পরিবেশদূষণ থেকে মানবজীবন সুরক্ষা কিভাবে সম্ভব?
পরিবেশের স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ইসলাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও বৃক্ষরোপণের বিস্তারিত নির্দেশ জারি করে এ সমস্যার সুস্পষ্ট সমাধান দিয়েছে। কোরআনে উদ্ভিদ ও বৃক্ষ নষ্ট করা বা কেটে ফেলাকে মুনাফিকদের পথ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন : ‘যখন সে প্রস্থান করে তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টির এবং শস্যক্ষেত্র ও জীবজন্তু ধ্বংসের চেষ্টা করে। আর আল্লাহ অশান্তি পছন্দ করেন না।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২০৫
বিনা প্রয়োজনে গাছ কাটা ইসলামী শিক্ষায় নিষিদ্ধ। এমনকি যুদ্ধে যাওয়ার সময়ও মুসলিম বাহিনীকে শহর ও ফসল ধ্বংস না করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো মক্কা বিজয়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শক্তি ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি সাহাবায়ে কিরামকে মানবজীবনের ক্ষতি করতে নিষেধ করেছেন এবং ফসল ও গাছ নষ্ট করতেও নিষেধ করেছেন। মহানবী (সা.) বৃক্ষরোপণকে সদকা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং কিয়ামতের আগে একটি গাছ লাগানোর সুযোগ পেলে গাছ লাগাতেও নির্দেশ দিয়েছেন।
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ‘যদি কিয়ামত এসে যায় এবং তখন তোমাদের কারো হাতে (খেজুরের) চারাগাছ থাকে তবে কিয়ামত আসার আগেই সে যদি পারে এই চারাগাছ যেন রোপণ করে। (আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৪৮০; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১২৯০২)
হাদিসের আলোকে পরিবেশদূষণ সমস্যার সমাধান
যত্রতত্র দুর্গন্ধময় পানির কারণে পুরো শহর বন্যায় পরিণত হলে প্রাকৃতিক ও চিকিৎসার দিক থেকে এমন জায়গায় মানুষের জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ কারণেই ইসলাম সব ধরনের পরিবেশদূষণ দূর করার শিক্ষা দিয়েছে, যাতে মানুষ মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিকভাবে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনী এই ধরনের পরিবেশদূষণকে নির্মূল করাই যেন মুখ্য উদ্দেশ্য। এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো—
পানির অপচয় রোধ
পানি আল্লাহ তাআলার একটি বড় নিয়ামত। তা রক্ষা করতে হবে এবং যথাসম্ভব অপচয় এড়িয়ে চলতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কিরামকে পানির অপচয় থেকে রক্ষা করার জন্য কতটা তাগিদ দিয়েছেন, তা জানলে যে কেউ অবাক হবে। ইবনে উমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে অজু করতে দেখে বললেন, অপচয় কোরো না, অপচয় কোরো না। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪২৪)
রাসুলুল্লাহ (সা.) যেমন পানির অপচয় করতে নিষেধ করেছেন, তেমনি তিনি পানিকে অপবিত্রতা থেকে রক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন; সে পানি স্থির হোক বা প্রবাহিত। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যেন স্থিরকৃত পানিতে প্রস্রাব না করে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৪৪)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, জাবের (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বহমান পানিতে প্রস্রাব করতে নিষেধ করেছেন। (আল মুজামুল আওসাত, হাদিস : ১৭৪৯)
ভূমি ও বায়ুদূষণের প্রতিকার
হাদিসের আলোকে বৃক্ষরোপণ ভূমি ও বায়ুদূষণ থেকে পরিত্রাণের একটি উপায়, যা কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্মূল ও অক্সিজেন সমৃদ্ধ করার সর্বোত্তম মাধ্যম। রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবায়ে কিরামকেও গাছ লাগানোর প্রতি উৎসাহিত করেছেন এবং গাছ লাগানোর সওয়াব ঘোষণা করেছেন। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে মুসলমান গাছ লাগায় বা ক্ষেত চাষ করে এরপর তা থেকে পাখি, মানুষ বা পশু খায়, এটা তার জন্য সদকাস্বরূপ। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৩২০, সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৫৬৩)
সাহাবায়ে কিরামদের বৃক্ষরোপণ
আবু হুরায়রা (রা.) বলেছেন, ‘একদিন আমি একটি বৃক্ষ রোপণ করছিলাম, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং তিনি বলেন, হে আবু হুরায়রা! তুমি কী করছ? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল (সা.), আমি গাছ রোপণ করছি।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৮০৭)
বিনা প্রয়োজনে গাছ নিধন নিষিদ্ধ
আবদুল্লাহ ইবনে হুবশি (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি (অকারণে) একটি কুলগাছ কাটবে আল্লাহ তাকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ৫২৩৯)
বাজার বা রাস্তায় ময়লা ফেলা নিষিদ্ধ
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সিরাত থেকে রাস্তাঘাট ও বাজার পরিষ্কার রাখার ব্যাপারে নির্দেশ পাওয়া যায়। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ঈমানের সত্তরোর্ধ্ব কিংবা ষাটোর্ধ্ব শাখা আছে এবং সর্বনিম্ন শাখা হচ্ছে পথ থেকে কষ্টদায়ক কিছু সরিয়ে ফেলা। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩৫)
অর্থাৎ ঈমানের ন্যূনতম দাবি, চলার পথে সাধ্যানুযায়ী কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে দেওয়া। এটি আমার নাজাতেরও কারণ হয়ে যেতে পারে!
পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতার দিক থেকে ইসলামের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ধর্ম আর নেই। ইসলাম তার অনুসারীদের নিজেদের শরীর ও চারপাশ পরিষ্কার রাখার নির্দেশ দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) পবিত্রতাকে ঈমানের অর্ধেক বলে ঘোষণা করেছেন। আবু মালেক আল আশআরি (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : পবিত্রতা হলো, ঈমানের অর্ধেক। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২২৩)
আসুন! আমরা আমাদের চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখি। পাশাপাশি যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত হই। আল্লাহ তাআলা আমাদের এমন ভয়াবহ জলবায়ু পরিবর্তন থেকে হেফাজত করুন। আমিন।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান ও তত্ত্বাবধায়ক, ফতওয়া ও ইসলামী গবেষণা বিভাগ, আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম। ‘বৈশ্বিক পর্যালোচনা’ শীর্ষক লেকচার থেকে অনুলিখন করেছেন আসআদ শাহীন