বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ নদীর কিনার ঘেঁষে কাশগুচ্ছে মৃদু হাওয়ার দোলা। মাথার ওপর নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মতো ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘ কিংবা শিউলিতলায় ফুলের গল্পব্দমাখা স্নিগ্ধ ভোর—ইট-কংক্রিটের নাগরিক জীবনে শরতের এ রূপ দেখা এখন কল্পনায়ও আসে না। তারপরও প্রকৃতির নিয়মে ঝকঝকে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা জানিয়ে দেয় শরৎ এসেছে। গ্রামাঞ্চল আর বহমান নদ-নদী পাড়জুড়ে সাদা কাঁশ তাই জানান দিচ্ছে, শ্রাবণ ফুরিয়ে গেছে, এসেছে শরৎ।
শুক্রবার (১৬ আগস্ট) ভাদ্রের পয়লা তারিখ, শরৎ ঋতুর সূচনা দিন।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ প্রিয় শরৎকে স্বাগত জানিয়ে লিখেছিলেন, ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা—নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা/এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে,/এসো নির্মল নীলপথে’।
শরৎ শুধু প্রকৃতিতেই পরিবর্তন আনে না; বদলে দেয় মানুষের মনও। সেই পরিবর্তনের কথাও কবিগুরুর কাব্যে রয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘শিউলি ফুলের মালা দোলে শারদ-রাতের বুকে ঐ/এমন রাতে একলা জাগি সাথে জাগার সাথী কই’।
ঋতুচক্রে বিচিত্র সব অনুভূতি-জাগানিয়া শরৎ এখন। প্রিয় ঋতু শরতের রঙ গায়ে মেখেছে প্রকৃতি।
ভাদ্র মাসের নানা বৈশিষ্ট্য। তালপাকা গরম পড়ে এ মাসে। ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে যায় জনজীবন। অল্পবিস্তর বৃষ্টি হয় বটে, কিন্তু দুঃসহ গরম থেকে যায়। বাড়ে দুর্ভোগ। গ্রামগঞ্জের কাজের বেশ অভাব থাকে এ সময়। দিনমজুর, সাধারণ মেহনতি মানুষকে তাই যথেষ্ট ভুগতে হয়।
শরৎবন্দনা বাংলা সাহিত্যে বেশ আছে। কবি আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর’।
শরতের আভাস স্পস্ট করে পেতে অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী মাস আশ্বিন পর্যন্ত।
নিত্যদিনের জীবনযাপনের ক্লান্তি ও বেঁচের থাকার লড়াই, তার ফাঁকে কখন ভাদ্র এলো বা না এলো, তার খবর রাখার ফুসরত অনেকেরই নেই। বাংলা সন-তারিখের কদর ও চর্চা মূলত গ্রামগঞ্জেই বহাল আছে। চাষীরা বলে দিতে পারেন বাংলা মাসের কত তারিখ আজ। নিরক্ষর, শিক্ষাবঞ্চিত হলেও এটা তারা সহজেই মনে রাখতে পারেন। এই দেশের কৃষিব্যবস্থা বাংলা মাসের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত বলে এই তাদের মনে রাখতেই হয়।
আজকাল শস্য বুননের সময়-পদ্ধতি-কার্যক্রম আর সনাতনী নেই। তারপরও বাংলা মাসের কার্যকারিতা রয়ে গেছে। শহরের মানুষ বাংলা সন-তারিখের ধার ধারেন না। কখন কোন মাস চলছে, সে খবরও তারা বিশেষ একটা রাখেন না। এই যে নীরব উপেক্ষা-অবহেলা তা সত্ত্বেও প্রকৃতি তার নিজের নিয়মে চলতে থাকে। ঋতু বদল হতে থাকে চুপিসারে, নগরজীবনে অতিমাত্রায় ব্যস্ত মানুষের চোখের আড়ালে অলক্ষ্যে। ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি তার রূপ-সৌন্দর্যও কম-বেশি বদলায়। আকাশের চেহারা পাল্টে যায়, ফলফুলে প্রকৃতি একেক ঋতুর বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরে। সেটা সাধারণত বোদ্ধা, রসিকজনের চোখেই ধরা পড়ে।
প্রকৃতির রূপবদলে সবসময়ই ফুলের ভূমিকা অনেকখানি। এই শরতে নানা রকম ফুলের বর্ণিল উচ্ছ্বাস, প্রস্ফুটন আর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। সচাচর বর্ষার ফুল ফোটাই অব্যাহত থাকে এই শরতে।
প্রকৃতিবিষয়ক সংগঠন ‘তরুপল্লব’-এর সাধারণ সম্পাদক ও প্রকৃতিবিষয়ক গবেষক মোকারম হোসেন সাংবাদিককে বলেন, শরতের ফুল মূলত তিনটি—কাঁশ, শিউলি ও পদ্মা। শরতের শেষ দিকে ফোটে ছাতিম ফুল। খালে বিলে ঝিলে ফোটে সৌন্দর্যবর্ধক লাল শাপলা-শালুক ফোটে। আরও ফোটে কলমি ফুল। পূর্ণিমার রাতে শাপলা-শালুকের এই ফুটন্ত দৃশ্য বড়ই মায়াবি। এই দুর্লভ দৃশ্য শুধু এই শরতে দেখা মেলে। কৃষ্ণচূড়া ফুল এখনও ফুটবে কিছু কিছু। এ সময়ের ফুলের মধ্যে রয়েছে হলুদ রঙা সোনাইল বা বান্দরলাঠি, বিলিতি জারুল, শ্বেতকাঞ্চন, এলামেন্ডা ইত্যাদি। বর্ষার ফুলের মধ্যে কামিনী তো আছেই। দু’চারটি গন্ধরাজও থাকবে। ফুরুস (চেরি) ও থাকবে এই সময়টায়।
ফলের মধ্যে রয়েছে আমলকি ও জলপাই। এই শরতে উদযাপিত হয় হিন্দুধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দূর্গোৎসব। মণ্ডপে মণ্ডপে বাজে ঢাক। সেই ঢাকের সাজ-সজ্জাতে ব্যবহৃত হয় কাঁশফুল। শীতের আগমনী বার্তা শুরু হয় এই শরতেই। শরতের শেষ দিকে ঘাসের ডগায় পরতে থাকে শিশির বিন্দু।