ভৌগোলিক হাওর : বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, ব্রা?ক্ষণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে অশ্বখুরাকৃতি বা বাটির মতো একটি সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলকে ভাটি অঞ্চল বা হাওর অঞ্চল হিসেবে চেনা হয়। প্রকৌশলী এনামুল হকের মতে, ব্রহ্মপুত্র নদ তার প্রবাহপথ ১৭৮৭ সালের বন্যা ও ভূমিকম্পের পর মধুপুর গড়ের পূর্বদিক থেকে পশ্চিম দিকে পরিবর্তন করলে পলিমাটি ভরাট হওয়ার অভাবে এ অঞ্চল নিচু থেকে যায়। তাছাড়া মেঘালয় ও বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর সংঘটিত ডাউকি চুক্তির কারণে অতি প্রাচীনকালে এলাকাটি ৩ থেকে ১০ মিটিার বসে যায়। (হাওর পৃষ্ঠা ৪২) ১৭৬২ সালের ২ এপ্রিলের একটি ভূমিকম্পের বিবরণে বলা হয়, ওই ভূমিকম্পে ২০০ মানুষ মারা যায় এবং চট্টগ্রামের ১৬০ বর্গকিলোমিটার এলাকা বিলীন হয়ে যায়। ভূমিকম্পটি মায়ানমারের ব্যাপক পরিবর্তন করে এবং তৎকালে বেঙ্গলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ৮.৮ মাত্রার সেই ভূমিকম্পটির পরে সুনামিও আঘাত হানে। সেই ভূমিকম্পেই মধুপুরের গড় এবং হাওর এলাকার জন্ম হয়। এর পর ১৭৮৭ সালের ভূমিকম্পে ব্রহ্মপুত্র এবং তিস্তা তার গতিপথ বদলায়। ১৮৯১ সালের ভূমিকম্পে হাওরের উজানে খাসিয়া পাহাড়ের ৪০ হাজার বর্গমাইল এলাকা নষ্ট হয় বলেও জানা যায়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, এ এলাকাটি দেবে গিয়েই মধুপুরের গড় সৃষ্টি হয়। গারো ও খাসিয়া পাহাড়ের অববাহিকায় ছিল বলে সেই অঞ্চলটি অনাবাদি বনাঞ্চল ছিল। হাওরের অধিবাসীরা জানান, ১৯৩৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ভৈরবে মেঘনা নদীর উপরে রেল সেতু উদ্বোধন হওয়ার পর হাওর এলাকায় বন্যা বিপুল পরিমাণ পানি জমতে থাকে। এর আগে বর্ষাকালেও ওই অঞ্চলে তেমন প্লাবন হতো না। তারা মনে করেন ভৈরব সেতু নির্মাণের জন্য মেঘনার পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং সেতুটির জন্য উজানের পানি নামার পথে বাধাগ্রস্ত হয়।
যদি আমরা ১৭৬২ সালকে হাওর এলাকার জন্ম সময় হিসেবে গণ্য করি তবে এ এলাকাটির বর্তমান রূপের বয়স আড়াইশ বছর অতিক্রম করেছে মাত্র। খুব সঙ্গতকারণেই এ এলাকার আবাদি জনবসতিকে এর চেয়ে প্রাচীন মনে করার কোন কারণ নেই। তবে হাওর হিসেবে জন্ম নেয়ার আগে সেখানে বসতি থেকে থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। পুরো দেশের আর কোন অঞ্চলের সঙ্গে এর ভৌগোলিক মিল নেই। তবে বাংলাদেশের এ অঞ্চলের সংলগ্ন এলাকার বাইরেও দেশজুড়েই নানা ধরনের বিল, হাওর বা জলাভূমি রয়েছে। তবে দেশের সংলগ্ন যে এলাকাটিকে হাওর বলে চেনা হয় সেটি সাতটি জেলার প্রায় অর্ধ শতাধিক উপজেলার পুরো বা আংশিক অঞ্চল নিয়েই গড়ে ওঠেছে। হাওর উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব মতে, ৭টি জেলার মোট ১৯ লাখ ৬৬ হাজার ৯০৭ হেক্টর ভূমির মাঝে ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৪৬১ হেক্টর হাওর এলাকা। ৭টি জেলায় মোট ৭০টি উপজেলা থাকলেও এর অনেকগুলো হাওর এলাকা নয়
সুনামগঞ্জের ৩ লাখ ৬৭ হাজার হেক্টর ভূমির মাঝে ২ লাখ ৬৮ হাজার ৫৩১ হেক্টর হাওর। হবিগঞ্জের ২ লাখ ৬৩ হাজার ৭শ’ হেক্টর জমির মাঝে ১ লাখ ৯ হাজার ৫শ’ ১৪ হেক্টর হাওর। নেত্রকোনার ২ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমির মাঝে ৭৯ হাজার ৩শ’ ৪৫ হেক্টর হাওর। কিশোরগঞ্জের ২ লাখ ৭৩ হাজার ১শ’ হেক্টর ভূমির মাঝে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৯শ’ ৪৩ হেক্টর হাওর। মৌলভীবাজার জেলার ২ লাখ ৭৯ হাজার ৯শ’ হেক্টর জমির মাঝে ৪৭ হাজার ৬শ’ ২ হেক্টর ভূমি হাওর। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ১ লাখ ৯২ হাজার ৭শ’ হেক্টর জমির মাঝে ২৯ হাজার ৬১৬ হেক্টর জমি হাওর। হাওর বোর্ডের হিসাব মতে মোট হাওরের সংখ্যা ৩৭৩টি। সুনামগঞ্জে ৮৫, হবিগঞ্জে ১৪, নেত্রকোনায় ৫২, কিশোরগঞ্জে ৯৭, সিলেটে ১০৫, মৌলভীবাজারে ৩ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৭টি হাওর রয়েছে। এ এলাকায় ৩৭৩টি হাওরের মাঝে ৪৭টি বড় হাওর রয়েছে। এ এলাকায় সর্বমোট ৬৩০০ বিলের মাঝে ৩৫০০ স্থায়ী, যাতে শুকনো মৌসুমেও পানি থাকে এবং ২৮০০ অস্থায়ী বিল রয়েছে যা শুকনো মৌসুমে শুকিয়ে যায়। এলাকাটি যে কেবল নিচু তা নয়, বিশেষজ্ঞদের মতে প্রতিবছর ২০ মিলিমিটার হিসেবে এ এলাকাটি দেবে যাচ্ছে। গত কয়েকশ বছরে এর কোন কোন অংশ ১০ মিটার পর্যন্ত দেবে গেছে বলেও মনে করা হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হাওর অঞ্চলের সাধারণ উচ্চতার তিনটি স্তর আছে। সবচেয়ে নিচু এলাকাটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০ ফুট উঁচু, পরেরটি ১৫ ফুট এবং সবচেয়ে উঁচুটি ২০ ফুট উঁচু। তবে এর গভীর বিল অঞ্চলগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠের ২০-৫০ ফুট নিচে অবস্থান করে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের এলাকা ভারতের চেরাপুঞ্জি হাওর এলাকার উত্তরপ্রান্ত থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। বর্তমানে হাওর এলাকার সবচেয়ে সচল নদীর নাম ধনু। এটি ভৈরবের কাছে এসে মেঘনায় মিশেছে। ভারতের আহু বা বরাক নদী থেকে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীসহ শ’খানেক নদী হয়ে হাওরে বিপুল পরিমাণ জলরাশি প্রবেশ করে। এসব পানি ধনু-মেঘনা সাগরে বহন করে।
হাওর এলাকায় দেশের শতকরা ১৮ ভাগ চাল উৎপাদিত হয়। দেশের শতকরা ২২ ভাগ গবাদিপশু এ এলাকায় পালিত হয়। ভৈরবে মেঘনা নদীর ওপর নির্মিত রেলসড়ক সেতু থেকে উজানে বাংলাদেশ সীমান্তের সর্ব উত্তর প্রান্তের খাসিয়া ও গারো পাহাড় পর্যন্ত বিস্তৃত হাওর এলাকাটি। এ এলাকার উত্তরে গারো ও খাসিয়া পাহাড় এবং ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরাম রাজ্য এবং পূর্বে ভারতের আসাম ও মণিপুর রাজ্য অবস্থিত। দেশের অভ্যন্তরে এর পশ্চিমাংশে রয়েছে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ, দক্ষিণ দিকে আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পূর্বদিকে মৌলভীবাজার, সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলাসমূহের সমতল বা পাহাড়ি অঞ্চল।
হাওরের সংকট ও সম্ভাবনা : হাওর এলাকার সংকটের কথা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। বস্তুত এ এলাকার মানুষ কেবল পশ্চাদপদ জীবনযাপন করে না বরং একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তার যে নূ্যনতম পাওনা সেটিও সে পায় না। প্রধানত কৃষিভিত্তিক এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের সব ক্ষেত্রেই সংকট রয়েছে। যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, কৃষি ইত্যাদির কোনটাই এমনকি দেশের অনুন্নত অঞ্চলের সঙ্গেও তুলনীয় নয়। হাওর এলাকায় দেশের অন্য এলাকার সঙ্গে তুলনীয় কোন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা কার্যকর নয়। নদী-খাল-বিলসম্পন্ন এ এলাকায় যথাযথ নৌ-যোগাযোগও নেই। এখানে শিক্ষার হার দেশের সবচেয়ে কম। প্রচলিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে না। এখানকার মানুষ বেঁচে থাকে আল্লাহর ইচ্ছায়। কোন স্বাস্থ্যসেবা এখানে পাওয়া যায় না। দাদন এখানকার মানুষের রক্ত চুষে নেয়। কৃষি উপকরণ বা সহায়তা এখানকার মানুষের কাছে দুর্লভ। খাল-নদ-নদী-বিলগুলো শুকিয়ে যাওয়ার ফলে এখানকার পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য ও জীবন বিপন্ন। জলমহালগুলো থাকে লুটেরাদের দখলে। তার বাড়ির কাছের মৎস্যসম্পদ থাকে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। দেশের অন্য এলাকার চেয়ে এ এলাকার মানুষ সবচেয়ে বড় যে বিপদটির মুখোমুখি হয় সেটি হচ্ছে প্রচ- ঢেউয়ের আঘাত থেকে নিজের বাড়িটা রক্ষা করা। এখানে চোরের উপদ্রব, সরকারি কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতি, সরকারি সেবার অভাব_ এসব তো আছেই।
অথচ হাওরে প্রচুর ধান জন্মায়, হাওরে পাওয়া যায় দেশের সবচেয়ে বেশি মিষ্টি পানির মাছ। সম্ভাবনা আছে যে হাওরে তেল ও গ্যাস পাওয়া যেতে পারে। এমনকি হাওরে যে বিপুল পরিমাণ জলরাশি বর্ষায় প্লাবন সৃষ্টি করে সেই পানিকে কোথাও সংরক্ষণ করে তার যথাযথ ব্যবহার করা যেতে পারে। বিশ্ব উষ্ণায়ন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এবং টিপাই মুখ বাঁধ : বিশ্বব্যাপী যে জলবায়ু পরিবর্তন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির বিপদের কথা বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে তার প্রধান শিকার হবে হাওর অঞ্চলটি। এখন পর্যন্ত দেশের মানুষ কেবলমাত্র উপকূলীয় অঞ্চলের কথা বলছে- কার্যত আমরা জানিনা যে, উপকূলীয় অঞ্চল বিপন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ হাওর অঞ্চল বিপন্ন হবে। এ আসন্ন বিপদের জন্য কেবল এখানকার পরিবেশ বা জীববৈচিত্র্য নয়, পুরো জনপদ বিপন্ন হয়ে যাবে। মাত্র তিন থেকে ১০ ফুট উচ্চতার এ জনপদের অনেক অংশ এখনই সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচের এলাকা। মাত্র তিন মিটার পানি বাড়লে বাংলাদেশের উপকূলীয় অংশের সঙ্গে সঙ্গে পুরো হাওর এলাকা প্লাবিত হয়ে যাবে। ওই এলাকার মানুষ এখনও আন্দাজ করতে পারে না যে, এর ফলে তার জীবন কতোটা বিপন্ন হবে। একই সঙ্গে টিপাই মুখ বাঁধ হলে বিপন্ন হবে এ জনপদ। দুঃখের বিষয় যে গত ২২ অক্টোবর ২০১১ ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের জন্য একটি চুক্তি সই করেছে এবং এখন টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ একটি সময়ের ব্যাপার মাত্র। হাওরের কর্মপরিকল্পনা তৈরির সময় দৃশ্যত জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়নি যেভাবে এটি দেখা উচিত ছিল। ফলে আমি মনে করি যে এখন আবার নতুন করে ভাবার প্রয়োজন রয়েছে।
বাস্তবতা হলো, হাওর নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের একটি হাওর ও জলাশয় উন্নয়ন বোর্ড রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে এর প্রধান। হাওরের কয়েকজন সংসদ সদস্য এর সদস্য। ঢাকায় এর অফিস আছে। ছোটখাটো একটি কাঠামোও আছে। কিন্তু বাস্তবে এর তেমন কোন কাজ নেই। সম্প্রতি এ বোর্ডের পক্ষ থেকে একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। কাগজে কলমে দৃশ্যত মহাপরিকল্পনাটি সুন্দর। কিন্তু এটি কখন কবে কীভাবে কোন অর্থের উৎসে বাস্তবায়িত হবে সেটি অনেক বিশাল একটি প্রশ্ন। আমাদের প্রত্যাশা, দ্বিতীয় হাওর সম্মেলন এ অঞ্চলটির উন্নয়নে একটি বাস্তবসম্মত দিকনির্দেশনা প্রদান করবে। এর আগে ২০০৮ সালের মার্চে প্রথম হাওর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে হাওর ঘোষণা ২০০৮ তৈরি হয়েছিল এবং সেই ঘোষণার আলোকে সরকার একটি কর্মপরিকল্পনাও অনুমোদন করেছিল। হাওর মহাপরিকল্পনা সেই সম্মেলন ও তার পরবর্তী নানা কর্মকা-ের ফসল হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। এবার এ সম্মেলনে ইউএনডিপি, কনসার্ন ও অ্যাকশন এইডসহ ৩১টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিচ্ছে। এর মাঝে বেসরকারি সংস্থাসহ বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানও আছে। আলোচনা হবে হাওর মহাপরিকল্পনার ১৩২টি প্রকল্পের অর্থায়ন নিয়েও । খুব সঙ্গত কারণেই হাওরের মানুষ এ সম্মেলনটি নিয়ে ব্যাপক প্রত্যাশায় বুক বেঁধে আছে।