বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ একবার আমার মেয়ে অসুস্থ হওয়ায় রাত ৮টায় হাসপাতালে ছুটলাম। চাইল্ড স্পেশিয়ালিস্ট খুঁজছি। রিসেপশন থেকে জানানো হল- “এখন জেনারেল ডাক্তার পাবেন। চাইল্ড স্পেশিয়ালিস্ট বসে রাত দশটা থেকে ভোর ছ’টা”। বুঝলাম রোজার মাসের কারণে সময় ঘড়ি সর্বত্রই বদলেছে।
এখানে ঈদে সবকিছু থাকে জাঁকজমকপূর্ণ ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সব আরবিয়দের গাড়ি চকচক করে; ‘গাড়ির মিররে নয়, বডিতেই চেহারা দেখা যায়’- এমন অবস্থা। আর প্রবাসীদের ঈদ কাটে মোবাইলে। শিকড়ের সাথে কথোপকথনে। প্রবাসীদের ঈদ মানেই বিষণ্ণ ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।
এবার প্রবাসী হিসেবে আমাদের ঈদ কিছুটা ব্যতিক্রমভাবেই কাটালাম। ছুটিতে ছুটে গেলাম কিছু দর্শনীয় স্থানে। ‘হাওয়াইয়াত নাজম’ লেইক আর ‘জাবেল আখদারে’।
হাওয়াইয়াত নাজম লেক মাস্কাট থেকে প্রায় ১১৩ কিলোমিটার দূরে। স্থানীয় সবার মতে উল্কা পতনের ফলে এর সৃষ্টি। ‘হাওয়াইয়াত নাজম’ শব্দের অর্থই ‘উল্কা’। এখানকার পানি বেশ নীল। আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে এই লেকে আছে প্রচুর পরিমাণের ‘ডক্টর বা স্পা ফিশ’। যাদের মূল কাজ মানুষের ত্বকের মরা এবং রুক্ষ কোষ খেয়ে ফেলা। যার ফলে ত্বক হয় মসৃণ ও কোমল।
বিশ্বের অনেক দেশেই ‘ফিশ পেডিকিউর’ এর জনপ্রিয়তা বেশ তুঙ্গে। থাইল্যান্ডে তো পথে ঘাটে দেখেছি বালতির পানিতে সাদা চামড়ার লোকেরা পা চুবিয়ে বসে আছে। পা চুবিয়ে থাকার বিনিময়ে পার্লারে দিতে হয় মোটা অংকের থাই বাথ। আর বালতির পানিতে থাকে এই ‘স্পা ফিশ’।
পরের দিন ছুটে গেলাম ‘জাবেল আখদার’, এটি ওমানের সর্বোচ্চ পাহাড়। ‘জাবেল আখদার’ অর্থ ‘সবুজ পাহাড়’। মাস্কাট শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৫০ কিলোমিটার।
এ পাহাড় নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। এর আগের ঈদে এক বাঙালি ব্যবসায়ী হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে। সবার মুখে মুখে রটে গেল পাহাড়ের উচ্চতা দেখে নামার সময় ভয়ে হার্টফেইল করেছে। কতোটা সত্য জানার উপায় নেই। তবে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে সত্য।
এ কারণে পাহাড়ের নিচে পুলিশের চেক পোস্ট বসানো হয়েছে যাতে কেউ সাধারণ গাড়ি নিয়ে উপরে ওঠার সাহস না দেখায়। ফোর হুইলার গাড়ি ছাড়া ওপরে উঠা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
আমরা এক ওমানি গাইড কাম ড্রাইভার আর ফোর হুইলার গাড়ি ভাড়া নিয়ে নিলাম। পাহাড়ের নিচের তাপমাত্রা তখন পঞ্চাশ ডিগ্রি সেলসিয়াস হবে। এসি ছেড়ে রওয়ানা দিলাম। কিছুদূর ওঠার পর ওমানি গাইড এসি বন্ধ করে দিল। আমি অবাক। গরমে তো মারা যাবো। ওমানি বন্ধু হাসেম হাসি দিয়ে গাড়ির জানালা খুলে দিল।
দেখি জানালা দিয়ে বাতাস আসছে তাতে গরমের তাপদাহ নেই। যত উপরে উঠছি বাতাস ততই ঠাণ্ডা হচ্ছে। প্রায় দুই হাজার ৩০০ মিটার উপরে ওঠার পর দেখি শীতল বাতাস বইছে। সাথে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল কিছুক্ষণ আগেই পাহাড়ের পাদদেশে ছিল আগুন গরম। আর এখানে হিমশীতল বাতাস!
ট্যুরিস্টদের জন্য এখানে অনেক হোটেল আছে। ওমানি বাড়িও আছে। শুনলাম এসব বাড়িতে এসি’র প্রয়োজন নেই। বারো মাস বহে শীতল বাতাস। এসির কি দরকার?
মেঘেদের সাথে এ পাহাড়ের মিতালি বেশ। ফলে যখন তখন হয় বৃষ্টি। সাধারণত ওমানের বেশিরভাগ পাহাড় রুক্ষ ও শুষ্ক। সবুজের ছিটেফোঁটা নেই। জাবেল আখদার তার ব্যাতিক্রম। এখানে আছে আনার, আঙ্গুর, পিচ ও নাম না জানা অনেক ফলের বাগান।
মজার ব্যাপার হল এখানে গোলাপ বাগানও আছে। উন্নতমানের গোলাপজল এখান থেকেই হয়। তবে এ পাহাড়ে কোন খেজুর গাছ আমার চোখে পরেনি। হয়তো ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণেই খেজুর গাছ এখানে হার মেনেছে। অনেক বন্য ছাগল, ভেড়া আর গাধার দেখা পেয়েছি এ পাহাড়ে।
ইচ্ছে হচ্ছিল এখানে রাত্রিযাপন করার। প্রস্তুতি নিয়ে না আসায় আর সম্ভব হল না। আঁধারে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে ল্যাম্পপোস্টের আলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন মুক্তোর আলো জ্বলছে। জাবেল আখদার যেন মুক্তাখঁচিত এক মালা পরে আছে।
কেউ ওমানে এসে জাবেল আখদার না দেখলে সত্যি বড় বেশি অবিচার হবে। প্রবাসী হয়ে নয়, বরং ট্যুরিস্ট হয়েই আসুক বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা এখানে।