বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ সেমিস্টার শেষ। গত চার মাসের ধকল কাটিয়ে সতেজ হবার সময় এটা। শহরের যান্ত্রিক কোলাহলপূর্ণ ব্যস্ত জীবন থেকে কিছুটা সময়ের জন্য মুক্তি পেতে আগে থেকেই রাঙ্গামাটি যাওয়ার পরিকল্পনা করে রেখেছি। ভ্রমণসাথী হবে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় ভ্রমণ পাগল দল ‘ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ট্যুরবাজ’। সব মিলিয়ে আমরা ১০৮ জন যাচ্ছি লাল পাহাড়ির দেশে, রাঙ্গামাটির দেশে।
২৭ এপ্রিল রাতে আমরা বেরিয়ে পড়লাম রাঙ্গামাটির উদ্দেশে। সারারাত বাস হৈ-হুল্লোড়ে মেতে ছিল। আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমাদের একজন ভ্রমণসাথী বাসের দুই সিটের মাঝের ফাঁকা জায়গাতেই নাচ শুরু করল। কেউ সেই নাচের দৃশ্য ভিডিও করছে আবার কেউ তাকে উৎসাহ দিচ্ছে। এই আনন্দ উৎসবের মাঝেই এক তরফা ঘুম দিয়ে দিলাম। ঘুম ভাঙল সকালের মিষ্টি রোদে। ততক্ষণে রাঙ্গামাটি পৌঁছে গেছি। আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য আগে থেকেই বিশাল বিশাল পাহাড় ও অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরিই ছিল। রিজার্ভ বাস আমাদের একেবারে হোটেল প্রিন্সের সামনে নামিয়ে দিল। আমরা সবাই এখানেই থাকব।
হোটেল প্রিন্সে ঢুকতেই রিসিপশনের কিছুটা সামনে চোখে পড়ল কাঁচ দিয়ে ঘেরা একটি পাহাড়ি গ্রাম। কি সুন্দর শিল্পকর্ম! সবাই যার যার রুমের চাবি নিয়ে রুমে চলে গেল। এখন কিছুটা বিশ্রামের সময়। সামনের কয়েকটা দিনে অপেক্ষা করছে যে পাহাড়ি অ্যাডভেঞ্চার।
ঘণ্টা দুয়েক বিশ্রামের পর প্রিন্স হোটেলের সামনের এক খাবার দোকান থেকে নাস্তা সেরেই কিছুক্ষণ পায়ে হেটে শহরটা ঘুরে দেখলাম। ১.৩০ টার দিকে হোটেলে পৌঁছেই হোটেলের ছাদের রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সেরে নিলাম। বিশ্রাম আর খাওয়াদাওয়া তো হলো। তো আর অপেক্ষা কীসের? নেমে পরলাম রাঙ্গামাটিকে আবিস্কার করতে। পলওয়েল পার্কে গিয়েই থমকে দাঁড়াতে হলো বিশাল এক গাছ দেখে। টাঙ্গানো সাইনবোর্ড পরে বুঝলাম চাপালিশ গাছটির বয়স ৩০০ ছাড়িয়ে গেছে। কাপ্তাই লেকের ঠিক পাশে গাছটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির শোভা বৃদ্ধি করছে বছরের পর বছর ধরে। পার্ক থেকে কাপ্তাই লেকের যে দৃশ্য তা যে কাউকে বিমোহিত করতে যথেষ্ট। বিমোহিত হয়েই হয়তোবা গোসল করতে নেমে পড়লাম কাপ্তাইয়ে। প্রায় ঘণ্টাখানেক চলল নিরন্তর দাপাদাপি। সূর্যাস্ত উপভোগ শেষে হোটেলে গিয়ে কাপড় পরিবর্তন করেই আবার পলওইয়েল পার্কের বিচে আসা। এখন সবাই মিলে ফানুস উড়াব।
এক একটি ফানুস আকাশে উঠে আর সমস্বরে সবাই চিৎকার করে ফানুসের আগমন বার্তা জানিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পরে আকাশে ফানুস আর তারায় পার্থক্য করতে পারলাম না। পার্কে ডিনার সেরে হোটেলে ফিরে বেশ রাত পর্যন্ত চলল স্পিন দা বটল এর সাথে ট্রুথ অ্যান্ড ডেয়ার খেলা।
পরদিন ছিল কাপ্তাই লেক চষে বেড়ানোর দিন। সবাই মিলে একটা ট্রলারে সারাদিন কাপ্তাই ঘুরে কাটালাম। মাঝে ট্রলার থেকে নেমে রাজবন বিহার, রাজবাড়ি আর শুভলং ঝর্নার সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। শুভলং ঝর্ণাতে পৌঁছে এর বিশালতা দেখে একঝটকায় বিমোহিত হয়েছিলাম। পরমুহূর্তেই আশাহত হয়েছি ঝর্ণার পানির সল্পতা দেখে। এর আগেও বেশ কয়েকটি ঝর্ণা দেখলেও কোনটিতেই বিশাল পানির ধারা দেখার সুযোগ হয়নি।
আশাহত হলাম এবারও। তবে দুপুরের খাবার খেতে পেদা টিং টিং এ গিয়ে বাম্বু চিকেন এর স্বাদ পেয়ে সব দুঃখ ঘুচে গেল। জায়গাটা বেশ সুন্দর। কাপ্তাইের ঠিক মধ্যেখানে সুন্দরভাবে সাজানো রেস্টুরেন্টে নির্মল বাতাস আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করার সাথে সাথে বাম্বু চিকেন এর স্বাদ। আহা স্বর্গীয় অনুভূতি।
সন্ধ্যার কিছু পরে ফিরলাম হোটেলে। রাতে ডিনার হবে ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে যেতেই চারদিকে নিয়মশৃঙ্খলা চোখে পড়লো। সেনাবাহিনীর লোকেরা পোশাক পরে যখন বেশ সুন্দরভাবে সবাইকে বার-বি-কিউ পরিবেশন করলেন। নিজেদের কেমন যেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ কেউ মনে হলো।
পরের দিন ছিল এডভেঞ্চার এর। সবাই কায়াক করব। একসাথে দুইজন করে কায়াক নিয়ে নামবে। আমি আর মিশু আপু লাইফ জ্যাকেট পরে নামলাম এক কায়াকে। সবই ভাল যাচ্ছিল কিন্তু কিনার থেকে সরে কিছুটা মাঝে আসতেই ঢেউ প্রবল হলো। মিশু আপুর সে কি চিৎকার! অনেক কষ্টে ভুলিয়ে ভালিয়ে তাকে পাড়ে এনে আল্লাহর কাছে অশেষ শুকরিয়া আদায় করলাম। কায়াক শেষে গেলাম শেখ রাসেল এভিয়ারি অ্যান্ড ইকোপার্কে। কেবল কারে চড়ে পুরো পার্ক টার সৌন্দর্য্য উপভোগ করলাম। দুপুরের খাবার হবে বড়াদম বাজারের বেরানইয়ে রেস্টুরেন্টে। এখানকার বাম্বু চিকেন এর স্বাদ পেদা টিং টিং এর টার থেকে ভালই মনে হলো।
খাওয়া শেষে লেকের উপর বসানো ছোট ছোট খোলা ঘরে আরাম করে কাটিয়ে দিলাম কিছুক্ষণ। অনেকে স্লিপিং রোপে বিকালটা পার করল। ওইদিন হোটেলে ফিরে ঢাকায় ফেরার প্রস্ততি নেয়া শুরু করলাম। রাতে আবার রওয়ানা হলাম যান্ত্রিক কোলাহলপূর্ণ ব্যস্ত জীবনে ফিরে আসার জন্য। তবে খালি হাতে না সাথে আছে রাঙ্গামাটির গন্ধ আর একগাদা সুখস্মৃতি।