আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা জানিয়েছেন, তৃণমূলে কোন্দল নিরসনে দলের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দেশের আট বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তিন মাস পূর্তি হচ্ছে আজ। এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ এখনো থামেনি। অনেক আসনেই মুখোমুখি অবস্থানে আছে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষ। নৌকার পক্ষে ভোট করে অনেক নেতাকর্মী এখনো এলাকাছাড়া, এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) তথ্য মতে, নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় গত মার্চ মাসে ১০টি ঘটনায় দুজন নিহত, ১২ জন গুলিবিদ্ধ ও ৮৭ জন আহত হয়েছেন। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে ১০টি ঘটনায় দুজন নিহত, চারজন গুলিবিদ্ধ ও ৬৯ জন আহত হন।
কুষ্টিয়া-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সেলিম আলতাফ জর্জ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিহিংসার রাজনীতির সর্বোচ্চটা দেখা গেছে আমার নির্বাচনী এলাকায়। নির্বাচনের ১৫ দিনের মধ্যে দুজন কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট হয়েছে। গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগিও রক্ষা পায়নি। দলের মধ্যে এই বিভক্তি কিভাবে দূর হবে, তা আমার জানা নেই। নেতাকর্মীদের মনের মধ্যে ক্ষোভ, যন্ত্রণা ঢুকে গেছে।’
সংঘাতের বিষয়ে বক্তব্য জানতে কুষ্টিয়া-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবদুর রউফের মোবাইলে কল দিয়ে ও খুদে বার্তা পাঠিয়ে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
মুন্সীগঞ্জ আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, মুন্সীগঞ্জ-৩ (সদর ও গজারিয়া) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মোহাম্মদ ফয়সালের কাছে পরাজিত হন দুইবারের সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাশ। নির্বাচনের পরদিনই মৃণাল কান্তি দাশের অনুসারীদের অনেককেই এলাকাছাড়া করেন মোহাম্মদ ফয়সালের অনুসারীরা। মৃণাল কান্তি দাশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক। এর পরও তিনি তাঁর অনুসারীদের নিরাপত্তা দিতে পারছেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মৃণাল কান্তি দাশের অনুসারী ও রামপাল ইউনিয়ন কৃষক লীগের একজন নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নৌকার ভোট করাটাই আমার অপরাধ হয়ে গেছে। ধানক্ষেতে ওষুধ ও পানি দিতে যেতে পারিনি, এ কারণে ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। একজনের পুরো কলাবাগান ধ্বংস করা হয়েছে। অনেকেই এখনো এলাকাছাড়া, কিন্তু বর্তমান এমপির ভয়ে কিছু বলতে সাহস করছেন না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাশ কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তিনি বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা। দলের কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা আমার জন্য শোভন নয়।’
অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ফয়সালের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে খুলনার দুটি আসনে দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ চরমে পৌঁছে। ভোটের তিন মাস পেরিয়ে গেলেও সেখানে অবস্থার উন্নতি হয়নি।
ভোটের পরদিন থেকে টানা কয়েক দিন খুলনা-৪ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শেদীর অনুসারীদের হামলার শিকার হন স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম মোর্ত্তাজা রশিদী দারার অনুসারীরা। সে সময় অর্ধশতাধিক অনুসারী আহত হয়েছেন বলে অভিযোগ তুলেছিলেন দারা।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, দুই পক্ষের মধ্যে সম্পর্কের কোনো উন্নতি হয়নি। পরাজিত প্রার্থীর অনুসারীরা কোণঠাসা অবস্থায় আছেন।
খুলনা-৫ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আকরাম হোসেন। তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য ফুলতলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ ছাড়েন। তিনি ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের কাছে পরাজিত হন। ভোটের পর একাধিকবার হামলার শিকার হন আকরাম হোসেনের অনুসারীরা।
ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, আসন্ন উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবারও বিরোধ চাঙ্গা হচ্ছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী আকরাম হোসেন জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত হয়ে আবার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান প্রার্থী হচ্ছেন। ফলে স্থানীয় সংসদ সদস্যের অনুসারীদের সঙ্গে আকরাম হোসেনের অনুসারীরা মুখোমুখি অবস্থানে আছেন।
গোপালগঞ্জ-১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার জন্য মুকসুদপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদ ছাড়েন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক উপকমিটির সদস্য কাবির মিয়া। দলের সভাপতিমণ্ডলীর প্রভাবশালী সদস্য মুহম্মদ ফারুক খানের বিরুদ্ধে তিনি শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়েও পরাজিত হন। ওই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরোধ চলছে। আসন্ন উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সেই বিরোধ আরো বেড়ে গেছে। আবার উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন কাবির মিয়া।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, ঢাকা, রাজশাহী, বরিশাল, কুমিল্লা, মাদারীপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, গাজীপুর, মানিকগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার একাধিক আসনে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষ।
বিবদমানদের ঢাকায় ডেকে বৈঠক করছে কেন্দ্র
তৃণমূলে বিরোধ মিটিয়ে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে গতি বাড়াতে চাচ্ছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকরা। এ লক্ষ্যে দেশের আট বিভাগের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা বিবদমান নেতাদের ঢাকায় ডেকে বৈঠক করছেন। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম, খুলনা, রংপুর বিভাগের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঈদের পর রাজশাহী বিভাগের বৈঠক ডাকা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দল। এখানে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকাটা স্বাভাবিক। তবে তা যেন কোনোভাবেই সহিংসতা-সংঘাতের দিকে না যায়, সে বিষয়ে আমরা তৃণমূলের নেতাদের কঠোর সতর্কবার্তা দিয়েছি। যারা এর ব্যত্যয় ঘটাবে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, ‘পৃথিবীর যে প্রান্তে তিনজন বাঙালির অস্তিত্ব রয়েছে, সেখানেই একাধিক গ্রুপের অস্তিত্ব দেখা যায়। এটি আমাদের স্বভাবগত নেতিবাচক দিক। বাঙালির আপন দল আওয়ামী লীগও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে আমরা দলের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো নিরসনে সচেষ্ট রয়েছি।’