ঢাকা , মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দুর্নীতির মামলায় কারও সাজা হলে সরকারের কী করার আছে

আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, এতিমদের টাকা আত্মসাতের দায়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা হয়েছে। তবে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ায় তার সাজার রায় রাজনীতিতে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলবে। সম্প্রতি একটি দৈনিকের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তা হুবহু তুলে ধার হলো-প্রশ্ন : তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিশেষ ধারার প্রতিবাদ করছে গণমাধ্যম কর্মীসহ বিশিষ্টজন। তাদের বক্তব্য, এতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ হবে। আপনি আশ্বাস দিয়েছিলেন, প্রস্তাবিত আইন সংশোধন করবেন। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।

আনিসুল হক: সাংবাদিকরা ধারণা করছেন, প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় তাদের অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করবে। এটা ঠিক নয়। প্রথমত, সাংবাদিকদের টার্গেট করে ৩২ ধারা করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, গণতান্ত্রিক যে কোনো দেশেই সাইবার ক্রাইম, হ্যাকিং এসব প্রতিরোধ করতে ৩২ ধারার মতো আইন রয়েছে। ৩২ ধারাকে নতুন করে সৃজন করা হয়নি। এর আগেও সিকিউরিটি অ্যাক্টে এ রকম ধারা ছিল। সে কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ওই ধারাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখন যেহেতু কথা হচ্ছে, তাই ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সুরক্ষায়’ প্রয়োজনে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারার সঙ্গে একটি উপধারা যোগ করা যেতে পারে। সংবাদপত্রের সংশ্নিষ্ট মহল সন্তুষ্ট হলে আমরা নিশ্চয়ই সেটা করব। রাষ্ট্র বা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় তথ্য হ্যাকিং করে কোনো ক্রিমিনাল সংগঠন এটা নিয়ে গেল, আমরা কি তাকে শাস্তি দিতে পারব না? সংবিধানে ফ্রিডম অব স্পিচ ও ফ্রিডম অব প্রেসে পরিস্কার বলা আছে। আপনারা যেহেতু অনুসন্ধানী রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে সন্দেহ করছেন, সে কারণেই এটা করব।

প্রশ্ন : দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার সাজাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? রাজনীতিতে এর প্রভাব পড়বে কি?

আনিসুল হক: এতিমদের টাকা আত্মসাতের মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হয়েছে। তিনি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সে হিসেবে রাজনীতিতে একটা প্রভাব পড়বে। তবে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা করা হয়েছিল ২০০৮ সালের ৩ জুলাই, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে। অভিযোগ গঠন করা হয় ২০১০ সালে। এরপর উনারা (খালেদা জিয়া) মামলা, তদন্ত প্রতিবেদন, অভিযোগ গঠন ও সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ নিয়ে একাধিকবার হাইকোর্টে ও আপিল বিভাগে গেছেন। সেখানে প্রত্যেকটিতে তারা পরাজিত হয়েছেন। আপিল বিভাগ বলে দিয়েছেন, এ মামলা বিচারিক আদালতে চলতে পারে। এখানে সরকারের কোনো সংশ্নিষ্টতা নেই। তিনি দুর্নীতি করেছেন। মামলাটি ডকুমেন্টারি।

প্রশ্ন: আপনি বলেছেন, মামলায় খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা ভুল করেছেন। কোথায় এবং কী ভুল করেছেন বলবেন কি?

আনিসুল হক: আমি বাংলাদেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করেছি। কোনো ট্রায়াল মামলা থাকলে রায়ের দিন সব সময় ২-৩টা দরখাস্ত আগাম প্রস্তুত করে রাখতাম। ধরুন, কোনো মামলার রায় বা আদেশের পর আসামিকে যদি কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে তিনি যেন ডিভিশন পান সে জন্য আগাম আবেদন করতাম। এ মামলায় খালেদা জিয়ার বিজ্ঞ আইনজীবীরা সেটা করেননি। যেদিন আদালতের কাছে ডিভিশন চেয়ে আবেদন করা হলো, সেদিনই আদালত তাকে ডিভিশন দিয়েছেন। তাহলে সেটা দু’দিন আগে কেন করলেন না? কোনো ফৌজদারি মামলার উচ্চ আদালতে আপিল দাখিল করা হলে বিচারক রায় স্থগিত করার আগে বিচারিক আদালতের নথি চাইতে পারেন। এ ধরনের মামলায় কোনো বিচারক নিম্ন আদালতের রেকর্ড না দেখে আদেশ দেন না। এ পর্যায়ে বিচারক মামলার রেকর্ড তলব করেন। সেখানে আদালত এক মাসের সময়ের কথা বললে আমরা কমিয়ে ১৫ দিন বলি। আদালত ১৫ দিন বললে আমরা সাত দিন সময়ের কথা বলি। এটা তারা করেননি। এগুলো খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের ভুল।

প্রশ্ন: বিএনপি অভিযোগ করেছে, খালেদা জিয়ার কোনো মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মামলা উচ্চ আদালত থেকে বাতিল করা হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।

আনিসুল হক: ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা একাধিক মামলা উচ্চ আদালত থেকে বাতিল হয়ে গেছে। সেটা এখন তারা বলছেন না। ওই সময় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সব মামলা বিচারপতি এমএ আজিজ বাতিল (কোয়াশমেন্ট) করে দিয়েছিলেন। পরে বিচারপতি আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বানানো হয়েছিল। সম্প্রতি উচ্চ আদালত থেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেসব মামলা বাতিল করা হয়েছে, সেগুলো দুদক অনুসন্ধান ও তদন্ত করে কিছু পায়নি। এখানে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কিছুই করা হয়নি।

প্রশ্ন: ২০১৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারির পর থেকে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বর্তমানে আপিল বিভাগে চারজন এবং হাইকোর্টে ৮০ জন বিচারক আছেন। বিচারপতির এই সংকট নিরসনে কী ভাবছেন?

আনিসুল হক: এ সংকট শিগগিরই নিরসন করা হবে। ইতিমধ্যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

প্রশ্ন: সংবিধানে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের কথা বলা আছে। এ ছাড়া কয়েকটি রায়েও আইন বা নীতিমালা তৈরির জন্য উচ্চ আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছেন কি?

আনিসুল হক: সরকার এসব বিষয় তাড়াতাড়ি করার চেষ্টা করছে। এ বছরের শেষ দিকে বিচারক নিয়োগের আইন পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

প্রশ্ন: রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে ইতিমধ্যে হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন। এর বিরুদ্ধে দলটি আপিলও করেছে। কিন্তু দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও আপিলটির শুনানি হচ্ছে না কেন?

আনিসুল হক: নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। জাতীয় সংসদের নির্বাচন করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত। জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে মামলাটি যেহেতু সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন, সে কারণে এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না।

প্রশ্ন: গত এক দশকে দুদকের করা দুর্নীতির মামলায় ৮শ’ জনের সাজা হয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্তরা অনেকে পালিয়ে আছেন, অনেকে প্রকাশ্যে, আবার অনেকে বিদেশে চলে গেছেন। তাদেরকে দেশে ফেরত এনে বিচারের মুখোমুখি করতে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন কি?

আনিসুল হক: দুর্নীতি দমন কমিশন পালিয়ে থাকা আসামিদের গ্রেফতার বা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য যে মুহূর্তে সুপারিশ করবে, সে মুহূর্তে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।

প্রশ্ন: বিচারাধীন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ অন্যান্য স্পর্শকাতর মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে কোনো পদক্ষেপ নেবেন কিনা? মামলাজট কমাতে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন কি?

আনিসুল হক: বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। বিচারাধীন কোনো মামলার বিষয়ে কথা বলা যায় না। তারপরও বলছি, আমি আইনমন্ত্রী হওয়ার আগে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাটি সপ্তাহে একদিন শুনানি হতো। বর্তমানে সপ্তাহে ২-৩ দিন শুনানি হয়। এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে মনে হয়েছে, মামলা শেষ করতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

প্রশ্ন: মন্ত্রী হিসেবে এই মুহূর্তে আপনার বড় চ্যালেঞ্জ কী?

আনিসুল হক: জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিছুটা আইন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পড়ে, সে ক্ষেত্রে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করে থাকে। তাছাড়া বিচার বিভাগের সঙ্গে আমি সংশ্নিষ্ট। সে কারণেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে আরও সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করার জন্য যা যা করা দরকার, সবই করা হবে।

প্রশ্ন: আপনার মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন নিবন্ধন অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি-অনিয়ম রোধে বিশেষ পদক্ষেপ নেবেন কি?

আনিসুল হক: যারা দুর্নীতি করে এবং প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। বর্তমানে নিবন্ধন অধিদপ্তর আগে পরিদপ্তর ছিল। আগে নিবন্ধন পরিদপ্তরে বদলি বাণিজ্য হতো। দায়িত্ব নেওয়ার পর দুর্নীতি রোধ করতে পেরেছি। বলব না শতভাগ করা হয়েছে। এখানে বদলির বিশৃঙ্খলা ছিল। সেটাকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনা হয়েছে। এখন জানুয়ারি ও জুন মাস ছাড়া রেজিস্ট্রেশন বিভাগের কর্মকর্তাদের বদলি করা হয় না।

প্রশ্ন: আপনি মন্ত্রীর পাশাপাশি একজন এমপিও বটে। গত চার বছরে নিজ এলাকায় কতটুকু উন্নয়ন করতে পেরেছেন বলে আপনি মনে করেন?

আনিসুল হক: আমি মনে করি, আমার নির্বাচনী এলাকা কসবা ও আখাউড়ার বেকার লোকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছি। মানুষের যাতায়াতের সুবিধার জন্য অনেক রাস্তাঘাট করেছি। অনেক ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করেছি। সেতুমন্ত্রীকে (ওবায়দুল কাদের) এ জন্য ধন্যবাদ, তিনি আমার এলাকায় অনেক রাস্তা করে দিয়েছেন। এ ছাড়া আখাউড়ায় শতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে আর কসবায় এ মাসের মধ্যে একনেকে পাস হয়ে যাবে। এলাকায় জনগণের জরুরি যা প্রয়োজন, তাই করা হয়েছে। আখাউড়াতে আধুনিক একটি স্থলবন্দর করা হবে।

সৌজন্যে দৈনিক সমকাল

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

দুর্নীতির মামলায় কারও সাজা হলে সরকারের কী করার আছে

আপডেট টাইম : ১০:৫৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১০ মার্চ ২০১৮

আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, এতিমদের টাকা আত্মসাতের দায়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা হয়েছে। তবে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ায় তার সাজার রায় রাজনীতিতে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলবে। সম্প্রতি একটি দৈনিকের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তা হুবহু তুলে ধার হলো-প্রশ্ন : তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিশেষ ধারার প্রতিবাদ করছে গণমাধ্যম কর্মীসহ বিশিষ্টজন। তাদের বক্তব্য, এতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ হবে। আপনি আশ্বাস দিয়েছিলেন, প্রস্তাবিত আইন সংশোধন করবেন। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।

আনিসুল হক: সাংবাদিকরা ধারণা করছেন, প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় তাদের অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করবে। এটা ঠিক নয়। প্রথমত, সাংবাদিকদের টার্গেট করে ৩২ ধারা করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, গণতান্ত্রিক যে কোনো দেশেই সাইবার ক্রাইম, হ্যাকিং এসব প্রতিরোধ করতে ৩২ ধারার মতো আইন রয়েছে। ৩২ ধারাকে নতুন করে সৃজন করা হয়নি। এর আগেও সিকিউরিটি অ্যাক্টে এ রকম ধারা ছিল। সে কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ওই ধারাটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখন যেহেতু কথা হচ্ছে, তাই ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সুরক্ষায়’ প্রয়োজনে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারার সঙ্গে একটি উপধারা যোগ করা যেতে পারে। সংবাদপত্রের সংশ্নিষ্ট মহল সন্তুষ্ট হলে আমরা নিশ্চয়ই সেটা করব। রাষ্ট্র বা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় তথ্য হ্যাকিং করে কোনো ক্রিমিনাল সংগঠন এটা নিয়ে গেল, আমরা কি তাকে শাস্তি দিতে পারব না? সংবিধানে ফ্রিডম অব স্পিচ ও ফ্রিডম অব প্রেসে পরিস্কার বলা আছে। আপনারা যেহেতু অনুসন্ধানী রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে সন্দেহ করছেন, সে কারণেই এটা করব।

প্রশ্ন : দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়ার সাজাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? রাজনীতিতে এর প্রভাব পড়বে কি?

আনিসুল হক: এতিমদের টাকা আত্মসাতের মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা হয়েছে। তিনি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সে হিসেবে রাজনীতিতে একটা প্রভাব পড়বে। তবে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা করা হয়েছিল ২০০৮ সালের ৩ জুলাই, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে। অভিযোগ গঠন করা হয় ২০১০ সালে। এরপর উনারা (খালেদা জিয়া) মামলা, তদন্ত প্রতিবেদন, অভিযোগ গঠন ও সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ নিয়ে একাধিকবার হাইকোর্টে ও আপিল বিভাগে গেছেন। সেখানে প্রত্যেকটিতে তারা পরাজিত হয়েছেন। আপিল বিভাগ বলে দিয়েছেন, এ মামলা বিচারিক আদালতে চলতে পারে। এখানে সরকারের কোনো সংশ্নিষ্টতা নেই। তিনি দুর্নীতি করেছেন। মামলাটি ডকুমেন্টারি।

প্রশ্ন: আপনি বলেছেন, মামলায় খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা ভুল করেছেন। কোথায় এবং কী ভুল করেছেন বলবেন কি?

আনিসুল হক: আমি বাংলাদেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করেছি। কোনো ট্রায়াল মামলা থাকলে রায়ের দিন সব সময় ২-৩টা দরখাস্ত আগাম প্রস্তুত করে রাখতাম। ধরুন, কোনো মামলার রায় বা আদেশের পর আসামিকে যদি কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে তিনি যেন ডিভিশন পান সে জন্য আগাম আবেদন করতাম। এ মামলায় খালেদা জিয়ার বিজ্ঞ আইনজীবীরা সেটা করেননি। যেদিন আদালতের কাছে ডিভিশন চেয়ে আবেদন করা হলো, সেদিনই আদালত তাকে ডিভিশন দিয়েছেন। তাহলে সেটা দু’দিন আগে কেন করলেন না? কোনো ফৌজদারি মামলার উচ্চ আদালতে আপিল দাখিল করা হলে বিচারক রায় স্থগিত করার আগে বিচারিক আদালতের নথি চাইতে পারেন। এ ধরনের মামলায় কোনো বিচারক নিম্ন আদালতের রেকর্ড না দেখে আদেশ দেন না। এ পর্যায়ে বিচারক মামলার রেকর্ড তলব করেন। সেখানে আদালত এক মাসের সময়ের কথা বললে আমরা কমিয়ে ১৫ দিন বলি। আদালত ১৫ দিন বললে আমরা সাত দিন সময়ের কথা বলি। এটা তারা করেননি। এগুলো খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের ভুল।

প্রশ্ন: বিএনপি অভিযোগ করেছে, খালেদা জিয়ার কোনো মামলা প্রত্যাহার করা হয়নি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মামলা উচ্চ আদালত থেকে বাতিল করা হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।

আনিসুল হক: ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমানের বিরুদ্ধে করা একাধিক মামলা উচ্চ আদালত থেকে বাতিল হয়ে গেছে। সেটা এখন তারা বলছেন না। ওই সময় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে সব মামলা বিচারপতি এমএ আজিজ বাতিল (কোয়াশমেন্ট) করে দিয়েছিলেন। পরে বিচারপতি আজিজকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বানানো হয়েছিল। সম্প্রতি উচ্চ আদালত থেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেসব মামলা বাতিল করা হয়েছে, সেগুলো দুদক অনুসন্ধান ও তদন্ত করে কিছু পায়নি। এখানে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কিছুই করা হয়নি।

প্রশ্ন: ২০১৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারির পর থেকে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বর্তমানে আপিল বিভাগে চারজন এবং হাইকোর্টে ৮০ জন বিচারক আছেন। বিচারপতির এই সংকট নিরসনে কী ভাবছেন?

আনিসুল হক: এ সংকট শিগগিরই নিরসন করা হবে। ইতিমধ্যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

প্রশ্ন: সংবিধানে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে আইন প্রণয়নের কথা বলা আছে। এ ছাড়া কয়েকটি রায়েও আইন বা নীতিমালা তৈরির জন্য উচ্চ আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছেন কি?

আনিসুল হক: সরকার এসব বিষয় তাড়াতাড়ি করার চেষ্টা করছে। এ বছরের শেষ দিকে বিচারক নিয়োগের আইন পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

প্রশ্ন: রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে ইতিমধ্যে হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন। এর বিরুদ্ধে দলটি আপিলও করেছে। কিন্তু দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলেও আপিলটির শুনানি হচ্ছে না কেন?

আনিসুল হক: নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। জাতীয় সংসদের নির্বাচন করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত। জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে মামলাটি যেহেতু সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন, সে কারণে এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না।

প্রশ্ন: গত এক দশকে দুদকের করা দুর্নীতির মামলায় ৮শ’ জনের সাজা হয়েছে। দণ্ডপ্রাপ্তরা অনেকে পালিয়ে আছেন, অনেকে প্রকাশ্যে, আবার অনেকে বিদেশে চলে গেছেন। তাদেরকে দেশে ফেরত এনে বিচারের মুখোমুখি করতে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন কি?

আনিসুল হক: দুর্নীতি দমন কমিশন পালিয়ে থাকা আসামিদের গ্রেফতার বা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য যে মুহূর্তে সুপারিশ করবে, সে মুহূর্তে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।

প্রশ্ন: বিচারাধীন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ অন্যান্য স্পর্শকাতর মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে কোনো পদক্ষেপ নেবেন কিনা? মামলাজট কমাতে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন কি?

আনিসুল হক: বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। বিচারাধীন কোনো মামলার বিষয়ে কথা বলা যায় না। তারপরও বলছি, আমি আইনমন্ত্রী হওয়ার আগে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাটি সপ্তাহে একদিন শুনানি হতো। বর্তমানে সপ্তাহে ২-৩ দিন শুনানি হয়। এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে মনে হয়েছে, মামলা শেষ করতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

প্রশ্ন: মন্ত্রী হিসেবে এই মুহূর্তে আপনার বড় চ্যালেঞ্জ কী?

আনিসুল হক: জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিছুটা আইন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পড়ে, সে ক্ষেত্রে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করে থাকে। তাছাড়া বিচার বিভাগের সঙ্গে আমি সংশ্নিষ্ট। সে কারণেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে আরও সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করার জন্য যা যা করা দরকার, সবই করা হবে।

প্রশ্ন: আপনার মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন নিবন্ধন অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি-অনিয়ম রোধে বিশেষ পদক্ষেপ নেবেন কি?

আনিসুল হক: যারা দুর্নীতি করে এবং প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। বর্তমানে নিবন্ধন অধিদপ্তর আগে পরিদপ্তর ছিল। আগে নিবন্ধন পরিদপ্তরে বদলি বাণিজ্য হতো। দায়িত্ব নেওয়ার পর দুর্নীতি রোধ করতে পেরেছি। বলব না শতভাগ করা হয়েছে। এখানে বদলির বিশৃঙ্খলা ছিল। সেটাকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনা হয়েছে। এখন জানুয়ারি ও জুন মাস ছাড়া রেজিস্ট্রেশন বিভাগের কর্মকর্তাদের বদলি করা হয় না।

প্রশ্ন: আপনি মন্ত্রীর পাশাপাশি একজন এমপিও বটে। গত চার বছরে নিজ এলাকায় কতটুকু উন্নয়ন করতে পেরেছেন বলে আপনি মনে করেন?

আনিসুল হক: আমি মনে করি, আমার নির্বাচনী এলাকা কসবা ও আখাউড়ার বেকার লোকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পেরেছি। মানুষের যাতায়াতের সুবিধার জন্য অনেক রাস্তাঘাট করেছি। অনেক ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ করেছি। সেতুমন্ত্রীকে (ওবায়দুল কাদের) এ জন্য ধন্যবাদ, তিনি আমার এলাকায় অনেক রাস্তা করে দিয়েছেন। এ ছাড়া আখাউড়ায় শতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে আর কসবায় এ মাসের মধ্যে একনেকে পাস হয়ে যাবে। এলাকায় জনগণের জরুরি যা প্রয়োজন, তাই করা হয়েছে। আখাউড়াতে আধুনিক একটি স্থলবন্দর করা হবে।

সৌজন্যে দৈনিক সমকাল