ঢাকা , মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পাট খাত ও বিজেএমসি

বাঙ্গাল কণ্ঠ ডেস্কঃ  বাংলাদেশের অর্থকরী ফসলের মধ্যে একমাত্র পাট খাতই শতভাগ মূল্য সংযোজনকারী, পশ্চাৎ ও সম্মুখ সংযোগ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং একইসঙ্গে বিপুলসংখ্যক নাগরিকের জীবন-জীবিকার উৎস।

এই পাটের ইতিহাস অনেক পুরনো। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে লেখা মহাভারতে পাটবস্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। সুপ্রাচীনকাল থেকেই এদেশের মানুষ দৈনন্দিন প্রয়োজনে পাট ও পাট পণ্যের ব্যবহার করে আসছে।

কিন্তু ঔপনিবেশিক স্বার্থে সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই পাটচাষ বন্ধ করা কিংবা পাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলে আসছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাটকেন্দ্রিক এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে এ খাতকে ছয় দফার অন্তর্ভুক্ত করেন এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে পাটকলগুলোকে জাতীয়করণ করেন ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ পিও ২৭-এর মাধ্যমে।

কিন্তু প্রথম পাঁচসালা (৭৩-৭৮) ও পরবর্তী সময়ে দুইসালা পরিকল্পনা (৭৯-৮০) শেষে ৮০’র দশক থেকে আবারও পাটশিল্পকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৮২-৮৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচি বা Structural Adjustment Programme (SAP)-এর আওতায় অনেক মিল বিরাষ্ট্রীয়করণ করে মুনাফা অর্জনের সুখস্বপ্ন দেখালেও ফলাফল আরও নাজুক হয়ে পড়ে।

এই বাস্তব দৃষ্টান্ত সামনে থাকা সত্ত্বেও ১৯৯৩ সালে তৎকালীন সরকার আবারও বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে একই কর্মসূচি হাতে নেয়। এর নাম দেয় Jute Sector Adjustment Programme (JSAP)। JSAP-এর আওতায় ৯৩-৯৪ থেকে তিন বছরমেয়াদি Jute Sector Reform Programme ঘোষণা করা হয়।

১৯৯৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি Jute Sector Adjustment Credit-এর আওতায় বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের চুক্তি হয়। ১২ এপ্রিল ১৯৯৪-এ প্রকল্পের একটি কর্মশালায় তৎকালীন পাটমন্ত্রী, বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি এবং পাটসচিব রাষ্ট্রীয় পাটশিল্পের ‘স্থূল শরীরকে’ ‘একহারা’ করার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন এবং ৬৯৭ কোটি ৩৭.৫০ লাখ টাকা ব্যয়সাপেক্ষে বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধি নিুোক্ত কর্মসূচির ঘোষণা দেন-

১. রাষ্ট্রীয় খাতের অবশিষ্ট ২৯টি মিলের মধ্যে ৯টি মিল বন্ধ এবং ২টি বৃহৎ মিলের তাঁতসংখ্যা হ্রাস করা।

২. মিলের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বাকি ২০টির মধ্যে অন্তত ১৮টি মিল ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেয়া।

৩. মজুরি খরচ কমানোর লক্ষ্যে ১৯৯৪ সালের মধ্যে ২০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করা।

৪. উৎপাদন হার সুষম করার জন্য বিজেএমসি চালিত ১৫ হাজার ৮০০ তাঁতের মধ্যে ১১ হাজার ৮০০ তাঁত বিলুপ্ত করা; এর ফলে মাত্র ৪ হাজার তাঁত অবশিষ্ট থাকবে।

৫. ৯০০ মিলিয়ন ডলার বা তৎকালীন ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার পুরনো ব্যাংকঋণ পুনর্বিন্যাস করে মিলের জন্য চলতি মূলধনের ব্যবস্থা করা।

৬. ছাঁটাইকৃত শ্রমিকদের রিট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা রাখা।

৭. পাট খাতকে সরকারি হস্তক্ষেপ থেকে দূরে রাখা।

মূলত এ কর্মসূচির মাধ্যমে পাটশিল্পের মৃত্যুঘণ্টা বেজে ওঠে। শিল্পঋণের নামে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের পাটশিল্পকে ধ্বংস করে। সরকারি পাটখাতে লোকবল নিয়োগ বন্ধ করে বংশধরের অভাবে যেমন বংশ নির্বংশ হয়; তদ্রুপ জনবলের অভাবেও বিজেএমসি তথা সরকারি পাটশিল্প বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।

আর যেসব মিল বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বেসরকারিকরণ করা হয়, তার সিংহভাগই আলোর মুখ দেখেনি; বরং এর মেশিনারি বিক্রি শেষে জায়গা নিয়েও ভিন্ন ব্যবসা করা হয়েছে।

পাট হচ্ছে বাংলাদেশের সোনার খনি। কিন্তু প্রকৃতি এই অঢেল সম্পদ যেমন আমাদের দিয়েছে, তেমনি দিয়েছে সম্পদের রাজনীতি; ঠিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মতো। তেলসমৃদ্ধ হয়েও যেমন তেল রাজনীতিতে অভিশপ্ত, পাটখনিও আমাদের জন্য তেমনি অবস্থার সৃষ্টি করেছে।

১৯৪৭-৪৮ সালে বিশ্বের উৎপন্ন পাটের শতকরা ৮০.১৭ ভাগ বাংলাদেশে উৎপন্ন হতো আর ঔপনিবেশিক চক্রান্তের ক্রমাগত ধারাবাহিকতায় বর্তমানে তা অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। আপন মাংসই যেমন হরিণের আসল শত্রু; তেমনি সরকারি পাটকলগুলোর জায়গা-জমিই অনেক ক্ষেত্রে বিজেএমসির শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ সম্পদে লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে অনেকের; তাই তারা অস্থিরতা সৃষ্টি করে পাটকলগুলো বন্ধ করার মাধ্যমে সম্পদ গ্রাসের অপচেষ্টায় লিপ্ত।

কথায় কথায় প্রশ্ন তুলে পাটে ভর্তুকি দেয়ার বিষয়ে; অথচ এটা কিন্তু প্রাইমারি বিনিয়োগ, যার বহুমুখী প্রভাব রয়েছে। কেননা এ অর্থের মাধ্যমে পাটকলগুলো সচল থাকে, চাষীরা ন্যায্যমূল্য পায়, মেশিনারি প্রস্তুতকারী শিল্পগুলোও বেঁচে থাকে, ক্যারিং, হ্যান্ডলিংসহ সংশ্লিষ্ট যাবতীয় ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায় প্রাণচাঞ্চল্য পান।

তাছাড়া পাট হচ্ছে বাংলাদেশের ব্র্যান্ড। এই ব্র্যান্ড টিকিয়ে রাখতেও সরকারের বিনিয়োগ প্রয়োজন। মাত্র ১০০ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে পাটের আঁশ পাওয়া যায়। এত কম সময়ে অন্য কোনো প্রাকৃতিক তন্তু পাওয়া সম্ভব নয়। প্রতি হেক্টরে পাট গাছ ১৫ টন কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং প্রায় ১১ টন অক্সিজেন দেয়। এখনও প্রায় ৮ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয় বাংলাদেশে।

প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় এই যে অবদান; তার জন্যও বিনিয়োগ প্রয়োজন, যেখানে দিন দিন দেশে বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে। আমেরিকা এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে, যেমন তারা গম উৎপাদনে ভর্তুকি দেয়; যাতে গম উৎপাদনে দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি বা সাহায্যের মাধ্যমে খাদ্য রাজনীতি করা যায়।

তাছাড়া আমাদের দেশের বাজেট এখন লাখ লাখ কোটি টাকার, তাহলে দেশের বিরাট একটা জনগোষ্ঠী যেখানে পাটশিল্পের সঙ্গে জড়িত; তাদের জন্য বাজেটে বরাদ্দ কোথায়? বিশ্বব্যাংককে ভয় পেলে চলবে না। পদ্মা সেতুর মতো সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে।

যেমনিভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বন্ধ পাটকলগুলো পুনঃচালুর ব্যাপারে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের ও দেশীয় সহযোগীদের চক্রান্তে বাংলাদেশে আদমজী বন্ধ হয় আর ভারতে আনন্দ হয় এবং নতুন পাটকল চালু হয়।

ভারত বর্তমানে আমাদের চেয়ে বেশি পাট উৎপাদন করে অথচ রফতানি করে আমাদের চেয়ে কম; কেননা তারা অভ্যন্তরীণ বাজারে ভোগ করে থাকে সিংহভাগ, অথচ আমাদের চিত্র পুরো উল্টা। পাটবীজের প্রায় ৯০ শতাংশ ভারত থেকে আমদানি করতে হয়, আমাদের বীজ উন্নত হওয়া সত্ত্বেও।

এটা দেখা কার দায়িত্ব? এটাও কি বিজেএমসির ব্যর্থতা? অথচ এর ফলে আমরা দিন দিন দেশীয় উন্নত মানের কোয়ালিটি হারাচ্ছি। পাটের অপার সম্ভাবনা দেখেছিল বলেই ব্রিটিশরা ১৭৯১ সালেই পাটকল স্থাপনে গবেষণা শুরু করে আর আমরা তা বন্ধ, হ্রাস অথবা বেসরকারিকরণের মধ্যেই সমাধান খুঁজছি।

২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুর রক্তের ধারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে পাটশিল্প নতুন করে প্রাণ পেতে শুরু করে। নিয়োগ দেয়া হয় লোকবল, চালু করা হয় বন্ধ বেশ কয়েকটি মিল-কারখানা, কর্মসংস্থান হয় বৃহৎ একটা জনগোষ্ঠীর, পাটচাষীরা ন্যায্যমূল্য পেয়ে পাটচাষে আগ্রহী হয়ে পাটচাষ বৃদ্ধি করে।

কিন্তু তাই বলে কি ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে আছে? তারা বারবার চেষ্টা করেছে পাটশিল্পকে লোকসানি শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করে পুরনো ধারায় তথা ধ্বংসের ধারায় ফিরে যেতে। তুলনা করে হাতেগোনা দু’একটি বেসরকারি মিলের সঙ্গে।

কিন্তু তারা একবারও চিন্তা করেন না, ওই দু’একটি মিলের শ্রমিক মজুরি, চাকরির স্থায়িত্ব, আনুতোষিক, অবসর ভাতা, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা, সন্তানাদির শিক্ষা, আবাসন সুবিধা, ছুটির সুবিধা, স্বাস্থ্যসেবা, লে-অফ সুবিধা ইত্যাদি নানারকম সরকারি সুবিধাগুলো তাদের শ্রমিক, কর্মচারী-কর্মকর্তারা পান কিনা? (২০১৩ সালের মজুরি স্কেল অনুযায়ী বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম মজুরি ও ভাতা হচ্ছে ৫ হাজার ১৫০ টাকা, পক্ষান্তরে ২০১০ সালের মজুরি স্কেল অনুযায়ী বিজেএমসির শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৯ হাজার ৮৬০ টাকা ও ২০১৫ সালের মজুরি স্কেল অনুযায়ী তা ১৯ হাজার ৫১৭ টাকা আর বিজেএমসির শ্রমিকদের অধিকাংশই ইনক্রিমেন্ট পেয়ে অনেক উপরের স্কেলে মজুরি পেয়ে থাকে)।

মূলত ওই হাতেগোনা দু’একটি মিলও চালান বিজেএমসি থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত তথা এখানকার সাবেক কর্মকর্তারা। তাহলে যারা সরকারি মিলে লাভ দেখাতে পারেননি, তারা বেসরকারি মিলে ভালো করছেন কিভাবে? খুবই সরল উত্তর হচ্ছে, কম মজুরি বা বেতন, চাকরি সুবিধা কর্তন, শ্রমিকদের সংখ্যা কমিয়ে ৮ ঘণ্টার অতিরিক্ত তথা ১২ ঘণ্টা কাজ করান, রাজনীতিমুক্ত, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্রুততা এবং বাজার উন্নয়নে সক্ষমতা।

পক্ষান্তরে সরকার চায় তার শ্রমিক, কর্মচারী-কর্মকর্তারা ভালো থাকুক, তাদের জীবনমান উন্নত হোক, পাটচাষীরা ন্যায্যমূল্য পাক ইত্যাদি কারণে সরকার তার শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুবিধাগুলো নিশ্চিত করে। তার ওপর সুবিধাবাদীদের অপরাজনীতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা, নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় কলকারখানা বিষয়ে অনভিজ্ঞতার উপস্থিতি, বাজার উন্নয়নে অপেশাদার লোকদের সুবিধা গ্রহণ ইত্যাদি নানা বিষয় জড়িত।

এসব কারণে বিজেএমসির উৎপাদন ব্যয় বেশি পক্ষান্তরে বিক্রি করতে হয় বেসরকারি বা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীদের সঙ্গে সমন্বয় রেখে। ফলে বিজেএমসি ব্যবসায়িক লস করে আর বদনাম এসে পড়ে নিরীহ কর্মচারীদের ওপর।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এসব বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে ঢালাওভাবে বিজেএমসি’র দুর্নীতির কথা বলে সত্যিকার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। প্রশাসন মানে যদি হয় Integration of public policy, Formulation of public policy & Implementation of public policy, তাহলে তো সঠিক তথ্য Integration-এর অভাবে সঠিক নীতি প্রণয়ন হচ্ছে না। তাই বারবার একই ভুলের চক্রে আমরা আবর্তিত হচ্ছি এবং একটা পর্যায়ে কৃষকের গলার ফাঁস হয়ে পাট চাষটাই বাংলাদেশ থেকে উঠে যেতে পারে। এক্ষেত্রে কোরবানির গরুর চামড়া আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

২০০০ সালেও যখন চামড়ার স্যান্ডেল পাওয়া যেত ২০০ থেকে ৫০০ টাকায়, তখন প্রতি চামড়ার গড় মূল্য প্রায় ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা আর এখন চামড়ার স্যান্ডেলের মূল্য ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা আর চামড়ার গড় মূল্য প্রায় ৪০০ টাকা। যেহেতু এখানে প্রতিযোগিতায় সরকার নেই, তাই সাধারণের স্বার্থ দেখারও কেউ নেই। দেশের মোট উৎপন্ন পাটের ২০ শতাংশ রফতানি হয়, ৫২ শতাংশ বেসরকারি মিল ব্যবহার করে আর প্রায় ১৫ শতাংশ বিজেএমসি ব্যবহার করলেও বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে সরকারের উপস্থিতি একটা বিরাট ভূমিকা রাখে। এসব বিষয় পাট প্রশাসনে যারা কাজ করেন, তাদের ভাবনায় থাকতে হবে।

দুর্নীতি আমাদের সমাজের একটি মারাত্মক ব্যাধি। বিজেএমসি এই সমাজেরই একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর থেকে কোনোভাবেই মুক্ত নয়। কিন্তু বিজেএমসির পোড়খাওয়া সাধারণ শ্রমিক, কর্মচারী-কর্মকর্তাদের সিংহভাগই অসহায় এবং খুবই সাধারণ শ্রেণির মানুষ।

তিন-চার মাস বেতন না পেয়েও তারা বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে হাজিরা দিয়ে নিয়মিত অফিস করে। এদের স্বার্থরক্ষায় তথা এদেশের পাটের ঐতিহ্য ধরে রাখার স্বার্থে নিুোক্ত প্রস্তাবনাগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে-

১. বিজেএমসির শ্রমিক, কর্মচারী-কর্মকর্তার সংখ্যানুযায়ী বেসরকারি মিলের সঙ্গে মজুরি ও বেতনের যে বাৎসরিক ব্যবধান, তা আর্থিক বছরের শুরুতে মিলগুলো বা বিজেএমসিকে সরকার কর্তৃক প্রদান নিশ্চিত করা।

২. জাতীয় বাজেটে পাট খাতে বরাদ্দ নিশ্চিত করা এবং মিলগুলোর ও বিজেএমসির সব শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরি-উত্তর পাওনাদি সরকার তথা রাজস্ব খাত থেকে প্রদান নিশ্চিত করা অথবা পেনশন স্কিমের আওতায় নিয়ে আসা।

৩. অভ্যন্তরীণ বাজার নিশ্চিতে পদক্ষেপ নেয়া। ভারত সরকার এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে। সড়ক ও জনপথ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারি অন্যান্য বিভাগে জিও জুট তথা পাটের ব্যবহার নিশ্চিত করা।

এক্ষেত্রে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও বর্তমান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার খাঁন স্যারের প্রকাশনা ও ভারতের সঙ্গে যৌথ গবেষণার সহায়তা নেয়া যেতে পারে।

৪. পাটকলগুলোর আগের গৃহীত সব ঋণ সুদসহ মওকুফ করা এবং পাটক্রয়ে নিজস্ব তহবিল সৃষ্টিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

৫. দুর্নীতি বন্ধে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষাকে ঢেলে সাজানো এবং নিরীক্ষা টিমকে চক্রাকারে দায়িত্ব দেয়া।

৬. বিজেএমসি বোর্ডকে আরও কার্যকর, মিলগুলোয় আরও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং পরিচালনা পর্ষদে সংশ্লিষ্ট কাজে অভিজ্ঞ লোকদের পদায়ন নিশ্চিত করা।

৭. বিজেএমসির আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো আরও শক্তিশালী করা এবং বিজেএমসির মেকানিক্যাল টিমকে কার্যকর ও দক্ষ করে গড়ে তোলা।

৮. বাজার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে, বিশেষ করে বিদেশ সফরে ছোট ছোট টিমে বিভক্ত হয়ে নির্মোহভাবে কেবলমাত্র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দেয়া।

৯. অনুকরণপ্রিয়তা তথা আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের নির্দেশনাকে গুরুত্ব না দিয়ে দেশাত্মবোধে জাগ্রত হয়ে নিজ অর্থনীতির শক্তিশালী ভিত রচনায় ভয়, লোভ-অহংকার-ক্ষমতা ভুলে দুর্নীতিমুক্ত পাটপ্রশাসন প্রতিষ্ঠায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একযোগে কাজ করা।

সরকার নানা বিষয়েই দেশের স্বার্থে বিনিয়োগ করে থাকে, যার বহুমুখী প্রভাব রয়েছে। যেমন স্বাস্থ্য খাত, জ্বালানি খাত, শিক্ষা খাত ইত্যাদি। পাট খাতেও সময়োপযোগী বিনিয়োগ প্রয়োজন, যার রয়েছে বহুমুখী সম্ভাবনা। পাট খাত সম্পূর্ণ দেশীয় পণ্যের ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে।

এটা একটা প্রকৃতি। একে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। এর পরিসর ছোট করা কিংবা একেবারে সরকারি পর্যায় থেকে ছেড়ে দেয়া- কোনোটাই সমাধান হতে পারে না; বরং এর সুষ্ঠু পরিচর্যাই সমাধান হতে পারে। নিকট অতীত অন্তত তাই বলে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

পাট খাত ও বিজেএমসি

আপডেট টাইম : ০৫:১০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ জানুয়ারী ২০২০

বাঙ্গাল কণ্ঠ ডেস্কঃ  বাংলাদেশের অর্থকরী ফসলের মধ্যে একমাত্র পাট খাতই শতভাগ মূল্য সংযোজনকারী, পশ্চাৎ ও সম্মুখ সংযোগ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং একইসঙ্গে বিপুলসংখ্যক নাগরিকের জীবন-জীবিকার উৎস।

এই পাটের ইতিহাস অনেক পুরনো। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে লেখা মহাভারতে পাটবস্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। সুপ্রাচীনকাল থেকেই এদেশের মানুষ দৈনন্দিন প্রয়োজনে পাট ও পাট পণ্যের ব্যবহার করে আসছে।

কিন্তু ঔপনিবেশিক স্বার্থে সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই পাটচাষ বন্ধ করা কিংবা পাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলে আসছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাটকেন্দ্রিক এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে এ খাতকে ছয় দফার অন্তর্ভুক্ত করেন এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে পাটকলগুলোকে জাতীয়করণ করেন ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ পিও ২৭-এর মাধ্যমে।

কিন্তু প্রথম পাঁচসালা (৭৩-৭৮) ও পরবর্তী সময়ে দুইসালা পরিকল্পনা (৭৯-৮০) শেষে ৮০’র দশক থেকে আবারও পাটশিল্পকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৮২-৮৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচি বা Structural Adjustment Programme (SAP)-এর আওতায় অনেক মিল বিরাষ্ট্রীয়করণ করে মুনাফা অর্জনের সুখস্বপ্ন দেখালেও ফলাফল আরও নাজুক হয়ে পড়ে।

এই বাস্তব দৃষ্টান্ত সামনে থাকা সত্ত্বেও ১৯৯৩ সালে তৎকালীন সরকার আবারও বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে একই কর্মসূচি হাতে নেয়। এর নাম দেয় Jute Sector Adjustment Programme (JSAP)। JSAP-এর আওতায় ৯৩-৯৪ থেকে তিন বছরমেয়াদি Jute Sector Reform Programme ঘোষণা করা হয়।

১৯৯৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি Jute Sector Adjustment Credit-এর আওতায় বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের চুক্তি হয়। ১২ এপ্রিল ১৯৯৪-এ প্রকল্পের একটি কর্মশালায় তৎকালীন পাটমন্ত্রী, বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি এবং পাটসচিব রাষ্ট্রীয় পাটশিল্পের ‘স্থূল শরীরকে’ ‘একহারা’ করার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন এবং ৬৯৭ কোটি ৩৭.৫০ লাখ টাকা ব্যয়সাপেক্ষে বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধি নিুোক্ত কর্মসূচির ঘোষণা দেন-

১. রাষ্ট্রীয় খাতের অবশিষ্ট ২৯টি মিলের মধ্যে ৯টি মিল বন্ধ এবং ২টি বৃহৎ মিলের তাঁতসংখ্যা হ্রাস করা।

২. মিলের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বাকি ২০টির মধ্যে অন্তত ১৮টি মিল ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেয়া।

৩. মজুরি খরচ কমানোর লক্ষ্যে ১৯৯৪ সালের মধ্যে ২০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করা।

৪. উৎপাদন হার সুষম করার জন্য বিজেএমসি চালিত ১৫ হাজার ৮০০ তাঁতের মধ্যে ১১ হাজার ৮০০ তাঁত বিলুপ্ত করা; এর ফলে মাত্র ৪ হাজার তাঁত অবশিষ্ট থাকবে।

৫. ৯০০ মিলিয়ন ডলার বা তৎকালীন ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার পুরনো ব্যাংকঋণ পুনর্বিন্যাস করে মিলের জন্য চলতি মূলধনের ব্যবস্থা করা।

৬. ছাঁটাইকৃত শ্রমিকদের রিট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা রাখা।

৭. পাট খাতকে সরকারি হস্তক্ষেপ থেকে দূরে রাখা।

মূলত এ কর্মসূচির মাধ্যমে পাটশিল্পের মৃত্যুঘণ্টা বেজে ওঠে। শিল্পঋণের নামে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের পাটশিল্পকে ধ্বংস করে। সরকারি পাটখাতে লোকবল নিয়োগ বন্ধ করে বংশধরের অভাবে যেমন বংশ নির্বংশ হয়; তদ্রুপ জনবলের অভাবেও বিজেএমসি তথা সরকারি পাটশিল্প বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।

আর যেসব মিল বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বেসরকারিকরণ করা হয়, তার সিংহভাগই আলোর মুখ দেখেনি; বরং এর মেশিনারি বিক্রি শেষে জায়গা নিয়েও ভিন্ন ব্যবসা করা হয়েছে।

পাট হচ্ছে বাংলাদেশের সোনার খনি। কিন্তু প্রকৃতি এই অঢেল সম্পদ যেমন আমাদের দিয়েছে, তেমনি দিয়েছে সম্পদের রাজনীতি; ঠিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মতো। তেলসমৃদ্ধ হয়েও যেমন তেল রাজনীতিতে অভিশপ্ত, পাটখনিও আমাদের জন্য তেমনি অবস্থার সৃষ্টি করেছে।

১৯৪৭-৪৮ সালে বিশ্বের উৎপন্ন পাটের শতকরা ৮০.১৭ ভাগ বাংলাদেশে উৎপন্ন হতো আর ঔপনিবেশিক চক্রান্তের ক্রমাগত ধারাবাহিকতায় বর্তমানে তা অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে। আপন মাংসই যেমন হরিণের আসল শত্রু; তেমনি সরকারি পাটকলগুলোর জায়গা-জমিই অনেক ক্ষেত্রে বিজেএমসির শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ সম্পদে লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে অনেকের; তাই তারা অস্থিরতা সৃষ্টি করে পাটকলগুলো বন্ধ করার মাধ্যমে সম্পদ গ্রাসের অপচেষ্টায় লিপ্ত।

কথায় কথায় প্রশ্ন তুলে পাটে ভর্তুকি দেয়ার বিষয়ে; অথচ এটা কিন্তু প্রাইমারি বিনিয়োগ, যার বহুমুখী প্রভাব রয়েছে। কেননা এ অর্থের মাধ্যমে পাটকলগুলো সচল থাকে, চাষীরা ন্যায্যমূল্য পায়, মেশিনারি প্রস্তুতকারী শিল্পগুলোও বেঁচে থাকে, ক্যারিং, হ্যান্ডলিংসহ সংশ্লিষ্ট যাবতীয় ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায় প্রাণচাঞ্চল্য পান।

তাছাড়া পাট হচ্ছে বাংলাদেশের ব্র্যান্ড। এই ব্র্যান্ড টিকিয়ে রাখতেও সরকারের বিনিয়োগ প্রয়োজন। মাত্র ১০০ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে পাটের আঁশ পাওয়া যায়। এত কম সময়ে অন্য কোনো প্রাকৃতিক তন্তু পাওয়া সম্ভব নয়। প্রতি হেক্টরে পাট গাছ ১৫ টন কার্বন-ডাই অক্সাইড শোষণ করে এবং প্রায় ১১ টন অক্সিজেন দেয়। এখনও প্রায় ৮ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয় বাংলাদেশে।

প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় এই যে অবদান; তার জন্যও বিনিয়োগ প্রয়োজন, যেখানে দিন দিন দেশে বনাঞ্চল উজাড় হচ্ছে। আমেরিকা এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে, যেমন তারা গম উৎপাদনে ভর্তুকি দেয়; যাতে গম উৎপাদনে দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি বা সাহায্যের মাধ্যমে খাদ্য রাজনীতি করা যায়।

তাছাড়া আমাদের দেশের বাজেট এখন লাখ লাখ কোটি টাকার, তাহলে দেশের বিরাট একটা জনগোষ্ঠী যেখানে পাটশিল্পের সঙ্গে জড়িত; তাদের জন্য বাজেটে বরাদ্দ কোথায়? বিশ্বব্যাংককে ভয় পেলে চলবে না। পদ্মা সেতুর মতো সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে।

যেমনিভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বন্ধ পাটকলগুলো পুনঃচালুর ব্যাপারে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের ও দেশীয় সহযোগীদের চক্রান্তে বাংলাদেশে আদমজী বন্ধ হয় আর ভারতে আনন্দ হয় এবং নতুন পাটকল চালু হয়।

ভারত বর্তমানে আমাদের চেয়ে বেশি পাট উৎপাদন করে অথচ রফতানি করে আমাদের চেয়ে কম; কেননা তারা অভ্যন্তরীণ বাজারে ভোগ করে থাকে সিংহভাগ, অথচ আমাদের চিত্র পুরো উল্টা। পাটবীজের প্রায় ৯০ শতাংশ ভারত থেকে আমদানি করতে হয়, আমাদের বীজ উন্নত হওয়া সত্ত্বেও।

এটা দেখা কার দায়িত্ব? এটাও কি বিজেএমসির ব্যর্থতা? অথচ এর ফলে আমরা দিন দিন দেশীয় উন্নত মানের কোয়ালিটি হারাচ্ছি। পাটের অপার সম্ভাবনা দেখেছিল বলেই ব্রিটিশরা ১৭৯১ সালেই পাটকল স্থাপনে গবেষণা শুরু করে আর আমরা তা বন্ধ, হ্রাস অথবা বেসরকারিকরণের মধ্যেই সমাধান খুঁজছি।

২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধুর রক্তের ধারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে পাটশিল্প নতুন করে প্রাণ পেতে শুরু করে। নিয়োগ দেয়া হয় লোকবল, চালু করা হয় বন্ধ বেশ কয়েকটি মিল-কারখানা, কর্মসংস্থান হয় বৃহৎ একটা জনগোষ্ঠীর, পাটচাষীরা ন্যায্যমূল্য পেয়ে পাটচাষে আগ্রহী হয়ে পাটচাষ বৃদ্ধি করে।

কিন্তু তাই বলে কি ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে আছে? তারা বারবার চেষ্টা করেছে পাটশিল্পকে লোকসানি শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করে পুরনো ধারায় তথা ধ্বংসের ধারায় ফিরে যেতে। তুলনা করে হাতেগোনা দু’একটি বেসরকারি মিলের সঙ্গে।

কিন্তু তারা একবারও চিন্তা করেন না, ওই দু’একটি মিলের শ্রমিক মজুরি, চাকরির স্থায়িত্ব, আনুতোষিক, অবসর ভাতা, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা, সন্তানাদির শিক্ষা, আবাসন সুবিধা, ছুটির সুবিধা, স্বাস্থ্যসেবা, লে-অফ সুবিধা ইত্যাদি নানারকম সরকারি সুবিধাগুলো তাদের শ্রমিক, কর্মচারী-কর্মকর্তারা পান কিনা? (২০১৩ সালের মজুরি স্কেল অনুযায়ী বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানে ন্যূনতম মজুরি ও ভাতা হচ্ছে ৫ হাজার ১৫০ টাকা, পক্ষান্তরে ২০১০ সালের মজুরি স্কেল অনুযায়ী বিজেএমসির শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৯ হাজার ৮৬০ টাকা ও ২০১৫ সালের মজুরি স্কেল অনুযায়ী তা ১৯ হাজার ৫১৭ টাকা আর বিজেএমসির শ্রমিকদের অধিকাংশই ইনক্রিমেন্ট পেয়ে অনেক উপরের স্কেলে মজুরি পেয়ে থাকে)।

মূলত ওই হাতেগোনা দু’একটি মিলও চালান বিজেএমসি থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত তথা এখানকার সাবেক কর্মকর্তারা। তাহলে যারা সরকারি মিলে লাভ দেখাতে পারেননি, তারা বেসরকারি মিলে ভালো করছেন কিভাবে? খুবই সরল উত্তর হচ্ছে, কম মজুরি বা বেতন, চাকরি সুবিধা কর্তন, শ্রমিকদের সংখ্যা কমিয়ে ৮ ঘণ্টার অতিরিক্ত তথা ১২ ঘণ্টা কাজ করান, রাজনীতিমুক্ত, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্রুততা এবং বাজার উন্নয়নে সক্ষমতা।

পক্ষান্তরে সরকার চায় তার শ্রমিক, কর্মচারী-কর্মকর্তারা ভালো থাকুক, তাদের জীবনমান উন্নত হোক, পাটচাষীরা ন্যায্যমূল্য পাক ইত্যাদি কারণে সরকার তার শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুবিধাগুলো নিশ্চিত করে। তার ওপর সুবিধাবাদীদের অপরাজনীতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা, নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় কলকারখানা বিষয়ে অনভিজ্ঞতার উপস্থিতি, বাজার উন্নয়নে অপেশাদার লোকদের সুবিধা গ্রহণ ইত্যাদি নানা বিষয় জড়িত।

এসব কারণে বিজেএমসির উৎপাদন ব্যয় বেশি পক্ষান্তরে বিক্রি করতে হয় বেসরকারি বা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীদের সঙ্গে সমন্বয় রেখে। ফলে বিজেএমসি ব্যবসায়িক লস করে আর বদনাম এসে পড়ে নিরীহ কর্মচারীদের ওপর।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এসব বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে ঢালাওভাবে বিজেএমসি’র দুর্নীতির কথা বলে সত্যিকার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। প্রশাসন মানে যদি হয় Integration of public policy, Formulation of public policy & Implementation of public policy, তাহলে তো সঠিক তথ্য Integration-এর অভাবে সঠিক নীতি প্রণয়ন হচ্ছে না। তাই বারবার একই ভুলের চক্রে আমরা আবর্তিত হচ্ছি এবং একটা পর্যায়ে কৃষকের গলার ফাঁস হয়ে পাট চাষটাই বাংলাদেশ থেকে উঠে যেতে পারে। এক্ষেত্রে কোরবানির গরুর চামড়া আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।

২০০০ সালেও যখন চামড়ার স্যান্ডেল পাওয়া যেত ২০০ থেকে ৫০০ টাকায়, তখন প্রতি চামড়ার গড় মূল্য প্রায় ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা আর এখন চামড়ার স্যান্ডেলের মূল্য ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা আর চামড়ার গড় মূল্য প্রায় ৪০০ টাকা। যেহেতু এখানে প্রতিযোগিতায় সরকার নেই, তাই সাধারণের স্বার্থ দেখারও কেউ নেই। দেশের মোট উৎপন্ন পাটের ২০ শতাংশ রফতানি হয়, ৫২ শতাংশ বেসরকারি মিল ব্যবহার করে আর প্রায় ১৫ শতাংশ বিজেএমসি ব্যবহার করলেও বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে সরকারের উপস্থিতি একটা বিরাট ভূমিকা রাখে। এসব বিষয় পাট প্রশাসনে যারা কাজ করেন, তাদের ভাবনায় থাকতে হবে।

দুর্নীতি আমাদের সমাজের একটি মারাত্মক ব্যাধি। বিজেএমসি এই সমাজেরই একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর থেকে কোনোভাবেই মুক্ত নয়। কিন্তু বিজেএমসির পোড়খাওয়া সাধারণ শ্রমিক, কর্মচারী-কর্মকর্তাদের সিংহভাগই অসহায় এবং খুবই সাধারণ শ্রেণির মানুষ।

তিন-চার মাস বেতন না পেয়েও তারা বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে হাজিরা দিয়ে নিয়মিত অফিস করে। এদের স্বার্থরক্ষায় তথা এদেশের পাটের ঐতিহ্য ধরে রাখার স্বার্থে নিুোক্ত প্রস্তাবনাগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে-

১. বিজেএমসির শ্রমিক, কর্মচারী-কর্মকর্তার সংখ্যানুযায়ী বেসরকারি মিলের সঙ্গে মজুরি ও বেতনের যে বাৎসরিক ব্যবধান, তা আর্থিক বছরের শুরুতে মিলগুলো বা বিজেএমসিকে সরকার কর্তৃক প্রদান নিশ্চিত করা।

২. জাতীয় বাজেটে পাট খাতে বরাদ্দ নিশ্চিত করা এবং মিলগুলোর ও বিজেএমসির সব শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরি-উত্তর পাওনাদি সরকার তথা রাজস্ব খাত থেকে প্রদান নিশ্চিত করা অথবা পেনশন স্কিমের আওতায় নিয়ে আসা।

৩. অভ্যন্তরীণ বাজার নিশ্চিতে পদক্ষেপ নেয়া। ভারত সরকার এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে। সড়ক ও জনপথ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারি অন্যান্য বিভাগে জিও জুট তথা পাটের ব্যবহার নিশ্চিত করা।

এক্ষেত্রে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও বর্তমান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার খাঁন স্যারের প্রকাশনা ও ভারতের সঙ্গে যৌথ গবেষণার সহায়তা নেয়া যেতে পারে।

৪. পাটকলগুলোর আগের গৃহীত সব ঋণ সুদসহ মওকুফ করা এবং পাটক্রয়ে নিজস্ব তহবিল সৃষ্টিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

৫. দুর্নীতি বন্ধে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষাকে ঢেলে সাজানো এবং নিরীক্ষা টিমকে চক্রাকারে দায়িত্ব দেয়া।

৬. বিজেএমসি বোর্ডকে আরও কার্যকর, মিলগুলোয় আরও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং পরিচালনা পর্ষদে সংশ্লিষ্ট কাজে অভিজ্ঞ লোকদের পদায়ন নিশ্চিত করা।

৭. বিজেএমসির আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো আরও শক্তিশালী করা এবং বিজেএমসির মেকানিক্যাল টিমকে কার্যকর ও দক্ষ করে গড়ে তোলা।

৮. বাজার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে, বিশেষ করে বিদেশ সফরে ছোট ছোট টিমে বিভক্ত হয়ে নির্মোহভাবে কেবলমাত্র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দেয়া।

৯. অনুকরণপ্রিয়তা তথা আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের নির্দেশনাকে গুরুত্ব না দিয়ে দেশাত্মবোধে জাগ্রত হয়ে নিজ অর্থনীতির শক্তিশালী ভিত রচনায় ভয়, লোভ-অহংকার-ক্ষমতা ভুলে দুর্নীতিমুক্ত পাটপ্রশাসন প্রতিষ্ঠায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে একযোগে কাজ করা।

সরকার নানা বিষয়েই দেশের স্বার্থে বিনিয়োগ করে থাকে, যার বহুমুখী প্রভাব রয়েছে। যেমন স্বাস্থ্য খাত, জ্বালানি খাত, শিক্ষা খাত ইত্যাদি। পাট খাতেও সময়োপযোগী বিনিয়োগ প্রয়োজন, যার রয়েছে বহুমুখী সম্ভাবনা। পাট খাত সম্পূর্ণ দেশীয় পণ্যের ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে।

এটা একটা প্রকৃতি। একে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। এর পরিসর ছোট করা কিংবা একেবারে সরকারি পর্যায় থেকে ছেড়ে দেয়া- কোনোটাই সমাধান হতে পারে না; বরং এর সুষ্ঠু পরিচর্যাই সমাধান হতে পারে। নিকট অতীত অন্তত তাই বলে।