বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ দায়িত্বে অবহেলার পরিণাম কী ভয়াবহ আর মর্মান্তিক হতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ জয়পুরহাটে রেলের ধাক্কায় বাসের ১২ যাত্রীর প্রাণহানির ঘটনাটি। শনিবার সকালে ঘটেছে এ দুর্ঘটনা। জয়পুরহাট থেকে ছেড়ে আসা একটি বাস হিলি স্থলবন্দরের দিকে যাচ্ছিল। জয়পুরহাট সদর উপজেলার পুরানাপৈল রেলগেট অতিক্রম করার সময় গেটম্যান বার না ফেলার কারণে বাসটি রেললাইনের উপর উঠে যায়। সেসময় রাজশাহীগামী উত্তরা এক্সপ্রেস ট্রেন বাসটিকে সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে ট্রেনটি রেললাইন ধরে বাসটিকে প্রায় আধা কিলোমিটার টেনে নিয়ে যায়। এতে বাসে থাকা ১০ জন যাত্রী ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আহত হন আরও পাঁচজন।
এটিকে ‘দুর্ঘটনা’ না বলে ‘হত্যাকাণ্ড’ বলাই হবে যথাযথ। গেটম্যান দায়িত্বশীল হলে এ ঘটনা যে এড়ানো যেত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। জয়পুরহাটে বাস ও ট্রেনের সংঘর্ষের সময় লেভেল ক্রসিংয়ের গেট খোলা ছিল। আর ঘুমিয়েছিলেন গেটম্যান। জয়পুরহাটের পুলিশ সুপার গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এই একজনের ঘুমের কারণে কতজনকে চিরতরে ঘুমিয়ে যেতে হল? কে নেবে এই মর্মন্তুদ মৃত্যুর দায়? উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে-গেটম্যানের দায়িত্বে অবহেলার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগেও অবহেলাজনিত কারণে ঘটে গেছে অনেক দুর্ঘটনা। এবং তাতে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম নয়।
রেল দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। কোনোভাবেই যেন এই অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং, অপরিকল্পিত ও অননুমোদিত সংযোগ সড়ক এবং সচেতনতার অভাবে অকাতরে প্রাণ যাচ্ছে। গত আড়াই বছরে দেশে রেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন আট শতাধিক। আহত ও পঙ্গু হয়েছেন আরও ছয় শতাধিক। রেলওয়ে পুলিশের হিসাবমতে মৃতের সংখ্যা ৭০০। বাংলাদেশ রেলওয়ে পুলিশের (জিআরপি) কমলাপুর থানা সূত্রমতে, রেল দুর্ঘটনায় গত বছর জানুয়ারি থেকে ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত মারা গেছেন ১০৩ জন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২৫, মার্চে ২৩ ও এপ্রিলে ২২ জন মারা যান।
রেল দুর্ঘটনার জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর অব্যবস্থাপনাও দায়ী। রেলওয়ের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিন কারণে রেল দুর্ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে লেভেল ক্রসিং দুর্ঘটনা, সিগন্যাল লাইনে ত্রুটি এবং উন্নয়ন কাজ চলা অবস্থায় ট্রেন লুপ লাইন কিংবা সাইড লাইনে চলে গিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। রেল যোগাযোগ অনেকটা সাশ্রয়ী ও নিরাপদ হওয়ায় সাধারণ মানুষ রেলে যাতায়াত করে থাকেন বেশি। সরকারও রেলের প্রভূত উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। মেট্রো রেলের যুগেও প্রবেশ করতে যাচ্ছে দেশ। ভবিষ্যতে রেলপথও বাড়বে। কিন্তু সে তুলনায় নিরাপদ হয়নি রেল যোগাযোগ। রেলপথের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। এমনিতে রেলপথের একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে সাধারণের প্রবেশ আইনত দণ্ডনীয়। কিন্তু এ আইন বাংলাদেশের মতো দেশে মেনে চলা হয় কি?
সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে লেভেল ক্রসিং। দেশের ২ হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার রেলপথে প্রায় ২ হাজার ৫৪১টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর বেশির ভাগেই কোনো গেট নেই। কোনো সংকেতবাতি দূরের কথা, নেই যান নিয়ন্ত্রণের কোনো কর্মী। নিয়ম অনুযায়ী কোনো রেললাইনের উপর দিয়ে সড়ক নিয়ে যেতে হলে গেট নির্মাণ, কর্মী নিয়োগসহ আনুষঙ্গিক সব স্থাপনা নির্মাণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সেবা সংস্থার। কিন্তু এসব দেখার যেন কেউ নেই!
২.
অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনাও থেমে নেই। প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে ঘটছে দুর্ঘটনা। তাতে প্রাণহানিও হচ্ছে। অনেক জীবন ক্ষয়ের পরও নিরাপদ হয়নি সড়ক। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু শুধু একটি পরিবারে গভীর শোক, ক্ষত সৃষ্টি করে না, আর্থিকভাবেও পঙ্গু করে ফেলে ওই পরিবারকে। কোনো কোনো দুর্ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি প্রাণ হারান। তখন ওই পরিবারের কী অবস্থা হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর যারা পঙ্গুত্ব বরণ করে, তাদের পরিবারের অবস্থা হয় আরও করুণ, আরও শোচনীয়। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার ফলে বছরে গড়ে দেশের জিডিপির শতকরা দেড় ভাগ নষ্ট হয়, যার অঙ্ক ৫ হাজার কোটি টাকা। বিগত ১৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৫৫ হাজার মানুষ। আর দুর্ঘটনাজনিত মামলা হয়েছে প্রায় ৭৭ হাজার। এসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা এখন অন্যতম জাতীয় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সঙ্গত কারণেই এ সমস্যা থেকে মানুষকে মুক্ত রাখার সার্বিক পদক্ষেপ গ্রহণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া জরুরি।
দুর্ঘটনার কারণগুলো সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সবাই কমবেশি জানেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, দেশে সড়ক অবকাঠামো এবং স্থলভাগের আয়তন অনুপাতে জনসংখ্যার চাপ বেশি, সড়কের তুলনায় মোটরযানের সংখ্যা অনেক বেশি, একই সড়কে বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, রিকশাসহ নানারকম যানবাহন চলাচল, উপরন্তু সড়ক ও মহাসড়কগুলো ত্রুটিপূর্ণ থাকা। দেশব্যাপী মহাসড়কের অনেক স্থানেই রয়েছে বিপজ্জনক বাঁক। এসব বাঁকের কারণে প্রায়ই সেসব জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটছে। এছাড়া অবকাঠামোগত কারণেও দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি ও ঝুঁকি খুব বেশি বলে মনে করেন অনেক বিশেষজ্ঞ। সম্প্রতি দুর্ঘটনা মহামারীর আকার ধারণ করার জন্য যেসব কারণকে দায়ী করা হচ্ছে, এর মধ্যে অন্যতম হল-চালকের অসতর্কতা ও বেপরোয়া গাড়ি চালনা। এ সমস্যা বারবার চিহ্নিত হলেও এর কোনো প্রতিকার নেই।
প্রতিবার দুর্ঘটনার পরপরই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই তদন্ত প্রতিবেদন কোনোদিন আলোর মুখ দেখে না। আর সঙ্গত কারণেই দোষীদের শাস্তিও হয় না। সমাজের উঁচু স্তর থেকে নিচু শ্রেণির মানুষ, যারাই দুর্ঘটনার শিকার হন না কেন, কোনো একটি ঘটনার বিচার হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত মেলা ভার। আর বিচারহীন, প্রতিকারহীন অবস্থায় কোনো কিছু চলতে থাকলে সেটির পুনরাবৃত্তি তো ঘটবেই। প্রশ্ন হচ্ছে, কত প্রাণ গেলে, মৃত্যুর মিছিল কত দীর্ঘ হলে থামবে এই হত্যাযজ্ঞ?
৩.
বাংলাদেশ প্রবেশ করতে যাচ্ছে মেট্রো রেলের যুগে। কিন্তু বিদ্যমান রেল যোগাযোগ নিরাপদ না হলে এটি এক বড় দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সর্বশেষ শনিবারের রেল দুর্ঘটনায় ১২ জন মারা গেছেন। নিহতের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে। আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখে কারও কোনো অবহেলা থাকলে সে অনুযায়ী দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। রেল যোগাযোগ নিরাপদ করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালাতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ভালো যানবাহন, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চালক, সড়কব্যবস্থা উন্নতকরণ, সিগন্যালিং ব্যবস্থা আধুনিক ও যুগোপযোগী করার বিষয়গুলোয় নজর দিতে হবে। এর সঙ্গে দুর্ঘটনায় পতিতদের দ্রুত চিকিৎসা পাওয়ার বিষয়টিও অত্যন্ত জরুরি। অনেক সময় আইনি জটিলতার কারণে আহতদের চিকিৎসা দিতে সমস্যা হয়। এ সমস্যার সমাধানেও নিতে হবে ব্যবস্থা। আমরা চাই নিরাপদ রেলপথ, সড়কপথসহ সব ধরনের যোগাযোগে যাত্রী নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক।
ড. হারুন রশীদ : সাংবাদিক, কলামিস্ট