বাংলাদেশ এমনই একটি দেশ, প্রতিদিনই কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর থাকেই পত্রিকার পাতায়। এসব খবর পড়ি আবার ভুলেও যাই একসময়। এত খবর মাথায় রাখার মতো ধারণক্ষমতা বোধ হয় নেই আমাদের মস্তিষ্কে। কিন্তু গতকাল একটি খবর পড়ার পর থেকে কিছুতেই ভুলতে পারছি না খবরটা। পত্রিকায় পড়লাম, একটি মেয়েকে আট বছর ধরে ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। আর এ কাজে সহযোগিতা করেছে মেয়েটিরই আপন মা। খবরটা পড়ার পর, আমার বারবার মনে হচ্ছিল, তিনি কি মেয়েটির আপন মা? আমি আবারও পড়লাম খবরটা, হ্যাঁ মেয়েটির আপন মা তিনি! সৎবাবা মেয়েটির মায়ের সহযোগিতায় মেয়েটিকে দীর্ঘ আট বছর ধর্ষণ করেছে।
আমি বিস্মিত, হতভম্ব, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আমি ভাবতেই পারছি না, কোনো মা তার কন্যার সাথে এমন কিছু করতে পারে। এর আগে অনেকবারই পত্রিকায় পড়েছি, পিতার দ্বারা কন্যা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তাই যখন জানলাম, মেয়েটির সৎবাবা মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছে, খুব একটা অবাক হইনি তখনো। ভাবলাম, আজকাল আপন বাবারাই যেভাবে হরহামেশা নিজের মেয়েকে ধর্ষণ করছে, সেখানে সৎবাবা আর কতটা ভালো হবে। কিন্তু এই ঘটনাটি একেবারেই অপ্রত্যাশিত। একটি মেয়ের আপন মায়ের সহযোগিতায় ওই মেয়েটিকে ধর্ষিত হতে হয়েছে, এটা আমার চিন্তারও বাইরে! পত্রিকার খবর বলছে, মেয়েটি অভিযোগ করেছে যে, ১৩ বছর বয়সে একবার গর্ভবতীও হতে হয়েছে তাকে। এরপর তার মা হাসপাতালে নিয়ে সে বাচ্চা নষ্ট করেছেন।
এই মা যে একজন অসুস্থ্ ও বিকৃত মানসিকতার অধিকারী, কোনো সন্দেহ নেই তাতে। নিশ্চিতভাবেই এমন একজন/দুজন মা আমাদের সমাজের সব মাকে প্রতিনিধিত্ব করে না। নিশ্চয়ই এই ঘটনা জানতে পেরে, মায়েরা আজ বিব্রত বোধ করছেন, বিস্মিত হচ্ছেন কীভাবে একজন মা পারে এমন একটি ন্যক্কারজনক কাজ করতে। জানা যায়, মেয়েটির বাবা বিদেশে থাকতেন। তার অনুপস্থিতিতে মেয়েটির মা অন্য এক পুরুষের সাথে সম্পর্কে জড়ান। মেয়েটির বয়স যখন আট থেকে নয় বছর তখন থেকেই তার মায়ের ওই প্রেমিক নিজেকে মেয়েটির মামা পরিচয় দিয়ে মেয়েটির বাসায় আসা-যাওয়া করত। ১০ বছর বয়স থেকেই মেয়েটির মা নাকি মেয়েটিকে জোর করে ওই তথাকথিত মামার কাছে পাঠাত রাতে ঘুমানোর জন্য। অর্থাৎ খুব অল্প বয়স থেকেই মেয়েটি বিকৃত যৌনাচারের শিকার হয়েছে।
আচ্ছা, হঠাৎ করে মায়েরা সন্তানদের জন্য এতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছেন কেন? কয়েক মাস আগেই খবর বের হলো, মাহফুজা নামের এক মা তার দুই সন্তানকে হত্যা করেছে! এবার আবার খবর বের হলো, মায়ের সহযোগিতায় দীর্ঘ আট বছর ধরে এই সৎবাবা তার কন্যাকে ধর্ষণ করে আসছে। এনারা কি সেই মা, যারা দীর্ঘ দশ মাস ধরে সীমাহীন কষ্ট সহ্য করে তার সন্তান জন্ম দেন? যে মা নিজে না খেয়ে সন্তানের জন্য খাবার জমিয়ে রাখেন, যে মা সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজের শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দেন, সেই মায়েরা কীভাবে পারছেন এভাবে সন্তানের ক্ষতি করতে?
আমাদের সমাজে খুন, ধর্ষণ সব সময়ই ছিল। এসব ঘটনা সচরাচর ঘটাতেন অনাত্মীয়রা বা আত্মীয়রা। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন একটি অবক্ষয় আমাদের সমাজে ঢুকে পড়েছে। সমাজের এই অবক্ষয়ের কারণে আজ সন্তান তার বাবা-মাকে খুন করছে, মা খুন করছে তার সন্তানদের আবার বাবা ধর্ষণ করছে নিজের মেয়েকে। এর কারণ হিসেবে অনেকেই হয়তো দায়ী করবেন মাদক বা পরকীয়া সম্পর্ককে। কিন্তু আমার মনে হয়, এই চেয়েও বড় কারণ রয়েছে যা আমরা খালি চোখে দেখতে পাচ্ছি না। আমরা কি বুঝতে পারি, আমাদের পারিবারিক সম্পর্কগুলো কেমন যেন হালকা হয়ে গেছে। আর এ কারণেই হয়তো, মাদকের প্রতি আসক্তি বা পরকীয়ার মতো ঘটনাগুলোও বাড়ছে। সেই সাথে যোগ হয়েছে অপরাধীর অপরাধ করার সাহস। অপরাধীরা দেখছে তনু, মিতুরা হত্যা হচ্ছে, অপরাধীরা থাকছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। আবার শাজনীনদের হত্যার বিচার পেতে সময় লাগছে দেড় যুগ। কাজেই এসব দেখে অপরাধীরা তো উৎসাহিত হবেই অপরাধ করতে।
তবে, সবচে বড় সত্যিটা হলো, সন্তানের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় হলো তার মা। সেই মা-ই যদি হয়ে ওঠেন সন্তানের ঘাতক, তবে পৃথিবীর কোনো সন্তানই আর সুরক্ষিত থাকতে পারবে না। একজন মা-ই যদি তার কন্যাকে ধর্ষকের হাতে তুলে দেন, তবে সেই কন্যার আর বাইরে যেতে হবে না, নিজের ঘরেই সে ধর্ষিত হবে বছরের পর বছর, কেউ জানতেও পারবে না। লেখক: সাংবাদিক।