ঢাকা , শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যাযাবরদের পাল্টে দিচ্ছে জলবায়ু

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ  ভয়ংকর শীত আর শুষ্ক গ্রীষ্ম মঙ্গোলিয়ার যাযাবর পশুপালকদের জীবনে আনছে পরিবর্তন৷ প্রতিকূল অবস্থা থেকে নিজেদের ও পশুর পাল রক্ষার জন্য একত্রিত হচ্ছে বিভিন্ন যাযাবর সম্প্রদায়৷

শত শত বছর ধরে বিশাল স্তেপ অঞ্চলে পশুর পাল চড়িয়ে বেড়িয়েছে মঙ্গোলিয়ার যাযাবর সম্প্রদায়৷ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এটাই তাদের জীবনধারা৷ কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তন আসছে এই স্তেপ অঞ্চলেও৷ ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই জীবনধারাও পালটাতে হচ্ছে মঙ্গোলিয়ার নোমাডদের৷ পরিস্থিতি দিনদিন প্রতিকূল হয়ে উঠছে, বেশিরভাগ সময়ই আবহাওয়া থাকছে চরমে৷

বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে মঙ্গোলিয়ার জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে দ্রুততর৷ ‘‘গত ৭০ বছরে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ২ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৩ দশমিক ৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট)৷ এটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা হ্রাসের রেকর্ডগুলোর একটি“, বলছিলেন সারুল খুদু পরিবেশ গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক টোঙ্গা উলামবায়ার৷

তিনি বলেন, ‘‘এই শতকের শেষ দিকে তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে৷ তীব্র শীতের পরিমাণ দিনদিন, যা মঙ্গোলিয়ায় ‘জুদ` নামে পরিচিত৷ কোনো কোনো এলাকায় গ্রীষ্মে ভয়াবহ বৃষ্টি হচ্ছে, কোথাও আবার শীতকালে ঝড় হচ্ছে৷“

পশুপালনের ওপর নির্ভরশীল পৃথিবীর হাতেগোনা কয়েকটি দেশের একটি মঙ্গোলিয়া৷ দেশটির অর্থনীতি নির্ভর করে পশুসম্পদের ওপর এবং ৮০ শতাংশ অঞ্চলই তৃণভূমি৷

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদেরও অবশেষে পালটাতে বাধ্য হচ্ছে যাযাবররা৷ কিছু পশুপালক সম্প্রদায় বড় একটি সম্প্রদায়ে একত্রিত হচ্ছে৷ তাঁদের আশা, এর ফলে কিছুটা পরিবর্তন আনলেও ঐতিহ্যবাহী যাযাবর জীবন ধরে রাখার আশা করছেন তাঁরা৷

ঝুঁকিতে চারণভূমি

মঙ্গোলিয়ার ২৮ শতাংশ নাগরিক দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে৷ এদের মধ্যেও অনেকে শুধু কোনোরকমে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছেন৷ একদিকে, কিছু অংশের চরম দারিদ্র্য, অন্যদিকে প্রতিকূল আবহাওয়ায় চারণভূমি নষ্ট হওয়ায় পরিস্থিতি হয়ে উঠছে আরো ভয়াবহ৷ জলবায়ু পরিবর্তন এবং অতিরিক্ত পশুচারণের ফলে চারণভূমি আরো হুমকিতে পড়বে বলে আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা৷

“স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক সেন্টিমিটার বেশি বরফ পড়লে ঘাস চাপা পড়ে যায়৷ মঙ্গোলিয়ায় পশুর মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ এটি“, বলছেন উলামবায়ার৷

তিনি বলেন, ‘‘যাযাবররা অন্য জেলায় চলে যেতে বাধ্য হয়, এর ফলে ঐ অঞ্চলের সম্প্রদায় এবং চারণভূমির ওপরও চাপ পড়ে৷ অনেকেই তখন শহরে চলে যেতে বাধ্য হয়৷

এদিকে চাপ বাড়তে থাকায় দ্রুত নগরায়নের বিরূপ প্রভাব পড়েছে মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটারে৷ এর মধ্যে অন্যতম বায়ু দূষণ৷

‘জুদ`-এর প্রভাবে ১৯৯৯ -২০০০ সালের শীতে দেশটি ৩০ শতাংশ পশুসম্পদ হারায়৷ বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট`-এ উলামবায়ার উল্লেখ করেছেন ২০০৯ সালের ‘জুদ`-এ প্রাণ হারিয়েছে দেশটির ২০ শতাংশ পশু, সংখ্যায় এর পরিমাণ ২০ লাখেরও বেশি৷

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ‘জুদ`-এর পরিমাণ বাড়ছে বলে আশংকা করা হয়েছে গবেষণায়৷ যাযাবরেরা আরো ছোটখাট পরিবর্তনও টের পাচ্ছেন৷ বিভিন্ন নদীতে পানির পরিমাণ কমে আসার কথা জানিয়েছেন তারা৷

অনেক নোমাডই ‘নেগডেল` শাসনের কথা ভুলতে পারেননি৷ দেশটি যখন সমাজতান্ত্রিক সরকারের অধীনে ছিল, তখন সমস্ত চারণভূমিও ছিল রাষ্ট্রের মালিকানায়৷ সবাইকে সমানভাবে পশুচারণের অধিকার দেয়া হতো, এমনকি কোন সম্প্রদায় কোন পথ ধরে যাবে, সেটিও ঠিক করে দেয়া হতো৷ ফলে কোনো একটি অঞ্চলের ওপর বেশি চাপ কখনই পড়তো না৷ সামাজিক সেবা, পশুর চিকিৎসা, এবং জুদের সময় সরকারি ত্রাণের কথাও ভুলেননি যাযাবররা৷

কিন্তু ১৯৯০ সালে দেশটিতে সমাজতন্ত্রের পতনের পর এই ব্যবস্থাও ধ্বংস হয়ে যায়, শুরু হয় বাজার নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির যুগ৷

এর আগে উৎপাদন বাড়ানোর চিন্তা ছিলো না পশুপালকদের৷ মাস শেষে সবাই পেত নির্ধারিত ভাতা, এবং সামাজিক সেবা৷ কিন্তু এখন কাশ্মিরি লাভজনক হওয়ায় ১৯৬০ সালের তুলনায় প্রায় ৫ গুণ কাশ্মিরি উৎপাদন করেন পশুপালকরা৷

শক্তিশালী সম্প্রদায়

২০০০ সালের ভয়াবহ শীতের পর একসাথে থাকার কথা চিন্তা করা শুরু করেছেন মঙ্গোলিয়ার যাযাবররা৷ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় প্রাকৃতিক সম্পদ ও চারণভূমি সংরক্ষণে সম্প্রদায় গড়ে তুলছে তারা৷ গবেষণায় দেখা গেছে, যারা একত্রিত হয়ে পশুসম্পদ রক্ষা করছেন, শীতে তাদের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে অন্যদের তুলনায় কম৷

সম্প্রদায়ে থাকলে অনেক সামাজিক সহায়তাও পাওয়া যায়৷ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় অনেক সম্প্রদায় গড়ে তুলছে নিজেদের তহবিল৷

যাযাবরদের সুদীর্ঘ ইতিহাস ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসলেও ভবিষ্যত পরিবর্তন মোকাবেলায় এর বিকল্প দেখছেন না অনেকেই৷

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

যাযাবরদের পাল্টে দিচ্ছে জলবায়ু

আপডেট টাইম : ০১:২৫ অপরাহ্ন, রবিবার, ৩০ জুলাই ২০১৭

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ  ভয়ংকর শীত আর শুষ্ক গ্রীষ্ম মঙ্গোলিয়ার যাযাবর পশুপালকদের জীবনে আনছে পরিবর্তন৷ প্রতিকূল অবস্থা থেকে নিজেদের ও পশুর পাল রক্ষার জন্য একত্রিত হচ্ছে বিভিন্ন যাযাবর সম্প্রদায়৷

শত শত বছর ধরে বিশাল স্তেপ অঞ্চলে পশুর পাল চড়িয়ে বেড়িয়েছে মঙ্গোলিয়ার যাযাবর সম্প্রদায়৷ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এটাই তাদের জীবনধারা৷ কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তন আসছে এই স্তেপ অঞ্চলেও৷ ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই জীবনধারাও পালটাতে হচ্ছে মঙ্গোলিয়ার নোমাডদের৷ পরিস্থিতি দিনদিন প্রতিকূল হয়ে উঠছে, বেশিরভাগ সময়ই আবহাওয়া থাকছে চরমে৷

বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে মঙ্গোলিয়ার জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে দ্রুততর৷ ‘‘গত ৭০ বছরে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ২ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৩ দশমিক ৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট)৷ এটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা হ্রাসের রেকর্ডগুলোর একটি“, বলছিলেন সারুল খুদু পরিবেশ গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক টোঙ্গা উলামবায়ার৷

তিনি বলেন, ‘‘এই শতকের শেষ দিকে তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে৷ তীব্র শীতের পরিমাণ দিনদিন, যা মঙ্গোলিয়ায় ‘জুদ` নামে পরিচিত৷ কোনো কোনো এলাকায় গ্রীষ্মে ভয়াবহ বৃষ্টি হচ্ছে, কোথাও আবার শীতকালে ঝড় হচ্ছে৷“

পশুপালনের ওপর নির্ভরশীল পৃথিবীর হাতেগোনা কয়েকটি দেশের একটি মঙ্গোলিয়া৷ দেশটির অর্থনীতি নির্ভর করে পশুসম্পদের ওপর এবং ৮০ শতাংশ অঞ্চলই তৃণভূমি৷

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদেরও অবশেষে পালটাতে বাধ্য হচ্ছে যাযাবররা৷ কিছু পশুপালক সম্প্রদায় বড় একটি সম্প্রদায়ে একত্রিত হচ্ছে৷ তাঁদের আশা, এর ফলে কিছুটা পরিবর্তন আনলেও ঐতিহ্যবাহী যাযাবর জীবন ধরে রাখার আশা করছেন তাঁরা৷

ঝুঁকিতে চারণভূমি

মঙ্গোলিয়ার ২৮ শতাংশ নাগরিক দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে৷ এদের মধ্যেও অনেকে শুধু কোনোরকমে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করে চলেছেন৷ একদিকে, কিছু অংশের চরম দারিদ্র্য, অন্যদিকে প্রতিকূল আবহাওয়ায় চারণভূমি নষ্ট হওয়ায় পরিস্থিতি হয়ে উঠছে আরো ভয়াবহ৷ জলবায়ু পরিবর্তন এবং অতিরিক্ত পশুচারণের ফলে চারণভূমি আরো হুমকিতে পড়বে বলে আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা৷

“স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক সেন্টিমিটার বেশি বরফ পড়লে ঘাস চাপা পড়ে যায়৷ মঙ্গোলিয়ায় পশুর মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ এটি“, বলছেন উলামবায়ার৷

তিনি বলেন, ‘‘যাযাবররা অন্য জেলায় চলে যেতে বাধ্য হয়, এর ফলে ঐ অঞ্চলের সম্প্রদায় এবং চারণভূমির ওপরও চাপ পড়ে৷ অনেকেই তখন শহরে চলে যেতে বাধ্য হয়৷

এদিকে চাপ বাড়তে থাকায় দ্রুত নগরায়নের বিরূপ প্রভাব পড়েছে মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটারে৷ এর মধ্যে অন্যতম বায়ু দূষণ৷

‘জুদ`-এর প্রভাবে ১৯৯৯ -২০০০ সালের শীতে দেশটি ৩০ শতাংশ পশুসম্পদ হারায়৷ বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট`-এ উলামবায়ার উল্লেখ করেছেন ২০০৯ সালের ‘জুদ`-এ প্রাণ হারিয়েছে দেশটির ২০ শতাংশ পশু, সংখ্যায় এর পরিমাণ ২০ লাখেরও বেশি৷

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ‘জুদ`-এর পরিমাণ বাড়ছে বলে আশংকা করা হয়েছে গবেষণায়৷ যাযাবরেরা আরো ছোটখাট পরিবর্তনও টের পাচ্ছেন৷ বিভিন্ন নদীতে পানির পরিমাণ কমে আসার কথা জানিয়েছেন তারা৷

অনেক নোমাডই ‘নেগডেল` শাসনের কথা ভুলতে পারেননি৷ দেশটি যখন সমাজতান্ত্রিক সরকারের অধীনে ছিল, তখন সমস্ত চারণভূমিও ছিল রাষ্ট্রের মালিকানায়৷ সবাইকে সমানভাবে পশুচারণের অধিকার দেয়া হতো, এমনকি কোন সম্প্রদায় কোন পথ ধরে যাবে, সেটিও ঠিক করে দেয়া হতো৷ ফলে কোনো একটি অঞ্চলের ওপর বেশি চাপ কখনই পড়তো না৷ সামাজিক সেবা, পশুর চিকিৎসা, এবং জুদের সময় সরকারি ত্রাণের কথাও ভুলেননি যাযাবররা৷

কিন্তু ১৯৯০ সালে দেশটিতে সমাজতন্ত্রের পতনের পর এই ব্যবস্থাও ধ্বংস হয়ে যায়, শুরু হয় বাজার নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির যুগ৷

এর আগে উৎপাদন বাড়ানোর চিন্তা ছিলো না পশুপালকদের৷ মাস শেষে সবাই পেত নির্ধারিত ভাতা, এবং সামাজিক সেবা৷ কিন্তু এখন কাশ্মিরি লাভজনক হওয়ায় ১৯৬০ সালের তুলনায় প্রায় ৫ গুণ কাশ্মিরি উৎপাদন করেন পশুপালকরা৷

শক্তিশালী সম্প্রদায়

২০০০ সালের ভয়াবহ শীতের পর একসাথে থাকার কথা চিন্তা করা শুরু করেছেন মঙ্গোলিয়ার যাযাবররা৷ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় প্রাকৃতিক সম্পদ ও চারণভূমি সংরক্ষণে সম্প্রদায় গড়ে তুলছে তারা৷ গবেষণায় দেখা গেছে, যারা একত্রিত হয়ে পশুসম্পদ রক্ষা করছেন, শীতে তাদের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে অন্যদের তুলনায় কম৷

সম্প্রদায়ে থাকলে অনেক সামাজিক সহায়তাও পাওয়া যায়৷ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় অনেক সম্প্রদায় গড়ে তুলছে নিজেদের তহবিল৷

যাযাবরদের সুদীর্ঘ ইতিহাস ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসলেও ভবিষ্যত পরিবর্তন মোকাবেলায় এর বিকল্প দেখছেন না অনেকেই৷