বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ দেশের পুঁজিবাজার ও আর্থিক খাতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পৃক্ততা বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন চৌধুরীর। শেয়ারবাজারের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি তিনি একটি জনপ্রিয় দৈনিকের সঙ্গে কথা হয় তার। তার হুবহু অংশ তুলে ধরা হলো-
এক কথায় বললে, ব্রোকারেজ হাউজগুলোয় গ্রাহকদের বিক্রয়াদেশ বেড়েছে বলেই এখন শেয়ারের দাম ও সূচক নিম্নমুখী। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে ব্যাংকিং খাতে উদ্ভূত তারল্য সংকট আর আমানতের সুদ বেড়ে যাওয়াই এর মূল কারণ। বিক্রয় চাপ সামলাতে যে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনে থাকে, এবার তাদেরও তহবিলে টান পড়েছে। উল্টো শেয়ার বেচে তাদের অনেককে পোর্টফোলিও সমন্বয় করতে হয়েছে। বাজারসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে আমরা মানি মার্কেট ও শেয়ারবাজারে তারল্যপ্রবাহ বাড়ানোর জন্য নীতিনির্ধারকদের কাছে কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ তুলে ধরেছি, যেগুলো বাস্তবায়ন হলে শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াবে। আমি আশাবাদী। কারণ আমাদের বাজারটিকে এখন অতিমূল্যায়িত বলা যাবে না।
আমরা দেখছি, শেয়ারবাজারে চাহিদা পরিস্থিতি খুব অল্প সময়ের ব্যবধানেই অনেক বদলে যায়। এর কারণ কী?
এটি সব শেয়ারবাজারেই কম-বেশি হয়। তবে যে বাজারের গভীরতা যত বেশি, সে বাজারে পরিস্থিতি বদলাতে তত সময় নেয়।
আমার দৃষ্টিতে চাহিদার দুটি দিক আছে। প্রথমটি অর্গানিক চাহিদা। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতি কিছু সম্পদ সৃষ্টি করে, যেগুলোর দীর্ঘমেয়াদি গন্তব্যই শেয়ারবাজার। এগুলোকে আমরা শেয়ারবাজারের নিজস্ব তহবিল ধরে নিতে পারি।
দ্বিতীয় ধরনের চাহিদাটি কিছুটা স্পেকুলেটিভ। এখন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করলে বেশি লাভবান হওয়া যাবে— এমন চিন্তা থেকে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিকল্প খাতগুলোয় না গিয়ে শেয়ার কেনে। শেয়ারবাজারে সমস্যা দেখলে দ্রুত সরে গিয়ে তারা নিজের ঝুঁকিটি প্রশমন করার চেষ্টা করে।
শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতার জন্য আমাদের প্রথম ধরনের তহবিল বেশি দরকার। মিউচুয়াল ফান্ড, পেনশন ফান্ড পরোক্ষ বিনিয়োগ স্কিমের ভালো উদাহরণ।
দেশের শেয়ারবাজারে ভালো সিকিউরিটিজের সরবরাহ নিয়েও অসন্তোষ আছে। আপনি কি মনে করেন?
আমাদের দুই স্টক এক্সচেঞ্জে এখন পর্যন্ত সিকিউরিটিজ বলতে শেয়ার আর মিউচুয়াল ফান্ডই দাঁড়িয়েছে। ট্রেজারি বা করপোরেট বন্ডের সেকেন্ডারি বাজারটিকে আমরা জনপ্রিয় করে তুলতে পারিনি। এক্ষেত্রে বাধাগুলো শনাক্ত করে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
দেশী-বিদেশী প্রাতিষ্ঠানিক তহবিল যেভাবে বাজারের মূলধারার বিনিয়োগকারী হয়ে উঠছে, তাতে আমাদের খুব তাড়াতাড়িই অন্যান্য প্রডাক্ট চালু করতে হবে। কারণ ভালো একটি পোর্টফোলিও গঠন করতে হলে, শেয়ারের বিকল্প অনেক প্রডাক্ট দরকার হয়।
ভালো সিকিউরিটিজ বলতে আপনি সম্ভবত আইপিওর কথা বোঝাচ্ছিলেন। বাজারের সার্বিক আকারের তুলনায় আইপিওর সংখ্যা বা আকারকে খুব ছোট বলা যাবে না। তবে এটি ঠিক, আরো অনেক ভালো কোম্পানি রয়েছে, যাদেরকে আমরা শেয়ারবাজার পর্যন্ত আনতে পারছি না।
এর কারণ কী? বিশেষ করে যখন তালিকাভুক্তিতে সরকার কিছু ইনসেনটিভ দিয়ে রেখেছে…
এর কারণ হতে পারে, কস্ট বেনিফিট অ্যানালাইসিস করে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত না হওয়াকেই বেটার অপশন মনে করছে। আইপিও প্রক্রিয়ার সময় নিয়েও অনেকে অভিযোগ করেন। এটি সত্য, আইপিওতে আসার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তহবিল হাতে পাওয়া পর্যন্ত একেকটি কোম্পানির অনেক সময় লেগে যায়। অনেকের সম্প্রসারণ পরিকল্পনাও বাধাগ্রস্ত হয় এ কারণে। সব পক্ষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ সময়টি কমিয়ে আনতে হবে।
আমরা মার্চেন্ট ব্যাংকাররা ইস্যু ব্যবস্থাপক হিসেবে নিজেদের পেশাদারিত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি, যেন আমরা নিয়ন্ত্রক সংস্থায় একটি কোম্পানির আইপিও আবেদন জমা দিলে সেখানে বারবার পরিবর্তন-পরিমার্জনের প্রয়োজন না পড়ে। আমি যতটুকু জানি, নিয়ন্ত্রক সংস্থার ডেস্কগুলোতেও লোকবল বৃদ্ধি এবং তাদের কর্মদক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
আপনি তো দীর্ঘদিন দেশের শেয়ারবাজারের সঙ্গে যুক্ত আছেন। ২০১০ সালের আগের বাজার আর এখনকার বাজারের মধ্যে কোনো পার্থক্য চোখে পড়ছে কি?
অনেক পার্থক্য। রেগুলেটরি ও অপারেশনাল ফ্রেমওয়ার্ক অনেক উন্নত হয়েছে। পেশাদারিত্ব এসেছে ইন্টারমিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানগুলোয়ও। বিনিয়োগ পেশায় অনেক স্কিলড মানুষ দেশের পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোয় কাজ করছেন। কিছু স্বল্পমূলধনি কোম্পানির কথা বাদ দিলে আমি বলব, বাজারের আচরণও আগের চেয়ে অনেক পরিণত।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে, তা হলো বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সক্রিয়তা। ২০১০ সালের ধসের পর শেয়ারদর ও সূচক যখন অনেক নেমে যায়, তখন বিদেশী ফান্ডগুলো এখানে বেছে বেছে ভালো ভালো কোম্পানির অবমূল্যায়িত শেয়ারগুলো কিনেছে। তারা ভালো মুনাফা করায় বিশ্বের বড় আর্থিক কেন্দ্রগুলোয় বাংলাদেশের বাজার সম্পর্কে অনেক প্রতিষ্ঠানের ফান্ড ম্যানেজারদের আগ্রহ বেড়েছে। ব্লুমবার্গে তারা বাংলাদেশী শেয়ারবাজারের আপডেট নিচ্ছেন। অনেক বিদেশী স্টক ব্রোকার এখানে তাদের গ্রাহকদের বিনিয়োগ হ্যান্ডল করার জন্য সাব-ব্রোকার খুঁজছে। বাংলাদেশী কোম্পানি ও ইন্টারমিডিয়ারিগুলো বিশ্বের নানা প্রান্তে রোড শো করে নিজেদের সম্ভাবনার কথা জানাচ্ছে, তাদের বিনিয়োগ আকর্ষণ করছে। অনেক স্থানীয় কোম্পানি এখন আন্তর্জাতিক পরিসরে যাচ্ছে। সব বিবেচনাতেই তারা এখন আন্তর্জাতিক সক্ষমতাসম্পন্ন কোম্পানি।
আমি মনে করি, এখন আমাদের দুটি দিক নিশ্চিত করতে হবে। প্রডাক্ট ডাইভারসিফিকেশন আর স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ও পেশাদারদের সক্ষমতা বৃদ্ধি। পেশাদার ফান্ড ম্যানেজাররা শুধু শেয়ার কেনাবেচা করে দীর্ঘমেয়াদে একটি বাজারে যথেষ্ট সক্রিয় থাকে না। এজন্য ইনভেস্টমেন্ট প্রডাক্টে বৈচিত্র্য আবশ্যক। আর স্থানীয় বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ও তাদের পেশাদার কর্মীদের সক্ষমতা ও স্কিল বাড়াতে হবে এ কারণে যে, আগামীর বাজারে তারা আন্তর্জাতিক ফান্ড ম্যানেজারদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ব্যবসা করবে। স্থানীয়রা জ্ঞানে, স্কিলে, কৌশলে বিদেশীদের চেয়ে পিছিয়ে থাকলে পুঁজিবাজার হিসেবে আমরা এক সময় পিছিয়েও পড়তে পারি।
মার্চেন্ট ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রি কেমন চলছে?
মার্চেন্ট ব্যাংক পুঁজিবাজারের একমাত্র ইন্ডাস্ট্রি, যারা ডিমান্ড সাপ্লাই দুদিকেই কাজ করে। সাপ্লাইয়ের জন্য তারা কোম্পানির ইস্যু ব্যবস্থাপনা করে, বন্ডের লিড অ্যারেঞ্জার হয়। ডিমান্ড সাইডে তারা পোর্টফোলিও ম্যানেজ করে। মার্চেন্ট ব্যাংকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রোল হতে পারে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং। সারা পৃথিবীতে তা-ই। আমাদের অনেক মার্চেন্ট ব্যাংক এখন সিন্ডিকেটেড ফিন্যান্স, অধিগ্রহণ-একীভূতকরণ, ইনভেস্টমেন্ট অ্যাডভাইজরির মতো সেবাগুলো দিচ্ছে। আগামীতে এ ট্রেন্ড আরো জোরালো হবে বলে আমার বিশ্বাস।
২০১০ সালের ধসের পর মার্জিন অ্যাকাউন্টগুলো থেকে ফোর্সড সেল না করায় দীর্ঘদিন ঋণাত্মক ইকুইটির সমস্যায় ভুগেছে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো। বাজার ঘুরে দাঁড়ানোয় ২০১৬ সাল থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করে। আমরা আশা করছি, নিজ নিজ যোগ্যতায় তারা সবাই ব্যবসায় ভালো করবে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) পুঁজিবাজারের ইন্টারমিডিয়ারিগুলোর রিস্ক বেইজড ক্যাপিটাল সংরক্ষণের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে সব পক্ষের সক্ষমতা বাড়বে। পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের সময় শুধু একটু চেষ্টা রাখতে হবে, যাতে সবাইকে অ্যাকোমোডেট করেই এগোনো যায়।
মানুষের ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে পুঁজিবাজারের নানা প্রডাক্টের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগানোই এ বাজারের মূল উদ্দেশ্য। এ কাজে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি, মার্চেন্ট ব্যাংক, ব্রোকারেজ হাউজ— এসব প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অনেক।
বিনিয়োগে ভালো করার জন্য কী করতে হবে? সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
শেয়ারবাজার হলো তথ্য প্রাপ্তি আর এর প্রভাব পূর্বানুমানের জায়গা। প্রাসঙ্গিক তথ্য যার কাছে যত বেশি থাকবে, তিনি তত রিচ। সে তথ্য তাকে অ্যাডভান্টেজ দেবে তখনই, যখন তিনি এর অর্থ ও প্রভাব বিশ্লেষণ করতে পারবেন। এ ইমপ্যাক্ট অ্যানালাইসিস একেক পক্ষের কাছে একেক রকম বলেই শেয়ারবাজারে লেনদেন হয়। নয়তো এত কেনাবেচা এখানে দেখা যেত না। একজন যথেষ্ট বিচার-বিশ্লেষণ করে যে শেয়ারটি বিক্রি করছেন, তার মতো বুদ্ধিমান আরেকজনই আবার সেটি কিনে মুনাফা করছেন। তবে তাদের দুজনেরই রয়েছে নিজস্ব বিশ্লেষণ ও বিনিয়োগ কৌশল।
বিনিয়োগকারীদের পরামর্শ দেয়ার জন্য আমি সঠিক ব্যক্তি কিনা জানি না। তবে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় আমি একটি কথা বলতে পারি, বেশি দামে শেয়ার কেনা থেকে বিরত থাকতে হবে। অতিমূল্যায়িত শেয়ার অন্যরা কিনে মুনাফা করুক। আমি বেশি দামে না কিনলে শেষ পর্যন্ত আমাকে লোকসান গুনতে হবে না।
আমি যদি বিনিয়োগ করি, তাহলে একটি কোম্পানির শেয়ার এমন রেটে কিনব, যে রেটে পুরো কোম্পানিটি কিনলেও আমি লাভবান হব। অর্থাৎ অবমূল্যায়িত শেয়ার কেনাই সবচেয়ে নিরাপদ। এক্ষেত্রে কেনার পর দাম কিছুটা কমলে বা বাড়লে বিচলিত না হয়ে এর মৌলভিত্তিক অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সব ঠিক থাকলে বাজার একসময় এ শেয়ারের যথেষ্ট মূল্য দেবে।
অন্যদিকে যারা নিছক ট্রেডিং করেন, তারা মৌলভিত্তির বদলে শেয়ারটির দাম বাড়বে না কমবে এদিকে বেশি মনোযোগ দেন। অতিমূল্যায়িত শেয়ার ট্রেডিংয়ের সময় যদি দাম কমতে থাকে এবং অনেক কমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হয়, তখন কিছু লোকসানে হলেও সে শেয়ার থেকে বেরিয়ে আসা বুদ্ধিমানের কাজ।
বিনিয়োগে ভালো করার জন্য শুধু কোম্পানির পর্যালোচনা না করে সামষ্টিক অর্থনীতি, বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা, অর্থনীতির থ্রাস্ট সেক্টর, সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প সবই বিবেচনা করতে হবে। স্থানীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পলিসি এবং রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ঘটনাবলিও গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো বাজারের সার্বিক আচরণ অনুধাবনে সহায়ক হয়।
সাধারণ বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে এটুকুই বলতে পারি, নিজের পুঁজির সুরক্ষার জন্য নিজেকেই শিখতে হবে। যে কোনো দামে যেনতেন শেয়ার কিনলে শেষ পর্যন্ত সরকার, রেগুলেটর, ব্রোকার, পরামর্শদাতা কেউই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। লোকসানটুকু নিজেরই হয়। তা এড়াতে নিজের বিনিয়োগ শিক্ষায় জোর দিতে হবে আর শেয়ার কেনাবেচায় সতর্ক থাকতে হবে।
আমরা দেখি, মানবিক দিক বিবেচনা করে সরকার বিভিন্ন সময়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য কিছু প্রটেকশন সুবিধা দেয়। এগুলোর কিছু সুফলও তারা পান। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বিনিয়োগ শিক্ষাই শেয়ারবাজারে সবচেয়ে বড় প্রটেকশন। আমাদের সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিষয়টিকে সঠিকভাবেই অ্যাড্রেস করেছে।
(দৈনিক বণিক বার্তা থেকে সংগৃহীত)