ঢাকা , শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনটি অক্ষত থাকুক

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ পৃথিবীর বিবর্তনে সবচেয়ে শক্তিশালী অলিখিত ইতিহাস হচ্ছে স্থাপত্য। অনেক ক্ষেত্রে আমরা বইয়ের পাতায় যে ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা পাই, তা হয়তো হারিয়েও যেতে পারে; কিন্তু ইট-চুন-সুরকিতে লেখা ইতিহাস সহজে হারায় না। সভ্যতার প্রয়োজনে তারা কথা বলে ওঠে। এর সত্যতা জানতে বহুদূরে যাওয়ার দরকার নেই, পাহাড়পুর বা ময়নামতীতেই তা আমরা খুঁজে পাব। পানাম নগরীর ইতিহাস বই খুলে না পড়লেও এর সরু রাস্তা ধরে হেঁটে গেলেই যে কেউ শুনতে পাবে এ নগরীর গল্প। এই মাটি, এই দেশ কী বুঝতে হলে এর ক্রমবিকাশ, ঐতিহ্যের ধারা, স্বকীয়তার টানাপোড়েন, জাতি হিসেবে চারিত্রিক গুণাবলি আর রুচি বুঝতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে আমরা কতটুকু এগিয়েছি তা বুঝতে হলেও এই অলিখিত ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরাতে হয়। তাই তো আমরা গর্ব করে বলতে পারি, এ স্থাপনা বাংলাদেশি স্থাপনা।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) ভেঙে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়ার খবর এসেছে গণমাধ্যমে। এ স্থাপনাটিকে বোঝা দরকার এর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও জাতীয় চেতনার মাপকাঠিতে। এর পূর্বদিকে রয়েছে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান, যা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান-বাংলার প্রাণের একুশে গ্রন্থমেলার অনবদ্য ঠিকানা। দক্ষিণে বাংলা একাডেমি, আরও দক্ষিণে মোগল স্থাপনা; ঢাকার প্রবেশদ্বারখ্যাত মির জুমলার তোরণ বা রমনা গেট, যার উল্টো পাশে তিন নেতার মাজার। কিছুদূর গেলেই দোয়েল চত্বর, যাকে ঘিরে আছে শিশু একাডেমি আর কার্জন হল। কার্জন হল থেকে পশ্চিমে শহীদ মিনার। আর টিএসসির উত্তরে আছে শাহবাগ। এবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন-এ সবকিছুর নিউক্লিয়াস হল এই টিএসসি। নাগরিক মননে এ স্থাপনা যে অবয়ব তৈরি করে রেখেছে, তা বহুদিনের। এই সম্পর্ক আত্মার, যা স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও সবার কাছে একরকম। এই ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো যে সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করেছে, তা এ রাষ্ট্রের অলিখিত ইতিহাস, একদিন আমরা না থাকলেও স্থাপনাগুলোই আমাদের ঐতিহ্যের কথা বলবে। এবার আসি এই স্থাপনার নির্মাণশৈলীতে, যার মূল ভবন নকশা করেন গ্রিক স্থপতি কন্সটেন্টিনোস এপোস্তলো ডক্সিয়াডিস। একটি অভ্যন্তরীণ উঠানকে কেন্দ্র করে তৈরি এই নকশা। ঢুকতেই যে ভবন, তাতে ‘বাটারফ্লাই ক্যানপি’ দেখতে পাওয়া যায়, যা আসলে ছাদের কাঠামোকে অনেকটা প্রজাপতির পাখার মতো করে তুলেছে। এর ভেতরে গেলে পাওয়া যাবে ছাত্রসংগঠনগুলোর মূল কক্ষ, পাঠাগার, অডিটোরিয়াম, খাবারের জায়গা, খেলার জন্য নির্ধারিত কক্ষ, সুইমিংপুলসহ আরও কিছু সুবিধা সংবলিত কক্ষ। অডিটোরিয়ামের ছাদ অর্ধবৃত্তাকার বা প্যারাবলিক ভল্ট আকারে তৈরি। এ ছাদের নির্মাণশৈলী এখনও অনুকরণীয়। ভবনে জালির ব্যবহার যেমন আলো-বাতাস ঢুকতে দিচ্ছে, তেমনি অভ্যন্তরীণ পরিসরকে আড়ালও দিচ্ছে। চত্বরের সবগুলো ভবন স্টিলের কলামে তৈরি করিডর দিয়ে সংযুক্ত, যা করিডরের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিয়েছে। সর্বোপরি বাইরের সঙ্গে দৃশ্যত যে যোগাযোগ তা অটুট রেখেছে। উঠানের দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় আছে দেশের একমাত্র গ্রিক স্থাপনা, চৌকো একটি সমাধি, নির্মাণশৈলীতে গ্রিক স্থাপত্যের ছাপ সুস্পষ্ট। আর আছে দুটো শিবমন্দির। সব স্থাপনা যে সাম্য আর সামঞ্জস্যে একে অপরকে ধারণ করেছে, তা এখনও আমাদের কাছে একটা ধাঁধার মতো। কেউ যদি একবার ভেতরে ঢোকে, যেন নতুন আরেকটা শহর খুঁজে পাবে।

আমরা অবশ্যই উন্নয়ন চাই, তবে ইতিহাস বিসর্জন দিয়ে নয়। আমরা কি এতই নির্বোধ হয়ে গেছি যে ইতিহাস, শহরের গল্প, নাগরিক মনন বিসর্জন দিয়ে এমন একটা স্থাপনা ভেঙে ফেলব? আমি বিশ্বাস করি, কয়েকজন জ্ঞানী-গুণী মানুষ একত্রে বসে টিএসসি ভবন অক্ষুণ্ন রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসর বৃদ্ধির একটা সময়োপযোগী সমাধান বের করতে পারেন। আমরা সেই অপেক্ষায় থাকলাম।

অমিত ইমতিয়াজ : স্থপতি; সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনটি অক্ষত থাকুক

আপডেট টাইম : ০৪:৫২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২০

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ পৃথিবীর বিবর্তনে সবচেয়ে শক্তিশালী অলিখিত ইতিহাস হচ্ছে স্থাপত্য। অনেক ক্ষেত্রে আমরা বইয়ের পাতায় যে ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা পাই, তা হয়তো হারিয়েও যেতে পারে; কিন্তু ইট-চুন-সুরকিতে লেখা ইতিহাস সহজে হারায় না। সভ্যতার প্রয়োজনে তারা কথা বলে ওঠে। এর সত্যতা জানতে বহুদূরে যাওয়ার দরকার নেই, পাহাড়পুর বা ময়নামতীতেই তা আমরা খুঁজে পাব। পানাম নগরীর ইতিহাস বই খুলে না পড়লেও এর সরু রাস্তা ধরে হেঁটে গেলেই যে কেউ শুনতে পাবে এ নগরীর গল্প। এই মাটি, এই দেশ কী বুঝতে হলে এর ক্রমবিকাশ, ঐতিহ্যের ধারা, স্বকীয়তার টানাপোড়েন, জাতি হিসেবে চারিত্রিক গুণাবলি আর রুচি বুঝতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে আমরা কতটুকু এগিয়েছি তা বুঝতে হলেও এই অলিখিত ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরাতে হয়। তাই তো আমরা গর্ব করে বলতে পারি, এ স্থাপনা বাংলাদেশি স্থাপনা।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) ভেঙে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়ার খবর এসেছে গণমাধ্যমে। এ স্থাপনাটিকে বোঝা দরকার এর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও জাতীয় চেতনার মাপকাঠিতে। এর পূর্বদিকে রয়েছে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান, যা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যান-বাংলার প্রাণের একুশে গ্রন্থমেলার অনবদ্য ঠিকানা। দক্ষিণে বাংলা একাডেমি, আরও দক্ষিণে মোগল স্থাপনা; ঢাকার প্রবেশদ্বারখ্যাত মির জুমলার তোরণ বা রমনা গেট, যার উল্টো পাশে তিন নেতার মাজার। কিছুদূর গেলেই দোয়েল চত্বর, যাকে ঘিরে আছে শিশু একাডেমি আর কার্জন হল। কার্জন হল থেকে পশ্চিমে শহীদ মিনার। আর টিএসসির উত্তরে আছে শাহবাগ। এবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন-এ সবকিছুর নিউক্লিয়াস হল এই টিএসসি। নাগরিক মননে এ স্থাপনা যে অবয়ব তৈরি করে রেখেছে, তা বহুদিনের। এই সম্পর্ক আত্মার, যা স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও সবার কাছে একরকম। এই ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো যে সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করেছে, তা এ রাষ্ট্রের অলিখিত ইতিহাস, একদিন আমরা না থাকলেও স্থাপনাগুলোই আমাদের ঐতিহ্যের কথা বলবে। এবার আসি এই স্থাপনার নির্মাণশৈলীতে, যার মূল ভবন নকশা করেন গ্রিক স্থপতি কন্সটেন্টিনোস এপোস্তলো ডক্সিয়াডিস। একটি অভ্যন্তরীণ উঠানকে কেন্দ্র করে তৈরি এই নকশা। ঢুকতেই যে ভবন, তাতে ‘বাটারফ্লাই ক্যানপি’ দেখতে পাওয়া যায়, যা আসলে ছাদের কাঠামোকে অনেকটা প্রজাপতির পাখার মতো করে তুলেছে। এর ভেতরে গেলে পাওয়া যাবে ছাত্রসংগঠনগুলোর মূল কক্ষ, পাঠাগার, অডিটোরিয়াম, খাবারের জায়গা, খেলার জন্য নির্ধারিত কক্ষ, সুইমিংপুলসহ আরও কিছু সুবিধা সংবলিত কক্ষ। অডিটোরিয়ামের ছাদ অর্ধবৃত্তাকার বা প্যারাবলিক ভল্ট আকারে তৈরি। এ ছাদের নির্মাণশৈলী এখনও অনুকরণীয়। ভবনে জালির ব্যবহার যেমন আলো-বাতাস ঢুকতে দিচ্ছে, তেমনি অভ্যন্তরীণ পরিসরকে আড়ালও দিচ্ছে। চত্বরের সবগুলো ভবন স্টিলের কলামে তৈরি করিডর দিয়ে সংযুক্ত, যা করিডরের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিয়েছে। সর্বোপরি বাইরের সঙ্গে দৃশ্যত যে যোগাযোগ তা অটুট রেখেছে। উঠানের দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় আছে দেশের একমাত্র গ্রিক স্থাপনা, চৌকো একটি সমাধি, নির্মাণশৈলীতে গ্রিক স্থাপত্যের ছাপ সুস্পষ্ট। আর আছে দুটো শিবমন্দির। সব স্থাপনা যে সাম্য আর সামঞ্জস্যে একে অপরকে ধারণ করেছে, তা এখনও আমাদের কাছে একটা ধাঁধার মতো। কেউ যদি একবার ভেতরে ঢোকে, যেন নতুন আরেকটা শহর খুঁজে পাবে।

আমরা অবশ্যই উন্নয়ন চাই, তবে ইতিহাস বিসর্জন দিয়ে নয়। আমরা কি এতই নির্বোধ হয়ে গেছি যে ইতিহাস, শহরের গল্প, নাগরিক মনন বিসর্জন দিয়ে এমন একটা স্থাপনা ভেঙে ফেলব? আমি বিশ্বাস করি, কয়েকজন জ্ঞানী-গুণী মানুষ একত্রে বসে টিএসসি ভবন অক্ষুণ্ন রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসর বৃদ্ধির একটা সময়োপযোগী সমাধান বের করতে পারেন। আমরা সেই অপেক্ষায় থাকলাম।

অমিত ইমতিয়াজ : স্থপতি; সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়