ঢাকা , শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রোদে ধান শুকানো ব্যস্ত কৃষকরা

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ রইদের (রোদ) লাগি হায় হায় করছি, যদি রইদ না উঠত তাইলে সব ধানঅই নষ্ট হইয়া যাইত। প্রায় দেড়’শ মণ ধানও গেরা (চারা গজানো) আইছে। আইজকা (আজ) রইদ না দিলে এই ধান খাওনও গেল নায়, বেচনও গেলনায়। রইদ উঠায় ধান হুকাইতাম পারতাছি।’

টানা বৃষ্টিপাতের পর গতকাল শনিবার দিনভর কড়া রোদে ধান শুকানোর বিষয়ে এভাবেই বলছিলেন, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার লক্ষণশ্রী ইউনিয়নের হালুয়াঘাট গ্রামের কৃষাণী নুরুন নাহার (৩৫)।

গতকাল দুপুরে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের পশ্চিম দিকে জেলা কারাগারের রাস্তায় ধান শুকাচ্ছিলেন তিনি। অতিবৃষ্টির কারণে ধান শুকানোর খলা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আশপাশের পাকা সড়কের উপর ধান শুকানোর কাজ করছেন স্থানীয় কৃষকরা।

কৃষাণী নুরুন নাহার জানান, হাওরে তাদের নিজেদের জমি মাত্র ৩ কেদার। বর্গা নিয়ে চলতি বোরো মওসুমে ১৮ কেদার জমি চাষ করেছিলেন তার স্বামী আব্দুল গফফার। জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে কয়েকদিন আগেই, তবে টানা বৃষ্টিপাতের কারণে রোদ না থাকায় ধান শুকাতে পারছিলেন না। ১৫০ মণ ধান ভেজা ছিল তাদের। এর মধ্যে অনেক ধানেই চারা গজিয়েছে। ধান শুকালেও অনেক ক্ষতি হয়েছে তাদের।

একই গ্রামের কৃষাণী রাহেলা বেগম (৪৫) বলেন,‘টানা বৃষ্টিপাতের কারণে ধান শুকানোর খলায় অনেক কাদা হয়ে গেছে। রোদের অভাবে ভেজা ধান স্তুপে থাকতে থাকতে চারা গজিয়ে, সেদ্ধ হয়ে প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। চারা গজানো ও সেদ্ধ ধান শুকালে কোনো কাজে আসবে না। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, চারা গজানো ধান মেশিনে দিলে চাল পাওয়া যায় না। সেদ্ধ ধানের চাল গন্ধের জন্য খাওয়া যায় না। তবুও রোদে শুকানো যাচ্ছে। ’

টানা ১০-১২ দিন বৃষ্টিপাতের পর কড়া রোদ থাকায় হাওরপাড়ের হাজার হাজার কৃষক পরিবার ভেজা ধান ও গবাদিপশুর জন্য খড় শুকানোর সুযোগ পেয়েছেন। ধান ও খড় শুকানোর সুযোগ পাওয়ায় গতকাল শনিবার কৃষকদের মুখে ছিল হাসির ঝিলিক। রোদে পুড়েই ধান শুকিয়েছেন কৃষাণ-কৃষাণীরা।’

জানা যায়, চলতি বোরো মওসুমে সুনামগঞ্জের ১১ টি উপজেলায় ২ লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে (চাল) ৮ লাখ ৯৩ হাজার মে.টন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পুনর্বাসনে জেলার ৩ লাখ কৃষক পরিবারকে ৫ কেজি করে বীজ ধান, ৩০ কেজি রাসায়নিক সার ও নগদ ১ হাজার করে সাড়ে ৫৮ কোটি টাকার কৃষি ভর্তুকি প্রদান করেছে।

জেলার ছোট-বড় ৫২টি হাওরের বোরো ফসলরক্ষায় বাঁধ নির্মাণ কাজ করেছে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিকে (পিআইসি)। বাঁধ নির্মাণে ৯৬৬ টি পিআইসিকে ১৭৭ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ প্রদান করেছে। পিআইসি প্রায় ১৪০০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করেছে। ইতোমধ্যে পিআইসির অনুকূলে ১৩৩ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে।

তাহিরপুর উপজেলার মধ্য তাহিরপুর গ্রামের কৃষক নিয়ামুল হক চৌধুরী বলেন,‘ রোদ না থাকায় ভেজা ধান নিয়ে ছোট-বড় সব কৃষক পরিবারই একই দুর্ভোগে পড়েছিল। গত শুক্রবার কিছুটা ও শনিবার কড়া রোদ থাকায় আমাদের রক্ষা হয়েছে। না হলে সব ভেজা ধানই পঁচে যেত। ’

জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শামীম আল ইমরান বলেন,‘ গত বছর বোরো ফসলহানির পর চলতি বোরো মওসুমে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছিল। কিন্তু হাওরে যখন পুরোদমে ধান কাটা শুরু হয় তখনই টানা বৃষ্টিপাত শুরু হয়। এতে করে কৃষকদের চরম দুর্ভোগ দেখা দিয়েছিল। রোদের অভাবে কৃষকদের ধানে চারা গজিয়েছে। তবে গত দুইদিন ধরে রোদ থাকায় ধান ও খড় দু’টোই শুকাতে পারছেন তারা। ’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক স্বপন কুমার সাহা বলেন,‘ হাওরের প্রায় ৯০ ভাগ ধান কাটা হয়ে গেছে। কয়েকদিন বৃষ্টিপাত হওয়ায় ধান শুকাতে একটু সমস্যা ছিল, তবে গত দুই দিন ধরে রোদ থাকায় ধান শুকানো যাচ্ছে। আমরা আশা করছি আগামী কয়েকদিনের মধ্যে হাওরের সব ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানোর কাজ শেষ হয়ে যাবে।’

সিলেট আবহাওয়া অফিসের প্রধান আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন,‘ প্রকৃতির গতিবিধি বুঝা খুবই মুশকিল। টানা বৃষ্টির কারণে কৃষকদের দুর্ভোগ ছিল চরমে। তবে গত দুইদিন সুনামগঞ্জ হাওর অঞ্চলে রোদ ছিল। আজ রোববার ও আগামীকাল সোমবার আবহাওয়া কৃষকদের অনুকূলে থাকবে। দুইদিন বৃষ্টিপাত হলেও হালকা হবে, ভারী বা মাঝারি বৃষ্টি হওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই।’

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

রোদে ধান শুকানো ব্যস্ত কৃষকরা

আপডেট টাইম : ১০:২৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৩ মে ২০১৮

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ রইদের (রোদ) লাগি হায় হায় করছি, যদি রইদ না উঠত তাইলে সব ধানঅই নষ্ট হইয়া যাইত। প্রায় দেড়’শ মণ ধানও গেরা (চারা গজানো) আইছে। আইজকা (আজ) রইদ না দিলে এই ধান খাওনও গেল নায়, বেচনও গেলনায়। রইদ উঠায় ধান হুকাইতাম পারতাছি।’

টানা বৃষ্টিপাতের পর গতকাল শনিবার দিনভর কড়া রোদে ধান শুকানোর বিষয়ে এভাবেই বলছিলেন, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার লক্ষণশ্রী ইউনিয়নের হালুয়াঘাট গ্রামের কৃষাণী নুরুন নাহার (৩৫)।

গতকাল দুপুরে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের পশ্চিম দিকে জেলা কারাগারের রাস্তায় ধান শুকাচ্ছিলেন তিনি। অতিবৃষ্টির কারণে ধান শুকানোর খলা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আশপাশের পাকা সড়কের উপর ধান শুকানোর কাজ করছেন স্থানীয় কৃষকরা।

কৃষাণী নুরুন নাহার জানান, হাওরে তাদের নিজেদের জমি মাত্র ৩ কেদার। বর্গা নিয়ে চলতি বোরো মওসুমে ১৮ কেদার জমি চাষ করেছিলেন তার স্বামী আব্দুল গফফার। জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে কয়েকদিন আগেই, তবে টানা বৃষ্টিপাতের কারণে রোদ না থাকায় ধান শুকাতে পারছিলেন না। ১৫০ মণ ধান ভেজা ছিল তাদের। এর মধ্যে অনেক ধানেই চারা গজিয়েছে। ধান শুকালেও অনেক ক্ষতি হয়েছে তাদের।

একই গ্রামের কৃষাণী রাহেলা বেগম (৪৫) বলেন,‘টানা বৃষ্টিপাতের কারণে ধান শুকানোর খলায় অনেক কাদা হয়ে গেছে। রোদের অভাবে ভেজা ধান স্তুপে থাকতে থাকতে চারা গজিয়ে, সেদ্ধ হয়ে প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। চারা গজানো ও সেদ্ধ ধান শুকালে কোনো কাজে আসবে না। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, চারা গজানো ধান মেশিনে দিলে চাল পাওয়া যায় না। সেদ্ধ ধানের চাল গন্ধের জন্য খাওয়া যায় না। তবুও রোদে শুকানো যাচ্ছে। ’

টানা ১০-১২ দিন বৃষ্টিপাতের পর কড়া রোদ থাকায় হাওরপাড়ের হাজার হাজার কৃষক পরিবার ভেজা ধান ও গবাদিপশুর জন্য খড় শুকানোর সুযোগ পেয়েছেন। ধান ও খড় শুকানোর সুযোগ পাওয়ায় গতকাল শনিবার কৃষকদের মুখে ছিল হাসির ঝিলিক। রোদে পুড়েই ধান শুকিয়েছেন কৃষাণ-কৃষাণীরা।’

জানা যায়, চলতি বোরো মওসুমে সুনামগঞ্জের ১১ টি উপজেলায় ২ লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে (চাল) ৮ লাখ ৯৩ হাজার মে.টন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের পুনর্বাসনে জেলার ৩ লাখ কৃষক পরিবারকে ৫ কেজি করে বীজ ধান, ৩০ কেজি রাসায়নিক সার ও নগদ ১ হাজার করে সাড়ে ৫৮ কোটি টাকার কৃষি ভর্তুকি প্রদান করেছে।

জেলার ছোট-বড় ৫২টি হাওরের বোরো ফসলরক্ষায় বাঁধ নির্মাণ কাজ করেছে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিকে (পিআইসি)। বাঁধ নির্মাণে ৯৬৬ টি পিআইসিকে ১৭৭ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ প্রদান করেছে। পিআইসি প্রায় ১৪০০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করেছে। ইতোমধ্যে পিআইসির অনুকূলে ১৩৩ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে।

তাহিরপুর উপজেলার মধ্য তাহিরপুর গ্রামের কৃষক নিয়ামুল হক চৌধুরী বলেন,‘ রোদ না থাকায় ভেজা ধান নিয়ে ছোট-বড় সব কৃষক পরিবারই একই দুর্ভোগে পড়েছিল। গত শুক্রবার কিছুটা ও শনিবার কড়া রোদ থাকায় আমাদের রক্ষা হয়েছে। না হলে সব ভেজা ধানই পঁচে যেত। ’

জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শামীম আল ইমরান বলেন,‘ গত বছর বোরো ফসলহানির পর চলতি বোরো মওসুমে ধানের বাম্পার ফলন হয়েছিল। কিন্তু হাওরে যখন পুরোদমে ধান কাটা শুরু হয় তখনই টানা বৃষ্টিপাত শুরু হয়। এতে করে কৃষকদের চরম দুর্ভোগ দেখা দিয়েছিল। রোদের অভাবে কৃষকদের ধানে চারা গজিয়েছে। তবে গত দুইদিন ধরে রোদ থাকায় ধান ও খড় দু’টোই শুকাতে পারছেন তারা। ’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক স্বপন কুমার সাহা বলেন,‘ হাওরের প্রায় ৯০ ভাগ ধান কাটা হয়ে গেছে। কয়েকদিন বৃষ্টিপাত হওয়ায় ধান শুকাতে একটু সমস্যা ছিল, তবে গত দুই দিন ধরে রোদ থাকায় ধান শুকানো যাচ্ছে। আমরা আশা করছি আগামী কয়েকদিনের মধ্যে হাওরের সব ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানোর কাজ শেষ হয়ে যাবে।’

সিলেট আবহাওয়া অফিসের প্রধান আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন,‘ প্রকৃতির গতিবিধি বুঝা খুবই মুশকিল। টানা বৃষ্টির কারণে কৃষকদের দুর্ভোগ ছিল চরমে। তবে গত দুইদিন সুনামগঞ্জ হাওর অঞ্চলে রোদ ছিল। আজ রোববার ও আগামীকাল সোমবার আবহাওয়া কৃষকদের অনুকূলে থাকবে। দুইদিন বৃষ্টিপাত হলেও হালকা হবে, ভারী বা মাঝারি বৃষ্টি হওয়ার তেমন সম্ভাবনা নেই।’