বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ঠিক এক বছর আগে বিশ্বের সাতটি দেশে দুই লাখ টন চাল রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছিল খাদ্য মন্ত্রণালয়। পরে তা আর এগোয়নি। এর আগে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে শ্রীলঙ্কায় ৫০ হাজার টন চাল রপ্তানিও হয়েছিল। এসব খবর বাংলাদেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার আভাস দিয়েছিল। কিন্তু জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) গত মাসে বিশ্বের দানাদার খাদ্যের উৎপাদন ও আমদানি পরিস্থিতি নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তা ভিন্ন কথা বলছে।
এফএওর বৈশ্বিক খাদ্য পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বের স্বল্প আয়ের দেশগুলোর মধ্যে দানাদার খাদ্য (চাল ও গম) আমদানিতে এখন শীর্ষস্থানীয় দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। সংস্থাটির হিসাবে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৬৭ লাখ মেট্রিক টন চাল-গম আমদানি করবে। বাংলাদেশের পরই বিশ্বের অন্য শীর্ষ আমদানিকারক দেশগুলো হচ্ছে ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, মাদাগাস্কার, নাইজেরিয়া, ইরাক, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, ইরান ও চীন।
গত সেপ্টেম্বরে ‘ফসলের সম্ভাবনা ও খাদ্য পরিস্থিতি : ত্রৈমাসিক বৈশ্বিক প্রতিবেদন’ ও ‘চাল পূর্বাভাস-২০১৭’ শীর্ষক দুটি প্রতিবেদনে এসব তথ্যের উল্লেখ করা হয়েছে।
বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ২০১৩ সাল থেকেই প্রতিবছর ৩০ থেকে ৪০ লাখ টন করে চাল ও গম আমদানি করে থাকে। ২০১৬ সালে আমদানি কমলেও ২০১৭ সালে তা রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে গেছে, যা বিশ্বের প্রধান চাল আমদানিকারক দেশগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে।
আমদানিনির্ভরতা বেড়ে যাওয়ার আগে দেশে চাল ও গমের দামও ধারাবাহিকভাবে বেড়ে সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছেছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গতকাল রোববারও রাজধানীর বেশির ভাগ বাজারে মোটা চাল প্রতি কেজি ৪৪ থেকে ৪৮ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। তবে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, চালের দাম কেজিপ্রতি ৪৪ থেকে ৪৬ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর আগে ২০০৮ সালে মোটা চালের কেজি সর্বোচ্চ ৪০ টাকা উঠেছিল।
সরকারি সংস্থাগুলোর হিসাবেই চার মাস ধরে মোটা চালের দাম ৪৫ টাকার নিচে নামেনি। দেশের হতদরিদ্র হিসেবে চিহ্নিত প্রায় দুই কোটি মানুষের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য এই দামকে বড় ধরনের হুমকি মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও খাদ্য বিশেষজ্ঞরা। এতে দীর্ঘমেয়াদি গরিব মানুষের পুষ্টি সমস্যা বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও কৃষিসচিব এ এম এম শওকত আলী এ ব্যাপারে বাঙালী কণ্ঠকে বলেন, টানা কয়েক মাস চালের দাম প্রতি কেজি ৪৫ টাকার ওপরে থাকা দেশের গরিব মানুষের খাদ্যনিরাপত্তার জন্য দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা তৈরি করবে। এফএওর একটি গবেষণার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, চালের দাম বেড়ে গেলে গরিব মানুষ তিন বেলার জায়গায় দুই বেলা খায়, আর যারা দুই বেলা খায় তারা খাওয়া একবেলায় নামিয়ে আনে। এতে তাদের কর্ম ও জীবনীশক্তি কমে যায়, অপুষ্ট একটি প্রজন্ম তৈরি হয়।
সাবেক ওই কৃষিসচিবের কথার প্রমাণ মেলে গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর ‘বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন পরিস্থিতি ও চাল পূর্বাভাস’ শীর্ষক দুটি প্রতিবেদনে। সেখানে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক দুই দফা বন্যার কারণে ফসলহানির চিত্র তুলে ধরে বলা হয়েছে, এই বছর খাদ্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ শতাংশ কম হতে পারে। সাত বছরের মধ্যে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন সবচেয়ে কম হবে। এর ফলে বাংলাদেশ সরকারকে ১২ লাখ টন চাল আমদানি করতে হচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন চাল রপ্তানিকারক দেশ থেকে আমদানির প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ায় বিশ্বে চালের দামও বেড়ে গেছে।
ওই প্রতিবেদনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাল খাওয়ার পরিমাণের একটি হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, ২০১৩-১৪ সময়ে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বেশি ও দাম ছিল কম। ওই সময়ে বাংলাদেশের মানুষ ৩ কোটি ৪৯ লাখ টন চালের ভাত খেয়েছে। ২০১৪-১৫ সালে এর পরিমাণ দুই লাখ টন বেড়ে যায়। ২০১৫-১৬ সালে চালের দাম বাড়তে থাকলে ভাত খাওয়ার পরিমাণ আবার দুই লাখ টন কমে যায়। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশে এর পরিমাণ আরও এক লাখ টন কমে যাবে বলে ‘চাল পূর্বাভাস’ নামের ইউএসডিএর ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদ বাঙালী কণ্ঠকে বলেন, চালের দাম মূলত বেড়েছে বন্যায় ফসল নষ্ট হওয়ার কারণে। সময়মতো চাল আমদানির সিদ্ধান্ত না নেওয়াটাও একটা বড় কারণ ছিল। তিনি মনে করেন, দেশের দুই কোটি হতদরিদ্র মানুষের জন্য ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে চাল কেনা বড় ধরনের সমস্যা। ফলে তাদের জন্য সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়াতে হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি গুদামের ধারণক্ষমতা বর্তমানে ১৭ লাখ টন। আর গুদামে বর্তমানে চাল আছে মাত্র ৩ লাখ ৬৬ হাজার টন। আপৎকালীন মজুত ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো চালিয়ে নিতে সরকারি গুদামে ৮ থেকে ১০ লাখ টন চাল থাকা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু ছয় মাস ধরে সরকারি গুদামের মজুত চার লাখ টনের ওপরে ওঠেনি।