পুলিশেও শুদ্ধি অভিযান

বাঙালী কন্ঠ ডেস্কঃ ঘুষ,দুর্নীতি, জোর করে টাকা আদায়, হয়রানি, প্রতারণা, যৌন হয়রানি, ধর্ষণসহ নানা অপরাধ বাড়ছে পুলিশের মধ্যে। চলমান ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির পর পুলিশের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আরও ব্যাপকভাবে উঠে আসছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ মাসে নানা অপরাধের অভিযোগে ১৪ হাজারের বেশি পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় জনগণের আস্থা অর্জনে নিয়মতান্ত্রিক এ বাহিনীর ভাবমূর্তি ফেরানোয় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে পুলিশ বাহিনীতেও শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ঢাকায় আট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) সরিয়ে নতুনদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সামনে এ ধরনের বদলি আরও ব্যাপকভাবেই হবে বলে দায়িত্বশীল সূত্রটি জানিয়েছে।

গত কয়েক বছরে পুলিশের দক্ষতা ও পেশাদারিত্বে ব্যাপক বদল ঘটেছে। বিশেষ করে ২০১৭ সালে হলি আর্টিজান ট্র্যাজেডির পর জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরিসরে প্রশংসিত হয়েছে বাংলাদেশের পুলিশ। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও পেশাগত দৃষ্টিভঙ্গির উৎকর্ষতায় অনেকটাই বদলে যাচ্ছে এ বাহিনী। অপরাধের তরিত্ব তদন্ত ও অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে নানা সময়ে নন্দিত হয়েছে পুলিশ সদস্যরা। কিন্তু আবার এ বাহিনীর সদস্যদের নানা অপকর্মে নিন্দিতও হতে হচ্ছে। দুর্নীতিগ্রস্ত ও অপরাধী পুলিশ সদস্যদের ভূমিকার কারণে সুশৃঙ্খল এ বাহিনী নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন যেমন উঠছে আবার ম্লান হয়ে উঠছে পুরো বাহিনীর অর্জন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন কোনো অপরাধ নেই যাতে পুলিশ সদস্যরা জড়াচ্ছেন না। অসৎ ও অপেশাদার সদস্যরা নিজেদের মধ্যে অপরাধের সিন্ডিকেট গড়ে তুলছে। ফলে অসহায় হয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষ। থানা-পুলিশ সাধারণ মানুষের কাছে আশ্রয়স্থল হওয়ার বদলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। পুলিশের কাছে অন্যায়ভাবে নিপীড়নের শিকার হয়ে দেশও ছেড়েছেন অনেকে। পুলিশ সদস্যদের ঘুষ, দুর্নীতি, জোর করে টাকা আদায়, ইয়াবা দিয়ে টাকা আদায়, হয়রানি, ধর্ষকের সঙ্গে আসামিকে বিয়ে দেওয়া, যৌন নিপীড়নের নানা খবর প্রতিনিয়তই গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে।

২০১৭ সালে সরকারের সেবা খাতের দুর্নীতি নিয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) একটি খানা জরিপ চালায়। ওই জরিপে দুর্নীতিতে শীর্ষ স্থান পায় পুলিশ। জরিপে উঠে আসে, পুলিশের কাছে সেবা নিতে গিয়ে ৭২.৫% খানা দুর্নীতি-অনিয়মের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছি। বছরে টাকার অঙ্কে যা দুই হাজার ১০০ কোটি টাকারও বেশি।

আসামি গ্রেফতার, ট্রাফিক সংক্রান্ত বিষয়, পাসপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশন, মামলা দায়ের, চার্জশিট এমনকি জিডি করতে গিয়ে ৭০ শতাংশেরও বেশি মানুষ দুর্নীতির শিকার হয়েছেন বলে উঠে আসে। সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় চার্জশিট সংক্রান্ত বিষয়ে। টাকার অঙ্কে যা গড়ে ২১ হাজার টাকারও বেশি। হাইওয়ে পুলিশ, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, থানা পুলিশসহ সব সংস্থাতেই কমবেশি দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে ওই জরিপে।

এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গণমাধ্যমে বলেছেন, জরিপ করতে গিয়ে তারা দেখেছেন পুলিশের মধ্যে দুর্নীতির ব্যাপ্তি ও গভীরতা অনেক। তিনি বলেন, ‘পর্যবেক্ষণে আমরা যেটা দেখতে পাই যে, এখন এমন কোনো অপরাধ নেই যাতে পুলিশ জড়িয়ে পড়ছে না। এটার ব্যপ্তি খুব গভীর, বিস্তৃত এবং সব পর্যায়ে। কেউ কেউ যেমন সততার দৃষ্টান্ত দেখাচ্ছেন, তাদের সংখ্যা কম আবার অবস্থানও দুর্বল হয়ে আসছে।’

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, একদিকে যেমন ব্যক্তিগতভাবে নৈতিক অবক্ষয়ের ঘটনা আছে। অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে পুলিশকে ব্যবহার করার যে প্রবণতা, সেখান থেকেও সমস্যা তৈরি হচ্ছে। পুলিশে দুর্নীতি এত বিস্তৃত হওয়ার কারণ এর সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগ। এর ফলে যেমন অনেকে জবাবদিহিতার বাইরে থাকার সুযোগ পান। আবার অনেকে রাজনৈতিকে উদ্দেশ্য সাধনে বাধ্য হওয়ার পর নিজেও ব্যক্তিগতভাবে অন্যান্য অপরাধে জড়িয়ে অর্থ উপার্জনের পথ ধরছেন।

তিনি মনে করেন, পুলিশ বাহিনীর মধ্যে যেমন দুর্নীতি-অনিয়ম-অপরাধের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক কারণে পুলিশকে অপরাধের দিকে ঠেলে দেওয়া বন্ধ করতে হবে।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত নানাস্তরের সদস্যদের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপরাধের একের পর এক ঘটনায় সুনাম নষ্ট হয়েছে পুরো বাহিনী। ঘুষকাণ্ডে ডিআইজি মিজান, নুসরাতের ঘটনায় ওসি মোয়াজ্জেম, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সম্পদ দখলে ডিসি মোহাম্মদ ইব্রাহিম খান, বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণে ওসি মাহমুদুল হক, থানা হেফাজতে ধর্ষণে ওসি ওসমান গনি পাঠান, ক্যাসিনোর নেপালি জুয়াড়িদের পালাতে সহায়তায় এএসআই গোলাম হোসেন মিঠু ও রমনা থানার কনস্টেবল দীপঙ্কর চাকমা, থানা হেফাজতে ধর্ষিতার সঙ্গে ধর্ষকের বিয়ের ঘটনায় ওসি ওবায়দুর রহমান ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন।

পুলিশের নাকের ডগায় দিনের পর দিন অবৈধভাবে ক্যাসিনো চললেও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় সমালোচনা আরও তীব্র হয়। অভিযুক্ত ফু-ওয়াং ক্লাবে অভিযানে পুলিশ কোনো অসামঞ্জস্য না পাওয়ার পর র‌্যাবের অভিযানে বিপুল পরিমাণ মদ মেলায় প্রশ্নও ওঠে পুলিশের অভিযানের স্বচ্ছতা নিয়ে। একপর্যায়ে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয় পুলিশকে। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, একই কাজ একটা বাহিনী করা ভালো। একটা কাজ যদি পাঁচজনকে ভাগ করে দেওয়া হয়, পাঁচজন পাঁচটা ফলাফল দেখাবে। এ কারণে র‌্যাবকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

সদস্যরা যাতে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অপরাধে না জড়ান সেজন্য পুলিশ সদর দফতর থেকে আর্থিক লেনদেন, ঘুষ, দুর্নীতি নিয়ে পুলিশ সদস্যদের সতর্ক করে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পুলিশের ‘নৈতিক স্খলনজনিত প্রসঙ্গে’ চিঠিটি ইস্যু করা হয়। চিঠিটি পুলিশের সব রেঞ্জ, মেট্রোপলিটন ও ইউনিটের ঊর্ধ্বতনদের কাছে পাঠানো হয়েছে।

চিঠিতে জানানো হয়েছে, সম্প্রতি বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তা-কর্মচারীর কর্মকাণ্ডে নৈতিক স্খলনের বিষয়টি পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা একটি ‘ডিসিপ্লিন ফোর্স’ হিসেবে বাংলাদেশ পুলিশের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন করে। অপরাধ চিহ্নিত ও দমন করাসহ জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করার ক্ষেত্রে পুলিশের প্রতিটি সদস্যকে নৈতিকতা, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে।

সদস্যদের অপরাধ ও অনিয়মে জড়িত হওয়া প্রসঙ্গে, পুলিশ সদর দফতর বলছে পুলিশের আড়াই লাখ সদস্যদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকই অপরাধে জড়াচ্ছেন। অভিযোগ পেলেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, গত ২০ মাসে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ১৪ হাজারেরও বেশি পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর