ঢাকা , শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

জঙ্গিবাদের ভয়কে জয় করে রুখে দাঁড়াবার সময় এখন

খুজিস্তা নূর ই নাহারীন মুন্নী:

বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ নৃশংসতম গুলশান হামলার সঙ্গে জড়িত যে তরুণরা নিহত হয়েছে তাদের ছবি ও পরিচয় যতবার দেখেছি ততবার নিজেদের সন্তানের কথা ভেবে বিচলিত হয়েছি, উদ্বিগ্ন হয়েছি, ব্যথিত হয়েছি। মনে হয়েছে এদের কেউ একজন হতে পারত আমার সন্তান। ওদের জায়গায় যেতে পারত আমার সন্তান। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে দেখেছি, সবার অনুভূতি ও চিন্তা অভিন্ন হয়ে কাছাকাছি। যে তরুণরা এই নৃশংস হামলা চালিয়ে পৈশাচিকভাবে একে একে মানুষ জবাই ও গুলি করে হত্যা করেছে। বিশ্ববাসীর সামনে বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-অনুভূতি, মূল্যবোধ ও হৃদ্যতাকে জবাই করেনি, নিজেদেরকেও পৈশাচিক চরিত্রের ড্রাকুলার মত চিহ্নিত করেছে। এরা সবাই ধনাঢ্য আধুনিক পরিবারের সন্তানই নয়, দেশি-বিদেশী স্বনামধন্য স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া উচ্চ শিক্ষিত তরুণ। এদের নিয়ে বাবা-মায়ের বুক ভরা স্বপ্ন ছিল। তাদের নিজেদেরও লেখাপড়া শেষে ক্যারিয়ার গড়ে মানবিক জীবন-যাপনের মধ্যে দিয়ে সমাজে ইতিবাচক অনবদ্য ভূমিকা রেখে মানবিক হৃদয়ে শান্তি ও সুখের বসতি গড়ার জন্য ভূমিকা রাখার স্বপ্ন থাকার কথা ছিল। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নিজেদের তৈরি করার কথা ছিল আইডল হিসাবে। রূপকথার গল্পের নায়কের মত নিজেদের ইমেজ তৈরি করে সমাজকে ন্যায়-সুন্দর ও সত্যের পথে, আদর্শের পথে, সম্প্রীতির পথে টেনে নেবার কথা ছিল। কিন্তু পরিবারই নয় সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল স্বপ্ন আশা-আকাঙ্ক্ষার কবর রচনা করে মানবিক শক্তির বিরুদ্ধে দানবিক শক্তির কাছে তারা হেরে গেছে। সকল মানবিক গুণাবলীর পথ হারিয়ে দানবের অন্ধকার কালো শক্তির পথটিই তারা বেচে নিয়েছে। এতে করে ধর্মান্ধ, বিভ্রান্ত শক্তির কাছে নিজেদের সমর্পণ করে আত্মাহুতিই দেয়নি, ইতিহাসে নিন্দিতই করেনি, পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে তাদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করে গেছে। সমাজকে এবং জাতিকে বিশ্বমানবতার ইতিহাসে কলঙ্কিত করে গেছে। যে বয়সে রোমান্টিক মন নিয়ে  আবেগে স্বপ্ন দেখার কথা যুগলবন্ধি হবার। যে বয়সে স্বপ্ন দেখার কথা সুন্দর ভবিষ্যৎ ও আলোকিত সমাজ প্রতিষ্ঠায় টগবগে তারুণ্যর চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখার। সে বয়সে তারা নিজেদের জীবনকে অভিশপ্ত করে অন্ধকার শক্তির হয়ে কাজ করেছে। পরিবার সমাজ ও জাতির সকল স্বপ্ন আকাঙ্খাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে, জান্নাত লাভের বিভ্রান্ত মিথ্যা আশ্বাসে। গোটা জাতিকে এই ৬ জঙ্গি ঝাঁকুনিই দেয়নি, গোটা বাংলাদেশকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। গোটা ঢাকা নগরীতেই নয়, দেশজুড়েই ফের কখন জঙ্গি হামলা হয় এ আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। যে কালো শক্তির হয়ে তারা কাজ করেছে, তাতে নিজেদের জীবনই শেষ করেনি, দেশ-বিদেশের মানুষ হত্যায় বাংলাদেশের ইমেজকেও ক্ষুণ্ণ করে গেছে। তাদের অধরা কালো শক্তির ইচ্ছাটাকে বাস্তবায়ন করে গেছে। মাঝখানে পথে বসেছে তাদের পরিবার-পরিজন। জনজীবনে নেমে এসেছ অনিশ্চয়তা, ভয়-ভীতি, আতঙ্ক গ্রাস করেছে গোটা সমাজকে। ব্যবসা-বাণিজ্য, জীবনযাত্রায় ঘটেছে ছন্দপতন। যে গুলশান সন্ধ্যা নামলেই সরগরম হয়ে ওঠত, সেখানে নামছে ভূতুড়ে পরিবেশ। নামি-দামি হোটেল-রেস্তোঁরা দেশি-বিদেশী অতিথি শূণ্যতায় ফাঁকা হয়ে গেছে। রক্তাক্ত গুলশান ট্র্যাজেডি বা জঙ্গিবাদের এই ভয়াবহ আঘাতে আমাদের চিন্তা ও ভাবনার দুয়ার যেমন খুলেছে, তেমনি সময় এসেছে ভয়কে জয় করে রুখে দাঁড়াবার।

একদা সুবিধা বঞ্চিত অনগ্রসর শিক্ষাকেন্দ্র মাদ্রাসাগুলো যেখানে জঙ্গিবাদের উৎসস্থল মনে করা হত, সেখানে গুলশানের ভয়াবহ হামলা আমাদের আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে সমাজের সুবিধাভোগী পরিবারের উচ্চ শিক্ষিত আধুনিক বিজ্ঞান মনস্ক সন্তানরা সমাজ-সভ্যতা ও মানবিকতার বিরুদ্ধে বর্বর জঙ্গিবাদে যুক্ত হয়ে পড়ছে। সে ইংরেজি মাধ্যমের জনপ্রিয় স্কুল স্কলাস্টিকা পড়ুয়া হোক আর দেশের নাম করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ পড়ুয়াই হোক, কিংবা মালয়েশিয়ার নাম করা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াই হোক আমাদের তরুণদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ রাখতে আমাদের তারুণ্যর শক্তিকে আধুনিক উন্নত মানবিক চিন্তা ধারার সঙ্গে যুক্ত রাখতে সমাজ ও জাতীয় জীবনে তাদের মেধার স্বাক্ষর রাখার সুযোগ দিতে অগ্রসর ও প্রগতিশীল মুক্ত চিন্তা ও চেতনা নিয়ে এগিয়ে যেতে সার্বিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। তরুণ সমাজ একটি জাতি বা রাষ্ট্রের অমূল্য সম্পদ। এই সম্পদ বিপদগামী হতে দেওয়া যায় না। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের দিকে ঠেলে দেওয়া দূরে থাক, উল্টো তাদের মানবিক শক্তি দিয়ে দানবের শক্তিকে পরাস্ত করার উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মত আধুনিক বিশ্ব মানের শিক্ষাঙ্গনের লাইব্রেরীতে যদি  জিহাদি বই মেলে, ছাত্র বিভ্রান্ত করার শিক্ষক মেলে তাহলে অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কি হচ্ছে তা খতিয়ে দেখাই নয়, তাদের সামনে আদর্শিক পাঠদানের সময় এসেছে। আমরা মানুষ সৃষ্টির শিক্ষা চাই, জঙ্গি সৃষ্টির শিক্ষা নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে দরকার নিজস্ব ক্যাম্পাস যেখানে খেলাধূলা, ব্যায়াম, বিনোদন এবং চিত্তকে প্রফুল্ল ও আনন্দময় রাখতে, তারুণ্যর প্রাণের উচ্ছ্বাস ডানা মেলে ওড়ে যাওয়া পাখির মত ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ দিতে হলে, লেখাপড়ার পাশাপাশি তাদের বিনোদনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ক্যাম্পাসে জিম, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়মিত রাখার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়মিত পাঠ করানো। গুণীজনদের দিয়ে উদ্দীপনার বক্তৃতার আয়োজন। বার্ষিক ইনডোর-আউটডোর ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক সপ্তাহ, ছাত্রছাত্রীদের লেখা নিয়ে নিয়মিত বার্ষিকী প্রকাশ রাখা জরুরী। লাইব্রেরী থাকবে। কিন্তু তারুণ্য বিপথগামী হতে পারে এমন বই স্থান পাবে না। শিক্ষকরা পাঠ্য বইয়ের বাইরে কি পড়াচ্ছেন, কোন পথ দেখাচ্ছেন তা মনিটরিং করতে হবে। শুধু সরকার, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গিবাদের আক্রমণ মোকাবেলা করতে পারবে না। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক শক্তির এই ইস্যুতে অভিন্ন অবস্থান এবং সরকারি স্কুল-কলেজ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, বিনোদন, মুক্তচিন্তা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পরিবেশ নিশ্চিত করা। ছাত্রছাত্রীদের সৃজনশীলতার বিকাশে দেয়াল পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন, বার্ষিকীর প্রকাশনা এবং তাতে ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ উদ্ভূদ্ধ করণ এখন সময়ের দাবি। আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তাদের সামনে তুলে ধরা। জাতীয় দিবসগুলো থেকে শুরু করে নববর্ষের মত উৎসব পার্বণে শিক্ষাঙ্গন ভিত্তিক নানা আয়োজনে এক মোহনায় মিলিত করা খুবই প্রয়োজন। অভিযোগ রয়েছে ঢাকাসহ ঢাকার বাইরে অসংখ্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে শিক্ষক অনুপস্থিতির উদাসীনতা দৃশ্যমান। নানা মার্কেট-শপিং মলে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে ওঠেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। না আছে ক্যাম্পাস, না আছে চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা। দম বন্ধ পরিবেশে ছাত্রছাত্রীরা হতাশা ও বিষাদে ভুগছে। ইন্টারনেটে ঢুকতে ঢুকতে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে বিভ্রান্ত শক্তির ডাকে। এভাবেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মত সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্যাম্পাস, শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতির পরিবেশ নিশ্চিত করে শিক্ষাঙ্গন ভিত্তিক নবজাগরণ ঘটিয়ে তারুণ্যর নবশক্তিকে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শান্তি ও মানবিক সৌহার্দ্য সম্প্রীতির, আদর্শে উদ্ভূদ্ধ করে কালো শক্তিকে পরাস্ত করার সময় এখন। এখন জঙ্গিবাদের ভয়কে জয় করে রুখে দাঁড়াবার সময়।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জঙ্গিবাদের ভয়কে জয় করে রুখে দাঁড়াবার সময় এখন

আপডেট টাইম : ০৫:৩২ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৭ জুলাই ২০১৬

খুজিস্তা নূর ই নাহারীন মুন্নী:

বাংলাদেশের ইতিহাসে ভয়াবহ নৃশংসতম গুলশান হামলার সঙ্গে জড়িত যে তরুণরা নিহত হয়েছে তাদের ছবি ও পরিচয় যতবার দেখেছি ততবার নিজেদের সন্তানের কথা ভেবে বিচলিত হয়েছি, উদ্বিগ্ন হয়েছি, ব্যথিত হয়েছি। মনে হয়েছে এদের কেউ একজন হতে পারত আমার সন্তান। ওদের জায়গায় যেতে পারত আমার সন্তান। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে দেখেছি, সবার অনুভূতি ও চিন্তা অভিন্ন হয়ে কাছাকাছি। যে তরুণরা এই নৃশংস হামলা চালিয়ে পৈশাচিকভাবে একে একে মানুষ জবাই ও গুলি করে হত্যা করেছে। বিশ্ববাসীর সামনে বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-অনুভূতি, মূল্যবোধ ও হৃদ্যতাকে জবাই করেনি, নিজেদেরকেও পৈশাচিক চরিত্রের ড্রাকুলার মত চিহ্নিত করেছে। এরা সবাই ধনাঢ্য আধুনিক পরিবারের সন্তানই নয়, দেশি-বিদেশী স্বনামধন্য স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া উচ্চ শিক্ষিত তরুণ। এদের নিয়ে বাবা-মায়ের বুক ভরা স্বপ্ন ছিল। তাদের নিজেদেরও লেখাপড়া শেষে ক্যারিয়ার গড়ে মানবিক জীবন-যাপনের মধ্যে দিয়ে সমাজে ইতিবাচক অনবদ্য ভূমিকা রেখে মানবিক হৃদয়ে শান্তি ও সুখের বসতি গড়ার জন্য ভূমিকা রাখার স্বপ্ন থাকার কথা ছিল। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নিজেদের তৈরি করার কথা ছিল আইডল হিসাবে। রূপকথার গল্পের নায়কের মত নিজেদের ইমেজ তৈরি করে সমাজকে ন্যায়-সুন্দর ও সত্যের পথে, আদর্শের পথে, সম্প্রীতির পথে টেনে নেবার কথা ছিল। কিন্তু পরিবারই নয় সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল স্বপ্ন আশা-আকাঙ্ক্ষার কবর রচনা করে মানবিক শক্তির বিরুদ্ধে দানবিক শক্তির কাছে তারা হেরে গেছে। সকল মানবিক গুণাবলীর পথ হারিয়ে দানবের অন্ধকার কালো শক্তির পথটিই তারা বেচে নিয়েছে। এতে করে ধর্মান্ধ, বিভ্রান্ত শক্তির কাছে নিজেদের সমর্পণ করে আত্মাহুতিই দেয়নি, ইতিহাসে নিন্দিতই করেনি, পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে তাদেরকে প্রশ্নবিদ্ধ করে গেছে। সমাজকে এবং জাতিকে বিশ্বমানবতার ইতিহাসে কলঙ্কিত করে গেছে। যে বয়সে রোমান্টিক মন নিয়ে  আবেগে স্বপ্ন দেখার কথা যুগলবন্ধি হবার। যে বয়সে স্বপ্ন দেখার কথা সুন্দর ভবিষ্যৎ ও আলোকিত সমাজ প্রতিষ্ঠায় টগবগে তারুণ্যর চোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখার। সে বয়সে তারা নিজেদের জীবনকে অভিশপ্ত করে অন্ধকার শক্তির হয়ে কাজ করেছে। পরিবার সমাজ ও জাতির সকল স্বপ্ন আকাঙ্খাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে, জান্নাত লাভের বিভ্রান্ত মিথ্যা আশ্বাসে। গোটা জাতিকে এই ৬ জঙ্গি ঝাঁকুনিই দেয়নি, গোটা বাংলাদেশকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। গোটা ঢাকা নগরীতেই নয়, দেশজুড়েই ফের কখন জঙ্গি হামলা হয় এ আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে। যে কালো শক্তির হয়ে তারা কাজ করেছে, তাতে নিজেদের জীবনই শেষ করেনি, দেশ-বিদেশের মানুষ হত্যায় বাংলাদেশের ইমেজকেও ক্ষুণ্ণ করে গেছে। তাদের অধরা কালো শক্তির ইচ্ছাটাকে বাস্তবায়ন করে গেছে। মাঝখানে পথে বসেছে তাদের পরিবার-পরিজন। জনজীবনে নেমে এসেছ অনিশ্চয়তা, ভয়-ভীতি, আতঙ্ক গ্রাস করেছে গোটা সমাজকে। ব্যবসা-বাণিজ্য, জীবনযাত্রায় ঘটেছে ছন্দপতন। যে গুলশান সন্ধ্যা নামলেই সরগরম হয়ে ওঠত, সেখানে নামছে ভূতুড়ে পরিবেশ। নামি-দামি হোটেল-রেস্তোঁরা দেশি-বিদেশী অতিথি শূণ্যতায় ফাঁকা হয়ে গেছে। রক্তাক্ত গুলশান ট্র্যাজেডি বা জঙ্গিবাদের এই ভয়াবহ আঘাতে আমাদের চিন্তা ও ভাবনার দুয়ার যেমন খুলেছে, তেমনি সময় এসেছে ভয়কে জয় করে রুখে দাঁড়াবার।

একদা সুবিধা বঞ্চিত অনগ্রসর শিক্ষাকেন্দ্র মাদ্রাসাগুলো যেখানে জঙ্গিবাদের উৎসস্থল মনে করা হত, সেখানে গুলশানের ভয়াবহ হামলা আমাদের আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে সমাজের সুবিধাভোগী পরিবারের উচ্চ শিক্ষিত আধুনিক বিজ্ঞান মনস্ক সন্তানরা সমাজ-সভ্যতা ও মানবিকতার বিরুদ্ধে বর্বর জঙ্গিবাদে যুক্ত হয়ে পড়ছে। সে ইংরেজি মাধ্যমের জনপ্রিয় স্কুল স্কলাস্টিকা পড়ুয়া হোক আর দেশের নাম করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ পড়ুয়াই হোক, কিংবা মালয়েশিয়ার নাম করা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াই হোক আমাদের তরুণদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ রাখতে আমাদের তারুণ্যর শক্তিকে আধুনিক উন্নত মানবিক চিন্তা ধারার সঙ্গে যুক্ত রাখতে সমাজ ও জাতীয় জীবনে তাদের মেধার স্বাক্ষর রাখার সুযোগ দিতে অগ্রসর ও প্রগতিশীল মুক্ত চিন্তা ও চেতনা নিয়ে এগিয়ে যেতে সার্বিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। তরুণ সমাজ একটি জাতি বা রাষ্ট্রের অমূল্য সম্পদ। এই সম্পদ বিপদগামী হতে দেওয়া যায় না। জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের দিকে ঠেলে দেওয়া দূরে থাক, উল্টো তাদের মানবিক শক্তি দিয়ে দানবের শক্তিকে পরাস্ত করার উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মত আধুনিক বিশ্ব মানের শিক্ষাঙ্গনের লাইব্রেরীতে যদি  জিহাদি বই মেলে, ছাত্র বিভ্রান্ত করার শিক্ষক মেলে তাহলে অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কি হচ্ছে তা খতিয়ে দেখাই নয়, তাদের সামনে আদর্শিক পাঠদানের সময় এসেছে। আমরা মানুষ সৃষ্টির শিক্ষা চাই, জঙ্গি সৃষ্টির শিক্ষা নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে দরকার নিজস্ব ক্যাম্পাস যেখানে খেলাধূলা, ব্যায়াম, বিনোদন এবং চিত্তকে প্রফুল্ল ও আনন্দময় রাখতে, তারুণ্যর প্রাণের উচ্ছ্বাস ডানা মেলে ওড়ে যাওয়া পাখির মত ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ দিতে হলে, লেখাপড়ার পাশাপাশি তাদের বিনোদনের পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ক্যাম্পাসে জিম, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড নিয়মিত রাখার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়মিত পাঠ করানো। গুণীজনদের দিয়ে উদ্দীপনার বক্তৃতার আয়োজন। বার্ষিক ইনডোর-আউটডোর ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক সপ্তাহ, ছাত্রছাত্রীদের লেখা নিয়ে নিয়মিত বার্ষিকী প্রকাশ রাখা জরুরী। লাইব্রেরী থাকবে। কিন্তু তারুণ্য বিপথগামী হতে পারে এমন বই স্থান পাবে না। শিক্ষকরা পাঠ্য বইয়ের বাইরে কি পড়াচ্ছেন, কোন পথ দেখাচ্ছেন তা মনিটরিং করতে হবে। শুধু সরকার, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গিবাদের আক্রমণ মোকাবেলা করতে পারবে না। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক শক্তির এই ইস্যুতে অভিন্ন অবস্থান এবং সরকারি স্কুল-কলেজ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, বিনোদন, মুক্তচিন্তা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পরিবেশ নিশ্চিত করা। ছাত্রছাত্রীদের সৃজনশীলতার বিকাশে দেয়াল পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন, বার্ষিকীর প্রকাশনা এবং তাতে ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ উদ্ভূদ্ধ করণ এখন সময়ের দাবি। আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তাদের সামনে তুলে ধরা। জাতীয় দিবসগুলো থেকে শুরু করে নববর্ষের মত উৎসব পার্বণে শিক্ষাঙ্গন ভিত্তিক নানা আয়োজনে এক মোহনায় মিলিত করা খুবই প্রয়োজন। অভিযোগ রয়েছে ঢাকাসহ ঢাকার বাইরে অসংখ্য কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে শিক্ষক অনুপস্থিতির উদাসীনতা দৃশ্যমান। নানা মার্কেট-শপিং মলে ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে ওঠেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। না আছে ক্যাম্পাস, না আছে চিত্ত বিনোদনের ব্যবস্থা। দম বন্ধ পরিবেশে ছাত্রছাত্রীরা হতাশা ও বিষাদে ভুগছে। ইন্টারনেটে ঢুকতে ঢুকতে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে বিভ্রান্ত শক্তির ডাকে। এভাবেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মত সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্যাম্পাস, শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতির পরিবেশ নিশ্চিত করে শিক্ষাঙ্গন ভিত্তিক নবজাগরণ ঘটিয়ে তারুণ্যর নবশক্তিকে জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শান্তি ও মানবিক সৌহার্দ্য সম্প্রীতির, আদর্শে উদ্ভূদ্ধ করে কালো শক্তিকে পরাস্ত করার সময় এখন। এখন জঙ্গিবাদের ভয়কে জয় করে রুখে দাঁড়াবার সময়।