পানির রাজনীতিতে ক্রমান্বয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে এশিয়া। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানি ইস্যুতে এশিয়ার দেশগুলো যুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে না গেলেও নিরাপত্তা পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। দীর্ঘদিনের পানি সংকটের কারণে এ অবস্থা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
শুধু তাই নয়; এর ফলে এ অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ অনিশ্চিত পরিণতির দিকে চালিত হতে পারে। পানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানির জটিল সমীকরণে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ও জাতি বর্তমানে যেভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছেন; তা অতীতে কখনও দেখা যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিদ্যমান পানি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ও অবকাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার পানির রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান হারে একচেটিয়া ভূমিকা পালন করছে চীন। এর অন্যতম একটি কারণ হলো, তিব্বতের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল শাসন করছে দেশটি। এছাড়া এন্টার্কটিকা ও সুমেরু অঞ্চলের পর সবচেয়ে বেশি বরফ ও তুষার রয়েছে হিমালয় পর্বতমালায়।
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম বৈশ্বিক ঝুঁকি সংক্রান্ত ২০১৬ সালের এক প্রতিবেদনে বলছে, আগামী ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাবপূর্ণ ঝুঁকি তৈরি হবে পানি সংকট ঘিরে। এশিয়ার মতো উন্নয়নশীল অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অসম উন্নয়নের ফলে সম্পদের ওপর অস্থিতিশীল চাপ তৈরি হবে। নিজেদের উন্নয়ন জাহির করতে অপ্রত্যাশিত উপায়ে জনগণ, প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতির ক্ষতি উপেক্ষিত হবে। পানির নিরাপত্তাকে জরুরি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করবে।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি সতর্ক করে দিয়ে বলছে, শিল্পায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়নের ক্ষতিকর প্রভাবের চেয়ে এশিয়ায় মারাত্মক সংকট তৈরি হবে পানি নিয়ে, যা ২০৫০ সালের মধ্যে প্রকট আকার ধারণ করতে পারে।
২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৯৭০ কোটিতে। এই সময় খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে ৬০ শতাংশ; পানির চাহিদা ৫৫ শতাংশ বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এসব কিছু মোকাবেলায় বেশি সংকটের মুখে পড়বে উন্নয়নশীল অঞ্চলগুলো; বিশেষ করে এশিয়া। এই অঞ্চলে জনসংখ্যা হবে ৩৪০ কোটি।
জাতিসংঘের বিশ্ব পানি উন্নয়ন প্রতিবেদন-২০১৬ বলছে, ১৪০ কোটিরও বেশি মানুষ অর্থাৎ বিশ্বের মোট কর্মশক্তির ৪২ শতাংশ পুরোপুরি পানির ওপর নির্ভরশীল; বিশেষ করে কৃষিনির্ভর এশিয়ায়। এ অঞ্চলের অর্ধেকেরও বেশি চাষাবাদ ভূ-গর্ভস্থ পানিনির্ভর। কিন্তু ভূগর্ভ থেকে পানি উত্তোলন প্রক্রিয়া নজরদারির বাইরে। আর এ পানি উত্তোলন ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছে।
ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের পরিমাণ বিশ্বের অন্যান্য অংশের চেয়ে বেশি এশিয়ায়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা (এফএও) বলছে, বিশ্বের মোট পানি উত্তোলনের প্রায় ৭০ শতাংশই হয় এশিয়ায়। এ অঞ্চলে পানি উত্তোলনে সবার চেয়ে এগিয়ে ভারত, চীন ও পাকিস্তান।
ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর অ্যাপ্লাইড সিস্টেমস অ্যানালাইসিস বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে পানি উত্তোলনের পরিমাণ বাড়বে ৩০ শতাংশ; কিন্তু এশিয়ার ৮৬ শতাংশ পানি উত্তোলন হবে ওই তিন দেশে।
ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং নেপালে ২ কোটি ৩০ লাখ পাম্প ব্যবহার করা হয়। পানি উত্তোলনে ব্যবহৃত এসব পাম্পের পেছনে বিদ্যুৎ খরচের পরিমাণ প্রায় ৩৭৮ কোটি মার্কিন ডলার। পানি সংরক্ষণ প্রযুক্তির অভাব, সরকারি অব্যবস্থাপনার কারণে পানি সংকটকে আরও প্রকট করে তুলছে। এডব্লিউডিওর সতর্ক সঙ্কেত বলছে, সীমিত জ্ঞানের কারণে পানি সংকটের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে এশিয়া।
পানি নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে এমন একটি নেতৃস্থানীয় পর্যায়ের সংগঠনের বিশ্লেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতে আন্তঃসীমান্ত সংঘাতের সূচনা পানি ঘাটতি নিয়ে নয় বরং প্রাপ্তির হার নিয়ে হবে। এশিয়ান ডেভলপমেন্ট ব্যাংক বলছে, বিশ্বে পানি নিরাপত্তাহীনতার বিপজ্জনক এলাকা হচ্ছে এশিয়া।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভারত, পাকিস্তানের ৫৭ বছরের সিন্ধু নদী পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে দুই প্রতিবেশি দেশের সম্পর্কে উত্তেজনা দেখা দেয়। এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি পর্যালোচনার নির্দেশ দেন। জম্মু-কাশ্মিরের উরি সেনাঘাটিতে জঙ্গি হামলায় ১৮ ভারতীয় সেনার প্রাণহানির প্রতিশোধের ঢেউ লাগে ওই পানি বণ্টন চুক্তিতে। একই সময়ে ব্রহ্মপুত্র নদের উজানে চীন বাঁধ নির্মাণ করে। এই বাঁধ দিয়ে তিব্বতে ৭৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ব্রহ্মপুত্র নদ ভারতের অরুণাচল প্রদেশ হয়ে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করেছে।
ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে ঢাকাকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে উৎসাহিত করতেই চীনের এই প্রকল্প। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে ফাটল ধরে এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা তৈরিতে চীন কূটনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে পানি ইস্যুর ব্যবহার করতে পারে।