ঢাকা , বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আদর্শের দিন কখনো শেষ হবে না

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ প্রায় চার দশক ধরে পৃথিবীতে আদর্শগত শূন্যতা বিরাজ করছে এবং পুরনো পরিত্যক্ত সব সংস্কার-বিশ্বাসের পুনরুজ্জীবন ঘটছে। জনগণের জন্য মার্ক্সবাদ, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রকে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলার ফলেই সৃষ্টি হয়েছে আদর্শগত শূন্যতা।

আদর্শের অবলম্বন ছাড়া অপব্যবস্থা, দুর্নীতি, জুলুম-জবরদস্তি ও অসামাজিক কার্যকলাপের মধ্যে মানুষ অসহায় বোধ করছে। আদর্শগত শূন্যতার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে শুধু ধর্মের পুনরুজ্জীবন দেখে ১৯৮০-র দশক থেকেই কেউ কেউ বলে আসছেন, ইতিহাসের চাকা পেছন দিকে ঘুরছে।

দুনিয়াব্যাপী ইতিহাসের চাকাকে আবার সামনের দিকে ঘোরানোর কথা বলে যাঁরা তৎপর হয়েছেন, তাঁরা ধর্মের ও পুরনো সংস্কার-বিশ্বাসের অনুসারীদের বিরুদ্ধে নেতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রতিবাদী আন্দোলন চালিয়েছেন। যাঁরা ইতিহাসের চাকাকে আবার সামনের দিকে ঘোরানোর কথা বলছেন, গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্র নিয়ে তাঁরা অল্পই চিন্তা করেন। তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেন এবং মৌলবাদবিরোধী, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, দুর্নীতিবিরোধী ও নারীবাদী আন্দোলন করেন।

এর মধ্যে কোনো কোনো মহল থেকে প্রচার করা হয় যে ধর্ম ও আদর্শের দিন শেষ। রাষ্ট্রও গুরুত্বহীন হয়ে গেছে বলে তাঁরা মত প্রকাশ করেন। আর globalization, global state, global citizen, liberalism, pluralism, depoliticization (anarchism), NGO, CSO ইত্যাদি কথা ক্রমাগত উচ্চারিত হয়। প্রগতির প্রয়োজনে এসব সম্পর্কে গুরুতর আলোচনা ও সিদ্ধান্ত দরকার।

আমার ধারণা এই যে কিছু মানুষ ধর্মের অবসান চাইলেই ধর্মের অবসান হবে না। সভ্যতার বিকাশে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। প্রতিটি ধর্মই উন্মেষ পর্বে ও প্রথম পর্যায়ে জনগণের জন্য কল্যাণকর ও প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করেছে। যে অবস্থা এখন চলছে তাতে ধর্মকে শেষ করে দেওয়ার জন্য যত চেষ্টা করা হবে, ধর্ম ততই পুনরুজ্জীবিত হবে। গণতন্ত্রকে পুনর্গঠিত কিংবা নবায়িত করে সর্বজনীন গণতন্ত্রে রূপ দিলে এবং জনগণের জন্য প্রাণশক্তিসম্পন্ন করে সামনে আনা হলে অবস্থার উন্নতি হবে।

মানুষ জন্মগতভাবে যে জীবন ও জীবন-পরিস্থিতি লাভ করে, তা নিয়ে সে সন্তুষ্ট থাকে না। সে উন্নততর জীবন ও উন্নততর পরিবেশ আকাঙ্ক্ষা করে। বিশেষ বাস্তব অবস্থায় থেকে সে তার চিন্তাশক্তি ও কল্পনাশক্তি দিয়ে সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে সুন্দর অবস্থার কল্পচিত্র তৈরি করে। বহুজনের অভিপ্রেত এই কল্পিত বাস্তব কোনো কোনো প্রতিভাবান ব্যক্তির প্রচেষ্টায় সমন্বিত রূপ নিয়ে হয়ে ওঠে আদর্শ। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি এমনিভাবে সৃষ্ট আদর্শ।

আদর্শ ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত চেষ্টার মধ্য দিয়ে রূপ নেয়। আদর্শ হলো অভিপ্রেত কল্পিত বাস্তব। মানুষের ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত উন্নতিশীল অস্তিত্বের অপরিহার্য অবলম্বন আদর্শ। আদর্শ বিকাশশীল। আদর্শ, কর্মসূচি ও নেতৃত্ব অবলম্বন করে চললে সাধারণ মানুষ-জনগণ শক্তিশালী হয়। আর এসবের অবলম্বন ছাড়া তারা দুর্বল ও অসহায় থাকে। আদর্শহীন অবস্থায় জনসাধারণ শোষিত, বঞ্চিত ও প্রতারিত হয়। আদর্শ অবলম্বন করে নিজেদের থেকে নিজেদের জন্য নেতৃত্ব সৃষ্টি করে সংগ্রামের মাধ্যমে তারা শোষণ, বঞ্চনা ও প্রতারণা থেকে মুক্তি পেতে পারে।

কায়েমি স্বার্থবাদীদের ছাড়া বাকি সবার জন্যই আদর্শ অপরিহার্য। জনগণ আদর্শের অবলম্বন চায়, আদর্শের নামে প্রতারণা চায় না। আদর্শ বাস্তবায়িত হয় আদর্শ অভিমুখী পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করে। রাষ্ট্রও লোপ পাবে না, টিকে থাকবে। সবার কল্যাণে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত ও নবায়িত করতে হবে।

১৯৭৮ সালে আফগানিস্তানে সংঘটিত কথিত কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর এবং ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ইরানে সংঘটিত ইসলামী বিপ্লবের পর মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দেখা দেয় নতুন প্রতিযোগিতা। তখন আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে তালেবান এবং আরো কয়েকটি জঙ্গিবাদী গ্রুপ। তালেবান যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের দ্বারা ক্রমে সমগ্র আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়। তারপর দেখা যায়, কাবুলের তালেবান সরকার সাম্রাজ্যবাদী নীতির প্রতি অবাধ্য হয়ে ওঠে।

তখন যুক্তরাষ্ট্র অবাধ্য তালেবানকে এবং কাবুলে মোল্লা ওমরের তালেবান সরকারকে শায়েস্তা করার জন্য সামরিক অভিযান চালাতে থাকে। সে অবস্থায় চলমান ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ২০০১ সালে কোনো অজ্ঞাত শক্তি দ্বারা যুক্তরাষ্ট্রের গর্বের ধন টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়। তারপর সাম্রাজ্যবাদী মহল থেকে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে একে একে আফগানিস্তানে, ইরাকে, লিবিয়ায়, সিরিয়ায় চালানো হয় সামরিক আক্রমণ। তার প্রতিক্রিয়ায় আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ায় দেখা দেয় জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার একদিকে আছে সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের অনুসারীরা এবং অন্যদিকে আছে ইসলামপন্থীরা, যাদের মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী বলে অভিহিত করা হয়।

এ অবস্থায় ইতিহাসের চাকা সামনের দিকে ঘোরানোর জন্য বিভিন্ন দেশে দেখা যাচ্ছে মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদীদের বিরুদ্ধে পুলিশ, মিলিটারির আইন-আদালত, জেলখানা, ফাঁসিকাষ্ঠ ইত্যাদি নিয়ে ভীষণ সক্রিয়তা ও আগ্রাসী সামরিক আক্রমণ। সব কিছুর কেন্দ্রীয় পরিচালনায় দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্য রূপে আছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রে তাদের অনুসারীরা। মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ন্যাটোর আগ্রাসী উপস্থিতি, সামরিক আক্রমণ, গণহত্যা ও জবরদখল বজায় রেখে বিশ্বশান্তি আশা করা হচ্ছে।

মানুষের ধর্মবোধ, আদর্শবোধ ও ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নকে শাস্ত্রনিরপেক্ষ যুক্তি দিয়ে বিচার করা হচ্ছে না। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আন্দোলনকারীদের দিক থেকে ধর্মপন্থীদের প্রতি শুধু বিরূপ মনোভাব প্রদর্শন করা হচ্ছে। সভ্যতার বিকাশে ধর্মের ও আদর্শের ভূমিকা নিয়ে কিছুই ভাবা হচ্ছে না। দুনিয়ার কোথাও আদর্শগত পুনর্গঠনের কোনো প্রবণতাই খুঁজে পাওয়া যায় না।

ব্যক্তি, সমাজ, জাতি, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে ধর্মপন্থীদের কোনো সর্বাঙ্গীণ বক্তব্য নেই। একালে কোনো ধর্ম অবলম্বন করে তা সম্ভবও নয়। গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে আদর্শবোধ, আদর্শসন্ধিৎসা ও আদর্শনিষ্ঠা অল্পই আছে। তাঁরা আদর্শনিষ্ঠা ত্যাগ করে অবলম্বন করেছেন সুবিধাবাদ ও ভোগবাদ। ধর্মপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষতাপন্থীদের মধ্যে চলছে তীব্র স্বার্থের সংঘাত। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া স্বার্থান্ধ ও জয়-পরাজয়মূলক। এতে ন্যায়, সত্য, সুন্দর, প্রগতি ও সভ্যতার বিবেচনা নেই।

উনিশ শতকের মধ্য পর্বে মানবজাতির সামনে বিরাট আশার বাণী নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল মার্ক্সবাদ। তারপর অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। ক্রমে মার্ক্সবাদ প্রাধান্য বিস্তার করে চলছিল। বর্তমানে যে অবস্থা দেখা দিয়েছে, তাতে মার্ক্সবাদ ও মার্ক্সবাদীদের অবস্থা কেমন? আর মানবজাতির আদর্শগত ভবিষ্যৎই বা কী?

মধ্যপ্রাচ্যের তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদের প্রতি সব সময়ই দেখা গেছে সাম্রাজ্যবাদীদের সীমাহীন লোভ। এই লোভ চরিতার্থ করার এবং নিজেদের কর্তৃত্বের প্রয়োজনে একসময় তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের এবং সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ইসলামের পুনরুজ্জীবন চেয়েছিল। ওই সময়ে আফগানিস্তানে কমরেড তারাকির নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিপ্লব (১৯৭৮) এবং ইরানে খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লব (১৯৭৯) সাধিত হয়েছিল। দুটি বিপ্লবই ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী।

তাতে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব খর্ব হয়েছিল। আফগানিস্তানে কথিত এই কমিউনিস্ট বিপ্লবকে জনগণ মেনে নেয়নি। সে অবস্থায় বিপ্লব সফল করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে এক লাখেরও বেশি সৈন্য পাঠিয়েছিল। মুসলিম জনগণের ওপর মার্ক্সবাদ চাপিয়ে দেওয়ার এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আফগানিস্তানে আত্মপ্রকাশ করে তালেবান এবং আরো কয়েকটি জঙ্গিবাদী সংগঠন। তালেবান তখন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পেয়ে এতটাই শক্তিশালী হয় যে তারা আর সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণে থাকেনি। জঙ্গিবাদের উত্থানের পেছনে আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কারণ আছে; সর্বোপরি আছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ভূমিকা।

ব্যাপার শুধু ধর্মীয় ও আদর্শগত নয়—স্বার্থগতও। বস্তুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিচার না করে শুধু ইসলামকে দায়ী করে সমস্যাকে ব্যাখ্যা করা ভুল। একসময় মানুষ ধর্মের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকেছিল। কিন্তু গত প্রায় চার দশকের মধ্যে অবস্থা সম্পূর্ণ উল্টে গেছে। সমাজতন্ত্রের নামে বিভিন্ন দেশে যা চলেছে, তা দেখে সমাজতন্ত্রের প্রতি এখন খুব কম মানুষেরই আস্থা আছে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন লোপ পেয়েছে। মার্ক্সবাদের প্রতিও মানুষের আর কৌতূহল দেখা যায় না। মতান্ধ মার্ক্সবাদীদের বিশ্বাস যতই দৃঢ় হোক, মার্ক্সবাদ মতাদর্শ হিসেবে এখন আর কার্যকর নেই।

বিশ্বাসের দৃঢ়তা দিয়ে সত্যের প্রমাণ হয় না। উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে আফগানিস্তানে, ইরাকে, লিবিয়ায়, সিরিয়ায়, বাংলাদেশে এবং প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের আরো অনেক দেশে এখন যা চালানো হচ্ছে, তাতে খুব কম মানুষই কথিত উদার গণতন্ত্রে আস্থা রাখে। শুধু নির্বাচন দ্বারা সরকার গঠিত হলেই গণতন্ত্র হয় না। মুসোলিনি, হিটলার, সালাজার, ফ্রাংকো নির্বাচিত শাসক ছিলেন। নির্বাচনকালে তাঁরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু তাঁদের কেউই গণতন্ত্রী ছিলেন না। বিভিন্ন দেশে চলমান গণতন্ত্র ক্রমেই বেশি করে গণবিরোধী রূপ নিচ্ছে। কায়েমি স্বার্থবাদীরা গণতন্ত্রের নামে হুজুগ সৃষ্টি করে, ভাঁওতা-প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে হীন স্বার্থ হাসিল করে নিচ্ছে। দুর্নীতি বাড়ছে।

সমাজতন্ত্রবিরোধীরা আশা করেছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপের পর—কোল্ড ওয়ারের অবসানের পর গণতন্ত্রের স্বর্ণযুগ দেখা দেবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে উল্টোটা। চলমান গণতন্ত্রের কিংবা চলমান সমাজতন্ত্রের প্রতি এখনো যাঁরা আস্থা পোষণ করেন, তাঁদের অনেকে অন্ধবিশ্বাসী, অনেকে কায়েমি স্বার্থবাদী, অনেকে সুবিধাবাদী, অনেকে প্রতারক।

সুস্থ-স্বাভাবিক আদর্শবোধ ও আদর্শনিষ্ঠা নিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে চিন্তা ও কাজ করেন এমন মানুষ রাজনীতিবিদদের ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কোন দেশে কজন আছেন? জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ সম্পর্কেও বিজ্ঞানসম্মত ধারণা এখন দুর্লভ। রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার মতান্তরে সব কেন্দ্রে এখন কর্তৃত্বশীল আছে কায়েমি স্বার্থবাদীরা, সুবিধাবাদীরা ও ভোগবাদীরা। এ অবস্থার মধ্যে দুনিয়াব্যাপী জনসাধারণ এখন ঝুঁকছে পরিত্যক্ত পুরনো সব সংস্কার, বিশ্বাস ও ধর্মের দিকে।

বর্তমান আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্কের মধ্যে আছে আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রবল ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য। প্রবল রাষ্ট্রগুলো তৎপর আছে National superiority complex নিয়ে, আর দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে তারা ঠেলে দিচ্ছে National inferiority complex-এ। প্রবল রাষ্ট্রগুলোর কূটনীতি, বাণিজ্যনীতি, ঋণনীতি, প্রচারনীতি, প্রযুক্তিনীতি, গোয়েন্দানীতি একান্তভাবে প্রবল রাষ্ট্রগুলোরই অনুকূলে এবং দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর সম্পূর্ণ প্রতিকূলে।

রাষ্ট্রব্যবস্থার অভ্যন্তরে আছে প্রবলের ভোগবাদ, দুর্বলের বঞ্চনা, জুলুম-জবরদস্তি, অপব্যবস্থা ও দুর্নীতি। প্রশাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা প্রতারণামূলক নীতি নিয়ে কার্যকর আছে প্রবলদের স্বার্থে। দুর্বল রাষ্ট্রগুলো পরিচালিত হচ্ছে বিশ্বব্যাংক দ্বারা। লেখক-শিল্পী-চিন্তকদের মধ্যে intellectual character বলে কোনো কিছুর সন্ধান পাওয়া যায় না। চলমান এই ব্যবস্থা নিয়ে উল্লেখযোগ্য গঠনমূলক কোনো চিন্তা-ভাবনার সন্ধান পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যায় না।

দুর্বলরা শক্তিশালী হতে পারে ঐক্যবদ্ধ হয়ে—নিজেদের থেকে, নিজেদের চেষ্টায়, নিজেদের জন্য ভালো নেতৃত্ব সৃষ্টি করে। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রে দুর্বল জনগণের মধ্যে সেই চেষ্টা দরকার। রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থাকে সর্বজনীন কল্যাণে পরিবর্তন করে উন্নত প্রগতিশীল রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

লেখক : চিন্তাবিদ, অধ্যাপক

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

আদর্শের দিন কখনো শেষ হবে না

আপডেট টাইম : ০৯:৩৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ প্রায় চার দশক ধরে পৃথিবীতে আদর্শগত শূন্যতা বিরাজ করছে এবং পুরনো পরিত্যক্ত সব সংস্কার-বিশ্বাসের পুনরুজ্জীবন ঘটছে। জনগণের জন্য মার্ক্সবাদ, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রকে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলার ফলেই সৃষ্টি হয়েছে আদর্শগত শূন্যতা।

আদর্শের অবলম্বন ছাড়া অপব্যবস্থা, দুর্নীতি, জুলুম-জবরদস্তি ও অসামাজিক কার্যকলাপের মধ্যে মানুষ অসহায় বোধ করছে। আদর্শগত শূন্যতার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে শুধু ধর্মের পুনরুজ্জীবন দেখে ১৯৮০-র দশক থেকেই কেউ কেউ বলে আসছেন, ইতিহাসের চাকা পেছন দিকে ঘুরছে।

দুনিয়াব্যাপী ইতিহাসের চাকাকে আবার সামনের দিকে ঘোরানোর কথা বলে যাঁরা তৎপর হয়েছেন, তাঁরা ধর্মের ও পুরনো সংস্কার-বিশ্বাসের অনুসারীদের বিরুদ্ধে নেতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রতিবাদী আন্দোলন চালিয়েছেন। যাঁরা ইতিহাসের চাকাকে আবার সামনের দিকে ঘোরানোর কথা বলছেন, গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্র নিয়ে তাঁরা অল্পই চিন্তা করেন। তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেন এবং মৌলবাদবিরোধী, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী, দুর্নীতিবিরোধী ও নারীবাদী আন্দোলন করেন।

এর মধ্যে কোনো কোনো মহল থেকে প্রচার করা হয় যে ধর্ম ও আদর্শের দিন শেষ। রাষ্ট্রও গুরুত্বহীন হয়ে গেছে বলে তাঁরা মত প্রকাশ করেন। আর globalization, global state, global citizen, liberalism, pluralism, depoliticization (anarchism), NGO, CSO ইত্যাদি কথা ক্রমাগত উচ্চারিত হয়। প্রগতির প্রয়োজনে এসব সম্পর্কে গুরুতর আলোচনা ও সিদ্ধান্ত দরকার।

আমার ধারণা এই যে কিছু মানুষ ধর্মের অবসান চাইলেই ধর্মের অবসান হবে না। সভ্যতার বিকাশে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। প্রতিটি ধর্মই উন্মেষ পর্বে ও প্রথম পর্যায়ে জনগণের জন্য কল্যাণকর ও প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করেছে। যে অবস্থা এখন চলছে তাতে ধর্মকে শেষ করে দেওয়ার জন্য যত চেষ্টা করা হবে, ধর্ম ততই পুনরুজ্জীবিত হবে। গণতন্ত্রকে পুনর্গঠিত কিংবা নবায়িত করে সর্বজনীন গণতন্ত্রে রূপ দিলে এবং জনগণের জন্য প্রাণশক্তিসম্পন্ন করে সামনে আনা হলে অবস্থার উন্নতি হবে।

মানুষ জন্মগতভাবে যে জীবন ও জীবন-পরিস্থিতি লাভ করে, তা নিয়ে সে সন্তুষ্ট থাকে না। সে উন্নততর জীবন ও উন্নততর পরিবেশ আকাঙ্ক্ষা করে। বিশেষ বাস্তব অবস্থায় থেকে সে তার চিন্তাশক্তি ও কল্পনাশক্তি দিয়ে সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে সুন্দর অবস্থার কল্পচিত্র তৈরি করে। বহুজনের অভিপ্রেত এই কল্পিত বাস্তব কোনো কোনো প্রতিভাবান ব্যক্তির প্রচেষ্টায় সমন্বিত রূপ নিয়ে হয়ে ওঠে আদর্শ। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি এমনিভাবে সৃষ্ট আদর্শ।

আদর্শ ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত চেষ্টার মধ্য দিয়ে রূপ নেয়। আদর্শ হলো অভিপ্রেত কল্পিত বাস্তব। মানুষের ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত উন্নতিশীল অস্তিত্বের অপরিহার্য অবলম্বন আদর্শ। আদর্শ বিকাশশীল। আদর্শ, কর্মসূচি ও নেতৃত্ব অবলম্বন করে চললে সাধারণ মানুষ-জনগণ শক্তিশালী হয়। আর এসবের অবলম্বন ছাড়া তারা দুর্বল ও অসহায় থাকে। আদর্শহীন অবস্থায় জনসাধারণ শোষিত, বঞ্চিত ও প্রতারিত হয়। আদর্শ অবলম্বন করে নিজেদের থেকে নিজেদের জন্য নেতৃত্ব সৃষ্টি করে সংগ্রামের মাধ্যমে তারা শোষণ, বঞ্চনা ও প্রতারণা থেকে মুক্তি পেতে পারে।

কায়েমি স্বার্থবাদীদের ছাড়া বাকি সবার জন্যই আদর্শ অপরিহার্য। জনগণ আদর্শের অবলম্বন চায়, আদর্শের নামে প্রতারণা চায় না। আদর্শ বাস্তবায়িত হয় আদর্শ অভিমুখী পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করে। রাষ্ট্রও লোপ পাবে না, টিকে থাকবে। সবার কল্যাণে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত ও নবায়িত করতে হবে।

১৯৭৮ সালে আফগানিস্তানে সংঘটিত কথিত কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর এবং ১৯৭৯ সালে ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে ইরানে সংঘটিত ইসলামী বিপ্লবের পর মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দেখা দেয় নতুন প্রতিযোগিতা। তখন আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে তালেবান এবং আরো কয়েকটি জঙ্গিবাদী গ্রুপ। তালেবান যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের দ্বারা ক্রমে সমগ্র আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়। তারপর দেখা যায়, কাবুলের তালেবান সরকার সাম্রাজ্যবাদী নীতির প্রতি অবাধ্য হয়ে ওঠে।

তখন যুক্তরাষ্ট্র অবাধ্য তালেবানকে এবং কাবুলে মোল্লা ওমরের তালেবান সরকারকে শায়েস্তা করার জন্য সামরিক অভিযান চালাতে থাকে। সে অবস্থায় চলমান ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে ২০০১ সালে কোনো অজ্ঞাত শক্তি দ্বারা যুক্তরাষ্ট্রের গর্বের ধন টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়। তারপর সাম্রাজ্যবাদী মহল থেকে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে একে একে আফগানিস্তানে, ইরাকে, লিবিয়ায়, সিরিয়ায় চালানো হয় সামরিক আক্রমণ। তার প্রতিক্রিয়ায় আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ায় দেখা দেয় জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ড, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার একদিকে আছে সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের অনুসারীরা এবং অন্যদিকে আছে ইসলামপন্থীরা, যাদের মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী বলে অভিহিত করা হয়।

এ অবস্থায় ইতিহাসের চাকা সামনের দিকে ঘোরানোর জন্য বিভিন্ন দেশে দেখা যাচ্ছে মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদীদের বিরুদ্ধে পুলিশ, মিলিটারির আইন-আদালত, জেলখানা, ফাঁসিকাষ্ঠ ইত্যাদি নিয়ে ভীষণ সক্রিয়তা ও আগ্রাসী সামরিক আক্রমণ। সব কিছুর কেন্দ্রীয় পরিচালনায় দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্য রূপে আছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রে তাদের অনুসারীরা। মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ন্যাটোর আগ্রাসী উপস্থিতি, সামরিক আক্রমণ, গণহত্যা ও জবরদখল বজায় রেখে বিশ্বশান্তি আশা করা হচ্ছে।

মানুষের ধর্মবোধ, আদর্শবোধ ও ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্নকে শাস্ত্রনিরপেক্ষ যুক্তি দিয়ে বিচার করা হচ্ছে না। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী আন্দোলনকারীদের দিক থেকে ধর্মপন্থীদের প্রতি শুধু বিরূপ মনোভাব প্রদর্শন করা হচ্ছে। সভ্যতার বিকাশে ধর্মের ও আদর্শের ভূমিকা নিয়ে কিছুই ভাবা হচ্ছে না। দুনিয়ার কোথাও আদর্শগত পুনর্গঠনের কোনো প্রবণতাই খুঁজে পাওয়া যায় না।

ব্যক্তি, সমাজ, জাতি, রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে ধর্মপন্থীদের কোনো সর্বাঙ্গীণ বক্তব্য নেই। একালে কোনো ধর্ম অবলম্বন করে তা সম্ভবও নয়। গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে আদর্শবোধ, আদর্শসন্ধিৎসা ও আদর্শনিষ্ঠা অল্পই আছে। তাঁরা আদর্শনিষ্ঠা ত্যাগ করে অবলম্বন করেছেন সুবিধাবাদ ও ভোগবাদ। ধর্মপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষতাপন্থীদের মধ্যে চলছে তীব্র স্বার্থের সংঘাত। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া স্বার্থান্ধ ও জয়-পরাজয়মূলক। এতে ন্যায়, সত্য, সুন্দর, প্রগতি ও সভ্যতার বিবেচনা নেই।

উনিশ শতকের মধ্য পর্বে মানবজাতির সামনে বিরাট আশার বাণী নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল মার্ক্সবাদ। তারপর অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। ক্রমে মার্ক্সবাদ প্রাধান্য বিস্তার করে চলছিল। বর্তমানে যে অবস্থা দেখা দিয়েছে, তাতে মার্ক্সবাদ ও মার্ক্সবাদীদের অবস্থা কেমন? আর মানবজাতির আদর্শগত ভবিষ্যৎই বা কী?

মধ্যপ্রাচ্যের তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদের প্রতি সব সময়ই দেখা গেছে সাম্রাজ্যবাদীদের সীমাহীন লোভ। এই লোভ চরিতার্থ করার এবং নিজেদের কর্তৃত্বের প্রয়োজনে একসময় তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের এবং সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ইসলামের পুনরুজ্জীবন চেয়েছিল। ওই সময়ে আফগানিস্তানে কমরেড তারাকির নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিপ্লব (১৯৭৮) এবং ইরানে খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লব (১৯৭৯) সাধিত হয়েছিল। দুটি বিপ্লবই ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধী।

তাতে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব খর্ব হয়েছিল। আফগানিস্তানে কথিত এই কমিউনিস্ট বিপ্লবকে জনগণ মেনে নেয়নি। সে অবস্থায় বিপ্লব সফল করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তানে এক লাখেরও বেশি সৈন্য পাঠিয়েছিল। মুসলিম জনগণের ওপর মার্ক্সবাদ চাপিয়ে দেওয়ার এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আফগানিস্তানে আত্মপ্রকাশ করে তালেবান এবং আরো কয়েকটি জঙ্গিবাদী সংগঠন। তালেবান তখন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পেয়ে এতটাই শক্তিশালী হয় যে তারা আর সাম্রাজ্যবাদীদের নিয়ন্ত্রণে থাকেনি। জঙ্গিবাদের উত্থানের পেছনে আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কারণ আছে; সর্বোপরি আছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ভূমিকা।

ব্যাপার শুধু ধর্মীয় ও আদর্শগত নয়—স্বার্থগতও। বস্তুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বিচার না করে শুধু ইসলামকে দায়ী করে সমস্যাকে ব্যাখ্যা করা ভুল। একসময় মানুষ ধর্মের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকেছিল। কিন্তু গত প্রায় চার দশকের মধ্যে অবস্থা সম্পূর্ণ উল্টে গেছে। সমাজতন্ত্রের নামে বিভিন্ন দেশে যা চলেছে, তা দেখে সমাজতন্ত্রের প্রতি এখন খুব কম মানুষেরই আস্থা আছে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন লোপ পেয়েছে। মার্ক্সবাদের প্রতিও মানুষের আর কৌতূহল দেখা যায় না। মতান্ধ মার্ক্সবাদীদের বিশ্বাস যতই দৃঢ় হোক, মার্ক্সবাদ মতাদর্শ হিসেবে এখন আর কার্যকর নেই।

বিশ্বাসের দৃঢ়তা দিয়ে সত্যের প্রমাণ হয় না। উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে আফগানিস্তানে, ইরাকে, লিবিয়ায়, সিরিয়ায়, বাংলাদেশে এবং প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের আরো অনেক দেশে এখন যা চালানো হচ্ছে, তাতে খুব কম মানুষই কথিত উদার গণতন্ত্রে আস্থা রাখে। শুধু নির্বাচন দ্বারা সরকার গঠিত হলেই গণতন্ত্র হয় না। মুসোলিনি, হিটলার, সালাজার, ফ্রাংকো নির্বাচিত শাসক ছিলেন। নির্বাচনকালে তাঁরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু তাঁদের কেউই গণতন্ত্রী ছিলেন না। বিভিন্ন দেশে চলমান গণতন্ত্র ক্রমেই বেশি করে গণবিরোধী রূপ নিচ্ছে। কায়েমি স্বার্থবাদীরা গণতন্ত্রের নামে হুজুগ সৃষ্টি করে, ভাঁওতা-প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে হীন স্বার্থ হাসিল করে নিচ্ছে। দুর্নীতি বাড়ছে।

সমাজতন্ত্রবিরোধীরা আশা করেছিলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলোপের পর—কোল্ড ওয়ারের অবসানের পর গণতন্ত্রের স্বর্ণযুগ দেখা দেবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে উল্টোটা। চলমান গণতন্ত্রের কিংবা চলমান সমাজতন্ত্রের প্রতি এখনো যাঁরা আস্থা পোষণ করেন, তাঁদের অনেকে অন্ধবিশ্বাসী, অনেকে কায়েমি স্বার্থবাদী, অনেকে সুবিধাবাদী, অনেকে প্রতারক।

সুস্থ-স্বাভাবিক আদর্শবোধ ও আদর্শনিষ্ঠা নিয়ে আন্তরিকতার সঙ্গে চিন্তা ও কাজ করেন এমন মানুষ রাজনীতিবিদদের ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কোন দেশে কজন আছেন? জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ সম্পর্কেও বিজ্ঞানসম্মত ধারণা এখন দুর্লভ। রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার মতান্তরে সব কেন্দ্রে এখন কর্তৃত্বশীল আছে কায়েমি স্বার্থবাদীরা, সুবিধাবাদীরা ও ভোগবাদীরা। এ অবস্থার মধ্যে দুনিয়াব্যাপী জনসাধারণ এখন ঝুঁকছে পরিত্যক্ত পুরনো সব সংস্কার, বিশ্বাস ও ধর্মের দিকে।

বর্তমান আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্কের মধ্যে আছে আধিপত্য ও নির্ভরশীলতা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রবল ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য। প্রবল রাষ্ট্রগুলো তৎপর আছে National superiority complex নিয়ে, আর দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে তারা ঠেলে দিচ্ছে National inferiority complex-এ। প্রবল রাষ্ট্রগুলোর কূটনীতি, বাণিজ্যনীতি, ঋণনীতি, প্রচারনীতি, প্রযুক্তিনীতি, গোয়েন্দানীতি একান্তভাবে প্রবল রাষ্ট্রগুলোরই অনুকূলে এবং দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর সম্পূর্ণ প্রতিকূলে।

রাষ্ট্রব্যবস্থার অভ্যন্তরে আছে প্রবলের ভোগবাদ, দুর্বলের বঞ্চনা, জুলুম-জবরদস্তি, অপব্যবস্থা ও দুর্নীতি। প্রশাসনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা প্রতারণামূলক নীতি নিয়ে কার্যকর আছে প্রবলদের স্বার্থে। দুর্বল রাষ্ট্রগুলো পরিচালিত হচ্ছে বিশ্বব্যাংক দ্বারা। লেখক-শিল্পী-চিন্তকদের মধ্যে intellectual character বলে কোনো কিছুর সন্ধান পাওয়া যায় না। চলমান এই ব্যবস্থা নিয়ে উল্লেখযোগ্য গঠনমূলক কোনো চিন্তা-ভাবনার সন্ধান পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যায় না।

দুর্বলরা শক্তিশালী হতে পারে ঐক্যবদ্ধ হয়ে—নিজেদের থেকে, নিজেদের চেষ্টায়, নিজেদের জন্য ভালো নেতৃত্ব সৃষ্টি করে। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রে দুর্বল জনগণের মধ্যে সেই চেষ্টা দরকার। রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থাকে সর্বজনীন কল্যাণে পরিবর্তন করে উন্নত প্রগতিশীল রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

লেখক : চিন্তাবিদ, অধ্যাপক