ঢাকা , মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উন্নত বিশ্ব যে রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করছে, বাংলাদেশও তাই করছে

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ১ জানুয়ারি দেশের চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের (সিএ) সংগঠন আইসিএবির সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছেন দেওয়ান নূরুল ইসলাম।  ১৯৯০ সালে তিনি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি সম্পন্ন করেন। অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনি থেকে ফিন্যান্সে এমবিএ ডিগ্রিও নিয়েছেন। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন করপোরেট ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। সরকারি প্রতিষ্ঠান যমুনা অয়েল ও বিডিবিএলের পর্ষদেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বর্তমানে তিনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্রান্ড থর্টন কনসাল্টিং (বাংলাদেশ) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টেরও চেয়ারম্যান তিনি। সম্প্রতি তিনি একটি দৈনিকের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনায় সম্প্রতি দেশের হিসাব ও নিরীক্ষা পরিস্থিতি, পেশাদার হিসাববিদদের অবস্থান, আইসিএবির কর্মকাণ্ড, পুঁজিবাজার ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেন। উঠে আসে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড (আইএফআরএস) আত্মস্থকরণের সম্ভাব্য সুফলের কথাও। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-
চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি অত্যন্ত সম্মানজনক পেশা। আইসিএবির সদস্য কতজন, তারা কেমন করছেন?
মানুষের প্রতিটি কাজের সঙ্গেই অর্থনীতি যুক্ত। অর্থনীতির মূলে রয়েছে আর্থিক বিষয়াদি। সেখানে স্বচ্ছতা ও সুশাসন আবশ্যক। সিএরা মূলত আর্থিক স্বচ্ছতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করেন। এ কারণে সমাজে তারা শ্রদ্ধার পাত্র। আবার পেশাগত দক্ষতার কারণে কর্মক্ষেত্রেও তাদের মূল্য অনেক।
দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) অধীনে বর্তমানে ১ হাজার ৮০০-এর মতো সিএ রয়েছেন। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তারা সরাসরি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি করছেন না। বাকি ৩০ শতাংশ বিভিন্ন সিএ ফার্মের মাধ্যমে স্বাধীন হিসাববিদ হিসেবে কাজ করছেন। প্রায় প্রত্যেকেই নিজ ফিল্ডে সুপ্রতিষ্ঠিত। তবে দেশের অর্থনীতির কলেবর বিবেচনা করলে বলতে হবে, প্র্যাকটিসিং সিএর সংখ্যাটি অনেক কম।
পেশাদার হিসাববিদ তৈরি ও তাদের মানোন্নয়নে আইসিএবি কী করছে?
আইসিএবি রাষ্ট্রপতির বিশেষ আদেশে গঠিত একটি প্রতিষ্ঠান। আইসিএবির একটি উদ্দেশ্য, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড অডিট প্রফেশনকে রেগুলেট করা। অন্যটি হলো, সিএ তৈরি করা। আমরা দুটোই করছি। সঙ্গে স্ট্যান্ডার্ড সেটিংও। গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখেই একাডেমিক ও ব্যবহারিক সব প্রক্রিয়া শেষ করার মাধ্যমে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট তৈরি করছে আইসিএবি। এর স্বীকৃতিও মিলছে। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস অব ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস আইসিএবির সনদধারীদের সরাসরি গ্রহণ করে নেয়। আইসিএবির সনদধারীরা কোনো পরীক্ষা ছাড়াই অন্যান্য দেশে কাজ করতে পারেন।
আইসিএবি শুধু সনদ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে না। সনদপ্রাপ্ত সদস্যদের নতুন নতুন পরিস্থিতি, তথ্য ও আইনের সঙ্গে পরিচিত ও অভ্যস্ত করতে আইসিএবি নানা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। যারা সিএ ফার্মের মাধ্যমে সরাসরি প্র্যাকটিসে আছেন, আমাদের মূল কাজটি তাদের নিয়ে। বিভিন্ন কোম্পানিতে সার্ভিস দেয়া হিসাববিদদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নেও আইসিএবি কাজ করে। তবে সবকিছুর আগে পেশাগত নৈতিকতা ও স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেয় আইসিএবি।
আর্থিক সুশাসন ও পেশাদার হিসাববিদদের নৈতিকতার সম্পর্কটি ব্যাখ্যা করবেন?
সব পেশাতেই নৈতিকতা ও স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ। আর্থিক বিষয়াদিতে এটি আরো গুরুত্বপূর্ণ। এ বছর আমাদের স্লোগান হচ্ছে, নৈতিকতার ভিত্তিতে আর্থিক বিষয়াদিতে নেতৃত্ব দেয়া। শহরের জলাবদ্ধতা তৈরি হলে যেমন প্রকৌশলীর নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন আসে, তেমনি আর্থিক অনিয়ম দেখা দিলে হিসাববিদদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন আসে। প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন মুখ্যত অর্থনির্ভর হওয়ায় সেখানে হিসাববিদদের ভূমিকা অনেক বেশি। নৈতিকতা ও স্বাধীনতা সমুন্নত রেখে একজন হিসাববিদ নিরীক্ষা সম্পন্ন করলে সেখানে সুশাসন ঘাটতি থাকার কোনো সুযোগ নেই। তাই আমাদের নৈতিকতা ধরে রেখে জাতীয় এজেন্ডার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কাজ করতে হবে।
দেশে ভুয়া আর্থিক প্রতিবেদন তৈরির অভিযোগটি অনেক পুরনো, এগুলোয় নিরীক্ষক হিসেবে আপনাদের সদস্যরাও স্বাক্ষর করেন বলে জোরালো অভিযোগ আছে…
এটা খুবই উদ্বেগের বিষয় যে, অনেক প্রতিষ্ঠানই ভুয়া ও প্রতারণাপূর্ণ আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করছে। আমাদের সদস্যরা এর একটিতেও স্বাক্ষর করছেন না— এমনটি নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না। তবে আমি এটি জোর দিয়ে বলতে পারি, আইসিএবির অভ্যন্তরীণ মানদণ্ড ও শৃঙ্খলা ব্যবস্থায় তারা উপযুক্ত শাস্তি ও সংশোধনের সুযোগ পায়।
আমি অন্য একটি বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, তা হলো নিরীক্ষকের অজান্তেই তার স্বাক্ষর জাল করে আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করা। দেখুন, আমাদের ফার্মগুলো বছরে ১০-১২ হাজার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা করে। এদিকে এনবিআরে নাকি ৩০-৩২ হাজার প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষিত প্রতিবেদন জমা পড়ে। এখানে দুটো বিষয় হতে পারে, আমাদের কোনো সদস্য একটি দুর্বল বা ভুয়া প্রতিবেদনে সই করে তা গোপন করছে অথবা কোম্পানি নিরীক্ষকের অজান্তেই তার স্বাক্ষর জাল করে প্রতিবেদনটি বিভিন্ন দপ্তরে জমা দিচ্ছে। কমিউনিটির একজন হিসেবে আমি জানি, দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া প্রায় সব ভুয়া প্রতিবেদনেই আইসিএবির মেম্বার ফার্মগুলোর সই-সিল জাল করা হয়।
এ সমস্যার সমাধানে আমরা ২০১৭ সালের শেষদিকে ডিজিটাল ডাটাবেজ চালু করেছি। এ ব্যবস্থায় আমাদের ফার্মের মাধ্যমে প্রতিবেদন নিরীক্ষা করা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি তালিকা আইসিএবির ওয়েবসাইটে দেয়া রয়েছে।
এনবিআর বা আরজেএসসিতে হিসাব বিবরণী দাখিল করা প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়ে আমাদের তালিকা  মিলিয়ে দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন, জমা দেয়া একটি রিপোর্ট সত্যিই অডিটেড না ভুয়া।
অনেক সমস্যা-অভিযোগের মধ্যেও কিন্তু দেশে হিসাবচর্চা অনেক এগিয়েছে। হিসাব ও নিরীক্ষার মান বিবেচনা করলে আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে উন্নীত হয়েছি। আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় প্রতি বছরই আমাদের দেশ থেকে কিছু কোম্পানি চ্যাম্পিয়ন, রানারআপ হচ্ছে। বিভিন্ন খাতে আইসিএবির কাছ থেকে সেরা আর্থিক প্রতিবেদনের স্বীকৃতি পাওয়া কোম্পানিগুলো দক্ষিণ এশীয় পরিসরেও সেরার স্বীকৃতি পাচ্ছে। সর্বশেষ বছরের জন্য এরই মধ্যে বিজয়ীদের তালিকা প্রস্তুত করে ফেলেছে সাউথ এশিয়ান ফেডারেশন অব অ্যাকাউন্ট্যান্টসের (সাফা) জুরি বোর্ড। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ১৪টি ক্যাটাগরির মধ্যে ১০টিতেই চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশী কোম্পানি। এর বাইরে রানারআপ ও সার্টিফিকেট অব মেরিটের মতো পুরস্কারগুলোয় রয়েছেই। একাধিক খাতে দেখা যাচ্ছে, আইসিএবি বাংলাদেশ থেকে যে তিনটি কোম্পানিকে মনোনীত করেছে, তাদের প্রত্যেকেই আঞ্চলিক পরিসরেও শীর্ষ তিনের স্বীকৃতি পেয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকার কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই তারা এ স্বীকৃতি পাচ্ছে। আমার আত্মবিশ্বাস, তিনটির বেশি নাম পাঠানোর সুযোগ থাকলে বাংলাদেশের সাফল্য আরো বড় হতো।
অর্থাৎ দেশে যে কোম্পানি ও নিরীক্ষক ভালো করতে চাইছেন, তাদের সে সুযোগ আছে। আমাদের এখন অনিচ্ছুক ও পিছিয়ে থাকাদের উন্নয়নে কাজ করতে হবে।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতেই হবে, পুরস্কারপ্রাপ্ত কোম্পানিগুলোর প্রায় সবক’টির আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুতিতেই সেখানে কর্মরত চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টরা যুক্ত আছেন। অর্থাৎ অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স বিভাগে সিএরা যুক্ত থাকলে কোম্পানির ডিসক্লোজারের মান বাড়ে।
তালিকাভুক্ত কোম্পানির নিরীক্ষায় বিএসইসি কয়েকটি ফার্ম নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সেসব ফার্মের ওপর স্ট্যান্ডার্ড ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার চাপটি দৃশ্যমান। বাকি অডিট ফার্মগুলোর অবস্থা কেমন দেখছেন?
আমাদের শেয়ারবাজারে প্রায় সাড়ে ৩০০ কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ড তালিকাভুক্ত রয়েছে। এদের নিরীক্ষায় ৩৫টির মতো প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ফার্মগুলোর নানা কমপ্লায়েন্স ও বিএসইসির চাওয়ার জায়গাটা বিচার করেই এসব প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন করা হয়। এ প্যানেলভুক্ত ফার্মগুলোকে কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করার মতো প্রশিক্ষণ দেয় আইসিএবি।
এর বাইরে অন্য ফার্মগুলো যাতে ভালো করে এবং পেশাগত মানদণ্ডে পিছিয়ে না থাকে, সে চেষ্টাও ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে রয়েছে। সবাই এক মানের হবে না, এটিই স্বাভাবিক। তবে নিরীক্ষা কাজে নৈতিকতা ও স্বাধীন অবস্থানের কোনো বিকল্প নেই। এখানে যারা ছাড় দেবে, তারা আগামীতে আর টিকে থাকবে না।
দেখুন, অডিট ফার্মগুলোর সুশাসন ও নৈতিকতার বিষয়ে আমরা বেশ সতর্ক। কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে স্খলনের প্রমাণ পেলে তাদের লাইসেন্স স্থগিতের মতো সিদ্ধান্তও আমরা গ্রহণ করি। বিভিন্ন অডিট ফার্মে নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণে আমাদের একটি শক্তিশালী টিম রয়েছে। ডিসিপ্লিনারি কমিটি নামে এ টিমটি গঠিত হয় নিরপেক্ষ ও জ্যেষ্ঠ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের সমন্বয়ে। তারা দীর্ঘ সময় নিয়ে বিভিন্ন ফার্মের বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করে। সরকারি-বেসরকারিসহ যেকোনো কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে যেন মানসম্মত নিরীক্ষা হয়, সে বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। কোনো ফার্মের বিরুদ্ধে অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠলে, তাদেরকে ডেকে ব্যবস্থা নেয়া হয়। বড় অভিযোগ প্রমাণ হলে কোনো ফার্মকে স্থায়ীভাবে নিরীক্ষা বন্ধের ব্যবস্থা নেয়া হয়। সদস্যপদ বাতিলের মতো সিদ্ধান্তও আমরা নিয়ে থাকি।
আইসিএবি নিরীক্ষকদের মান ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি দেখে, ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) কাজও একই…
আমরা চাই এমন একটা আইন ও কাউন্সিল হোক, যারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। এমন একটা প্রতিষ্ঠানের অভিভাবকত্বে দেশে আর্থিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা হলে তা সবার জন্য মঙ্গলজনক। এফআরসির সর্বোচ্চ কার্যকারিতার জন্য আমরাও কাজ করছি। আমরা শুরু থেকে এফআরসি চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করছি।
দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় নিরীক্ষকদের করণীয় সম্পর্কে বলবেন—
দেশের অর্থনীতির কথা বলতে গেলে সবার আগে রফতানি প্রবৃদ্ধির কথা আসে। আমাদের বর্তমান রফতানি আয় ৩৫-৩৬ বিলিয়ন ডলার, মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশে ২০২১ সালে এটাকে ৫৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে হবে। হাতে চার বছর সময় আছে। প্রতি বছর ৫ বিলিয়ন ডলার করে রফতানি বাড়াতে হবে। ফলে তৈরি পোশাকের বাইরে চামড়া, তথ্যপ্রযুক্তি ও ফার্মাসিউটিক্যালসহ বিভিন্ন খাতে রফতানি বাড়াতে জোর দিতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমে যাওয়ার বিষয়টিতেও দৃষ্টি দিতে হবে।
লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে আমাদের অনেক বিনিয়োগ দরকার। বিনিয়োগকারীর স্বার্থ রক্ষায় আবার নিরীক্ষকের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পেশাগত দক্ষতা ও নৈতিকতার সমন্বয়ে আর্থিক সুশাসন নিশ্চিত করে নিরীক্ষকরা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন এবং এটি করতেই হবে।
আইসিএবির নতুন নেতৃত্বের কাছ থেকে আমরা কী প্রত্যাশা করব?
নেতৃত্বের পরিবর্তন খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই আমি সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছি। আমাদের পূর্বসূরিরা খুব আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। নতুন কমিটিতে আমরাও তাই করছি। প্র্রথমেই আমরা আগের কমিটির অসম্পন্ন কাজগুলো শেষ করার পদক্ষেপ নেব। আমাদের উদ্দেশ্য হলো, আর্থিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। নিরীক্ষকরা যেন নৈতিকতা, পেশাগত স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদা ধরে রেখে কাজ করেন এবং পারেন— সে বিষয়টি নিশ্চিত করাই আমাদের প্রধান কাজ।
পাশাপাশি আমরা নতুন ভ্যাট আইন ও আয়কর আইন নিয়ে কাজ করতে চাই। আমাদের লক্ষ্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংক, আরজেএসসি, ঢাকা চেম্বার, এফবিসিসিআই ও এমসিআইসহ বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও ব্যবসায়ী সংগঠন নিয়ে টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে কাজ করার।
বিএফআরএসের জায়গায় আইসিএবি পুরোপুরি আইএফআরএস আত্মস্থ করেছে। এর প্রভাব কী হবে?
বিএফআরএস আইএফআরএসের অনুকরণেই এসেছিল। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেই আমাদের স্থানীয় হিসাব ও নিরীক্ষা মানদণ্ডটি গড়ে উঠেছে। তবে সমস্যা দেখা দেয় বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে ডিল করার সময়। ধরুন, নিউইয়র্কভিত্তিক একটি বিনিয়োগ তহবিলের কর্মকর্তারা এখানে কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগের কথা ভাবছেন। তারা কোম্পানিটির আর্থিক বিবরণী দেখল। তাদের প্রশ্ন, এ প্রতিবেদন কোন হিসাব মানদণ্ড মেনে করা হয়েছে। আমরা বললাম, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড মেনে করা হয়েছে। এও বললাম, বিএফআরএস আইএফআরএস কার্যত একই। তার পরও সে বিনিয়োগকারী তার পদ্ধতিগত যথার্থতা ধরে রাখার জন্য বিবরণীগুলোর আইএফআরএস-ভিত্তিক সংস্করণ চাইল। কোম্পানির ওপর এটি একটি বাড়তি চাপ হয়ে দেখা দিল।
১ জানুয়ারি থেকে আইসিএবি হিসাব ও নিরীক্ষা মানদণ্ড হিসেবে শুধু আইএফআরএসকে বেছে নিয়েছে। ২০১৮ সালের যেকোনো সময়ে হিসাব বছর শুরু করা সব কোম্পানিকেই তা মেনে হিসাব প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হবে। নিরীক্ষকও আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডের ভিত্তিতেই তার কাজ করবে।
এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক পরিসরে চর্চা হয় আইএফআরএস ফর এসএমইর। হিসাব প্রতিবেদন তৈরির সময় বাধ্যবাধকতা কিছু কমিয়ে তাদের জন্য কাজটি আরো সহজ করা হয়। আমরা আইএফআরএস ফর এসএমইও আত্মস্থ করেছি।
অর্থাৎ উন্নত বিশ্ব যে হিসাব মানদণ্ড অনুসরণ করছে, বাংলাদেশও তাই করছে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিবেদনগুলোর গ্রহণযোগ্যতা আরো বাড়াবে, বিনিয়োগে যার সুফল আশা করা যায়। আবার যেহেতু আমাদের বিএফআরএস আইএফআরএস থেকে খুব দূরবর্তী কিছু ছিল না, সেহেতু এ পরিবর্তন দেশের কোম্পানি, নিরীক্ষক ও বিশ্লেষকদের ওপর সেভাবে চাপ বাড়াবে না।
পুঁজিবাজার সম্পর্কিত জ্ঞানের জন্য আপনি কমিউনিটিতে বেশ প্রশংসিত। দেশের শেয়ারবাজার সম্পর্কে কিছু বলবেন?
পুজিবাজারে বিনিয়োগকারীর সবচেয়ে বড় অবলম্বন হলো কোম্পানির ডিসক্লোজার। বেটার ডিসক্লোজার ও এর বিশ্বাসযোগ্যতা যত বাড়বে, বাজারে বিনিয়োগকারীও তত বাড়বে। আমি আশা করি, নিরীক্ষক, নিয়ন্ত্রক, বিনিয়োগকারী সবার সম্মিলিত চেষ্টায় দেশে একটা সময় আসবে, যেসব কোম্পানি শেয়ারদর প্রভাবিত করার জন্য আর্থিক প্রতিবেদনে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরা থেকে বিরত থাকবে, তারাই বেশি লোকসান করবে।
ইনসাইডার ট্রেডিং, সার্কুলার ট্রেডিংয়ের মতো অপরাধগুলো ঠেকাতে যা করা দরকার, তাই করতে হবে।
পুঁজিবাজার সম্পর্কে বলতে গেলে আরেকটি কথাও বলতে হবে, হুজুগে এ বাজারে অনেক সময় সম্পদের দাম অযৌক্তিক পর্যায়ে চলে যায়। বিনিয়োগকারীকে এ দামের সঙ্গে এর প্রকৃত মূল্যের পার্থক্যটি সবসময় মাথায় রাখতে হবে। নতুবা লোকসান এড়ানো কঠিন হবে।
পরিশেষে আমার আশাবাদী পর্যবেক্ষণটি শেয়ার করব, যেনতেন তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করে পার পাওয়া এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে কঠিন। কোনো আর্থিক প্রতিবেদনে গরমিল দেখা গেলে বা বাস্তবতার প্রতিফলন না ঘটলে বহু বিনিয়োগকারীর চোখ সেদিকে যায়, এগুলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়। গণমাধ্যমও সেগুলো নিয়ে বেশ সরব। নিয়ন্ত্রক সংস্থাও বিষয়গুলোকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখে। দেশের কোম্পানি ও হিসাববিদরা যত দ্রুত বিষয়গুলো বুঝবে, আমরা তত দ্রুত এগিয়ে যাব।
Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

উন্নত বিশ্ব যে রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করছে, বাংলাদেশও তাই করছে

আপডেট টাইম : ১১:৩৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৫ জানুয়ারী ২০১৮
বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ১ জানুয়ারি দেশের চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের (সিএ) সংগঠন আইসিএবির সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছেন দেওয়ান নূরুল ইসলাম।  ১৯৯০ সালে তিনি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি সম্পন্ন করেন। অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনি থেকে ফিন্যান্সে এমবিএ ডিগ্রিও নিয়েছেন। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন করপোরেট ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষপর্যায়ে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। সরকারি প্রতিষ্ঠান যমুনা অয়েল ও বিডিবিএলের পর্ষদেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বর্তমানে তিনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্রান্ড থর্টন কনসাল্টিং (বাংলাদেশ) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টেরও চেয়ারম্যান তিনি। সম্প্রতি তিনি একটি দৈনিকের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনায় সম্প্রতি দেশের হিসাব ও নিরীক্ষা পরিস্থিতি, পেশাদার হিসাববিদদের অবস্থান, আইসিএবির কর্মকাণ্ড, পুঁজিবাজার ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেন। উঠে আসে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড (আইএফআরএস) আত্মস্থকরণের সম্ভাব্য সুফলের কথাও। তা হুবহু তুলে ধরা হলো-
চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি অত্যন্ত সম্মানজনক পেশা। আইসিএবির সদস্য কতজন, তারা কেমন করছেন?
মানুষের প্রতিটি কাজের সঙ্গেই অর্থনীতি যুক্ত। অর্থনীতির মূলে রয়েছে আর্থিক বিষয়াদি। সেখানে স্বচ্ছতা ও সুশাসন আবশ্যক। সিএরা মূলত আর্থিক স্বচ্ছতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কাজ করেন। এ কারণে সমাজে তারা শ্রদ্ধার পাত্র। আবার পেশাগত দক্ষতার কারণে কর্মক্ষেত্রেও তাদের মূল্য অনেক।
দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) অধীনে বর্তমানে ১ হাজার ৮০০-এর মতো সিএ রয়েছেন। এর মধ্যে ৭০ শতাংশই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। তারা সরাসরি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি করছেন না। বাকি ৩০ শতাংশ বিভিন্ন সিএ ফার্মের মাধ্যমে স্বাধীন হিসাববিদ হিসেবে কাজ করছেন। প্রায় প্রত্যেকেই নিজ ফিল্ডে সুপ্রতিষ্ঠিত। তবে দেশের অর্থনীতির কলেবর বিবেচনা করলে বলতে হবে, প্র্যাকটিসিং সিএর সংখ্যাটি অনেক কম।
পেশাদার হিসাববিদ তৈরি ও তাদের মানোন্নয়নে আইসিএবি কী করছে?
আইসিএবি রাষ্ট্রপতির বিশেষ আদেশে গঠিত একটি প্রতিষ্ঠান। আইসিএবির একটি উদ্দেশ্য, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড অডিট প্রফেশনকে রেগুলেট করা। অন্যটি হলো, সিএ তৈরি করা। আমরা দুটোই করছি। সঙ্গে স্ট্যান্ডার্ড সেটিংও। গ্লোবাল স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখেই একাডেমিক ও ব্যবহারিক সব প্রক্রিয়া শেষ করার মাধ্যমে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট তৈরি করছে আইসিএবি। এর স্বীকৃতিও মিলছে। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস অব ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস আইসিএবির সনদধারীদের সরাসরি গ্রহণ করে নেয়। আইসিএবির সনদধারীরা কোনো পরীক্ষা ছাড়াই অন্যান্য দেশে কাজ করতে পারেন।
আইসিএবি শুধু সনদ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে না। সনদপ্রাপ্ত সদস্যদের নতুন নতুন পরিস্থিতি, তথ্য ও আইনের সঙ্গে পরিচিত ও অভ্যস্ত করতে আইসিএবি নানা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। যারা সিএ ফার্মের মাধ্যমে সরাসরি প্র্যাকটিসে আছেন, আমাদের মূল কাজটি তাদের নিয়ে। বিভিন্ন কোম্পানিতে সার্ভিস দেয়া হিসাববিদদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নেও আইসিএবি কাজ করে। তবে সবকিছুর আগে পেশাগত নৈতিকতা ও স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেয় আইসিএবি।
আর্থিক সুশাসন ও পেশাদার হিসাববিদদের নৈতিকতার সম্পর্কটি ব্যাখ্যা করবেন?
সব পেশাতেই নৈতিকতা ও স্বাধীনতা গুরুত্বপূর্ণ। আর্থিক বিষয়াদিতে এটি আরো গুরুত্বপূর্ণ। এ বছর আমাদের স্লোগান হচ্ছে, নৈতিকতার ভিত্তিতে আর্থিক বিষয়াদিতে নেতৃত্ব দেয়া। শহরের জলাবদ্ধতা তৈরি হলে যেমন প্রকৌশলীর নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন আসে, তেমনি আর্থিক অনিয়ম দেখা দিলে হিসাববিদদের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন আসে। প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন মুখ্যত অর্থনির্ভর হওয়ায় সেখানে হিসাববিদদের ভূমিকা অনেক বেশি। নৈতিকতা ও স্বাধীনতা সমুন্নত রেখে একজন হিসাববিদ নিরীক্ষা সম্পন্ন করলে সেখানে সুশাসন ঘাটতি থাকার কোনো সুযোগ নেই। তাই আমাদের নৈতিকতা ধরে রেখে জাতীয় এজেন্ডার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কাজ করতে হবে।
দেশে ভুয়া আর্থিক প্রতিবেদন তৈরির অভিযোগটি অনেক পুরনো, এগুলোয় নিরীক্ষক হিসেবে আপনাদের সদস্যরাও স্বাক্ষর করেন বলে জোরালো অভিযোগ আছে…
এটা খুবই উদ্বেগের বিষয় যে, অনেক প্রতিষ্ঠানই ভুয়া ও প্রতারণাপূর্ণ আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করছে। আমাদের সদস্যরা এর একটিতেও স্বাক্ষর করছেন না— এমনটি নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না। তবে আমি এটি জোর দিয়ে বলতে পারি, আইসিএবির অভ্যন্তরীণ মানদণ্ড ও শৃঙ্খলা ব্যবস্থায় তারা উপযুক্ত শাস্তি ও সংশোধনের সুযোগ পায়।
আমি অন্য একটি বিষয়ে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, তা হলো নিরীক্ষকের অজান্তেই তার স্বাক্ষর জাল করে আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করা। দেখুন, আমাদের ফার্মগুলো বছরে ১০-১২ হাজার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা করে। এদিকে এনবিআরে নাকি ৩০-৩২ হাজার প্রতিষ্ঠানের নিরীক্ষিত প্রতিবেদন জমা পড়ে। এখানে দুটো বিষয় হতে পারে, আমাদের কোনো সদস্য একটি দুর্বল বা ভুয়া প্রতিবেদনে সই করে তা গোপন করছে অথবা কোম্পানি নিরীক্ষকের অজান্তেই তার স্বাক্ষর জাল করে প্রতিবেদনটি বিভিন্ন দপ্তরে জমা দিচ্ছে। কমিউনিটির একজন হিসেবে আমি জানি, দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া প্রায় সব ভুয়া প্রতিবেদনেই আইসিএবির মেম্বার ফার্মগুলোর সই-সিল জাল করা হয়।
এ সমস্যার সমাধানে আমরা ২০১৭ সালের শেষদিকে ডিজিটাল ডাটাবেজ চালু করেছি। এ ব্যবস্থায় আমাদের ফার্মের মাধ্যমে প্রতিবেদন নিরীক্ষা করা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি তালিকা আইসিএবির ওয়েবসাইটে দেয়া রয়েছে।
এনবিআর বা আরজেএসসিতে হিসাব বিবরণী দাখিল করা প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়ে আমাদের তালিকা  মিলিয়ে দেখলেই আপনি বুঝতে পারবেন, জমা দেয়া একটি রিপোর্ট সত্যিই অডিটেড না ভুয়া।
অনেক সমস্যা-অভিযোগের মধ্যেও কিন্তু দেশে হিসাবচর্চা অনেক এগিয়েছে। হিসাব ও নিরীক্ষার মান বিবেচনা করলে আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে উন্নীত হয়েছি। আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় প্রতি বছরই আমাদের দেশ থেকে কিছু কোম্পানি চ্যাম্পিয়ন, রানারআপ হচ্ছে। বিভিন্ন খাতে আইসিএবির কাছ থেকে সেরা আর্থিক প্রতিবেদনের স্বীকৃতি পাওয়া কোম্পানিগুলো দক্ষিণ এশীয় পরিসরেও সেরার স্বীকৃতি পাচ্ছে। সর্বশেষ বছরের জন্য এরই মধ্যে বিজয়ীদের তালিকা প্রস্তুত করে ফেলেছে সাউথ এশিয়ান ফেডারেশন অব অ্যাকাউন্ট্যান্টসের (সাফা) জুরি বোর্ড। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ১৪টি ক্যাটাগরির মধ্যে ১০টিতেই চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশী কোম্পানি। এর বাইরে রানারআপ ও সার্টিফিকেট অব মেরিটের মতো পুরস্কারগুলোয় রয়েছেই। একাধিক খাতে দেখা যাচ্ছে, আইসিএবি বাংলাদেশ থেকে যে তিনটি কোম্পানিকে মনোনীত করেছে, তাদের প্রত্যেকেই আঞ্চলিক পরিসরেও শীর্ষ তিনের স্বীকৃতি পেয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকার কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই তারা এ স্বীকৃতি পাচ্ছে। আমার আত্মবিশ্বাস, তিনটির বেশি নাম পাঠানোর সুযোগ থাকলে বাংলাদেশের সাফল্য আরো বড় হতো।
অর্থাৎ দেশে যে কোম্পানি ও নিরীক্ষক ভালো করতে চাইছেন, তাদের সে সুযোগ আছে। আমাদের এখন অনিচ্ছুক ও পিছিয়ে থাকাদের উন্নয়নে কাজ করতে হবে।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতেই হবে, পুরস্কারপ্রাপ্ত কোম্পানিগুলোর প্রায় সবক’টির আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুতিতেই সেখানে কর্মরত চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টরা যুক্ত আছেন। অর্থাৎ অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স বিভাগে সিএরা যুক্ত থাকলে কোম্পানির ডিসক্লোজারের মান বাড়ে।
তালিকাভুক্ত কোম্পানির নিরীক্ষায় বিএসইসি কয়েকটি ফার্ম নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সেসব ফার্মের ওপর স্ট্যান্ডার্ড ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার চাপটি দৃশ্যমান। বাকি অডিট ফার্মগুলোর অবস্থা কেমন দেখছেন?
আমাদের শেয়ারবাজারে প্রায় সাড়ে ৩০০ কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ড তালিকাভুক্ত রয়েছে। এদের নিরীক্ষায় ৩৫টির মতো প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ফার্মগুলোর নানা কমপ্লায়েন্স ও বিএসইসির চাওয়ার জায়গাটা বিচার করেই এসব প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচন করা হয়। এ প্যানেলভুক্ত ফার্মগুলোকে কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করার মতো প্রশিক্ষণ দেয় আইসিএবি।
এর বাইরে অন্য ফার্মগুলো যাতে ভালো করে এবং পেশাগত মানদণ্ডে পিছিয়ে না থাকে, সে চেষ্টাও ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে রয়েছে। সবাই এক মানের হবে না, এটিই স্বাভাবিক। তবে নিরীক্ষা কাজে নৈতিকতা ও স্বাধীন অবস্থানের কোনো বিকল্প নেই। এখানে যারা ছাড় দেবে, তারা আগামীতে আর টিকে থাকবে না।
দেখুন, অডিট ফার্মগুলোর সুশাসন ও নৈতিকতার বিষয়ে আমরা বেশ সতর্ক। কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে স্খলনের প্রমাণ পেলে তাদের লাইসেন্স স্থগিতের মতো সিদ্ধান্তও আমরা গ্রহণ করি। বিভিন্ন অডিট ফার্মে নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণে আমাদের একটি শক্তিশালী টিম রয়েছে। ডিসিপ্লিনারি কমিটি নামে এ টিমটি গঠিত হয় নিরপেক্ষ ও জ্যেষ্ঠ চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের সমন্বয়ে। তারা দীর্ঘ সময় নিয়ে বিভিন্ন ফার্মের বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করে। সরকারি-বেসরকারিসহ যেকোনো কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনে যেন মানসম্মত নিরীক্ষা হয়, সে বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। কোনো ফার্মের বিরুদ্ধে অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠলে, তাদেরকে ডেকে ব্যবস্থা নেয়া হয়। বড় অভিযোগ প্রমাণ হলে কোনো ফার্মকে স্থায়ীভাবে নিরীক্ষা বন্ধের ব্যবস্থা নেয়া হয়। সদস্যপদ বাতিলের মতো সিদ্ধান্তও আমরা নিয়ে থাকি।
আইসিএবি নিরীক্ষকদের মান ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি দেখে, ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) কাজও একই…
আমরা চাই এমন একটা আইন ও কাউন্সিল হোক, যারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। এমন একটা প্রতিষ্ঠানের অভিভাবকত্বে দেশে আর্থিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা হলে তা সবার জন্য মঙ্গলজনক। এফআরসির সর্বোচ্চ কার্যকারিতার জন্য আমরাও কাজ করছি। আমরা শুরু থেকে এফআরসি চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করছি।
দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় নিরীক্ষকদের করণীয় সম্পর্কে বলবেন—
দেশের অর্থনীতির কথা বলতে গেলে সবার আগে রফতানি প্রবৃদ্ধির কথা আসে। আমাদের বর্তমান রফতানি আয় ৩৫-৩৬ বিলিয়ন ডলার, মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশে ২০২১ সালে এটাকে ৫৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে হবে। হাতে চার বছর সময় আছে। প্রতি বছর ৫ বিলিয়ন ডলার করে রফতানি বাড়াতে হবে। ফলে তৈরি পোশাকের বাইরে চামড়া, তথ্যপ্রযুক্তি ও ফার্মাসিউটিক্যালসহ বিভিন্ন খাতে রফতানি বাড়াতে জোর দিতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমে যাওয়ার বিষয়টিতেও দৃষ্টি দিতে হবে।
লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে আমাদের অনেক বিনিয়োগ দরকার। বিনিয়োগকারীর স্বার্থ রক্ষায় আবার নিরীক্ষকের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পেশাগত দক্ষতা ও নৈতিকতার সমন্বয়ে আর্থিক সুশাসন নিশ্চিত করে নিরীক্ষকরা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন এবং এটি করতেই হবে।
আইসিএবির নতুন নেতৃত্বের কাছ থেকে আমরা কী প্রত্যাশা করব?
নেতৃত্বের পরিবর্তন খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। চলমান প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই আমি সভাপতির দায়িত্ব নিয়েছি। আমাদের পূর্বসূরিরা খুব আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। নতুন কমিটিতে আমরাও তাই করছি। প্র্রথমেই আমরা আগের কমিটির অসম্পন্ন কাজগুলো শেষ করার পদক্ষেপ নেব। আমাদের উদ্দেশ্য হলো, আর্থিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। নিরীক্ষকরা যেন নৈতিকতা, পেশাগত স্বাধীনতা ও আত্মমর্যাদা ধরে রেখে কাজ করেন এবং পারেন— সে বিষয়টি নিশ্চিত করাই আমাদের প্রধান কাজ।
পাশাপাশি আমরা নতুন ভ্যাট আইন ও আয়কর আইন নিয়ে কাজ করতে চাই। আমাদের লক্ষ্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ব্যাংক, আরজেএসসি, ঢাকা চেম্বার, এফবিসিসিআই ও এমসিআইসহ বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও ব্যবসায়ী সংগঠন নিয়ে টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে কাজ করার।
বিএফআরএসের জায়গায় আইসিএবি পুরোপুরি আইএফআরএস আত্মস্থ করেছে। এর প্রভাব কী হবে?
বিএফআরএস আইএফআরএসের অনুকরণেই এসেছিল। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেই আমাদের স্থানীয় হিসাব ও নিরীক্ষা মানদণ্ডটি গড়ে উঠেছে। তবে সমস্যা দেখা দেয় বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে ডিল করার সময়। ধরুন, নিউইয়র্কভিত্তিক একটি বিনিয়োগ তহবিলের কর্মকর্তারা এখানে কোনো কোম্পানিতে বিনিয়োগের কথা ভাবছেন। তারা কোম্পানিটির আর্থিক বিবরণী দেখল। তাদের প্রশ্ন, এ প্রতিবেদন কোন হিসাব মানদণ্ড মেনে করা হয়েছে। আমরা বললাম, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড মেনে করা হয়েছে। এও বললাম, বিএফআরএস আইএফআরএস কার্যত একই। তার পরও সে বিনিয়োগকারী তার পদ্ধতিগত যথার্থতা ধরে রাখার জন্য বিবরণীগুলোর আইএফআরএস-ভিত্তিক সংস্করণ চাইল। কোম্পানির ওপর এটি একটি বাড়তি চাপ হয়ে দেখা দিল।
১ জানুয়ারি থেকে আইসিএবি হিসাব ও নিরীক্ষা মানদণ্ড হিসেবে শুধু আইএফআরএসকে বেছে নিয়েছে। ২০১৮ সালের যেকোনো সময়ে হিসাব বছর শুরু করা সব কোম্পানিকেই তা মেনে হিসাব প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে হবে। নিরীক্ষকও আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডের ভিত্তিতেই তার কাজ করবে।
এসএমই প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক পরিসরে চর্চা হয় আইএফআরএস ফর এসএমইর। হিসাব প্রতিবেদন তৈরির সময় বাধ্যবাধকতা কিছু কমিয়ে তাদের জন্য কাজটি আরো সহজ করা হয়। আমরা আইএফআরএস ফর এসএমইও আত্মস্থ করেছি।
অর্থাৎ উন্নত বিশ্ব যে হিসাব মানদণ্ড অনুসরণ করছে, বাংলাদেশও তাই করছে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিবেদনগুলোর গ্রহণযোগ্যতা আরো বাড়াবে, বিনিয়োগে যার সুফল আশা করা যায়। আবার যেহেতু আমাদের বিএফআরএস আইএফআরএস থেকে খুব দূরবর্তী কিছু ছিল না, সেহেতু এ পরিবর্তন দেশের কোম্পানি, নিরীক্ষক ও বিশ্লেষকদের ওপর সেভাবে চাপ বাড়াবে না।
পুঁজিবাজার সম্পর্কিত জ্ঞানের জন্য আপনি কমিউনিটিতে বেশ প্রশংসিত। দেশের শেয়ারবাজার সম্পর্কে কিছু বলবেন?
পুজিবাজারে বিনিয়োগকারীর সবচেয়ে বড় অবলম্বন হলো কোম্পানির ডিসক্লোজার। বেটার ডিসক্লোজার ও এর বিশ্বাসযোগ্যতা যত বাড়বে, বাজারে বিনিয়োগকারীও তত বাড়বে। আমি আশা করি, নিরীক্ষক, নিয়ন্ত্রক, বিনিয়োগকারী সবার সম্মিলিত চেষ্টায় দেশে একটা সময় আসবে, যেসব কোম্পানি শেয়ারদর প্রভাবিত করার জন্য আর্থিক প্রতিবেদনে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরা থেকে বিরত থাকবে, তারাই বেশি লোকসান করবে।
ইনসাইডার ট্রেডিং, সার্কুলার ট্রেডিংয়ের মতো অপরাধগুলো ঠেকাতে যা করা দরকার, তাই করতে হবে।
পুঁজিবাজার সম্পর্কে বলতে গেলে আরেকটি কথাও বলতে হবে, হুজুগে এ বাজারে অনেক সময় সম্পদের দাম অযৌক্তিক পর্যায়ে চলে যায়। বিনিয়োগকারীকে এ দামের সঙ্গে এর প্রকৃত মূল্যের পার্থক্যটি সবসময় মাথায় রাখতে হবে। নতুবা লোকসান এড়ানো কঠিন হবে।
পরিশেষে আমার আশাবাদী পর্যবেক্ষণটি শেয়ার করব, যেনতেন তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করে পার পাওয়া এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে কঠিন। কোনো আর্থিক প্রতিবেদনে গরমিল দেখা গেলে বা বাস্তবতার প্রতিফলন না ঘটলে বহু বিনিয়োগকারীর চোখ সেদিকে যায়, এগুলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়। গণমাধ্যমও সেগুলো নিয়ে বেশ সরব। নিয়ন্ত্রক সংস্থাও বিষয়গুলোকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখে। দেশের কোম্পানি ও হিসাববিদরা যত দ্রুত বিষয়গুলো বুঝবে, আমরা তত দ্রুত এগিয়ে যাব।