ঢাকা , শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :
জাকের-শামীমকে যে পুরস্কার দিতে বললেন উইন্ডিজ কিংবদন্তি স্ত্রীর করা যৌতুক মামলায় পুলিশ স্বামী কারাগারে হাইকোর্টে উপদেষ্টা হাসান আরিফের জানাজা অনুষ্ঠিত যারা দুর্দিনে দলের জন্য কাজ করেছে, তাদের মূল্যায়ন করা হবে: টুকু আবাসন ব্যবসায় মন্দা দ্য ইকোনমিস্টকে ড. ইউনূস ‘আমি আমার নিয়মিত কাজে ফিরে যেতে পারলে খুশি হবো’ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং হিন্দুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা নিয়ে ভারতের তথ্য বিভ্রান্তিকর টঙ্গীতে বেইলি ব্রিজ ভেঙে ট্রাক নদীতে, বিকল্প পথে চলার অনুরোধ অর্থহীন’ এর সাবেক গিটারিস্ট পিকলু মারা গেছেন নোয়াখালী জেলা আমীর ইসহাক খন্দকার ‘ভারতের আশেপাশের দেশগুলোর কোনোটির সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক নেই’

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ আমরা নিজের সম্পর্কে যে বিচার, মতামত, মূল্যায়ন করি, সেটাই হলো আত্মমর্যাদা। অন্যভাবে বললে, আমাদের সম্পর্কে নিজের যে আবেগীয় মূল্যায়ন এবং নিজের প্রতি নিজের যে দৃষ্টিভঙ্গি, নিজের প্রতি নিজের অনুভূতি, সেটাই হলো আত্মসম্মান বা আত্মমর্যাদা। স্মিথ অ্যান্ড ম্যাকলের (২০০৭) মতে, আমরা নিজের সম্পর্কে যা কিছু মনে করি, সেটাই হলো আত্মমর্যাদা।

আত্মমর্যাদা কিভাবে তৈরি হয়: আত্মসম্মান সারাজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে তৈরি হয়। অতীত অভিজ্ঞতাগুলো যদি ইতিবাচক হয়, তাহলে আপনার মধ্যে উচ্চ আত্মসম্মানবোধ তৈরি হবে। আর যদি নেতিবাচক হয়, তাহলে নিম্ন আত্মসম্মানবোধ তৈরি হবে। অতীত এবং বর্তমান জীবনের সব আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কগুলোও আত্মসম্মান তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি আপনার প্রতিটি সম্পর্ক সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারেন, দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করতে পারেন, তাহলে আত্মসম্মানবোধ বেড়ে যাবে। জীবনে যত মানুষের সাথে দেখা হয়েছে, সবাই হয় আপনার আত্মসম্মানবোধ বাড়িয়ে দিয়েছে; না হয় কমিয়ে দিয়েছে। তবে আত্মসম্মানবোধ সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হতে পারে।

আত্মমর্যাদার প্রকারভেদ: সাধারণত তিন রকমের আত্মমর্যাদাবোধ দেখা যায়। একই ব্যক্তির মধ্যে সময়ের পরিক্রমায় আত্মসম্মানের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যেতে পারে।

স্ফীত আত্মসম্মানবোধ: নিজের সম্মানকে খুব ফুলিয়ে ফাপিয়ে প্রকাশ করেন। যতটা না, তার চেয়েও বেশি সে প্রকাশ করেন বিভিন্ন আচরণের মাধ্যমে। তারা মনে করেন, অন্যদের চেয়ে অনেক ভালো, অনেক সম্মানিত এবং অনেক উপরে। তাই তারা আশেপাশের সবাইকে খুবই অবমূল্যায়ন করতে পিছপা হন না। এটি খুবই নেতিবাচক আত্মসম্মানবোধ। যেহেতু এর জন্য ব্যক্তি অন্যদের সাথে স্নেহময় এবং সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারেন না। তারা সব সময় যেকোনো প্রতিযোগিতায় উপস্থিত থাকেন এবং যেকোনো মূল্যে সর্বদা শীর্ষে আসতে চান। সফলতাই তাদের কাছে সুখ। তাই যেকোনো মূল্যে অন্যকে খাটো করে, অন্যের ক্ষতি করে তারা সফল হতে চান। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এরকম মনোভাবের কারণে তারা সত্যিকার অর্থে সুখী হন না।

তারা অন্যের কথা শুনতে চান না এবং নিজের সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না বা মেনে নেন না। নিজের ভুল-ভ্রান্তিগুলো শুধরে নিতে চান না। অনবরত অন্যকে দোষারোপ করে থাকেন। উপরন্তু তারা অন্যদের অবমূল্যায়ন করেন এবং তাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন আচরণ করেন। এ ধরনের স্ফীত আত্মসম্মানী মানুষের পক্ষে অন্যদের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। তারা সব সময় অন্যকে নিজের প্রতিপক্ষ মনে করেন।

উচ্চ আত্মসম্মানবোধ: উচ্চ আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি যেমনই হোক, নিজেকে গ্রহণ করেন এবং নিজেকে মূল্য দেন। এটি ইতিবাচক আত্মসম্মান। যেখানে ব্যক্তি নিজের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন। তাদের জীবনে যে বাধা-বিপত্তিগুলো আসে, সেটা তারা নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস ও সাহস দিয়ে মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যান।

আমেরিকান-কানাডিয়ান সাইকোথেরাপিস্ট নাথানিয়েল ব্রান্ডেনের মতে, ‘উচ্চ আত্মসম্মানী ব্যক্তি নিজেদের অন্যের চেয়ে উচ্চতর বা অন্যের উপর প্রতিষ্ঠিত করতে পরিচালিত হন না। তারা অন্যের সাথে নিজেকে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত করেন না বা নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন না। তারা যেমন আছেন তেমনই সুখী অনুভব করেন। তারা অন্যের চেয়ে ভালো হওয়ার বা অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হওয়ার মধ্যে সুখ খুঁজতে চান না।’

এ ধরনের মানুষ সব সময় নতুনদের সাথে মিশতে পছন্দ করেন, নতুন বা চ্যালেঞ্জিং এবং সৃজনশীল কাজ করতে পছন্দ করেন। অন্যরা তাদের কিভাবে মূল্যায়ন করবেন, এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন না। নিজে যেমন, তেমনই নিজেকে প্রকাশ করেন। কোনো ভুল করলে সেটা মেনে নিয়ে নিজেকে শোধরানোর চেষ্টা করেন। তারা অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং নমনীয়তা তাদের আচরণে পরিলক্ষিত হয়। জীবনের উত্থান-পতনের সাথে তারা মানিয়ে নিতে পারেন। উচ্চ আত্মমর্যাদার অধিকারী মানুষ তাদের জীবনের সব আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কগুলো সুন্দরভাবে পরিচালিত করতে পারেন।

নিচু আত্মমর্যাদা: উচ্চ আত্মমর্যাদার পুরোপুরি বিপরীত হলো নিচু আত্মমর্যাদা। নিজেরাই নিজেদের প্রতি আস্থা রাখতে পারেন না, নিজেকে মূল্যহীন মনে করেন। নিজেদের সামর্থের উপর নির্ভর করতে পারেন না। সব সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। কোনো কাজ শুরু করার আগেই ব্যর্থতার ভয় পেয়ে বসে। তারাই মূলত অসুখী মানুষের মডেল।

সব কিছু যদি সঠিকভাবে চলে, তাহলে নিচু আত্মমর্যাদার লোকজন আনন্দে সময় কাটান। কিন্তু যখনই কোনো ছোটখাটো বিষয় খারাপ হয়, তখনই তাদের আত্মমর্যাদা দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। তারা অন্যদের দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হন। নিজের কোনো ভুলের জন্য নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন না। তারা অন্যদের মত কখনোই ভালো বা সেরা হতে পারবেন না, এমন মনোভাব পোষণ করেন।

তারা বেশিরভাগ সময়ই একা থাকতে পছন্দ করেন। সৃজনশীল বা নতুন কোনো কাজ শুরু করতে চান না ব্যর্থ হওয়ার ভয়ে। তারা সব কিছু নিয়েই দুশ্চিন্তা করেন কিন্তু কিছুই করেন না। ‘আমি কিছুই পারবো না, আমার দ্বারা কিছুই সম্ভব নয়, আমি একজন অসফল মানুষ’- এরকম মনোভাব পোষণ করেন সব সময়।

আত্মমর্যাদা বাড়ানোর উপায়: যদিও আত্মমর্যাদাবোধ ছোটবেলা থেকেই গড়ে ওঠে। তবুও নিন্মোক্ত উপায়গুলোর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি আত্মমর্যাদা বাড়াতে চেষ্টা করতে পারেন:

১. যে বিষয়গুলো আপনি ভয় পান বা ভয়ের কারণে করা থেকে দূরে থাকেন, প্রথমেই সেই ভয়গুলোকে দূর করুন। ভয়গুলোকে আকাশের তারায় পরিণত করুন। যাতে সেটা থেকে দূরে না গিয়ে সেগুলো সাথে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারেন। একটি কাজ আগে করার অভিজ্ঞতা থাকুক বা না থাকুক, সুযোগ পেলে সেটি করার চেষ্টা করুন। সফল না হলেও অভিজ্ঞতার খাতায় সেটিই যোগ করুন। ব্যর্থতাকে স্বাগত জানান, পরবর্তীতে উন্নতির জন্য।

২. বুদ্ধিমত্তার সাথে যেটা পারবেন না, বা যেটা করা সম্ভব নয়; সেটা এড়িয়ে চলুন। সব কাজ সবার জন্য নয়। একজন মানুষ সব কাজ করতে পারে না। যখন আপনি সহজেই নিশ্চিত হবেন, কোনো একটি বিষয় পুরোপুরি আপনার আয়ত্তের বাইরে, সেটি এড়িয়ে যাওয়া উত্তম।

৩. পৃথিবীতে অন্যের জন্য যা-ই কিছু করেন না কেন, সেটির একটি বিনিময় আশা করেন। আপনার কোনো বন্ধুর বিপদে সহযোগিতা করলে স্বভাবতই আপনার বিপদে তার সহযোগিতা আশা করবেনই। কিন্তু আত্মমর্যাদার উন্নয়নে মাঝে মাঝে মানুষের জন্য বিনিময় প্রত্যাশা না করে কিছু করুন। মনে প্রশান্তি আসবে।

৪. কেউ আপনার জন্য ছোটখাটো কোনো উপকার করলেও তাকে ধন্যবাদ দিন। হতে পারে কাজটি ব্যক্তির কর্তব্য বা দায়িত্ব ছিল আপনার জন্য করার। তবুও তাকে ধন্যবাদ দিন, অভিনন্দন জানান। একইভাবে, কোনো কিছুর জন্য কেউ আপনাকে অভিনন্দন বা ধন্যবাদ জানালে, সেটি হাসিমুখে গ্রহণ করুন। এটি মানব চরিত্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক।

৫. একজন ব্যক্তি হিসেবে, পেশাজীবী হিসেবে আপনার দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে গ্রহণ করুন এবং তা করতে আন্তরিক হন। কোনো সহযোগিতা লাগলে সেটির জন্য জিজ্ঞেস করুন।

৬. নিজের জীবনের সঠিক, বাস্তবিক এবং অর্জনযোগ্য লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক করুন। যত বাধাই আসুক, আপনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের দিকে ধাবিত হোন পাখির চোখের মত। অন্যের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে স্ব-উদ্যোগী হয়ে নিজেকে চালিত করুন।

৭. নিজেকে সব সময় ইতিবাচক অটো সাজেশন দিন। ‘আমি পারবো, আমার দ্বারা সম্ভব, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে’- এরকম মন-মানসিকতা ধারণ করুন।

৮. যত বিপদই আসুক, আঘাত আসুক, ধৈর্য ধারণ করুন। নিজের রাগকে ইতিবাচকভাবে প্রকাশ করুন। আপনার সময় আসবেই।

৯. আপনার ভালো দিকগুলো এবং যেসব দিক উন্নতি করতে হবে, সেগুলো সব আলাদা করে তালিকা করুন। আপনার ভালো দিকগুলো বেশি বেশি অনুশীলন করুন, কাজে লাগান এবং উন্নতির দিকগুলো উন্নয়নে উদ্যোগী হোন।

১০. ইতিবাচক থাকুন। নিজের অধিকার, মতামত, অনুভূতিগুলো প্রকাশ করুন অন্যের অধিকার, মতামত এবং অনুভূতিগুলোকে অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধা না করে। ‘না’ বলার দরকার হলে অন্যকে আঘাত না করে ‘না’ বলুন। পাশাপাশি অন্যের মতামত, অনুভূতি এবং আবেগকে মূল্য দিতে গিয়ে নিজেকে কষ্ট দেবেন না। ‘তুমিও ঠিক, আমিও ঠিক’-এরকম চিন্তা-ভাবনা ধারণ করুন।

১১. নিজের সম্পর্কে নিজের নেতিবাচক চিন্তা বা ধারণাগুলো লিপিবদ্ধ করুন। এরপর সেগুলোকে চ্যালেঞ্জ করুন। আপনার সেই ধারণার পক্ষে বেশিরভাগ সময়ই কোনো প্রমাণ পাবেন না। তাই নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা ত্যাগ করুন।

১২. ইতিবাচক আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের উন্নয়ন করুন। সম্পর্কের মধ্যে যথাযথ সীমানা নির্ধারণ করুন। সম্পর্কের মধ্যে ব্যক্তিগত সীমানা অতিক্রম করবেন না। আপনার আশেপাশে যারা আপনাকে খারাপ অনুভব করতে বাধ্য করে, তাদের পরিত্যাগ করুন। যাদের সান্নিধ্যে আপনি আত্মবিশ্বাস অনুভব করেন, তাদের সাথে বেশি সময় কাটান। নীতিবান এবং আদর্শবান রোল মডেলদের অনুকরণ করুন।

১৩. নিজের জীবনের অতীত ভুলগুলোর জন্য নিজেকে ক্ষমা করে দিন। ‘অন্যরা কী মনে করবে?’ এমন চিন্তা বন্ধ করুন। যদি তা-ই করেন, তাহলে আপনি নিশ্চিন্তে কোনো কাজ করতে পারবেন না। নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন যে, অন্য মানুষ যা-ই চিন্তা করুক; সেটি নিয়ে আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনি কী করতে চাচ্ছেন, সেটাই করুন। অন্যরা কী চিন্তা করবে, সেটা না।

সবশেষে বলব, নিজে যেমনই হোন না কেন, ছোট মনে করবেন না, নিচে নামাবেন না। প্রতিটি মানুষের আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। নিজেকে অন্য কারো সাথে অহেতুক তুলনা করবেন না। আপনার তুলনা শুধুই আপনি।

লেখক: মনোবিজ্ঞানী, এমএসএফ-হল্যান্ড, নাইজেরিয়া মিশন।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

জাকের-শামীমকে যে পুরস্কার দিতে বললেন উইন্ডিজ কিংবদন্তি

আপডেট টাইম : ০৫:১৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ আমরা নিজের সম্পর্কে যে বিচার, মতামত, মূল্যায়ন করি, সেটাই হলো আত্মমর্যাদা। অন্যভাবে বললে, আমাদের সম্পর্কে নিজের যে আবেগীয় মূল্যায়ন এবং নিজের প্রতি নিজের যে দৃষ্টিভঙ্গি, নিজের প্রতি নিজের অনুভূতি, সেটাই হলো আত্মসম্মান বা আত্মমর্যাদা। স্মিথ অ্যান্ড ম্যাকলের (২০০৭) মতে, আমরা নিজের সম্পর্কে যা কিছু মনে করি, সেটাই হলো আত্মমর্যাদা।

আত্মমর্যাদা কিভাবে তৈরি হয়: আত্মসম্মান সারাজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে তৈরি হয়। অতীত অভিজ্ঞতাগুলো যদি ইতিবাচক হয়, তাহলে আপনার মধ্যে উচ্চ আত্মসম্মানবোধ তৈরি হবে। আর যদি নেতিবাচক হয়, তাহলে নিম্ন আত্মসম্মানবোধ তৈরি হবে। অতীত এবং বর্তমান জীবনের সব আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কগুলোও আত্মসম্মান তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যদি আপনার প্রতিটি সম্পর্ক সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারেন, দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করতে পারেন, তাহলে আত্মসম্মানবোধ বেড়ে যাবে। জীবনে যত মানুষের সাথে দেখা হয়েছে, সবাই হয় আপনার আত্মসম্মানবোধ বাড়িয়ে দিয়েছে; না হয় কমিয়ে দিয়েছে। তবে আত্মসম্মানবোধ সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হতে পারে।

আত্মমর্যাদার প্রকারভেদ: সাধারণত তিন রকমের আত্মমর্যাদাবোধ দেখা যায়। একই ব্যক্তির মধ্যে সময়ের পরিক্রমায় আত্মসম্মানের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যেতে পারে।

স্ফীত আত্মসম্মানবোধ: নিজের সম্মানকে খুব ফুলিয়ে ফাপিয়ে প্রকাশ করেন। যতটা না, তার চেয়েও বেশি সে প্রকাশ করেন বিভিন্ন আচরণের মাধ্যমে। তারা মনে করেন, অন্যদের চেয়ে অনেক ভালো, অনেক সম্মানিত এবং অনেক উপরে। তাই তারা আশেপাশের সবাইকে খুবই অবমূল্যায়ন করতে পিছপা হন না। এটি খুবই নেতিবাচক আত্মসম্মানবোধ। যেহেতু এর জন্য ব্যক্তি অন্যদের সাথে স্নেহময় এবং সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পারেন না। তারা সব সময় যেকোনো প্রতিযোগিতায় উপস্থিত থাকেন এবং যেকোনো মূল্যে সর্বদা শীর্ষে আসতে চান। সফলতাই তাদের কাছে সুখ। তাই যেকোনো মূল্যে অন্যকে খাটো করে, অন্যের ক্ষতি করে তারা সফল হতে চান। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এরকম মনোভাবের কারণে তারা সত্যিকার অর্থে সুখী হন না।

তারা অন্যের কথা শুনতে চান না এবং নিজের সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না বা মেনে নেন না। নিজের ভুল-ভ্রান্তিগুলো শুধরে নিতে চান না। অনবরত অন্যকে দোষারোপ করে থাকেন। উপরন্তু তারা অন্যদের অবমূল্যায়ন করেন এবং তাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন আচরণ করেন। এ ধরনের স্ফীত আত্মসম্মানী মানুষের পক্ষে অন্যদের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। তারা সব সময় অন্যকে নিজের প্রতিপক্ষ মনে করেন।

উচ্চ আত্মসম্মানবোধ: উচ্চ আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন ব্যক্তি যেমনই হোক, নিজেকে গ্রহণ করেন এবং নিজেকে মূল্য দেন। এটি ইতিবাচক আত্মসম্মান। যেখানে ব্যক্তি নিজের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন। তাদের জীবনে যে বাধা-বিপত্তিগুলো আসে, সেটা তারা নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস ও সাহস দিয়ে মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যান।

আমেরিকান-কানাডিয়ান সাইকোথেরাপিস্ট নাথানিয়েল ব্রান্ডেনের মতে, ‘উচ্চ আত্মসম্মানী ব্যক্তি নিজেদের অন্যের চেয়ে উচ্চতর বা অন্যের উপর প্রতিষ্ঠিত করতে পরিচালিত হন না। তারা অন্যের সাথে নিজেকে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত করেন না বা নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন না। তারা যেমন আছেন তেমনই সুখী অনুভব করেন। তারা অন্যের চেয়ে ভালো হওয়ার বা অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ হওয়ার মধ্যে সুখ খুঁজতে চান না।’

এ ধরনের মানুষ সব সময় নতুনদের সাথে মিশতে পছন্দ করেন, নতুন বা চ্যালেঞ্জিং এবং সৃজনশীল কাজ করতে পছন্দ করেন। অন্যরা তাদের কিভাবে মূল্যায়ন করবেন, এটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন না। নিজে যেমন, তেমনই নিজেকে প্রকাশ করেন। কোনো ভুল করলে সেটা মেনে নিয়ে নিজেকে শোধরানোর চেষ্টা করেন। তারা অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং নমনীয়তা তাদের আচরণে পরিলক্ষিত হয়। জীবনের উত্থান-পতনের সাথে তারা মানিয়ে নিতে পারেন। উচ্চ আত্মমর্যাদার অধিকারী মানুষ তাদের জীবনের সব আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কগুলো সুন্দরভাবে পরিচালিত করতে পারেন।

নিচু আত্মমর্যাদা: উচ্চ আত্মমর্যাদার পুরোপুরি বিপরীত হলো নিচু আত্মমর্যাদা। নিজেরাই নিজেদের প্রতি আস্থা রাখতে পারেন না, নিজেকে মূল্যহীন মনে করেন। নিজেদের সামর্থের উপর নির্ভর করতে পারেন না। সব সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। কোনো কাজ শুরু করার আগেই ব্যর্থতার ভয় পেয়ে বসে। তারাই মূলত অসুখী মানুষের মডেল।

সব কিছু যদি সঠিকভাবে চলে, তাহলে নিচু আত্মমর্যাদার লোকজন আনন্দে সময় কাটান। কিন্তু যখনই কোনো ছোটখাটো বিষয় খারাপ হয়, তখনই তাদের আত্মমর্যাদা দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। তারা অন্যদের দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হন। নিজের কোনো ভুলের জন্য নিজেকে ক্ষমা করতে পারেন না। তারা অন্যদের মত কখনোই ভালো বা সেরা হতে পারবেন না, এমন মনোভাব পোষণ করেন।

তারা বেশিরভাগ সময়ই একা থাকতে পছন্দ করেন। সৃজনশীল বা নতুন কোনো কাজ শুরু করতে চান না ব্যর্থ হওয়ার ভয়ে। তারা সব কিছু নিয়েই দুশ্চিন্তা করেন কিন্তু কিছুই করেন না। ‘আমি কিছুই পারবো না, আমার দ্বারা কিছুই সম্ভব নয়, আমি একজন অসফল মানুষ’- এরকম মনোভাব পোষণ করেন সব সময়।

আত্মমর্যাদা বাড়ানোর উপায়: যদিও আত্মমর্যাদাবোধ ছোটবেলা থেকেই গড়ে ওঠে। তবুও নিন্মোক্ত উপায়গুলোর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি আত্মমর্যাদা বাড়াতে চেষ্টা করতে পারেন:

১. যে বিষয়গুলো আপনি ভয় পান বা ভয়ের কারণে করা থেকে দূরে থাকেন, প্রথমেই সেই ভয়গুলোকে দূর করুন। ভয়গুলোকে আকাশের তারায় পরিণত করুন। যাতে সেটা থেকে দূরে না গিয়ে সেগুলো সাথে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারেন। একটি কাজ আগে করার অভিজ্ঞতা থাকুক বা না থাকুক, সুযোগ পেলে সেটি করার চেষ্টা করুন। সফল না হলেও অভিজ্ঞতার খাতায় সেটিই যোগ করুন। ব্যর্থতাকে স্বাগত জানান, পরবর্তীতে উন্নতির জন্য।

২. বুদ্ধিমত্তার সাথে যেটা পারবেন না, বা যেটা করা সম্ভব নয়; সেটা এড়িয়ে চলুন। সব কাজ সবার জন্য নয়। একজন মানুষ সব কাজ করতে পারে না। যখন আপনি সহজেই নিশ্চিত হবেন, কোনো একটি বিষয় পুরোপুরি আপনার আয়ত্তের বাইরে, সেটি এড়িয়ে যাওয়া উত্তম।

৩. পৃথিবীতে অন্যের জন্য যা-ই কিছু করেন না কেন, সেটির একটি বিনিময় আশা করেন। আপনার কোনো বন্ধুর বিপদে সহযোগিতা করলে স্বভাবতই আপনার বিপদে তার সহযোগিতা আশা করবেনই। কিন্তু আত্মমর্যাদার উন্নয়নে মাঝে মাঝে মানুষের জন্য বিনিময় প্রত্যাশা না করে কিছু করুন। মনে প্রশান্তি আসবে।

৪. কেউ আপনার জন্য ছোটখাটো কোনো উপকার করলেও তাকে ধন্যবাদ দিন। হতে পারে কাজটি ব্যক্তির কর্তব্য বা দায়িত্ব ছিল আপনার জন্য করার। তবুও তাকে ধন্যবাদ দিন, অভিনন্দন জানান। একইভাবে, কোনো কিছুর জন্য কেউ আপনাকে অভিনন্দন বা ধন্যবাদ জানালে, সেটি হাসিমুখে গ্রহণ করুন। এটি মানব চরিত্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক।

৫. একজন ব্যক্তি হিসেবে, পেশাজীবী হিসেবে আপনার দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে গ্রহণ করুন এবং তা করতে আন্তরিক হন। কোনো সহযোগিতা লাগলে সেটির জন্য জিজ্ঞেস করুন।

৬. নিজের জীবনের সঠিক, বাস্তবিক এবং অর্জনযোগ্য লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক করুন। যত বাধাই আসুক, আপনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের দিকে ধাবিত হোন পাখির চোখের মত। অন্যের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে স্ব-উদ্যোগী হয়ে নিজেকে চালিত করুন।

৭. নিজেকে সব সময় ইতিবাচক অটো সাজেশন দিন। ‘আমি পারবো, আমার দ্বারা সম্ভব, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে’- এরকম মন-মানসিকতা ধারণ করুন।

৮. যত বিপদই আসুক, আঘাত আসুক, ধৈর্য ধারণ করুন। নিজের রাগকে ইতিবাচকভাবে প্রকাশ করুন। আপনার সময় আসবেই।

৯. আপনার ভালো দিকগুলো এবং যেসব দিক উন্নতি করতে হবে, সেগুলো সব আলাদা করে তালিকা করুন। আপনার ভালো দিকগুলো বেশি বেশি অনুশীলন করুন, কাজে লাগান এবং উন্নতির দিকগুলো উন্নয়নে উদ্যোগী হোন।

১০. ইতিবাচক থাকুন। নিজের অধিকার, মতামত, অনুভূতিগুলো প্রকাশ করুন অন্যের অধিকার, মতামত এবং অনুভূতিগুলোকে অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধা না করে। ‘না’ বলার দরকার হলে অন্যকে আঘাত না করে ‘না’ বলুন। পাশাপাশি অন্যের মতামত, অনুভূতি এবং আবেগকে মূল্য দিতে গিয়ে নিজেকে কষ্ট দেবেন না। ‘তুমিও ঠিক, আমিও ঠিক’-এরকম চিন্তা-ভাবনা ধারণ করুন।

১১. নিজের সম্পর্কে নিজের নেতিবাচক চিন্তা বা ধারণাগুলো লিপিবদ্ধ করুন। এরপর সেগুলোকে চ্যালেঞ্জ করুন। আপনার সেই ধারণার পক্ষে বেশিরভাগ সময়ই কোনো প্রমাণ পাবেন না। তাই নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা ত্যাগ করুন।

১২. ইতিবাচক আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের উন্নয়ন করুন। সম্পর্কের মধ্যে যথাযথ সীমানা নির্ধারণ করুন। সম্পর্কের মধ্যে ব্যক্তিগত সীমানা অতিক্রম করবেন না। আপনার আশেপাশে যারা আপনাকে খারাপ অনুভব করতে বাধ্য করে, তাদের পরিত্যাগ করুন। যাদের সান্নিধ্যে আপনি আত্মবিশ্বাস অনুভব করেন, তাদের সাথে বেশি সময় কাটান। নীতিবান এবং আদর্শবান রোল মডেলদের অনুকরণ করুন।

১৩. নিজের জীবনের অতীত ভুলগুলোর জন্য নিজেকে ক্ষমা করে দিন। ‘অন্যরা কী মনে করবে?’ এমন চিন্তা বন্ধ করুন। যদি তা-ই করেন, তাহলে আপনি নিশ্চিন্তে কোনো কাজ করতে পারবেন না। নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন যে, অন্য মানুষ যা-ই চিন্তা করুক; সেটি নিয়ে আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনি কী করতে চাচ্ছেন, সেটাই করুন। অন্যরা কী চিন্তা করবে, সেটা না।

সবশেষে বলব, নিজে যেমনই হোন না কেন, ছোট মনে করবেন না, নিচে নামাবেন না। প্রতিটি মানুষের আলাদা কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। নিজেকে অন্য কারো সাথে অহেতুক তুলনা করবেন না। আপনার তুলনা শুধুই আপনি।

লেখক: মনোবিজ্ঞানী, এমএসএফ-হল্যান্ড, নাইজেরিয়া মিশন।