আড়ত থেকে খুচরা বাজার: ডিমের দাম ডজনে বাড়ে ২২ টাকা

আড়তে লাল ১০০ ডিমের দাম ১ হাজার ৫০ টাকা থেকে ১ হাজার ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর এক ডজন (১২টি) ১২৮ টাকা করে। কিন্তু সেই ডিম আড়ত থেকে নেওয়ার পর পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১০০ টাকায়। প্রতি ডজনের দাম পড়ছে ১৩২ টাকা। খুচরা ডিম ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছেন প্রতি ডজন ১৪০-১৫০ টাকা পর্যন্ত।

অর্থাৎ আড়ত থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত পৌঁছাতে ডিমের দাম ডজনে বাড়ে ১২ টাকা থেকে ২২ টাকা। যা একেবারেই অস্বাভাবিক। এতে ক্রেতাদের পকেট কাটছে। কিন্তু দেখার কেউ নেই। কোনো কারণ ছাড়াই গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে হঠাৎ করেই অস্থির হয়ে উঠেছে ডিমের বাজার।

জানা গেছে, গত কয়েকদিন ধরে কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোল্ট্রিসহ কয়েকটি কোম্পানি বেশি করে দাম বেঁধে দিচ্ছে। সে দামেই সারা দেশে ডিম বিক্রি হচ্ছে। দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে কোনোভাবে দায় নিচ্ছে না আড়তদাররা। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বেশি দামে ডিম বিক্রির অভিযোগে এর আগেও মামলা হয়েছিল।

ডিম ব্যবসায়ীরা বলছেন, খাদ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে খামারিদের বাঁচাতে হলে এই দামই রাখতে হবে। এই দামই স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে হবে। এর চেয়ে ডিমের দাম কমলে আরও খামার বন্ধ হয়ে যাবে। তখন ডিমের দাম আরও বাড়বে। রাজধানীর কারওয়ান বাজার, টাউনহলসহ বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় সরেজমিনে ঘুরে ঘুরে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে।

দেশের যেখানেই ডিমের উৎপাদন হোক না কেন তা রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ডিমের আড়তে আসে। এখান থেকে ডিম হাত বদল হতে হতে যায় রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে, পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোতে। এজন্য দামও বাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে। গত কয়েকদিন ধরে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে ডিমের দাম। যা খুচরা পর্যায়ে বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত ডজনপ্রতি ১৫০ টাকা গিয়ে ঠেকেছে। এর কমে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না ডিম।

বৃহস্পতিবার তেজগাঁও রেলস্টেশনের ডিমের আড়তে ডিম কত করে বিক্রি হচ্ছে সেই খোঁজ নিতে গিয়ে জানা যায়, সারা দেশ থেকেই এখানে দিনে ২০ থেকে ২৫ লাখ ডিম আসে। সেখানে পাইকারি পর্যায়ে একেক জনের কাছ থেকে একেক রকম তথ্য পাওয়া গেছে।

ডিমের দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে নাসির অ্যান্ড ব্রাদার্স এর মালিক মো. নাসির উদ্দিন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, কই দাম বেড়েছে। ১০০ ডিম ১ হাজার ৭০ টাকায় বিক্রি করছি। হালি ৪২ টাকা বা ডজন ১২৮ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। এর উপর কখনো উঠেনি। এক লাখ থেকে কমে ৬০ থেকে ৭০ হাজারে নেমে গেছে। ব্যবসা একেবারে নাই। দেখেন না ঘর ভরা দিম। বিক্রি হয়নি।

তিনি বলেন, দাম বাড়লে ব্যবসা একেবারে কমে যায়। হাজারে ১৫ থেকে ২০ টাকা লাভ করলেই যথেষ্ট। সবকিছুর দাম বেশি। তাই ফার্ম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ১ হাজার ৫০ টাকায় টাঙ্গাইল থেকেই কেনা। এর সঙ্গে কিছু খরচ আছে। একেবারে অস্থির নয়। কারণ এর চেয়ে কম হলে সব খামার বন্ধ হয়ে যাবে। খামারে তাদের উৎপাদন খরচই সাড়ে ১০ টাকা থেকে ১১ টাকা। তাহলে এর চেয়ে দাম কমবে কী করে। এ বাজারেই রেট নির্ধারণ হয়। আজকেও কাজী, প্যারাগন ১ হাজার ৭০ টাকা রেট দিয়ে গেছে। তারাই বাজারে দাম দেয়। সেভাবে আমরা বিক্রি করি, ৫ পয়সা লাভে।

নীলিমা এন্টারপ্রাইজের জোবায়েরও বলেন, ডিমের দাম ১ হাজার ৭০ টাকা বা পিস ১০ টাকা ৭০ পয়সা। কয়েকদিন থেকেই এ দামে বিক্রি করছি। আমরা ফার্ম থেকে ডিম এনে বাজার দরে বিক্রি করি। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে ২০ পয়সা কমিশন পাই। কাজী, প্যারাগনসহ বিভিন্ন কোম্পানি দর দেয়। রাত ১২টা থেকে সকাল পর্যন্ত ডিম বিক্রি করা হয়। হাজারে ১৫ থেকে ২০ টাকা লাভে আমরা ডিম বিক্রি করি। দাম বাড়লেও আমাদের লোকসান। কারণ এতে পুঁজি বেশি লাগে। বিভিন্ন খরচও আছে।

আল আমিন ট্রেডার্সের আল আমিন বলেন, টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ সাইড থেকে মিডিয়ার মাধ্যমে ডিম আনা হয়। বর্তমানে দাম বাড়তি। টাঙ্গাইলে ফার্মে রেট দেওয়া হয়। সেখান থেকে এনে বিক্রি করে কমিশন রেখে তাদের দাম দেওয়া হয়। দিনে ৬৫ থেকে ৭০ হাজার ডিম আনা হয়। আজকে ৯৫ হাজার ডিম আনা হবে। ১০০ ডিমের দাম ১ হাজার ৭০ টাকা। প্রতি পিস ১০ টাকা ৭০ টাকা। তাদের সাড়ে ১০ টাকায় দেওয়া হবে। আমরা ২০ পয়সা রাখব।

তিনি আরও বলেন, ১০ হাজার টাকার ডিম বিক্রি হলে সাড়ে ৭ হাজার টাকা গাড়ি ভাড়া, সঙ্গে স্টাফের খরচ, কিছু ডিমও ভাঙে। সব মিলে কিছু থাকে না।

তাহলে কি লোকসান করে ব্যবসা করেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক টাকা বাকি পড়ে আছে। ব্যবসা একেবারে বন্ধ করে দিলে তো আর টাকা আসবে না। ব্যবসা মানে তো লাভ-লোকসান। কিছুদিন আগে ১০০ ডিম ১ হাজার ২০ টাকা, মাস খানেক আগে ৯০০ টাকায় বিক্রি করেছি। বড় বড় ফার্ম কাজী, প্যারাগন, ডায়মন্ড কোম্পানি তাদের লোকের মাধ্যমে রেট দিয়ে দেয়। ২০ থেকে ২৫ লাখ প্রতিদিন ডিম আসে। আগে ৪০ লাখও আসত। খামারিরা লোকসান সামলাতে পারছে না। অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা বিপদে আছি। কারণ আমাদের খামার বন্ধ হয়ে গেলে আর ডিম পাব না। সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ পয়সা লাভ থাকে। এর বেশি কেউ লাভ করতে পারবে না। চা দোকানের চেয়ে খারাপ।

মেসার্স মুন্সি ট্রেডিং এর শফিক এর কাছে ডিমের দামের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি সাফ জানিয়ে দেন, ডিম নেই। অথচ আড়ত ভরা ডিম বলা মাত্র তিনি বলেন, এগুলো বিক্রি হয়ে গেছে। দাম কত জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ১০০ ডিমের দাম ১ হাজার ৪০ টাকা। কম দামে কেনা হলে কম দামেই বিক্রি করা হয়।

পাশেই ডিমের পাইকারি বাজার। সেখানে গিয়ে শাহ আলী ট্রেডার্স এর মালিক আব্দুল হালিমের কাছে ডিমের দাম জানতে চাইলে তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ১০০ লাল ডিমের দাম ১ হাজার ১০০ টাকা। পাইকারি দাম এটা। কাঁচামাল। তাই প্রায় দিন দাম উঠানামা করে। পাঁচ দিন থেকে একই বাজার। আগে কম ছিল। বেশি দামে কেনা। পাশের অন্যান্য পাইকারি ডিম বিক্রেতারাও জানান, কয়েকদিন থেকে দাম বেশি। আগে কম ছিল।

ওই বাজারের একটু দূরেই খুচরা ডিম বিক্রেতা টিটো বলেন, খুচরা ডিমের ডজন ১৪০ টাকা। কয়েকদিন থেকেই এ দাম। বেশি না?-এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এইতো ১০০ ডিম ১ হাজার ৮০ টাকায় কেনা। আগে কম ছিল।

এসময় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কিরণ নামে এক ক্রেতা বলেন, প্রচুর দাম। কেনা কমিয়ে দিয়েছি। আগে ২৭০ টাকা খাঁচি নিয়েছি। এখন ৩০০ টাকারও বেশি। শুধু বাড়তি আর বাড়তি।

পাশের আরেক খুচরা ডিম বিক্রেতা রহমত জানান, ৩৪০ টাকা খাঁচি। খুচরা বেশি, ৪৮ টাকা হালি। এত বেশি কেন?- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কী করমু, দাম বেশি। ডিরেক্ট আসে মাল। খাবারসহ সব জিনিসের দাম বেশি। তাই আড়তে বাড়তি দাম। আমাদেরও বেশি দামে কেনা। কিছু লাভ করে বিক্রি করি।

বাড়তি ডিমের এই রেট শুধু এই বাজারেই নয়, মোহাম্মদপুরের টাউনহল, কৃষিমার্কেটসহ বিভিন্ন বাজারের একই চিত্র। আর পাড়া-মহল্লায়ও বাড়তি দাম বিক্রি হচ্ছে। মোহাম্মদপুর ফিউচার টাউনহল হাউজিং এর আল আমিন এন্টারপ্রাইজের আনোয়ার বলেন, ১৫০ টাকা ডজন, তবে একটু কমে ১৪৫ টাকা। এর কমে বিক্রি করা যাবে না।

উল্লেখ্য, গত বছরের আগস্টে হঠাৎ করেই অস্থির হয়ে উঠেছিল ডিমের বাজার। ওই সময় বাধ্য হয়ে ভোক্তা অধিদপ্তর মাঠেও নামে। বেরিয়ে আসে ডিম কারসাজির বিষয়টি। কাজী ফার্মস ডিলার দাম বাড়িয়ে লুফে নেয় বাড়তি মুনাফা। প্যারাগনও সে সুযোগ নেওয়ায় বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন কাজী ফার্মস, প্যারাগনসহ কয়েকটি কোম্পানির বিরুদ্ধে গত ২৭ সেপ্টেম্বর মামলাও করেছে। কিন্তু সেসব মামলার এখানো সুরাহা হয়নি। তারপরও বাজার অস্থির করছে সেই কাজী, প্যারাগনসহ কয়েকটি কোম্পানি। এর ফলে কয়েক দিন থেকেই পাইকারি, খুচরা ব্যবসায়ীরা যে যেভাবে পারছেন, বাজারে নৈরাজ্য তৈরি করে ভোক্তাদের পকেট কাটছেন।

পোল্ট্রি শিল্প সমন্বয় কমিটির সভাপতি মশিউর রহমান জানিয়েছেন, সংকটের সময় বাজারে সুযোগ নেওয়ার এমন চেষ্টা অনেকেই করেন। কারণ দেশে দৈনিক প্রায় সাড়ে চার কোটি ডিম বিক্রি হয়। উৎপাদন হয় প্রায় পাঁচ কোটি।

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর