ঢাকা , শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নিরাপদ সড়ক কত দূরে

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে আমরা দেখতে পাচ্ছি সড়ক দুর্ঘটনার অসংখ্য বীভৎস ছবি, দেখতে পাচ্ছি স্বজন হারানোদের আহাজারি। বিশেষ করে ঈদের ছুটির সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় লাশের মিছিল দীর্ঘ হতে থাকে। বর্তমান সময়ে এক আতঙ্কের নাম সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় খালি হচ্ছে হাজারো মায়ের কোল। এই তো গত ২৯ জুলাই রোববার রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের এমইএসে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের বেশ কিছু শিক্ষার্থীর ওপর বাস তুলে দেয় চালক।

এতে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র রেজাউল করিম রাজু ও একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম নামের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়,। আহত হয় আরও কয়েকজন। ঘটনাস্থলেই ঝরল দুটি মেধাবী প্রাণ। প্রকাশ্যে বাসচাপায় মৃত্যু। সহপাঠীর লম্বা তালিকা আন্দোলনে শরীক হওয়ায় ঘটনাটি আলোচনায় এসেছে।

এ রকম কতো প্রাণ সড়কে ঝরছে। পরিচয় না পেয়ে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে মাটিচাপা পড়ে। গণমাধ্যমে তালিকাভুক্তি পরের কথা, অপমৃত্যুর তালিকা থেকেও বঞ্চিত হয় ওরা। নৌ, সড়ক ও রেলপথের সমন্বয়ে তৈরি করা তথ্যমতে ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৪৭২টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৪ হাজার ২৮৪ জন। এর মধ্যে ৫১৬ জন নারী ও ৫৩৯ শিশু। এতে আহত হয় ৯ হাজার ১১২ জন। ২০১৬ সালে ২ হাজার ৯৯৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৪১২ জনের প্রাণহানি হয়েছিল। আহতের সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৫৭২। ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭তে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ৪৭৪টি। আর দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়েছে ৮৭২। এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ২২ দশমিক ২ শতাংশ ও হতাহত ২৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। দুর্ঘটনার ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ পথচারীকে চাপা, ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১১ দশমিক ৯ শতাংশ খাদে পড়ে, ২ দশমিক ৮ শতাংশ চাকায় ওড়না পেছিয়ে সংঘটিত হয়।

কিন্তু কেন এই সড়ক দুর্ঘটনা? কেন এই অকাল অপমৃত্যু?
সড়কপথ একটি দেশের অর্থনৈতিক ও যোগাযোগ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বিআরটিএসহ যোগাযোগ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কি সদুত্তর দিতে পারবেন? দেশের মহাসড়কগুলোতে সংঘর্ষের সংবাদ শুনে মনে হতো দ্রুতগতি, সড়কগুলো সরু এবং কোনো ডিভাইডার নেই, বেপরোয়া অতিক্রম- এমন নানা কারণে সংঘর্ষ হয়ে থাকে। সম্প্রতি আমরা হতভম্ব হচ্ছি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষও নিরাপদ নয়। কখন যেন প্রাণটা কেড়ে নেয় ঘাতক যান।

দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, রাস্তাঘাটের নির্মাণক্রটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো, মহাসড়ক ও রেলক্রসিংয়ে ফিডার রোডে যানবাহন উঠে পড়া, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা, ভালো সড়কের অভাব, চালকের অদক্ষতা, পুরাতন ট্রাফিক সিগনাল ব্যবস্থা, বিকল্প যানবাহনের অপর্যাপ্ত সুবিধা, যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের অভাব সহজেই চোখে পড়ে।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নানামুখী পদক্ষেপের কথা বলা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা একেবারেই সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনার চ্যালেঞ্জও নিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু বাস্তবতা প্রশ্নবিদ্ধ। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে দুর্ঘটনার পরিমাণ বেড়েছে অন্তত ১৫ থেকে ২২ ভাগ। সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৪ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা মোট জিডিপির দুই শতাংশ।

সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দিনে দিনে অনেক অনিয়ম জমে গেছ। সেগুলোর দূর করার পাশাপাশি নিতে হবে প্রতিরোধমূরক ব্যবস্থা। তার বেশ কিছু ব্যবস্থার যেটুক চর্চা হয়, তা খুবই যৎসামান্য। সেগুলোর নিয়মিত চর্চা জরুরি হয়ে পড়েছে।

যানবাহন চালনার (ড্রাইভিং) লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি পাস বাধ্যতামূলক করা দরকার। চালক ও সহকারীসহ সব ধরনের পরিবহনকর্মীর নিয়োগপত্র ও শ্রম আইন মেনে মজুরি-ভাতা প্রদান এবং তাদের শ্রমঘণ্টা নির্ধারণ করে দিতে হবে। অবৈধ-ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে সারা বছর বিআরটিএর অভিযান; ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চালানোর দায়ে চালক, সুপারভাইজার ও সহকারীর সঙ্গে মালিককেও আইনের আওতায় আনতে হবে।

সড়ক,  মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কগুলো নিয়মিত সংস্কার, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকগুলো চিহ্নিতকরণ এবং সতর্ক সংকেত স্থাপন। ট্রাফিক আইন অমান্যকারী চালক ও সহকারীর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ। ক্ষুদ্র যানবাহনের জন্য আলাদা সড়ক, যানবাহনের চালক ও সহকারীর লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা, বিআরটিসিকে শক্তিশালীকরণ ও রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ রুটসহ দেশের সব আন্তঃজেলা রুটে বিআরটিসির সার্ভিস চালু, আধুনিক ডিজিটাল সিগনাল পোস্ট নির্মাণ, ফিটনেসবিহীন কোনো যানবাহন পথে না নামানো, ওভারব্রিজ পারাপারে লোকজনকে উৎসাহিত করা এবং আইন প্রয়োগে যথাসাধ্য চেষ্টা করা, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে সতর্ক হওয়া, রাস্তার উভয় পাশে ফুটপাত নির্মাণ করা, ফিটনেস চেকিংয়ের জন্য জনগণ ও সড়ক উন্নয়ন সংস্থার পক্ষ থেকে একজন মেজিস্ট্রাটের অধীনে মোবাইল টিম বের করা- সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রায়ই এসব সুপারিশ থাকলেও বাস্তবায়ন নেই।

সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে অদক্ষ ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালক বাসের স্টিয়ারিংয়ে বসা। ২৫ জুন টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়কের কালিহাতী উপজেলার সাতুটিয়া এলাকায় ট্রাক উল্টে খাদে পড়ে পিতা-পুত্রসহ পাঁচজনের মৃত্য হয়। আহতরা জানান, ট্রাকচালক নেশাগ্রস্ত ছিল। নেশা করতে মানা করায় চালক বলছিল সে নেশা করে তার বাবাও নেশা করত। নেশা না করলে গাড়ি চালানো যায় না। অধিকাংশ চালক নেশা করে স্টিয়ারিংয়ে বসে।

চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে দুই শর বেশি মাদক কারবারি ও সেবনকারীর মৃত্যু হয়েছে ‘বন্দুকযুদ্ধে’।  কিন্তু মাদকাসক্ত চালকের বিরুদ্ধে তেমন কোনো  পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিআরটিএর লাইসেন্স। লাইসেন্স প্রদানে সতর্কতা, মাদক সেবন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, অভারটেকিং নিষিদ্ধ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, পথচারী চলাচলের জন্য ফুটপাত ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, অবৈধ চালকের দৌরাত্ম্য বন্ধ, অপরাধীদের দ্রুত বিচার ব্যবস্থা চালু এবং অপ্রাপ্তবয়স্কদের হাতে স্টিয়ারিং ছেড়ে না দিয়ে সরকারি নজরদারি বাড়ালে নিরাপদ সড়ক খুব দূরে নেই।

সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ, মন্ত্রীর হাসি, পরবর্তীতে মন্ত্রীর ক্ষমা প্রার্থনা এসবের কোনোটাই সমাধান না। নিরাপদ সড়কের জন্য চাই কার্যকর পদক্ষেপ।

১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর চিত্রনায়ক ইলিয়াছ কাঞ্চনের স্ত্রী জাহান আরা কাঞ্চন শুটিং দেখতে মাইক্রোবাসে বান্দরবানে যাওয়ার পথে চট্টগ্রামের পটিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর ওই বছরই নিরাপদ সড়ক চাই নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন তিনি। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ গণসচেতনায় সফল। এই সংগঠনটি সক্রিয় থাকলেও শক্তিশালী কোনো গোষ্ঠী সরাসরি পাশে না থাকায় তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।

কিন্তু সহপাঠীর মৃত্যুতে ছাত্রসমাজ মাঠে নেমে সড়কের নানা অনিয়ম যেভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে তাতে আশা করি এবার নিরাপদ সড়ক হয়তো আর দূরে নেই। কেননা পৃথিবী কোথাও ছাত্র আন্দোলন বৃথা গেছে এ রকম ইতিহাস নেই। এ ছাড়া এবারের আন্দোলনে যৌক্তিকতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলছে না এমনকি সরকার, বিরোধীদলসহ অন্যান্য সংগঠনও এর বিরোধিতা করছে না।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় দ্রুত বিচারের বিধান রাখা হচ্ছে। মন্ত্রী জানিয়েছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় যে শাস্তি হওয়া উচিত, তার সর্বোচ্চটাই থাকছে সড়ক পরিবহন আইনে। আইনটিতে তড়িৎ গতিতে বিচারের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এই আইনে সংশ্øিষ্ট কোনো অপরাধী আইনের কোনো ফাঁক-ফোকর দিয়ে বের হতে পারবে না।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সংসদের আগামী অধিবেশনে আইনটি পাস হলেই তারা কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। প্রধানমন্ত্রীও চান আইনটি দ্রুত পাস হোক। এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের আন্তরিকতার কথাও বলেছেন আনিসুল হক।

শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের দাবিগুলোর দিকেও নজর দিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো ড্রাইভারের কঠোর শাস্তির বিধান আইনে সংযোজন করতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকরা গাড়ি চালাতে পারবেন না। বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া যাবে না। শিক্ষার্থীদের চলাচলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে ফুটওভারব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রত্যেক সড়কে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় স্পিডব্রেকার দিতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে। শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে থামিয়ে তাদের নিতে হবে এবং শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এমন নয়টি দাবি শিক্ষার্থীদের।

লেখক: সংবাদকর্মী।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

নিরাপদ সড়ক কত দূরে

আপডেট টাইম : ০৫:০৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ অগাস্ট ২০১৮

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে আমরা দেখতে পাচ্ছি সড়ক দুর্ঘটনার অসংখ্য বীভৎস ছবি, দেখতে পাচ্ছি স্বজন হারানোদের আহাজারি। বিশেষ করে ঈদের ছুটির সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় লাশের মিছিল দীর্ঘ হতে থাকে। বর্তমান সময়ে এক আতঙ্কের নাম সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনায় খালি হচ্ছে হাজারো মায়ের কোল। এই তো গত ২৯ জুলাই রোববার রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কের এমইএসে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের বেশ কিছু শিক্ষার্থীর ওপর বাস তুলে দেয় চালক।

এতে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র রেজাউল করিম রাজু ও একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম নামের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়,। আহত হয় আরও কয়েকজন। ঘটনাস্থলেই ঝরল দুটি মেধাবী প্রাণ। প্রকাশ্যে বাসচাপায় মৃত্যু। সহপাঠীর লম্বা তালিকা আন্দোলনে শরীক হওয়ায় ঘটনাটি আলোচনায় এসেছে।

এ রকম কতো প্রাণ সড়কে ঝরছে। পরিচয় না পেয়ে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে মাটিচাপা পড়ে। গণমাধ্যমে তালিকাভুক্তি পরের কথা, অপমৃত্যুর তালিকা থেকেও বঞ্চিত হয় ওরা। নৌ, সড়ক ও রেলপথের সমন্বয়ে তৈরি করা তথ্যমতে ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৪৭২টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৪ হাজার ২৮৪ জন। এর মধ্যে ৫১৬ জন নারী ও ৫৩৯ শিশু। এতে আহত হয় ৯ হাজার ১১২ জন। ২০১৬ সালে ২ হাজার ৯৯৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩ হাজার ৪১২ জনের প্রাণহানি হয়েছিল। আহতের সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৫৭২। ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭তে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ৪৭৪টি। আর দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়েছে ৮৭২। এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ২২ দশমিক ২ শতাংশ ও হতাহত ২৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ। দুর্ঘটনার ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ পথচারীকে চাপা, ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১১ দশমিক ৯ শতাংশ খাদে পড়ে, ২ দশমিক ৮ শতাংশ চাকায় ওড়না পেছিয়ে সংঘটিত হয়।

কিন্তু কেন এই সড়ক দুর্ঘটনা? কেন এই অকাল অপমৃত্যু?
সড়কপথ একটি দেশের অর্থনৈতিক ও যোগাযোগ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, বিআরটিএসহ যোগাযোগ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কি সদুত্তর দিতে পারবেন? দেশের মহাসড়কগুলোতে সংঘর্ষের সংবাদ শুনে মনে হতো দ্রুতগতি, সড়কগুলো সরু এবং কোনো ডিভাইডার নেই, বেপরোয়া অতিক্রম- এমন নানা কারণে সংঘর্ষ হয়ে থাকে। সম্প্রতি আমরা হতভম্ব হচ্ছি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষও নিরাপদ নয়। কখন যেন প্রাণটা কেড়ে নেয় ঘাতক যান।

দুর্ঘটনা পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, বিপজ্জনক ওভারটেকিং, রাস্তাঘাটের নির্মাণক্রটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো, মহাসড়ক ও রেলক্রসিংয়ে ফিডার রোডে যানবাহন উঠে পড়া, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা, ভালো সড়কের অভাব, চালকের অদক্ষতা, পুরাতন ট্রাফিক সিগনাল ব্যবস্থা, বিকল্প যানবাহনের অপর্যাপ্ত সুবিধা, যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের অভাব সহজেই চোখে পড়ে।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নানামুখী পদক্ষেপের কথা বলা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী, ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা একেবারেই সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনার চ্যালেঞ্জও নিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু বাস্তবতা প্রশ্নবিদ্ধ। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে দুর্ঘটনার পরিমাণ বেড়েছে অন্তত ১৫ থেকে ২২ ভাগ। সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৪ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা মোট জিডিপির দুই শতাংশ।

সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দিনে দিনে অনেক অনিয়ম জমে গেছ। সেগুলোর দূর করার পাশাপাশি নিতে হবে প্রতিরোধমূরক ব্যবস্থা। তার বেশ কিছু ব্যবস্থার যেটুক চর্চা হয়, তা খুবই যৎসামান্য। সেগুলোর নিয়মিত চর্চা জরুরি হয়ে পড়েছে।

যানবাহন চালনার (ড্রাইভিং) লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি পাস বাধ্যতামূলক করা দরকার। চালক ও সহকারীসহ সব ধরনের পরিবহনকর্মীর নিয়োগপত্র ও শ্রম আইন মেনে মজুরি-ভাতা প্রদান এবং তাদের শ্রমঘণ্টা নির্ধারণ করে দিতে হবে। অবৈধ-ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে সারা বছর বিআরটিএর অভিযান; ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চালানোর দায়ে চালক, সুপারভাইজার ও সহকারীর সঙ্গে মালিককেও আইনের আওতায় আনতে হবে।

সড়ক,  মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কগুলো নিয়মিত সংস্কার, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকগুলো চিহ্নিতকরণ এবং সতর্ক সংকেত স্থাপন। ট্রাফিক আইন অমান্যকারী চালক ও সহকারীর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ। ক্ষুদ্র যানবাহনের জন্য আলাদা সড়ক, যানবাহনের চালক ও সহকারীর লাইসেন্স বাধ্যতামূলক করা, বিআরটিসিকে শক্তিশালীকরণ ও রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ রুটসহ দেশের সব আন্তঃজেলা রুটে বিআরটিসির সার্ভিস চালু, আধুনিক ডিজিটাল সিগনাল পোস্ট নির্মাণ, ফিটনেসবিহীন কোনো যানবাহন পথে না নামানো, ওভারব্রিজ পারাপারে লোকজনকে উৎসাহিত করা এবং আইন প্রয়োগে যথাসাধ্য চেষ্টা করা, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে সতর্ক হওয়া, রাস্তার উভয় পাশে ফুটপাত নির্মাণ করা, ফিটনেস চেকিংয়ের জন্য জনগণ ও সড়ক উন্নয়ন সংস্থার পক্ষ থেকে একজন মেজিস্ট্রাটের অধীনে মোবাইল টিম বের করা- সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রায়ই এসব সুপারিশ থাকলেও বাস্তবায়ন নেই।

সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে অদক্ষ ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালক বাসের স্টিয়ারিংয়ে বসা। ২৫ জুন টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়কের কালিহাতী উপজেলার সাতুটিয়া এলাকায় ট্রাক উল্টে খাদে পড়ে পিতা-পুত্রসহ পাঁচজনের মৃত্য হয়। আহতরা জানান, ট্রাকচালক নেশাগ্রস্ত ছিল। নেশা করতে মানা করায় চালক বলছিল সে নেশা করে তার বাবাও নেশা করত। নেশা না করলে গাড়ি চালানো যায় না। অধিকাংশ চালক নেশা করে স্টিয়ারিংয়ে বসে।

চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে দুই শর বেশি মাদক কারবারি ও সেবনকারীর মৃত্যু হয়েছে ‘বন্দুকযুদ্ধে’।  কিন্তু মাদকাসক্ত চালকের বিরুদ্ধে তেমন কোনো  পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিআরটিএর লাইসেন্স। লাইসেন্স প্রদানে সতর্কতা, মাদক সেবন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, অভারটেকিং নিষিদ্ধ, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, পথচারী চলাচলের জন্য ফুটপাত ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, অবৈধ চালকের দৌরাত্ম্য বন্ধ, অপরাধীদের দ্রুত বিচার ব্যবস্থা চালু এবং অপ্রাপ্তবয়স্কদের হাতে স্টিয়ারিং ছেড়ে না দিয়ে সরকারি নজরদারি বাড়ালে নিরাপদ সড়ক খুব দূরে নেই।

সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ, মন্ত্রীর হাসি, পরবর্তীতে মন্ত্রীর ক্ষমা প্রার্থনা এসবের কোনোটাই সমাধান না। নিরাপদ সড়কের জন্য চাই কার্যকর পদক্ষেপ।

১৯৯৩ সালের ২২ অক্টোবর চিত্রনায়ক ইলিয়াছ কাঞ্চনের স্ত্রী জাহান আরা কাঞ্চন শুটিং দেখতে মাইক্রোবাসে বান্দরবানে যাওয়ার পথে চট্টগ্রামের পটিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর ওই বছরই নিরাপদ সড়ক চাই নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন তিনি। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ গণসচেতনায় সফল। এই সংগঠনটি সক্রিয় থাকলেও শক্তিশালী কোনো গোষ্ঠী সরাসরি পাশে না থাকায় তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি।

কিন্তু সহপাঠীর মৃত্যুতে ছাত্রসমাজ মাঠে নেমে সড়কের নানা অনিয়ম যেভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে তাতে আশা করি এবার নিরাপদ সড়ক হয়তো আর দূরে নেই। কেননা পৃথিবী কোথাও ছাত্র আন্দোলন বৃথা গেছে এ রকম ইতিহাস নেই। এ ছাড়া এবারের আন্দোলনে যৌক্তিকতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলছে না এমনকি সরকার, বিরোধীদলসহ অন্যান্য সংগঠনও এর বিরোধিতা করছে না।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় দ্রুত বিচারের বিধান রাখা হচ্ছে। মন্ত্রী জানিয়েছেন, সড়ক দুর্ঘটনায় যে শাস্তি হওয়া উচিত, তার সর্বোচ্চটাই থাকছে সড়ক পরিবহন আইনে। আইনটিতে তড়িৎ গতিতে বিচারের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এই আইনে সংশ্øিষ্ট কোনো অপরাধী আইনের কোনো ফাঁক-ফোকর দিয়ে বের হতে পারবে না।

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সংসদের আগামী অধিবেশনে আইনটি পাস হলেই তারা কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। প্রধানমন্ত্রীও চান আইনটি দ্রুত পাস হোক। এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের আন্তরিকতার কথাও বলেছেন আনিসুল হক।

শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের দাবিগুলোর দিকেও নজর দিতে হবে কর্তৃপক্ষকে। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো ড্রাইভারের কঠোর শাস্তির বিধান আইনে সংযোজন করতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকরা গাড়ি চালাতে পারবেন না। বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া যাবে না। শিক্ষার্থীদের চলাচলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে ফুটওভারব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রত্যেক সড়কে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকায় স্পিডব্রেকার দিতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্রছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে। শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে থামিয়ে তাদের নিতে হবে এবং শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এমন নয়টি দাবি শিক্ষার্থীদের।

লেখক: সংবাদকর্মী।