বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ বাংলাদেশে ৮২ প্রজাতির সাপ রয়েছে। তার মধ্যে ছয় প্রজাতির সাপ বিষধর। এই ছয় প্রজাতির যে কোনো সাপের কামড়ে একটাই প্রতিষেধক ব্যবহার করা হয়। তবে আগামীতে প্রজাতি অনুসারে বাংলাদেশে প্রতিষেধক ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নন কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম-এর ডিপিএম (ইপিআর) ডা. মাসুদ রেজা খান বলেন, বাংলাদেশে ছয় প্রজাতির বিষধর সাপ রয়েছে। এসব সাপের বিষের প্রতিষেধক হিসেবে কমন অ্যান্টি স্নেক ভেনম (পলি ভ্যালেন এন্টি স্নেক ভেনম) ব্যবহার করা হচ্ছে। যা ভারত থেকে আমদানি করা হয়। তবে বাংলাদেশেরও দুটি প্রতিষ্ঠান (ইনসেপটা ও পপুলার) কমন অ্যান্টি স্নেক ভেনম তৈরি করছে।
সব সাপের কামড়ে একই প্রতিষেধক ব্যবহার না করে, প্রজাতি অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষেধক ব্যবহারের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে ডা. মাসুদ রেজা খান বলেন, ‘আগামীতে প্রজাতি হিসেবে সাপের বিষের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষেধক তৈরি করে ব্যবহার করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রজাতি অনুসারে ‘মনো ভ্যালেন অ্যান্টি স্নেক ভেনম’ দেশেই তৈরি করা যায় কিনা সেই চিন্তা করা হচ্ছে। তৈরির ব্যাপারে গবেষণাও চলছে। আমরা চাচ্ছি এটা দেশেই তৈরি করবো।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানা যায়, ছয় ধরনের বিষধর সাপ হচ্ছে- গোখড়া/কোবরা/নাজা, শঙ্খচূড়/ রাজগোখরা, কেউটে/ক্রেইট, চন্দ্রবোড়া/রাসেলস ভাইপার, সবুজ সাপ/বাঁশবোড়া/গালটাওয়া ও সামুদ্রিক সাপ।
কোবরা সাপ পায়ে ও হাতে, ক্রেইট সাপ শরীরের যে কোন স্থানে, সামুদ্রিক সাপ হাতে ও সবুজ সাপ মাথা ও মুখমণ্ডলে দংশন করে। ক্ষত স্থান ও শরীরিক অবস্থা লক্ষ্য করে বিষধর সাপের দংশন চেনা যায়। বিষধর সাপের দংশনের স্থানে বিষ দাঁতের দাগ প্রায় ১.২৫ সে.মি অন্তর দুটি খোঁচা দেওয়ার চিহ্ন হিসেবে দেখা যেতে পারে।
‘মনো ভ্যালেন অ্যান্টি স্নেক ভেনম’ আবিস্কার করা হলে তখন ক্ষত দেখে ও শারীরিক লক্ষণে বোঝা যাবে রোগী কোন সাপের কামড়ে আক্রান্ত। তখন সে অনুযায়ী সেই প্রজাতির প্রতিষেধক প্রয়োগ করা হবে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা।
বিষধর সাপের কামড়ের লক্ষণ : ত্বকের রং পরিবর্তন হয়ে দংশনের স্থানে কালচে হওয়া, ফুলে যাওয়া, ফোসকা পড়া ও ব্যাথা হওয়া। মাথা ঘোরানো বা ব্যাথা হওয়া, বমিবমি ভাব হওয়া, চোখে ঝাপসা দেখা, ঘুম ঘুম ভাব আসা, দুর্বলতা অনুভব হওয়া, খিচুনী হওয়া ও অজ্ঞান হওয়া।
জিহ্বা জড়িয়ে আসা, কথা বলতে অসুবিধা হওয়া, চোখ ঘোরানোয় অসুবিধা হওয়া, মাংসপেশী দুর্বল হয়ে যাওয়া, ঢোক গিলতে অসুবিধা হওয়া, ঘাড় সোজা রাখতে না পারা, মুখ থেকে লালা ঝরা, খাওয়ার সময় নাক দিয়ে পানি চলে আসা, নাকি সুরে কথা বলা, স্বাস প্রশ্বাসে অসুবিধা হওয়া ও চোখের উপরের পাতা ভারী হওয়া এবং চোখ বুজে আসা।
দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্তক্ষরণ হওয়া, কফের সঙ্গে রক্ত যাওয়া, রক্ত বমি হওয়া, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাওয়া ও কামড়ের স্থান থেকে রক্ত ঝরা। এছাড়া মাংস পেশীতে ব্যথা হওয়া, কালো রঙের প্রস্রাব হওয়া, প্রস্রাবের পরিমান খুবই অল্প হওয়া, রক্তচাপ অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়া এবং নাড়ি দুর্বল হয়ে যাওয়া।
এসব লক্ষণের মধ্যে একাধিক লক্ষণ পাওয়া গেলে দংশনটি বিষধর সাপের বলে গণ্য করতে হবে। কোন লক্ষণ না পাওয়া গেলেও রোগীকে কমপক্ষে ২৪ ঘণ্টা হাসপাতালে পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
সাপের কামড়ে করণীয় : সাপে কামড়ালে রোগীকে বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা সম্পর্কে আশ্বস্ত করা। দংশিত স্থান সাবান পানি দিয়ে পরিস্কার করা। রক্তক্ষরণ হতে থাকলে চাপ দিয়ে ধরা। দংশিত হওয়ার পর অঙ্গ কাপড় দিয়ে (গামছা/ওড়না) বাধা। তবে বাঁধন বেশি শক্ত বা ঢিলে করা যাবে না। একটা গিট দিতে হবে। পায়ে কামড়ালে উরুতে, হাতে কামড়ালে কনুইয়ের কিছু উপরে বাঁধতে হবে। ৩০ মিনিট পর পর ৩০ সেকেন্ডের জন্য গিট খুলে দেওয়া। রোগীকে নিথর ও নিশ্চল হয়ে শুয়ে থাকতে হবে। যাতে আক্রান্ত অঙ্গ নাড়াচাড়া না হয়। নাড়া লাগলে বিষ দ্রুত ছড়ায়। এরপর যত দ্রুত সম্ভব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সদর হাসপাতাল বা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া।
বছরে সাপের কামড়ে ছয় হাজার মানুষের মৃত্যু : প্রতিবছর সাপের কামড়ে প্রায় ছয় হাজার মানুষ মারা যায়। আর আক্রান্ত হয় প্রায় আট লাখ মানুষ। বাংলাদেশে মোট সর্প দংশনের প্রায় ৯০ ভাগই অবিষধর সাপ দ্বারা হয়ে থাকে। দংশিত রোগীর ৩ শতাংশ আধুনিক চিকিৎসা পায়। আর ৮০ শতাংশ রোগী যায় ওঝার কাছে। সাপের কামড়ের প্রকোপ বরিশাল ও খুলনা অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। সাপের কামড়ের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি হয় বর্ষাকালে। শুকনো জায়গার খোঁজে এ সময় সাপ গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। সাপ অযথা মানুষকে কামড়ায় না। শুধু উত্ত্যক্ত হলে দংশন করে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশেষ করে বন্যার সময় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়। ১ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত বন্যা দুর্গত ১১ জেলায় সাপের কামড়ে আক্রান্ত ১০ জনের মধ্যে মারা গেছে আট জন।
প্রতিষেধক প্রয়োগে প্রশিক্ষণ শুরু : সাপের বিশের প্রতিষেধক প্রয়োগে কিছু সমস্যা আছে। তাই সমস্যা সমাধানে প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
ভেনম প্রয়োগে চিকিৎসকরা কোন সমস্যা মনে করেন কিনা জানতে চাইলে বাগেরহাটের সিভিল সার্জন ডা. অরুণ চন্দ্র মন্ডল বলেন, সমস্যা একটু আছে। চিকিৎসকরা অনেক সময় ভয় পান। এটার একটা (হাইপার সেনসিভিটি) রিয়েকশন আছে। এই রিয়েকশন হলে অনেক সময় দুর্ঘটনা হতে পারে। এজন্য চিকিৎসকরা ভয় পান। আগে কেউ তেমন ভেনম ব্যবহার করতে চাইতো না। এখন বলেছি, লিটারেচারের প্রিন্সিপাল অনুসারে ব্যবহার করতে হবে।
বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. তাপস কুমার দাস বলেন, এন্টি ভেনম স্যালাইনের মাধ্যমে দিতে হয়। কিছু সময় পরপর রোগীর পালস, ব্লাড পেশার, শ্বাস-প্রশ্বাস এগুলো চেক (পরীক্ষা) করতে হয়। মুলত সাপের বিষ রক্তের সঙ্গে মিশে যায়। আমাদের ব্রেনে এফেক্ট করে বেশি। মাথা ঘুরায়। এজন্য চিকিৎসকদের বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণের একটা উদ্যোগের কথা অনেক আগে শুনেছিলাম। পরে আর কোন কিছু জানতে পারিনি।
প্রশিক্ষণের ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নন কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম এর ডিপিএম (ইপিআর) ডা. মাসুদ রেজা খান বলেন, ব্যবহারবিধি সম্পর্কে সচেতন করতে মার্চ মাস থেকে ১০০ উপজেলায় প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব উপজেলায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।