ড. গোলসান আরা বেগমঃ মধুমতি নদীর তীরে টুঙ্গিপাড়া গাঁয়ে ১৯২০ সালে খোকা নামের ছেলেটির জন্ম হয়। তিনি ছিলেন বাবা শেখ লুৎফর রহমান মা সায়েরা বেগমের অত্যান্ত আদরের সন্তান। হেসে খেলে নদী জলে সাঁতার কেটে বেড়ে ওঠে ছেলেটির শিশু বেলা। আর দশটি ছেলের মতই ছিলো হামাগুড়ির শিশুকাল পেরিয়ে যৌবন ও তৎপরবর্তী জীবন। কে জানতো খোকা নামের ছেলেটির কপালে রাজটিকা আঁকা ছিলো।এই ছেলেটিই হয়ে ওঠবে হাজার বছরের শ্রেষ্ট্র বাঙালি? হবে অমর কাব্যের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু।
তিনি ছিলেন দুষ্ট প্রকৃতির,এক গুঁয়ে স্বভাবের। খেলাধুলা পছন্দ করতেন। ভালো গানও গাইতে পারতেন।দুরন্ত যুবকের যতগুলো গুনাবলি থাকা দরকার সবই ছিলো তার স্বভাব চরিত্রে। এক দল প্রিয় বন্ধু মহলকে ঘিরেই বেড়ে ওঠেছিলো তার শৈশব।তিনি ছোট বেলা থেকেই ছিলেন অতিশয় মানবিক।কেউ বৃষ্টিতে ভিজে আসছে তাঁর কাছে, তিনি নিজের ছাতাটাই দিয়ে দিলেন।আবার প্রচন্ড শীতে কাঁপছে এমন কাউকে নিজের গায়ের শীত বস্ত্র দিয়ে দেয়ার মানবীয় উদাহারণও রয়েছে।
গরীব ছেলেদের সাহায্য করার জন্য গোপালগঞ্জে একটা মুসলিম সেবা সমিতি গঠন করা হয়েছিলো।প্রতি রবিবার বন্ধুদের নিয়ে মুসলিম বাড়ী বাড়ী ঘুরে মুষ্ঠি ভিক্ষার চাল ওঠাতেন।এই চাল বিক্রি করে তিনি গরিব ছেলেদের বই, পরীক্ষা ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজে ব্যয় করতেন। সে সংগঠনের সম্পাদকের দায়িত্বও তরুন শেখ মুজিবুর রহমান পালন করতেন। যারা পৃথিবীতে ঐশ্বরিক মেধা নিয়ে জন্ম গ্রহন করেন, তাদের থাকে বহুমুখী প্রতিভার সমাহার। বঙ্গবন্ধুও ছিলেন পাহাড় সমান পরম সহিষ্ণু প্রতিভার অধিকারী।
কাজী আব্দুল হামিদ এমএসসি নামের একজন লজিং মাস্টার বঙ্গবন্ধুকে ছোট বেলায় পড়ানোর দায়িত্ব পালন করতেন। রাজনীতির বীজ শিশু খোকার মস্তিষ্কে তিনি গেঁথে দিয়েছিলেন। মাস্টার সাহেবের ঘরে ব্রিটিশ বিরুধী আন্দোলনের প্রখ্যাত নেতা সুভাস চন্দ্র বসু ও ক্ষুধিরামের ছবি ঝুলানো ছিলো। ঐ ছবি দেখিয়ে তাঁদের ত্যাগ তিতিক্ষাময় ইতিহাস তুলে ধরেন মাস্টার সাহেব পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বঙ্গবন্ধুর সামনে। এভাবেই রাজনীতির শস্যদানা শিশু মুজিবের চেতনায় যুক্ত হতে শুরু করেছিলো।
১৯৩৬ সালে গ্লূকোমা রুগে আক্রান্ত হলে দুইটি চোখের অপারেশন করা হয়।তখন চিকৎসকের পরামর্শে পড়ালেখা বন্ধ করে দিতে হয়। হাতে কাজ কাজ নেই কি আর করা, তিনি স্বদেশ আন্দোলনের সভা সমিতিতে গিয়ে ব্ক্তাদের আলোচনা শুনতেন।সে সময় থেকেই ইংরেজদের বিরুদ্বে নেতিবাচক চেতনা মনের গভীরে জন্ম নেয়।তিনি ভাবতে শুরু করেন ইংরেজদের এ দেশে থাকার অধিকার নেই।শিশু বয়সেই তিনি অনুভব করেন আমাদের স্বাধীনতা আনতে হবে।(বঙ্গবন্ধুর –অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ- ৯)।
বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছেন – আমার একটা দল ছিলো।কেউ কিছু বললে আর রক্ষা ছিলো না। মারপিট করতাম। মুষ্টি ভিক্ষার চাল দিতে না চাইলে রাতে তাদের বাড়িতে ইট নিক্ষেপ করতেন।তাঁর দলের ছেলেদের কেউ কিছু বললে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। মালেক নামের বন্ধুকে হিন্দু মহাসভার সভাপতি সুরেন ব্যানার্জি ধরে নিয়ে গিয়েছিলো।ঘটনা ক্রমে দাঙ্গা হাঙ্গামার ভয়ে ওখানে তিন জন পুলিশও হাজির হয়েছিলো।বঙ্গবন্ধু ঘটনাটি শুনার সাথে সাথে ওখানে ছুটে যান। তিনি বলতে থাকেন — ওকে ছেড়ে দেন,না হলে কেড়ে নিয়ে যাবো। এক কথায় দুই কথায় দুই পক্ষে ভীষণ মারপিট হয়। দরজা ভেঙ্গে তরুন মুজিব তাঁর বন্ধু মালেককে কেড়ে নিয়ে চলে আসেন।এখান থেকেই আন্দাজ করা যায় মুজিব কত সাহসি ছিলেন।
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে লুটপাট, মারামারি ও দাঙ্গাহাঙ্গামার মামলা হয়ে যায়।সে মামালায় মুজিব সহ বহু গন্যমান্য ব্যক্তির সন্তানকে আসামী করা হয়।
বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করতে গেলে তাঁর ফুফাত ভাই বলছিলো– মিয়া ভাই, পাশের বাসায় একটু সরে যাও না। শেখ মুজিব প্রতিউত্তরে বলছিলেন — যাব না।পালাবো না।লোকে বলবে আমি ভয় পেয়েছি। জীবনের শুরুতে এটাই ছিলো তাঁর প্রথম গ্রেফতারি পরোয়ানা।
এরপর বহুবার জেল হাজতে গিয়েছেন, দন্ডিত হয়েছেন। ভয় পাননি বা দমে যাননি।কারাগারের প্রতিটা ইট পাথরকেই সঙ্গী হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন। হায় সেলুকাস– বিনিময়ে কি পেয়েছিলেন?
তিনি গ্রেফতারি পরোয়ানা এড়িয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন, এমন নজির পাওয়া যায় না। বরং প্রায় সময় স্বেচ্ছায় ধরে দিয়েছেন, কথনও থানায় ফোন করে বলেছেন -আমি এখন বাসায় আছি, নিয়ে যেতে পারেন। বঙ্গবন্ধুকে যত বেশী দমন নির্যাতন করেছে তৎকালিন সরকার, ততবেশী আন্দোলনের গতিবেগ শক্তিশালী হয়েছিলো।রাজপথের লড়াই বিপ্লবে তীব্র থেকে তীব্রতর উষ্ণতা যুক্ত হয়েছিলো।
জয়বাংলা স্লোগানে, গণমানুষকে সঙ্গে নিয়ে, পথে পান্তরের ধূলিবালি ক্ষয় করেই হয়েছিলেন প্রঞ্জাবান জন দরদী রাজনৈতিক নেতা।৫৫ বছর দীর্ঘ জীবনে বঙ্গবন্ধু ১২ বছরই ছিলেন কারাবন্দি। তিনি হিমালয় সমান নেতৃত্ত্বের অধিকারী হয়েছিলো বহু ত্যাগ তিতিক্ষা, শ্রম ঘাম পরিশেষে জীবনের বিনিময়ে। এ ভাবেই রাষ্ট্র নায়ক, বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা, বিশ্ববন্ধুর খ্যাতি মর্যাদা অর্জন করেছেন।
বন্ধু মালেককে পুলিশের সামনে দরজা ভেঙ্গে উদ্ধার করার বিষয়টি নিয়ে মামলা হলে মুজিবকে গ্রেফতার করে কোর্টে তোলে।মুজিব খুব ভয়ানক ছেলে– এই অজুহাত দেখিয়ে সে মামলার জামিন আবেদন না মন্জুর করে জেল হাজতে প্রেরণ করে।এর পর বাদী বিবাদীদের মধ্য চলে দফায় দফায় মিটিং আলোচনা। পরিশেষে সিদ্ধান্ত হয় বাদীরা মামলা পরিচালনা করবে না। তবে তাদেরকে পনের শত টাকা ক্ষতিপুরণ দিতে হবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক সাত দিন কারাগারে বন্দি থেকে জামিনে মুক্তি পান।তার সঙ্গী সাথীরাও সে মামলা থেকে রেহাই পায়। এর পর পড়ালেখার জগতে ফিরে যান।
কিন্তু রাজনীতির পোকাটি মুজিবকে তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে। কে জানতো টুঙ্গিপাড়ার খোকা নামক ছেলেটির কপালের ভাঁজে রাজটিকা আঁকা আছে।বহু ঘাত প্রতিঘাত অত্রিক্রম করে শেখ মুজিবুর রহমান হবেন ইতিহাসের পুর্নাঙ্গ অংশ। বাংলাদেশের জন্ম দাতা। বাংলার মাটি হবে বঙ্গবন্ধুর বুক। পদ্মা মেঘনার অববাহিকার রুপালি চাঁদ বার বার নবায়িত করবে বঙ্গবন্ধুর চেতনা ও আর্দশকে। ইতিহাস জুড়ে লিখা হবে- বাংলাদেশের ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে আঁকা ছবি বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ।
লেখকঃ অধ্যক্ষ ড. গোলসান আরা বেগম।
কবি,কলামিস্ট,সিনেট সদস্য(জাবি).