ঢাকা , শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই এখন জনগণের প্রধান দাবি

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ সুশাসনের জন্য নাগরিক’ (সুজন) দেশে গণতন্ত্রের জন্য আশাবাদ ব্যক্ত করতে পারেনি। সম্প্রতি ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সুজন ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাম্প্রতিক নির্বাচন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে গত সোমবার বলেছে, এ নির্বাচন ছিল নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন, আর নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে কখনও গণতন্ত্র জোরদার হতে পারে না। এ অবস্থা যদি বেশি দিন চলে তাহলে দেশে অশুভ শক্তির উত্থান হতে পারে, যা কিছুতেই গণতন্ত্রের নিরিখে কাম্য হতে পারে না।

গত সোমবার ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে ‘ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচন ২০২০: বিজয়ীদের তথ্য বিশ্লেষণ ও নির্বাচন মূল্যায়ন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে সুজনের সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ইসি যে ব্যর্থ তা সিটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবারো প্রমাণিত হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনে ইসির সদিচ্ছারও অভাব রয়েছে। ঢাকা সিটি নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি অনেক কমেছে, যা একটি অশনিসংকেত।

সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন ছিল ইসি এবং সরকারের জন্য একটি অগ্নি পরীক্ষা। তারা পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হতে পারেনি। জাতীয় নির্বাচনে দৃশ্যমান ছিল কারচুপি। এবার অদৃশ্য কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। যে অভিযোগগুলো এসেছে সেগুলোর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের সময় প্রেসিডেন্টকে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে কারচুপির তদন্তের আহ্বান জানিয়েছিল সুজন। এবারও তারা সেই দাবি জানাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, প্রতিটি সেক্টরে ব্যবসায়ী জনপ্রতিনিধিদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বেশি সম্পদশালীরা বেশি নির্বাচিত হচ্ছেন। রাজনীতির ব্যবসায়ীকরণ আর ব্যবসায়ের রাজনীতিকরণ চলছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ইসির বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ভোটের নামে জনগণকে অপমান করা হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পরাজয় মেনে নেবার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। না হলে ভালো নির্বাচন সম্ভব নয়। ইসি, বিচার ব্যবস্থা, সংসদ, দুর্নীতি দমন কমিশন, তথ্য কমিশন সব প্রতিষ্ঠান ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। কোনো প্রতিষ্ঠান মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন কেমন হলো তা জানতে নির্বাচনের পর সুজনের ফেসবুক পেজে একটি অনলাইন ভোটের (পুল) ব্যবস্থা করা হয়। সুজনের প্রশ্ন ছিল, ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে আপনি মনে করেন কি না? এতে ৪ হাজার ৩০০ জন অংশ নেয়। যারা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তাদের ৯৪ শতাংশ বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। যদিও অনলাইন ভোট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয়, তবুও এটি জনসাধারণের ধারণার অনেকটা ইঙ্গিত বহন করে।

মূলত ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে খুবই অল্প ভোট পড়েছে। উত্তর সিটিতে গড়ে ২৫.৩৪ শতাংশ এবং দক্ষিণে গড়ে ২৪.৭ শতাংশ ভোট পড়েছে। সুজন বলছে, এত কম ভোটার উপস্থিতির কারণ ভোট সুষ্ঠু হবে না, এ ধরনের পূর্ব ধারণা। স্বল্প ভোটার উপস্থিতির আরও বেশ কিছু কারণ তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, একটি প্রচার আছে যে, নির্বাচন ছিল শান্তিপূর্ণ। আমরা মনে করি, এই শান্তি অশান্তির চেয়েও ভয়াবহ। কেন না ভয়ের সংস্কৃতির কারণে জনগণ যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস না পায়, তবে সে অন্যায়ের প্রতিকার পাওয়া দুষ্কর। ব্যাপক অনিয়ম হওয়ার পরও যদি সেই নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়, তবে বুঝতে হবে, প্রতিপক্ষ এখানে চরম দুর্বল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ইসির সামনে তাদের সামর্থ্য প্রমাণের সুযোগ এসেছিল। কিন্তু ইসি সে সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। আর ইভিএম সম্পর্কে ভোটারদের মধ্যে যে উদ্বেগ ও আস্থাহীনতা ছিল, এই নির্বাচনের পর তা ইসির পক্ষে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। বরং সেগুলো আরও প্রকট হয়েছে।

নাগরিকদের মধ্যে এই উদ্বেগ ও আস্থাহীনতা দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ার ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনই ক্ষমতা বদলের একমাত্র বৈধ এবং শান্তিপূর্ণ পথ। একের পর এক নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের কারণে যদি ক্ষমতা হস্তান্তরের শান্তিপূর্ণ পথটি রুদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে আমরা এক অশুভ ভবিষ্যতের পথে ধাবিত হতে পারি। পাতানো নির্বাচনের সুযোগ নিয়ে অশুভ শক্তির উত্থানের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। আর তার দায় সরকার ও ইসিকেই নিতে হবে। সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খানের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত প্রতিবেদন পাঠ করেন সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার।

এবার এ সম্পর্কে অল্প কিছু কথা বলেই আমরা আজকের এ লেখার ইতি টানতে চাই। বর্তমানে যে রাজনৈতিক দলটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছে, সেই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল পাকিস্তান আমলে দেশের প্রথম সরকার বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে। পাকিস্তান আমলে যথাযথ ভূমিকা পালন করায় তারা পাকিস্তান আমলের সর্বশেষ নির্বাচনে ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়, প্রায় একচেটিয়া বিজয় লাভ করে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভিত্তি নির্বাচনের সুযোগ লাভ করে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনকারী রাজনৈতিক দল হিসাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিষ্ঠিত হবার পর তারা গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একমাত্র একটি সরকারি দল রেখে দেশে একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে জনগণকে অবাক করে দেয়। কারণ অতীতে তারাই পাকিস্তান আমলে দেশে প্রথম বিরোধী দল গঠন করে গণতন্ত্রের পথ সুগম করেছিল।

বাংলাদেশের জনগণ চিরকালই গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। এর প্রমাণ পাওয়া যায় সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতবর্ষের সর্বশেষ নির্বাচনেও। ১৯৪৬ সালে আজকের পাকিস্তানের কোন প্রদেশের নির্বাচনে পাকিস্তান-সমর্থক মুসলিম লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠনে সমর্থ না হলেও একমাত্র তদানীন্তন অবিভক্ত বঙ্গীয় প্রদেশে মুসলিম লীগ বিজয়ী হয়ে জনাব হোসেন শহীদ সোহরওয়ার্দীর নেতৃত্বে সরকার গঠন করে পাকিস্তান আন্দোলনের তথা তদানীন্তন মুসলিম লীগের নেতা কায়েদে আজমের হাতকে শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়।

এরপর ১৯৪৭ সালের সিলেটের গণভোটে মুসলিম লীগ বিজয়ী হওয়ার ফলে সিলেট জেলাও পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাঙ্গালী মুসলমানদের এত অধিক অবদান ছিল, স্বাভাবিকভাবে তার কাছে বাঙ্গালী মুসলমানের প্রত্যাশাও ছিল অনেক। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের একাধিক কেন্দ্রীয় রাজধানী, আর্মি, নেভী, এয়ার ফোর্স তথা সমগ্র প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদর দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত হওয়ায় পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের যাত্রা শুরুই করতে হয় অনেকটা হতাশ মন নিয়ে।
এর সাথে যুক্ত হয় আরও কিছু বিষয়। যেমন, সমগ্র পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ব বঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রদেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি এবং তাদের সবার মাতৃভাষা ছিল বাংলা। সেই বাংলাকে অবমূল্যায়ন করে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার এক গোপন চক্রান্ত শুরু হয় নবগঠিত রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে অবাঙ্গালী উর্দুভাষীদের সংখ্যাধিক্যের সুযোগে। এই ঘটনা ঘটে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হবার আগেই। দ্বিতীয়ত পাকিস্তান আন্দোলনের মূল ভিত্তি ২৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি স্বীকৃত থাকা সত্তে¡ও পাকিস্তানের একাধিক কেন্দ্রীয় রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত হওয়ায় পাকিস্তানের সমস্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।

স্বাভাবিকভাবেই এসবের বিরুদ্ধে একটা হতাশা নিয়ে যাত্রা শুরু করে পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। ১৯৭০ সালে সমগ্র পাকিস্তান একসাথে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমগ্র দেশের মধ্যে প্রধান দল হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পরও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে পাকিস্তানের তদানীন্তন সেনা প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সে ন্যায্য প্রত্যাশা অস্বীকার করে সামরিক শাসন চালু করলে এদেশের জনগণ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ঐতিহাসিক মুক্তি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাত্র নয় মাসের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।

এ মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের সাহায্য করতে এগিয়ে এলেও তাদের মনোভাব যে স্বাধীন শক্তিশালী বাংলাদেশ দেখা ছিল না, তার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবার পর ভারতীয় বাহিনীর কিছু অংশ বাংলাদেশে থেকে যাওয়া এবং তাদের কখন বাংলাদেশ থেকে অপসারণ করা হবে তাও না বলা থেকে।

এখানে উল্লেখযোগ্য, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগারে আটক ছিলেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর তিনি প্রথম পাকিস্তান থেকে লন্ডন যান এবং সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, ভারতীয় বাহিনীর একটি অংশ বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এ সম্পর্কে সাথে সাথে তাঁর ইতিকর্তব্যও তিনি ঠিক করে ফেলেন। লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফেরার পথে দিল্লী বিমানবন্দরে স্বল্পবিরতিকালে ভারতের তদানীন্তন প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসেন, ম্যাডাম, বাংলাদেশ থেকে আপনার বাহিনী কখন ফিরিয়ে আনবেন?

জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, আপনি যখন বলবেন, তখনই। ফলে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনী অপসারণ সহজ হয়ে পড়ে। এভাবেই একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের পথ চলা শুরু হওয়া সম্ভব হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশ আজ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী দেশে এখনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা স্থিতিশীল হতে পারেনি। এব্যাপারে সরকার যতশীঘ্র তার ইতিকর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়, ততই সমগ্র জাতির জন্য মঙ্গল।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই এখন জনগণের প্রধান দাবি

আপডেট টাইম : ০৯:০৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী ২০২০

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ সুশাসনের জন্য নাগরিক’ (সুজন) দেশে গণতন্ত্রের জন্য আশাবাদ ব্যক্ত করতে পারেনি। সম্প্রতি ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সুজন ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাম্প্রতিক নির্বাচন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে গত সোমবার বলেছে, এ নির্বাচন ছিল নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন, আর নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে কখনও গণতন্ত্র জোরদার হতে পারে না। এ অবস্থা যদি বেশি দিন চলে তাহলে দেশে অশুভ শক্তির উত্থান হতে পারে, যা কিছুতেই গণতন্ত্রের নিরিখে কাম্য হতে পারে না।

গত সোমবার ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে ‘ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচন ২০২০: বিজয়ীদের তথ্য বিশ্লেষণ ও নির্বাচন মূল্যায়ন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে সুজনের সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ইসি যে ব্যর্থ তা সিটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আবারো প্রমাণিত হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনে ইসির সদিচ্ছারও অভাব রয়েছে। ঢাকা সিটি নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি অনেক কমেছে, যা একটি অশনিসংকেত।

সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন ছিল ইসি এবং সরকারের জন্য একটি অগ্নি পরীক্ষা। তারা পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হতে পারেনি। জাতীয় নির্বাচনে দৃশ্যমান ছিল কারচুপি। এবার অদৃশ্য কারচুপির অভিযোগ উঠেছে। যে অভিযোগগুলো এসেছে সেগুলোর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের সময় প্রেসিডেন্টকে সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে কারচুপির তদন্তের আহ্বান জানিয়েছিল সুজন। এবারও তারা সেই দাবি জানাচ্ছে। তিনি আরো বলেন, প্রতিটি সেক্টরে ব্যবসায়ী জনপ্রতিনিধিদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বেশি সম্পদশালীরা বেশি নির্বাচিত হচ্ছেন। রাজনীতির ব্যবসায়ীকরণ আর ব্যবসায়ের রাজনীতিকরণ চলছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ইসির বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ভোটের নামে জনগণকে অপমান করা হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পরাজয় মেনে নেবার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। না হলে ভালো নির্বাচন সম্ভব নয়। ইসি, বিচার ব্যবস্থা, সংসদ, দুর্নীতি দমন কমিশন, তথ্য কমিশন সব প্রতিষ্ঠান ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। কোনো প্রতিষ্ঠান মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন কেমন হলো তা জানতে নির্বাচনের পর সুজনের ফেসবুক পেজে একটি অনলাইন ভোটের (পুল) ব্যবস্থা করা হয়। সুজনের প্রশ্ন ছিল, ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে আপনি মনে করেন কি না? এতে ৪ হাজার ৩০০ জন অংশ নেয়। যারা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তাদের ৯৪ শতাংশ বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। যদিও অনলাইন ভোট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি নয়, তবুও এটি জনসাধারণের ধারণার অনেকটা ইঙ্গিত বহন করে।

মূলত ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে খুবই অল্প ভোট পড়েছে। উত্তর সিটিতে গড়ে ২৫.৩৪ শতাংশ এবং দক্ষিণে গড়ে ২৪.৭ শতাংশ ভোট পড়েছে। সুজন বলছে, এত কম ভোটার উপস্থিতির কারণ ভোট সুষ্ঠু হবে না, এ ধরনের পূর্ব ধারণা। স্বল্প ভোটার উপস্থিতির আরও বেশ কিছু কারণ তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, একটি প্রচার আছে যে, নির্বাচন ছিল শান্তিপূর্ণ। আমরা মনে করি, এই শান্তি অশান্তির চেয়েও ভয়াবহ। কেন না ভয়ের সংস্কৃতির কারণে জনগণ যদি অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস না পায়, তবে সে অন্যায়ের প্রতিকার পাওয়া দুষ্কর। ব্যাপক অনিয়ম হওয়ার পরও যদি সেই নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়, তবে বুঝতে হবে, প্রতিপক্ষ এখানে চরম দুর্বল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ইসির সামনে তাদের সামর্থ্য প্রমাণের সুযোগ এসেছিল। কিন্তু ইসি সে সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। আর ইভিএম সম্পর্কে ভোটারদের মধ্যে যে উদ্বেগ ও আস্থাহীনতা ছিল, এই নির্বাচনের পর তা ইসির পক্ষে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। বরং সেগুলো আরও প্রকট হয়েছে।

নাগরিকদের মধ্যে এই উদ্বেগ ও আস্থাহীনতা দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ার ভয়াবহ ঝুঁকি তৈরি করেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনই ক্ষমতা বদলের একমাত্র বৈধ এবং শান্তিপূর্ণ পথ। একের পর এক নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের কারণে যদি ক্ষমতা হস্তান্তরের শান্তিপূর্ণ পথটি রুদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে আমরা এক অশুভ ভবিষ্যতের পথে ধাবিত হতে পারি। পাতানো নির্বাচনের সুযোগ নিয়ে অশুভ শক্তির উত্থানের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। আর তার দায় সরকার ও ইসিকেই নিতে হবে। সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খানের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত প্রতিবেদন পাঠ করেন সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার।

এবার এ সম্পর্কে অল্প কিছু কথা বলেই আমরা আজকের এ লেখার ইতি টানতে চাই। বর্তমানে যে রাজনৈতিক দলটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছে, সেই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল পাকিস্তান আমলে দেশের প্রথম সরকার বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে। পাকিস্তান আমলে যথাযথ ভূমিকা পালন করায় তারা পাকিস্তান আমলের সর্বশেষ নির্বাচনে ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়, প্রায় একচেটিয়া বিজয় লাভ করে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভিত্তি নির্বাচনের সুযোগ লাভ করে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠনকারী রাজনৈতিক দল হিসাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিষ্ঠিত হবার পর তারা গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একমাত্র একটি সরকারি দল রেখে দেশে একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে জনগণকে অবাক করে দেয়। কারণ অতীতে তারাই পাকিস্তান আমলে দেশে প্রথম বিরোধী দল গঠন করে গণতন্ত্রের পথ সুগম করেছিল।

বাংলাদেশের জনগণ চিরকালই গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। এর প্রমাণ পাওয়া যায় সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতবর্ষের সর্বশেষ নির্বাচনেও। ১৯৪৬ সালে আজকের পাকিস্তানের কোন প্রদেশের নির্বাচনে পাকিস্তান-সমর্থক মুসলিম লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠনে সমর্থ না হলেও একমাত্র তদানীন্তন অবিভক্ত বঙ্গীয় প্রদেশে মুসলিম লীগ বিজয়ী হয়ে জনাব হোসেন শহীদ সোহরওয়ার্দীর নেতৃত্বে সরকার গঠন করে পাকিস্তান আন্দোলনের তথা তদানীন্তন মুসলিম লীগের নেতা কায়েদে আজমের হাতকে শক্তিশালী করতে সক্ষম হয়।

এরপর ১৯৪৭ সালের সিলেটের গণভোটে মুসলিম লীগ বিজয়ী হওয়ার ফলে সিলেট জেলাও পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাঙ্গালী মুসলমানদের এত অধিক অবদান ছিল, স্বাভাবিকভাবে তার কাছে বাঙ্গালী মুসলমানের প্রত্যাশাও ছিল অনেক। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তানের একাধিক কেন্দ্রীয় রাজধানী, আর্মি, নেভী, এয়ার ফোর্স তথা সমগ্র প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদর দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত হওয়ায় পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের যাত্রা শুরুই করতে হয় অনেকটা হতাশ মন নিয়ে।
এর সাথে যুক্ত হয় আরও কিছু বিষয়। যেমন, সমগ্র পাকিস্তানের মধ্যে পূর্ব বঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রদেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি এবং তাদের সবার মাতৃভাষা ছিল বাংলা। সেই বাংলাকে অবমূল্যায়ন করে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার এক গোপন চক্রান্ত শুরু হয় নবগঠিত রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে অবাঙ্গালী উর্দুভাষীদের সংখ্যাধিক্যের সুযোগে। এই ঘটনা ঘটে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে কোনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হবার আগেই। দ্বিতীয়ত পাকিস্তান আন্দোলনের মূল ভিত্তি ২৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি স্বীকৃত থাকা সত্তে¡ও পাকিস্তানের একাধিক কেন্দ্রীয় রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত হওয়ায় পাকিস্তানের সমস্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।

স্বাভাবিকভাবেই এসবের বিরুদ্ধে একটা হতাশা নিয়ে যাত্রা শুরু করে পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ। ১৯৭০ সালে সমগ্র পাকিস্তান একসাথে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমগ্র দেশের মধ্যে প্রধান দল হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পরও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে পাকিস্তানের তদানীন্তন সেনা প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সে ন্যায্য প্রত্যাশা অস্বীকার করে সামরিক শাসন চালু করলে এদেশের জনগণ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ঐতিহাসিক মুক্তি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাত্র নয় মাসের মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।

এ মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের সাহায্য করতে এগিয়ে এলেও তাদের মনোভাব যে স্বাধীন শক্তিশালী বাংলাদেশ দেখা ছিল না, তার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবার পর ভারতীয় বাহিনীর কিছু অংশ বাংলাদেশে থেকে যাওয়া এবং তাদের কখন বাংলাদেশ থেকে অপসারণ করা হবে তাও না বলা থেকে।

এখানে উল্লেখযোগ্য, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগারে আটক ছিলেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর তিনি প্রথম পাকিস্তান থেকে লন্ডন যান এবং সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, ভারতীয় বাহিনীর একটি অংশ বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এ সম্পর্কে সাথে সাথে তাঁর ইতিকর্তব্যও তিনি ঠিক করে ফেলেন। লন্ডন থেকে বাংলাদেশে ফেরার পথে দিল্লী বিমানবন্দরে স্বল্পবিরতিকালে ভারতের তদানীন্তন প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সরাসরি প্রশ্ন করে বসেন, ম্যাডাম, বাংলাদেশ থেকে আপনার বাহিনী কখন ফিরিয়ে আনবেন?

জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, আপনি যখন বলবেন, তখনই। ফলে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় বাহিনী অপসারণ সহজ হয়ে পড়ে। এভাবেই একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের পথ চলা শুরু হওয়া সম্ভব হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশ আজ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হলেও জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী দেশে এখনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা স্থিতিশীল হতে পারেনি। এব্যাপারে সরকার যতশীঘ্র তার ইতিকর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়, ততই সমগ্র জাতির জন্য মঙ্গল।