বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ বাংলাদেশকে একসময় পাট দিয়ে চিনতো সারাবিশ্ব। কৃষকের এ পণ্য ছিল দেশের প্রধান অর্থকারী ফসল। রফতানি আয়ের সিংহভাগ আসতো পাট থেকে। নানা ঘটনা আর সময়ের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে পাটের সেই গৌরব। হারানো সেই গৌরব ফিরিয়ে আনতে পাট থেকে দেশেই ভিসকস (রেশম) উৎপাদনের পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ২০১৯ সালের মধ্যে দেশে পাট থেকে ভিসকস উৎপাদন শুরু হবে বলে বাঙালী কণ্ঠকে জানিয়েছেন পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম।
মির্জা আজম বাঙালী কণ্ঠকে বলে, পাট থেকে ভিসকস উৎপাদনের জন্য আন্তর্জাতিক মানের একটি ফিজিবিলিটি স্টাডি (সম্ভাবতা যাচাই) তৈরি করতে হবে। এ ফিজিবিলিটি স্টাডির প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ডিসেম্বরের ১৫ তারিখের মধ্যে আমরা এ বিষয়ে পরামর্শক নিয়োগ দেবো।
‘ভিসকস উৎপাদনের জন্য কারখানা প্রস্তুত রয়েছে। জায়গাও প্রস্তুত। মেশিনারিজ থেকে শুরু করে টেকনিক্যাল হ্যান্ড সবকিছু রেডি (প্রস্তুত)। একনেক (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি)-এ গেলে ফিজিবিলিটি স্টাডি চাইবে। কোনো কিছু ঘাটতি রেখে আমরা এটি একনেকে পাঠাতে চাই না। সে কারণে ফিজিবিলিটি স্টাডির জন্য আমরা অপেক্ষা করছি’- যোগ করেন পাট ও বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী।
‘সরকার পাটের ওপর অনেক জোর দিচ্ছে’ উল্লেখ করে মির্জা আজম বলেন, এখন যে কোনো পাটপণ্যে ২০ শতাংশ ইনসেটিভ দেয়া হচ্ছে। পাট এখন প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য। প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য হিসেবে ব্যাংকিং সুবিধা দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে আরো ১০ হাজার কোটি টাকার একটি রিজার্ভ ফান্ড বস্ত্র কারখানার জন্য রেখেছে, সেটিও ব্যবহারে আমরা চেষ্টা করছি।
পাটের জন্য বিভিন্ন সহায়তা দেয়া হলেও পাটের বীজের জন্য বাংলাদেশকে এখনো ভারতের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ৯০ শতাংশ পাটের বীজ ভারত থেকে আনতে হচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, পাটের বীজ দেশে উৎপাদন হয় ১০ শতাংশের মতো। বাকি ৯০ শতাংশ ভারত থেকে আমদানি করতে হয়।
“দেশেই পাটের বীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সহায়তার জন্য ‘রূপসী প্রকল্প’ নাম আমাদের একটি প্রকল্প ছিল। সেই প্রকল্পের ছন্দপতন ঘটেছে। আমার নতুন আর একটি প্রকল্প করে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার প্রস্তাব পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। মার্চ থেকে পাটের সিজন (মৌসুম)। এর আগে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি থেকে আমরা সহায়তাগুলো অব্যাহত রাখবো”- বলেন মির্জা আজম।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পাট দিয়ে বহুমুখী পণ্য উৎপাদান করে বাংলাদেশ বিশ্ব রফতানির বাজার ধরতে পারে। এক্ষেত্রে পর্দা, টেবিল ক্লথ, রানার, প্লেসমেট, কুশন কভার, সোফার কভার, কিচেন ওয়্যার, লন্ড্রি বাস্কেট, ফ্রুট বাস্কেট, স্টোরেজ প্রোডাক্ট, হ্যাঙ্গার, ক্রিসমাস ডেকোরেশন সামগ্রী, গার্ডেনিং প্রোডাক্ট, ফ্লোর কাভারিং প্রোডাক্ট, শপিং ও ফ্যাশনেবল প্রোডাক্ট, লাইফ স্টাইল ও টেকনিক্যাল টেক্সটাইল উৎপাদনে মনোযোগী হতে হবে। দেশেই ভিসকস উৎপাদন করতে পারলে এসব পণ্যের গুণগত মান অনেক বেড়ে যাবে।
ইন্টারন্যাশনাল জুট স্টাডি গ্রুপের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, বর্তমান বিশ্ব বাজারে শপিং ব্যাগের বার্ষিক চাহিদা ৫০ বিলিয়ন পিস। পরিবেশ সচেতনতা ও সবুজ পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে পাটের তৈরি শপিং ও ফুড গ্রেড ব্যাগ, কম্পোজিট, জিও-টেক্সটাইল, পাল্প (মণ্ড) ও কাগজের বিশাল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। টেক্সটাইল ফাইবার হিসেবে পাটের ব্যবহারের বাইরে টেকনিক্যাল টেক্সটাইলের আওতায় জুট ফাইবার ব্যবহারের মাধ্যমে এ সেক্টরে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।
ব্যবসায়ীদের মতে, প্রতি বছর প্রায় ৮০০ থেকে এক হাজার কোটি টাকার ভিসকস আমদানি করা হয়। পাট দিয়ে দেশে ভিসকস উৎপাদন করা গেলে পাট পণ্যে বৈচিত্র আসবে। পাশাপাশি পাট দিয়ে পাল্প (মণ্ড) ও পেপার উৎপদান করা সম্ভব। এক্ষেত্রে পাটচাষী ও ব্যবসায়ীদের উৎসাহিত করতে দেশের যেসব অঞ্চলে পাটের চাষ বেশি হয়, সেখানে পাল্প (মণ্ড) ও কাগজ প্রস্তুতকারী কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে। এতে সাশ্রয়ী মূল্যে পাট হতে পাল্প ও পেপার প্রস্তুত করা যাবে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমানে ক্রেতারা অধিকহারে পরিবেশবন্ধব পণ্য ক্রয়ে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। গ্রিন প্রোডাক্ট, ন্যাচারাল প্রোডাক্ট, ইকো ফ্রেন্ডলি প্রোডাক্টবা গো-গ্রিনের দাবি জোরালো হচ্ছে। এক্ষেত্রে পাট বা কেনাফ জাতীয় ফাইবার হতে পারে পরিবেশবন্ধব প্রধান পণ্য। বাংলাদেশে বিশ্বের সবচেয়ে সেরা মানের পাট উৎপাদান হয়। পাট উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় (প্রথম ভারত)। পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে পাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল করীম মুন্না বলেন, বিশ্ববাজারে চটের ব্যাগের পাশাপাশি হোম টেক্সটাইল, গিফট অ্যান্ড হাউজওয়্যার প্রোডাক্ট, ফ্যাশন অ্যাক্সেসরিজ অ্যান্ড লাইফস্টাইল প্রোডাক্ট উৎপাদনে ন্যাচারাল ম্যাটেরিয়ালস হিসেবে পাটের ব্যবহার দিনদিন বেড়ে চলেছে। পাটপণ্য বহুমুখী করে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ববাজর থেকে মোটা অংকের রফতানি আয় করা সম্ভব। এজন্য ব্যবসায়ীদের নীতিগত, অবকাঠামো ও বাজার ব্যবস্থাপনা- এ তিন ধরনের সহায়তা দিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, নীতিগত সহায়তা হিসেবে সরকারের রফতানি নীতিতে বহুমুখী পাটপণ্য উপ-খাতকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে হবে। যাতে প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে উদ্যোক্তারা তাদের সক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারেন। পাশাপাশি বিশেষায়িত খাত হিসেবে সরকার ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনা ছোট-বড় সবাই যাতে পায়, সেই পদক্ষেপ নিতে হবে। দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সম্ভাবনাময় বিভিন্ন বিশেষায়িত খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দেয়া বিশেষ ফান্ড (রফতানি উন্নয়ন তহবিল-ইডিএফ)-এর আদলে বিশেষ ঋণ সুবিধার আওতায় পাট শিল্পকে আনতে হবে।