১৯৮৭ সাল থেকে প্রতিবছর ৩১ মে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং এর সহযোগী সংস্থাগুলো তামাকের স্বাস্থ্যঝুঁকি তুলে ধরে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালন করে আসছে। এ বছর দিনটির প্রতিপাদ্য বিষয় : Commit to Quit, অর্থাৎ ‘আসুন আমরা শপথ করি, জীবন বাঁচাতে তামাক ছাড়ি’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে যত মানুষ তামাক ব্যবহার করে, তাদের অন্তত অর্ধেক তামাকজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। তামাকজাত দ্রব্য জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। প্রতিবছর তামাক ব্যবহারের ফলে বিশ্বে ৮০ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এ ছাড়া পরোক্ষ ধূমপানের কারণে মৃত্যুবরণ করে আরও প্রায় ১০ লাখ মানুষ, যার একটি বড় অংশ শিশু। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বে প্রতিবছর তামাকের কারণে মারা যাবে ১ কোটি মানুষ। এর মধ্যে ৭০ লাখেরই অকালমৃত্যু হবে উন্নয়নশীল দেশে।
পৃথিবীর ১১০ কোটি ধূমপায়ীর ৮০ ভাগ বাস করে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশে। বিপুল জনসংখ্যা, দারিদ্র্য, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে বিশ্বের সর্বোচ্চ তামাকজাত পণ্য ব্যবহারকারী ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বিশ্বের সর্বোচ্চ তামাকজাত পণ্য ব্যবহারকারী ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তবে ২০১৭ সালে পরিচালিত গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভের তথ্যে দেখা যায়, দেশে তামাকের ব্যবহার ক্রমশ কমে আসছে। রিলেটিভ রিডাকশন বা আপেক্ষিক হ্রাস বিবেচনায় নিলে ৮ বছরে তামাকের ব্যবহার কমার হার ১৮.৫ শতাংশ। তামাকের ব্যবহার কমে আসার এ প্রবণতা ইতিবাচক।
মুখ গহ্বর, স্বরযন্ত্র, জিহ্বা ও ফুসফুসের ক্যানসারের প্রায় ৫০ ভাগের জন্যই দায়ী তামাক ও তামাকজাত দ্রব্য সেবন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, হৃদরোগের কারণে মৃত্যুর ৩০ শতাংশ, ক্যানসারে মৃত্যুর ৩৮ শতাংশ, ফুসফুসে যক্ষার কারণে মৃত্যুর ৩৫ শতাংশ এবং অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগে মৃত্যুর ২০ শতাংশের জন্য দায়ী ধূমপান। ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের (আইএইচএই) গবেষণা (২০১৩) অনুসারে, তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করে।
সারা বিশ্বে সমন্বিতভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণ ও তামাকের ব্যবহার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ২০০৩ সালের মে মাসে জেনেভায় অনুষ্ঠিত ৫৬তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) চুক্তি অনুমোদিত হয়। বাংলাদেশ এ চুক্তির প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ এবং ২০০৪ সালে এ চুক্তিকে অনুসমর্থন করে। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সরকার এফসিটিসির আলোকে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩) এবং ২০১৫ সালে এ সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়ন করে।
তামাকজনিত রোগব্যাধির চিকিৎসা ও অকালমৃত্যুর কারণে প্রতিবছর ৩০,৫৭০ কোটি টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু একই অর্থবছরে সরকার তামাক খাত থেকে রাজস্ব পায় অনেক কম (২২,৮১০ কোটি টাকা)। অর্থাৎ, সরকারের নেট ক্ষতি প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। আসন্ন অর্থবছরের বাজেটে তামাকজাত দ্রব্যের কর বৃদ্ধি এবং করোনা মোকাবিলায় অতিরিক্ত ৩ শতাংশ সারচার্জ আরোপ করা হলে সরকার অতিরিক্ত ১১ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব পেতে পারে। এ টাকা করোনা মহামারি মোকাবিলায় কাজে লাগানো যেতে পারে।
অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মানস (মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা); সদস্য, জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড এবং জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স
prof.arupratanchoudhury@yahoo.com