতীয় দৈনিকের সঙ্গে কথা বলেন। তা হুবহু তুলে ধারা হলো
বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়ণ ঘটছে। এটা কি সঠিক পথে হচ্ছে?
কয়েক দশক ধরেই বিশ্বে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা অর্থাত্ পাশ্চাত্য বিশ্বের বলয়ের বাইরে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রথম নগরসভ্যতার ইতিহাস তৈরি হয় একুশ শতকে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের বেশি এখন নগরে বসবাস করে। ২০৫০ সালের মধ্যেই এ সংখ্যা ৭৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। আর সবচেয়ে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে এশিয়ায়। দক্ষিণ এশিয়ায় ছয়-সাতটি মেগা বা মেট্রোপলিস রয়েছে, যেগুলোয় এক কোটির বেশি মানুষ বাস করে। বাংলাদেশের নগরায়ণের মৌলিক কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ ছিল শাশ্বত সবুজের গ্রামীণ সভ্যতার দেশ। ১৯৭১ সালে আমাদের নগরগুলোয় জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৭ শতাংশ। অর্থাত্ আমরা যখন স্বাধীন হলাম তখনো মোটামুটি গ্রামীণ আবহ ছিল। আশির দশকে অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি ও বৈশ্বিক ধারার প্রেক্ষাপটে নগরায়ণ শুরু হয়। আশির দশক থেকে নগরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে এবং নব্বইয়ের দশকে জোরালোভাবে নগরায়ণ হয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও নগরায়ণ হলো একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। কিন্তু কৃষিভিত্তিক সমাজের কিছু মৌলিক সীমাবদ্ধতা থাকে। কৃষিভিত্তিক সমাজে নগরায়ণের ক্ষেত্রে ভবিষ্যত্ দেখার সুযোগ কম থাকে। আমরা যেহেতু শাশ্বতভাবে গ্রামীণ সমাজ, তাই আমাদের জাতীয় চরিত্রে ভবিষ্যত্ দেখার প্রবণতা কম। আমরা ভবিষ্যত্ দেখতে চাই না। এখানে নগরায়ণ অনেকটা ‘ফেইটালিজম’-এর মতো। অর্থাত্ ভাগ্যবাদের মতো করে বিবর্তিত হতে থাকবে। নগরের ভবিষ্যত্ কী হবে তা আমরা ভাবি না বা দেখার চেষ্টা করি না। অথবা ভাবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি। ফলে আমাদের এখানে প্রতিক্রিয়াধর্মী নগরায়ণ হয়েছে। যেমন— আবাসন লাগবে, জমি ভরাট করে বাসা তৈরি করা হলো। একে আমি বলছি প্রতিক্রিয়াধর্মী নগরায়ণ। অর্থাত্ সমস্যার উত্তরে একটা সমাধান দেয়া। কিন্তু আমরা যদি কোনো বিশ্বমানের নগর দেখি যেমন— নিউইয়র্ক বা লন্ডন, তাহলে দেখব, ওদের পরিকল্পনা ভবিষ্যত্ দেখার একটা পদ্ধতি হিসেবে কাজ করেছে। নিউইয়র্কের যারা নগর প্রশাসক, তারা আগে থেকেই ভাবতে চেষ্টা করছেন যে, আগামীতে কী ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হবে। নিউইয়র্কের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই, উনিশ শতকের শেষদিকে যখন এখানে জোরকদমে নগরায়ণ হচ্ছিল, নগর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল, তখন তত্কালীন নগর প্রশাসকরা সক্রিয়ভাবে ভবিষ্যতের কথা ভেবে পরিকল্পনা করলেন এবং সেভাবে নগর তৈরি হলো। কিন্তু আমাদের এখানে পরিকল্পনা সবসময় প্রতিক্রিয়াভিত্তিক। এ কারণেই জলবদ্ধতা, আবাসিক সমস্যার মতো সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা শহরেই ৩০ লাখের মতো পোশাক কর্মী রয়েছেন। আমরা এদের নিয়ে ভবিষ্যত্ ভাবতে পারিনি। পোশাক খাতের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে যে স্রোতের মতো মানুষ আসবে তা আমরা ভাবিনি। তাদের আবাসন সংকট দেখা দেবে, সেটা ভাবিনি। এজন্য মানুষ এসে পড়ার পর খাল ভরাট করে আবাসন তৈরি করে ফেলা হলো। মানুষের চাপে নদী-নালা, খাল-বিল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকার পূর্বাঞ্চলের নিম্ন  জলাভূমিগুলো— যেগুলো ‘ইকোলজিক্যাল রিজার্ভ ওয়্যার’ হিসেবে কাজ করে, যেখানে বৃষ্টির, নদী-নালা, খাল-বিলের পানি গিয়ে জমা হবে এবং শহরকে জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা করবে— সেগুলো ভরাট করা হচ্ছে। অথচ ঢাকা যদি পাশ্চাত্য বিশ্বের নগরী হতো তাহলে শহরের পরিধি ও জনসংখ্যা বাড়তে শুরু করার সময়ই সরকার আশপাশের জলাভূমিগুলো সংরক্ষণ করত। এগুলো সংরক্ষিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দিয়ে কাউকে তা দখল করতে দিত না। আমেরিকায় একে বলা হয় ‘ইমিনেন্ট ডোমেইন’। এ ধারণা অনুযায়ী, রাষ্ট্র যদি মনে করে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে এবং জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে কোনো স্থান সংরক্ষিত করা উচিত তাহলে রাষ্ট্র এর অধিগ্রহণ করবে, সংরক্ষণ করবে। আমরা প্রতিক্রয়াধর্মী হওয়ায় এগুলো আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। কীভাবে ‘ইকোলজিক্যালি সেনসেটিভ’ জলাভূমিগুলো কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়? কোনো সচেতন নগর প্রশাসন কোনো দিনই এগুলোকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হতে দিত না। তারা এগুলো সংরক্ষণ করত। নিউইয়র্ক, প্যারিসের কথা বাদ দিলাম, কলকাতাও আমাদের থেকে বেশি সচেতন। ওরা এ ধরনের সেনসেটিভ ইকোলজিক্যাল এরিয়াগুলো সংরক্ষণ করেছে। আমাদের নগরায়ণ হয়েছে সাময়িক সমাধানের নগরায়ণ। ঢাকা শহরের জলভূমিগুলো সংরক্ষণ না করতে পারার ব্যর্থতায় আজ জলাবদ্ধতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অন্যদিকে উন্নয়নের ধারণাটাও অনেক সময় দেখা যায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক। আমাদের ডেভেলপাররা নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট করে যদি বিল্ডিং ওঠাতে পারে তাহলে সেটাকে মনে করা হয় উন্নয়নের প্রতীক। একে আমরা বলি মধ্যবিত্তায়ন। অন্যদিকে আমাদের উন্নয়নের ধারণাটা প্রতীকনির্ভর। একটি খাল সংরক্ষণ করলে যেহেতু এর প্রতীকী ব্যঞ্জনা নেই, তাই আমরা কিছু দেখতে পাই না। আমাদের মানসিকতা সেভাবে তৈরি হয়নি।
এ ধারা পরিবর্তনের জন্য কী করা যেতে পারে?
শহরে সমস্যা হবেই। উন্নত, উন্নয়নশীল সব দেশেই হচ্ছে। নগর প্রশাসনের একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা গঠন করতে হবে। ঢাকা শহরে ৫০টির ওপর নগরসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এদের এক ছাতার নিচে আনতে হবে। তবে শুধু নগরসেবা বা পরিকল্পনাকে একটি সামগ্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আনলে পরিবর্তন আসবে না। কাউকে না কাউকে রাতে ঘুমানোর আগে ভাবতে হবে শহরের সমস্যার কথা, সকালে ঘুম থেকে উঠে এগুলো সমাধানের জন্য নিরন্তরভাবে কাজ করতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ঢাকা শহর নিয়ে কেউই এ দায়িত্ব নিচ্ছে না।
চট্টগ্রামেও প্রতীকী উন্নতি বেশি হচ্ছে। যেমন— আকতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভার। এটি একটি অশুভ অজগরের মতো পুরো শহরে সবার কাঁধে চেপে রয়েছে। এতে কেউ উঠছে না, কাজ হয়েছে নিম্নমানের। আরেকটি বিষয় হলো, এটির ড্রেনেজ সিস্টেম। একটি ভালো ফ্লাইওভারে ড্রেনেজ সিস্টেমটা কনস্ট্রাকশনের ভেতরেই থাকে, বৃষ্টির পানি জমা হয়ে ড্রেনের ভেতর দিয়ে মাটির নিচে চলে যায়। আমি কোথাও দেখিনি ফ্লাইওভারে পাইপ দিয়ে ২০ ফুট পরপর পানি ফেলা হচ্ছে জলপ্রপাতের মতো। প্রথমত. যেখানে পানিটা পড়বে, সেখানে ধীরে ধীরে বিশাল গর্ত হয়ে যাবে, নিচের রাস্তা কোনোভাবেই ঠিক থাকবে না। এছাড়া ওই পাইপ দিয়ে পাথর পড়লে মানুষ আহত হবে, যানবাহনের ক্ষতি হবে। পরিকল্পনা করতে হবে সমস্যার আলোকে এবং আগামীতে কী ধরনের সমস্যা হতে পারে, তা বোঝার প্রবণতা তৈরি করতে হবে।
কেমন নগর প্রশাসন দরকার?
নগর প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। মেয়র নির্বাচনের ক্ষেত্রে, যিনি নগরের সমস্যা বোঝেন, তাকে নির্বাচিত করতে হবে। মেয়রের মধ্যে রাজনীতির পাশাপাশি প্রযুক্তিগত গুণের সমন্বয় থাকতে হবে। যোগ্য ব্যক্তিকে মেয়র পদে আনতে হবে। আর রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব যোগ্য ব্যক্তিকে সামনে নিয়ে আসা। ক্ষমতায় এলে দলগুলো কিছু প্রতীকী উন্নয়ন করে। আমাদের প্রতীকী নগরায়ণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, দেশে অবকাঠামো নির্মাণ প্রতিযোগিতা চলছে। এতে কি সমাধান আসবে?
এটা শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, উন্নয়নশীল অন্য দেশগুলোয়ও অবকাঠামো নির্মাণ, যেমন— ফ্লাইওভার, চার লেন সড়ক, টানেল ইত্যাদি তৈরি করার প্রতিযোগিতা চলছে। কারণ বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য দাতা সংস্থা ও দাতা দেশগুলো এগুলোয় বিনিয়োগ করার জন্য এগিয়ে আসে। আবার যেমন ধরুন, ফ্লাইওভার বানালে গাড়ির সংখ্যা বাড়বে। এতে গাড়ি বিক্রি বাড়বে। সুতরাং এখানে একটা অর্থনৈতিক সমীকরণও কাজ করে। অর্থনৈতিক ব্যাপারও কাজ করে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় এসেছিল। তারা পূর্ব ঢাকা নিয়ে একটা প্রোগ্রাম করল— ঢাকা ২০৩৫। অকল্পনীয় প্রস্তাব। একটা স্পর্শকাতর জলাভূমির জায়গায় ২০৩৫ সালের মধ্যে আরেকটা ঢাকা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা। বিশ্বব্যাংক কিন্তু লন্ডন বা নিউইয়র্কে গিয়ে এ ধরনের প্রস্তাব দেয়ার সাহস পাবে না। এ ধরনের বৃহত্ দাতাগোষ্ঠী আসেই এমন জায়গায় বিনিয়োগ করতে যেন সেখানে গ্লোবালাইজেশন বা বিশ্বায়নের একটা অংশ থাকে। যেমন— গাড়ি বিক্রি। নগরের ১৫ শতাংশকে লক্ষ করে (যাদের পকেট ভারী) আমরা নগরায়ণ করছি। আমরা এত ফ্লাইওভার কেন করব?
যেখানে প্রয়োজন সেখানে দু-একটা ফ্লাইওভার বানানো যেতে পারে। আমাদের মতো দেশে যেখানে ৭০ শতাংশ লোক পায়ে হেঁটে কর্মক্ষেত্রে যায়, সেখানে আমাদের প্রয়োজন ফুটপাত বাড়ানো। আমাদের বিনিয়োগ হওয়া উচিত ফুটপাতের ওপর। আমাদের লক্ষ্য হবে পথিককেন্দ্রিক নগরায়ণের দিকে। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত কীভাবে গাড়ির চাহিদা কমিয়ে আনা যায়। যেমন— যাদের পরিবার উত্তরায় থাকে, সেখানেই স্বয়ংসম্পূর্ণ নগরায়ণ করতে হবে, যাতে তাদের বাইরে আসতে না হয়। বাসার কাছাকাছি যদি স্কুল, হাসপাতাল ইত্যাদি থাকে তাহলে আমাদের গাড়ি ব্যবহার করতে হবে না। পথ চলাচলের জন্য সুন্দর ফুটপাত থাকলে গাড়ির প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে। বিশ্বের সব মানসম্পন্ন শহরে ব্যক্তিগত গাড়ি কেনাকে নিরুত্সাহিত করা হচ্ছে। গাড়ির বদলে মেট্রো বা বাস ব্যবহারের সদিচ্ছা তৈরিতে সামাজিক ক্যাম্পেইন চালানো হচ্ছে। এজন্য এসব শহরের নতুন প্রজন্ম গাড়ি কিনতে চায় না। তারা সাইকেল ব্যবহারে বেশি উত্সাহী। সাইকেল ও বাস ব্যবহার এখন বাসযোগ্য নগরায়ণের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের উন্নয়নশীল অনেক দেশের শহরগুলোয় অবকাঠামোর ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। কেননা এগুলো সবচেয়ে চাক্ষুষ প্রতীক এবং আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণী এগুলো নিয়ে খুব গর্ববোধ করে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, আমাদের নিউইয়র্ক বা লন্ডন হওয়ার দরকার নেই, আমাদের ঢাকার মতোই নগরায়ণ করতে হবে। আত্মবিশ্বাস আসতে পারে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব থেকে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুস্থ নগরায়ণের জন্য অনেক কিছু চিন্তা করেন। তিনি নদীরক্ষা, সুস্থ নগরায়ণের বিষয়ে অনেক সচেতন। কিন্তু একজন সচেতন হলে হবে না। সচেতনতার সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে। আমলাতান্ত্রিকতায় যদি আমরা সুস্থ নগরায়ণের সংস্কৃতি ও আত্মবিশ্বাস না আনতে পারি তাহলে মানসম্পন্ন শহর তৈরি করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী কিংবা দু-একজন মন্ত্রীর সদিচ্ছা দিয়ে দেশের সার্বিক উন্নতি হবে না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সুস্থ নগরায়ণে নাগরিক দায়িত্ব গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, ৫০ গজ দূরে বাজার, সেখানে তো গাড়ি নিয়ে যাওয়ার কোনো দরকার নেই; হেঁটেই যাওয়া যায়। আবার সন্তানদের স্কুলের বাসে পাঠানো। কিন্তু এক ধরনের আভিজাত্যের কারণে এগুলো করা হয় না। মধ্যবিত্তায়ন মানেই হচ্ছে প্রতীক নির্ভরতা।
কিছু অর্থ হলেই গাড়ি কেনা হচ্ছে। এ ধরনের অসুস্থ মানসিকতা থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে থাকলে তৃণমূল পর্যায়ে ভালো নগরায়ণ হবে। এজন্য আমার মনে হয়, এক ধরনের সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজন রয়েছে। নাটক, গান ইত্যাদি জনপ্রিয় সংস্কৃতির মাধ্যমে সুস্থ নগরায়ণের বার্তা দিতে হবে। নদীদূষণের মতো বিষয়গুলো শুধু আইন করে ঠেকানো যাবে না। এগুলোর জন্য সামাজিক আন্দোলন প্রয়োজন। তবে সুস্থ নগরায়ণের জন্য পরিবর্তনের তাত্ক্ষণিক কোনো সমাধান নেই এবং এর কোনো প্রযুক্তিগত সমাধানও নেই। আমাদের দেশে এখনো ৭০ ভাগ লোক গ্রামে এবং ৩০ ভাগ লোক শহরে বাস করে। আমাদের সাংস্কৃতিকভাবে পরিবর্তন আনতে হবে। ঢাকার যানজটের প্রযুক্তিগত সমাধান রয়েছে— এই অলীক ধারণার বাইরে না যেতে পারলে এ সমস্যার সমাধান আসবে না। বুঝতে হবে আমাদের স্থানিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা এখানে অফুরন্ত রাস্তাঘাট বানাতে পারব না।
শহরের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থা তো ভালো না…
এ জন্য আমরা গাড়ি কেনার ইচ্ছাটাকেও দোষারোপ করতে পারি না। আমরা চাইতেই পারি যে, আমাদের সন্তানরা একটু নিরাপদে যাতায়াত করুক। এটা দোষের নয়। কিন্তু আমরা যদি আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা ও গণপরিবহন ব্যবস্থায় উন্নতি করতে পারি তাহলে মানুষ কিন্তু আস্তে আস্তে এগুলো ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। এছাড়া স্বাস্থ্যের একটা ব্যাপার রয়েছে। আজকে উন্নত বিশ্বে বিশ্বমানের যেসব শহর রয়েছে, সেখানে নগর পরিকল্পনার মাধ্যমে মানুষকে হাঁটানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এতে স্বাস্থ্যচর্চা হচ্ছে, অনেক রোগ থেকে মুক্ত থাকা যাচ্ছে।
অনেক উপকারী প্রকল্প নেয়া হয়েছিল কিন্তু বাস্তবায়ন করা যায়নি…
বাস্তবায়ন করতে না পারার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। একটা বিষয় হলো, রাজউক পরিকল্পনা করে, উন্নয়ন করে, আবার তা মনিটর করে। এটা কিছুটা স্ববিরোধী অবস্থান। রাজউক পরিকল্পনা করে কিন্তু এটির জন্য যে গবেষণার প্রয়োজন, তার জন্য কি তাদের জনবল রয়েছে? এছাড়া অনুমাননির্ভর এক ধরনের পরিকল্পনা করার মানসিকতা আমাদের রয়েছে।
গবেষণা ও তথ্য ছাড়া শুধু অনুমাননির্ভর জগতে থাকলে কখনই সুস্থ নগরায়ণ হবে না। লেক করা হচ্ছে কিন্তু তা হচ্ছে নান্দনিক, কার্যকর নয়। দেখা যাচ্ছে লেকে পানি নেই, অথচ রাস্তা পানিতে ডুবে রয়েছে। আমাদের নগরায়ণ হচ্ছে, শহরের বিস্তৃতি ঘটছে। ইট আর কংক্রিটের চাদরে মুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে কিন্তু বৃষ্টির পানিটা কীভাবে নিচে যাবে তা নিয়ে চিন্তা করা হচ্ছে না। আমাদের ওয়াটার টেবিল নেমে যাচ্ছে। কারণ কংক্রিটের সারফেসের কারণে পানি মাটিতে যেতে পারছে না। আজকের বিশ্বমানের সব শহরে ‘পারমিয়েবল সারফেস’ থাকে; অর্থাত্ কিছু অংশ ঘাস, কিছু অংশ কংক্রিট, যাতে পানি নিচে যেতে পারে। এগুলো আমাদের এখানে হচ্ছে না। কারণ রাজউকের গবেষণা সেল নেই। আমাদের নদী-নালা, খাল-বিল ড্রেনের কী অবস্থা হচ্ছে, তার জন্য টপোগ্রাফিক ম্যাপ থাকতে হবে। অন্যদিকে আমাদের দেশে মধ্যবিত্তায়ন মানে গাড়ি কিনতে হবে, সবাইকে দেখাতে হবে। এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এটা এক প্রজন্মে হবে না। আমাদের যুব জনসংখ্যার ওপর বিনিয়োগ করতে হবে। তাদের সাইকেল চালাতে, গাছ রোপণে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
উন্নয়ন সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকার কথাও অনেকে বলেন…
অনেক উন্নয়নশীল অর্থনীতিতেই এমন সমন্ব্বয়হীনতা রয়েছে। এর সমাধান হলো, নগর প্রশাসনকে কিছুটা পিরামিডাল আকৃতির ব্যবস্থায় আনতে হবে। কিন্তু এরও একটি সমস্যা রয়েছে। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে এর অপব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।
আমরা নগর পরিকল্পনায় পরিবেশকে তেমন গুরুত্ব দেইনি, এখন আবার এ কথা বলা হচ্ছে…
সঠিক পরিকল্পনার কারণে আমরা অনেক ক্ষতি করে ফেলেছি। শহরের ভৌগোলিক পরিবর্তন করে ফেলেছি। তবে এখন হা-হুতাশ করা বাদ দিয়ে প্রো-অ্যাক্টিভ হতে হবে। আমাদের কিছু সাময়িক সমাধানের দিকে আবার কিছু দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের দিকে যেতে হবে। দীর্ঘমেয়াদির মধ্যে রয়েছে যুবসমাজের ওপর বিনিয়োগ করা, তাদের বোঝাতে হবে পরিবেশ সংরক্ষণ একটি নৈতিক দায়িত্ব। ঢাকা শহরের জন্য ৫০টির ওপর নগরসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে কিন্তু কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না। দায়িত্ব নেয়ার একটা ‘কনসলিডেটেড অর্গানাইজেশন’ দরকার। একটি মানবিক শহরের যেসব গুণাবলি থাকা দরকার, তা কি ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে রয়েছে? অবশ্যই নেই। আমার দৃষ্টিতে মানবিক শহরের অন্যতম সংজ্ঞা হলো, শহরের প্রতি সহজাত দরদ থাকতে হবে। এ দরদ না থাকলে কখনই মানসম্পন্ন শহর গড়ে তোলা যাবে না। এ দরদ এমন, কলার খোসা যেখানে সেখানে ফেলব না। কারণ যেখানে সেখানে ফেললে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। মাইক্রো লেবেলে নগরবাসীর চিন্তা-চেতনায় যদি এটা না আসে যে, নগরকে রক্ষা করা, পরিষ্কার রাখা, সংরক্ষণ করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব, ততদিন মানবিক শহর গড়ে উঠবে না। আরো যেসব বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দিতে হবে। নিরাপত্তার যদি মৌলিক অনুভূতি না থাকে, তাহলে সেটি কখনো মানবিক শহর হবে না। ভালো শিক্ষা ব্যবস্থা, ভালো আবাসন ব্যবস্থা থাকতে হবে। নাগরিকদের শহরের মৌলিক বিষয়গুলো জানতে হবে। যেমন— যারা উত্তরায় থাকে, তাদের মধ্যে অনেকে বড় হবে অথচ সারা জীবনে বুড়িগঙ্গা দেখবে না— এটা মানবিক শহরের লক্ষণ নয়। শহরের সঙ্গে নাগরিকদের একাত্ম হতে হবে। আমাদের জাতীয় সংসদের স্থপতি লুই কান মানবিক শহরের একটা সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, যে শহর একটি ছোট শিশুকে স্বপ্ন দেখায়, সে শহর একটি মানবিক শহর।
সবকিছু শহরকেন্দ্রিক না করে বিকেন্দ্রীকরণ করা যায় কিনা?
অবশ্যই বিকেন্দ্রীকরণ করা উচিত। বিকেন্দ্রীকরণ করতে হলে কিছু মৌলিক স্থাপনাকে সরাতে হবে। রাজধানীর বাইরে যারা থাকেন, তাদের একটি সাধারণ ধারণা— যদি উন্নতি করতে হয়, মধ্যবিত্তায়ন হতে হয়, তবে ঢাকায় যেতেই হবে। এ ভুল ধারণাকে একেবারে ভাঙতে হবে। এজন্য বিভিন্ন এলাকায় উন্নত মানের বিশ্ববিদ্যালয় করতে হবে, বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যেখানে ঢাকার মানুষ যাবে। সরকারের উচিত হবে একটি-দুটি মন্ত্রণালয় অন্য শহরে নিয়ে যাওয়া। এমনকি রাজধানীকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ঢাকাকে বাণিজ্যিক রাজধানী করে আরেকটি শহরকে প্রশাসনিক রাজধানী করা যেতে পারে।
পুরো দেশকে নিয়ে পরিকল্পনা কীভাবে করা যাবে?
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জনবহুল দেশ। এজন্য আমাদের দেশের প্রতিটি বর্গ ইঞ্চি পরিকল্পনার আওতায় আনতে হবে। পরিকল্পনা আমাদের বিলাসিতা বা দৃষ্টিনন্দন চর্চা নয়। পরিকল্পনা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন এজন্য যে, আমাদের দেশ ছোট কিন্তু জনসংখ্যা বেশি। তবে পরিকল্পনার সর্বজনীন কোনো সংজ্ঞা নেই। পরিকল্পনা করতে হলে অঞ্চলভিত্তিক ভৌগোলিক চরিত্র বুঝতে হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের পরিকল্পনা এক হবে না। আমাদের পরিকল্পনা হতে হবে স্থানকেন্দ্রিক। (বণিক বার্তা)