আজ রমজান পূর্ব মাস শাবানের শেষদিন। সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যাবে মাহে রমজান। এশার পরে শুরু হবে রমজানের বিশেষ নামাজ তারাবি। মসজিদে মসজিদে ধ্বনিত হবে আসমানী গ্রন্থ আল-কুরআনের সুমধুর সুর। রমজান এক বিশেষ অতিথি। এমন অতিথি যার আগমনে সাড়া পড়ে যায় জমিনে ও আসমানে! ধূলির ধরায় এবং ঊর্ধ্বজগতে। আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায় সমগ্র সৃষ্টি জগতে!
আল্লাহর হাবিবের মুখেই শুনুন সে কথা- ‘যখন রমজানের প্রথম রাত আগমন করে শয়তান ও অবাধ্য জিনদের শৃঙ্খলিত করা হয়। জাহান্নামের সব দরোজা বন্ধ করে দেয়া হয়; খোলা রাখা হয় না কোনো দ্বার। জান্নাতের দুয়ারগুলো অর্গলমুক্ত করে দেয়া হয়; বদ্ধ রাখা হয় না কোনো তোরণ। এদিকে একজন ঘোষক ঘোষণা করেন, ‘হে পুণ্যের অনুগামী, অগ্রসর হও। হে মন্দ-পথযাত্রী থেমে যাও’।
রমজানের প্রতি রাতে আল্লাহ বহু বান্দাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন। আর এমনটি করা হয় রমযানের প্রতি রাতেই।’ (তিরমিজি, হাদিস নং ৬৮২)।
বাড়িতে কোনো বিশেষ মেহমান আসার তারিখ থাকলে আমরা পূর্ব থেকেই নানা প্রস্তুতি নেই। ঘর-দোর পরিষ্কার করি। বিছানাপত্র সাফ-সুতরো করি। পরিপাটি করি বাড়ির পরিবেশ। নিশ্চিত করি মেহমানের যথাযথ সম্মান ও সন্তুষ্টি রক্ষার সার্বিক ব্যবস্থা। তারপর অপেক্ষা করতে থাকি মেহমানকে সসম্মানে বরণ করে নিতে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই রমজান আসার পূর্ব থেকেই এর জন্য প্রস্তুতি নিতেন। শাবান মাসে অধিকহারে নফল রোজা পালনের মাধ্যমে তিনি রমজানে সিয়াম সাধনার আগাম প্রস্তুতি নিতেন। পূর্বানুশীলন করতেন। দুমাস আগে থেকে তিনি দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি আমাদের রজব ও শাবানে বরকত দিন আর পৌঁছে দিন রমজানে।’
এমন অধীর অপেক্ষা আর কাতর প্রতীক্ষার পর যখন রমজানের পহেলা রাতের আবির্ভাব হত, নবীজির চেহারায় আনন্দের দীপ্তি ফুটে উঠত। খুশিতে তিনি সাহাবিদেরকে রমজানের শুভাগমনের সুসংবাদ দিতেন। তাদেরকে শোনাতেন রমজানের ফজিলতের কথা। তারা যেন রমজানে ইবাদত-বন্দেগিতে বেশি করে আত্মনিয়োগ করতে পারেন। নেকি অর্জনে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে প্রত্যয়ী হন।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সঙ্গী-সাথীদের এ মর্মে সুসংবাদ শোনাতেন, ‘‘তোমাদের সমীপে রমজান মাস এসেছে। এটি এক মোবারক মাস। আল্লাহ তা’আলা তোমাদের ওপর এ মাসের সিয়াম সাধনা ফরজ করেছেন। এতে জান্নাতের দ্বার খোলা হয়। বন্ধ রাখা হয় জাহান্নামের দরজা। শয়তানকে বাঁধা হয় শেকলে। এ মাসে একটি রজনী রয়েছে যা সহস্র মাস থেকে উত্তম। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো সে যেন যাবতীয় কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হলো।’’ (সুনান নাসাঈ, হাদীস নং ২৪২৭)।
তাই আমাদের কর্তব্য হবে, এ মাস আসার আগেই এর যথার্থ মূল্যায়নের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা। নীরবে এসে নীরবে চলে যাওয়ার আগেই এ মহান অতিথির যথাযথ সমাদর করা। এ মাস যেন আমাদের বিপক্ষে আল্লাহর কাছে নালিশ না করতে পারে তা নিশ্চিত করা। কারণ, মাসটি পেয়েও যে এর উপযুক্ত মূল্য দেবে না, বেশি বেশি পুণ্য আহরণ করতে পারবে না, পরোয়ানা পেল না জান্নাত লাভ ও জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের, সে বড় হতভাগ্য।
সবচেয়ে উদ্বেগের ব্যাপার হলো এমন ব্যক্তি আল্লাহর নিষ্পাপ ফেরেশতা এবং স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বদ-দো’আর অধিকারী। এমন ব্যক্তির ওপর জিবরীল আলাইহিস সালাম লা’নত করেছেন আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সঙ্গে ‘আমীন’ বলেছেন!
হাদীসে এসেছে, আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা মিম্বরে আরোহণ করলেন। অতপর বললেন, আমীন, আমীন আমীন। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল, এটা আপনি কী করলেন? তিনি বললেন, জিবরীল আমাকে বললেন, ওই ব্যক্তির নাক ধূলিধুসরিত হোক যার সামনে রমজান প্রবেশ করলো অথচ তাকে ক্ষমা করা হলো না।
আমি শুনে বললাম, আমীন (আল্লাহ কবুল করুন)। এরপর তিনি বললেন, ওই ব্যক্তির নাক ধূলিধুসরিত হোক যার সামনে আপনার কথা আলোচিত হয় তথাপি সে আপনার ওপর দরূদ পড়ে না। তখন আমি বললাম, আমীন (আল্লাহ কবুল করুন)। অতপর তিনি বললেন, ওই ব্যক্তির নাক ধূলিধুসরিত হোক যে তার পিতামাতা বা তাঁদের একজনকে জীবিত পেল অথচ সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারলো না। তখন আমি বললাম, আমীন (আল্লাহ কবূল করুন)।’ (আল-আদাবুল মুফরাদ, হাদীস নং ৬৪৬)।
রমজানকে স্বাগত জানানোর ক্ষেত্রে সুন্নাত হলো, রমজানের চাঁদ দেখে নিম্নের দো’আটি পাঠ করা। আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন চাঁদ দেখতেন, তিনি বলতেন, (উচ্চারণ 🙂 ‘আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিন ইউমনি ওয়াল-ঈমান ওয়াস-সালামাতি ওয়াল-ইসলাম, রাব্বী ওয়া রব্বুকাল্লাহ’। অর্থাৎ, ‘হে আল্লাহ আপনি একে আমাদের ওপর বরকত ও ঈমানের সঙ্গে এবং সুস্থতা ও ইসলামের সঙ্গে উদিত করুন, তোমার এবং আমার রব হলেন আল্লাহ।’ (তিরমিজি, হাদীস নং ৩৪৫১)।
রমজানকে স্বাগত জানানোর দ্বিতীয় উপায়, একে সকল গুনাহ থেকে বিশেষ তাওবার সঙ্গে গ্রহণ করা। কারণ, এটা তাওবারই মৌসুম। এ মাসে তাওবা না করলে তাওবা করবেন কবে? অতপর রমজানকে স্বাগত জানানো কর্তব্য ইবাদতে দ্বিগুণ চেষ্টা, দান-সাদাকা, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির-ইস্তেগফার এবং অন্যান্য নেক আমল অধিক পরিমাণে করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে এবং এ দো’আর মাধ্যমে- হে আল্লাহ, আমাদেরকে তোমার সন্তুষ্টি মত রোজা রাখা এবং তারাবি আদায়ের তাওফীক দাও।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমান ও নেকী প্রত্যাশার সঙ্গে রমজানে সিয়াম সাধনা করবে, আল্লাহ তার সমুদয় অতীত গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (বুখারি, হাদিস নং ৩৮) তারাবির ফজিলত সম্পর্কেও একই বর্ণনাকারী থেকে একই হাদিসগ্রন্থে অভিন্ন ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।
তাই আসুন আমরা এ মহান অতিথিকে বরণ করে নিয়ে এ মাসের দিন-রাতগুলো এমন সব আমলের মধ্য দিয়ে কাটানোর প্রত্যয় গ্রহণ করি যা আমাদেরকে আল্লাহ তা’আলার প্রিয় করে তুলবে। আমরা যেন সেসব লোকের দলে অন্তর্ভুক্ত না হই যারা কেবল রসনা তৃপ্তির রকমারি আয়োজন ও নামাজ বরবাদ করার মাধ্যমে রমজানকে স্বাগত জানায়।
আমরা তাদের মধ্যেও যেন অন্তর্ভুক্ত না হই যারা রমজান পাওয়ার পরও আল্লাহর কাছে মাগফিরাত না পেয়ে নিজেকে আল্লাহর ফিরিশতা ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বদ-দো’আর যোগ্য বানায়। আল্লাহ তা’আলা আমাদের কবুল করুন। আমীন।