বর্তমান পৃথিবীতে যে পেশাগুলো মানুষের পছন্দের তালিকার শীর্ষস্থান দখল করে রয়েছে সেগুলোর মধ্যে নেটওয়ার্কিং অন্যতম। এ যুগ অনেকটাই যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। সফল ও নিশ্চিত ক্যারিয়ার গড়ে তোলার জন্য এ পেশা অত্যন্ত উপযোগী। নেটওয়ার্কিং ব্যবস্থার মাধ্যমে অতি অল্প সময়ে বিপুল পরিমাণ কাজ দ্রুততার সঙ্গে করা যায়। ফলে বেসরকারী অফিস, ব্যাংক, কর্পোরেট হাউজ, এনজিও ছাড়াও সরকারি অফিসগুলোকেও কম্পিউটার নেটওয়ার্ক এর আওতায় আনা হচ্ছে।
এছাড়া দেশ বিদেশে নেটওয়ার্কারদের চাহিদা এখন ব্যাপক। বিভিন্ন টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আর এসব প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজন হচ্ছে বিপুল সংখ্যক নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার। এ ছাড়া বিভিন্ন টিভি চ্যানেল, আইএসপি কোম্পানি এবং ডেটা সেন্টারেও নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ারদের কাজের বিপুল সুযোগ রয়েছে। তাহলে জেনে নিন নেটওয়ার্কিং সম্পর্কে-
নেটওয়ার্কিং
একটি কম্পিউটার যখন এক বা একাধিক কম্পিউটারের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে তথ্য আদান প্রদান করে তখন তাকে নেটওর্য়াক বলে। নেটওর্য়াক করার জন্য ন্যূনতম দুটি কম্পিউটার প্রয়োজন।
নেটওয়ার্কিংয়ের উৎপত্তি
প্রথম দিকের নেটওয়ার্ক ছিল মেইনফ্রেম ভিত্তিক। মেইনফ্রেম কম্পিউটারের সঙ্গে যুক্ত থাকত বিভিন্ন টার্মিনাল। এই মেইনফ্রেমের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার লাইন অনেক সময় বেশ দীর্ঘ হতো, অনেক দূর থেকে সেগুলাতে যুক্ত হওয়া যেত। দুটি নেটওয়ার্ক থেকে আজকের এই আধুনিক নেটওয়ার্কের জন্ম।
প্রথমদিকের একটি নেটওয়ার্ক হলো সেমি অটোমেটিক গ্রাউন্ড এনভায়রনমেন্ট (SAGE)। যা যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় বিভিন্ন রাডার স্টেশনের সরকারি কম্পিউটারসমূহকে যুক্ত করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে এটি উদ্ভাবন করা হয়েছিল। এরপর ১৯৬০ সালে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির গবেষকরা আইবিএম মেইনফ্রেম কম্পিউটারে কম্প্যাটিবল টাইম-শেয়ারিং সিস্টেম (CTSS) পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এই পদ্ধতির মেইনফ্রেম কম্পিউটার মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা একই সময়ে একাধিক কাজ করতে সক্ষম হয়।
বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ১৯৬৪ সালে আমেরিকান এয়ারলাইন্সের নেটওয়ার্কে প্রথম ডায়াল-আপ সার্ভিস ব্যবহার করা হয়েছিল। আইবিএম এর রিজার্ভেশন সিস্টেম ৬৫ টি শহরের ২০০০ কম্পিউটারকে যুক্ত করেছিল কেবল দুটি আইবিএম মেইনফ্রেম ও টেলিফোন লাইন ব্যবহার করে। বিভিন্ন কোয়েরি প্রসেস করা হতো কেন্দ্রের মেইনফ্রেম কম্পিউটারে।
এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যেকোনো ফ্লাইট সম্পর্কিত তথ্য তিন সেকেন্ডের মধ্যে পাওয়া যেত। ষাট ও সত্বর দশকের নেটওয়ার্কসমূহ মেইনফ্রেম ভিত্তিক হওয়ায় এতে সকল প্রসেসিং চলত মেইনফ্রেমে। এর সঙ্গে বিভিন্ন স্থান থেকে টার্মিনাল যোগ করা হতো। এরপর এলো ইথারনেট। হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ছাত্র রবার্ট মেটাকাফ তার পিএইচডি থিসিসের মধ্যে প্রথম ইথারনেটের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। তারপর গড়ে ওঠে পরীক্ষামূলক ইথারনেট নেটওয়ার্ক। আজকের দিনে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেটওয়ার্ক হলো এই ইথারনেট (Ethernet)।
নেটওয়ার্কে সাধারণত তিন ভাগে ভাগ করা যায়-
১. লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক (LAN):
ছোট কিংবা মাঝারি প্রায় সব ধরনের প্রকিষ্ঠানে এ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ একই বিল্ডিং এর মাঝে অবস্থিত বিভিন্ন কম্পিউটার নিয়ে গঠিত নেটওয়ার্রকে LAN বলে। এর মাধ্যমে অনেক ডিভাইসে এসসেস পাওয়া যায়। এই নেটওয়ার্ক এর ডাটা ট্রান্সফার গতি ১০ এমবিপিএস। এই নেটওয়ার্কে ব্যবহৃত ডিভাইসগুলো হলো রিপিটার, হাব, নেটওয়ার্ক ইন্টারফেস ইত্যাদি।
2. মেট্রোপলিটন এরিয়া নেটওয়ার্ক (MAN):
একই শহরের মধ্যে অবস্থিত কয়েকটি LAN এর সমন্বয়ে গঠিত ইন্টারফেসকে MAN বলা হয়। বিভিন্ন সরকারি অফিস এর প্রধান ব্যবহারকারি। যেমন শহরের প্রতিটি পুলিশ ষ্টেশনের নেটওয়ার্ককে নিয়ে গড়ে তোলা হলো একটি নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্ক হলো MAN। এটি ৫০ থেকে ৭৫ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। এই নেটওয়ার্কর ডাটা ট্রান্সফার স্পিড গিগাবিট পার সেকেন্ড। এ ধরনের নেটওয়ার্কে ব্যবহৃত ডিভাইস গুলো হলো রাউটার, সুইজ, মাইক্রোওয়েভ এন্টেনা ইত্যাদি।
৩. ওয়াইড এরিয়া নেটওয়ার্ক (ডব্লিউএএন):
বিস্তৃত ভৌগলিক এলাকায় অবিস্থত একাধিক LAN বা MAN কে নিয়ে গড়ে ওঠে WAN। অর্থাৎ দূরবর্তী ল্যানসমূকে নিয়ে গড়ে উঠা নেটওয়ার্ককে WAN বলে। এই নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে টেলিফোন কোম্পানি ক্যাবল ব্যবহার করে। এ ধরনের নেটওয়ার্ক এর ডাটা ট্রান্সফার স্পীড ৫৬ কেবিপিএস থেকে ১.৫৪৪ এমবিপিএস। এতে সবোর্চ্চ গতি হতে পারে ৪৫ এম বিপিএস। ওয়্যানের গতি ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। এই নেটওয়ার্কে ব্যবহৃত ডিভাইসগুলো হলো রাউটার, মডেম, ওয়্যান সুইজ ইত্যাদি।
টপোলজি
অনেক কম্পিউটারকে নেটওয়ার্কে একসঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়। একটি কম্পিউটারের সঙ্গে আরেকটি কম্পিউটার জুড়ে দেয়ার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। আর এ পদ্ধতিগুলোকেই বলা হয় নেটওয়ার্ক টপোলজি। যেমন- ক্যাবল, পিসি, রাউটার ইত্যাদি।
নেটওয়ার্ক ডিজাইনের ক্ষেত্রে টপোলজি বিশেষ ভূমিকা রাখে। কম্পিউটার নেটওয়ার্কিং এর জন্য মূলত ছয় ধরনের টপোলজি ব্যবহৃত হয়। নীচে টপোলজিগুলোর বর্ণনা দেয়া হলো-
• বাস টপোলজি (Bus Topology): যে টপোলজিতে একটি মূল তারের সঙ্গে সবকটি ওয়ার্কস্টেশন বা কম্পিউটারে সংযুক্ত থাকে তাকে বাস টপোলজি বলা হয়। বাস টপোলজির প্রধান ক্যাবলটিকে বলা হয় ব্যাকবোন (Backbone) বা ট্রাঙ্ক (Trunk)।
সিগন্যাল যখন ব্যাকবোনে চলাফেরা করে তখন শুধু প্রাপক কম্পিউটার সিগন্যাল গ্রহণ করে এবং বাকিরা একে অগ্রাহ্য করে। বাস টপোলজি ছোট আকারের নেটওয়ার্কে ব্যবহার খুব সহজ, সাশ্রয়ী। এক্ষেত্রে কোনো কম্পিউটার নষ্ট হয়ে গেলে সম্পূর্ণ সিস্টেম নষ্ট হয়ে যায় না। বাস টপোলজিতে একই নেটওয়ার্ক এ ভিন্ন ক্যাবল ব্যবহৃত হতে পারে।
• রিং টপোলজি (Ring Topology): রিং টপোলজিতে প্রতিটি কম্পিউটার তার পার্শ্ববর্তী কম্পিউটারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। এভাবে রিং টপোলজির সর্বশেষ কম্পিউটারটি প্রথম কম্পিউটারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে।
এ ব্যবস্থায় কোনো কম্পিউটার ডেটা পাঠালে তা বৃত্তকার পথে ঘুরতে থাকে। যতক্ষণ না পর্যন্ত প্রাপক কম্পিউটারটি ডেটা গ্রহণ করে। এ ব্যবস্থায় কোনো কেন্দ্রীয় কম্পিউটার থাকে না। যার ফলে প্রতিটি কম্পিউটারের গুরুত্ব সমান।
• স্টার টপোলজি (Star Topology): যে টপোলজি একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকারী কম্পিউটার অন্যান্য কম্পিউটার সংযুক্ত করে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে তাকে স্টার টপোলজি বলা হয়।
এক্ষেত্রে একটি কম্পিউটার কেন্দ্রীয় কম্পিউটারের মাধ্যমে তথ্য আদান প্রদান করে থাকে। এ টপোলজিতে কোনো একটি কম্পিউটার নষ্ট বা বিকল হলে নেটওয়ার্ক এর উপর কোনো প্রভাব পড়ে না।
খুব সহজেই সমস্যা হওয়া কম্পিউটারটি সরিয়ে নেয়া যায়। স্টার টপোলজি একটি বহুল ব্যবহৃত টপোলজি। এই টপোলজিতে একই নেটওয়ার্ক এ বিভিন্ন ধরনের ক্যাবল ব্যবহৃত হতে পারে।
• ট্রি টপোলজি (Tree Topology): যে টপোলজিতে কম্পিউটারগুলো পরস্পরের সঙ্গে গাছের শাখা-প্রশাখার মতো বিন্যস্ত থাকে তাকে ট্রি টপোলজি বলে।
এ টপোলজিতে এক বা একাধিক স্তরের কম্পিউটার হোস্ট কম্পিউটারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। অর্থাৎ প্রথম স্তরের কম্পিউটারগুলো দ্বিতীয় স্তরের কম্পিউটারগুলোর হোস্ট হয়। একইভাবে দ্বিতীয় স্তরের কম্পিউটারগুলো তৃতীয় স্তরের কম্পিউটারগুলোর হোস্ট হয়। অফিস ব্যবস্থাপনার কাজে এ নেটওয়ার্ক টপোলজি খুবই উপযোগী।
• হাইব্রিড টপোলজি (Hybird Topology): বাস, স্টার, রিং ইত্যাদি টপোলজির সমন্বয়ে গঠিত নেটওয়ার্ক টপোলজিকে বলা হয় হাইব্রিড টপোলজি।
উদাহরণস্বরূপ ইন্টারনেটকে এ ধরনের টপোলজি হিসেবে অভিহিত করা যায়। কেননা ইন্টারনেট হলো বৃহৎ পরিসরের একটি নেটওয়ার্ক যেখানে সব ধরনের টপোলজির মিশ্রণ দেখা যায়।
এ টপোলজিতে প্রয়োজন অনুযায়ী নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি করার সুযোগ রয়েছে। কোনো সমস্যা দেখা দিলে তা সহজেই নির্ণয় করা সম্ভব হয়। কোনো একটি অংশ নষ্ট হয়ে গেলে সম্পূর্ণ নেটওয়ার্ক নষ্ট না হয়ে অংশবিশেষ নষ্ট হয়।