বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ বদলগাছী ও মহাদেবপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত নওগাঁ-৩ আসন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সম্ভাব্য প্রার্থীদের রঙবেরঙের পোস্টার, লিফলেট ও পদচারণায় সরব এ দুই উপজেলা। তৃণমূলের নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটারদের রাজনীতির আলোচনায় মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কে হচ্ছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থী। কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক অ্যাডভোকেট তোফাজ্জল হোসেনকে জাতীয় পার্টির একক প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ: এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন বর্তমান এমপি ছলিম উদ্দীন তরফদার সেলিম এবং সাবেক এমপি ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ড. আকরাম হোসেন চৌধুরী। ছলিম উদ্দিন তরফদার ছিলেন মহাদেবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। দশম সংসদ নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী আকরাম হোসেনকে ৩০ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে নির্বাচিত হন। দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করায় তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। নির্বাচিত হওয়ার প্রায় সাড়ে তিন বছর পর গত ৭ই মে আওয়ামী লীগ তাকে দলীয় এমপি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এ দুই উপজেলায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দুটি ভাগ রয়েছে বর্তমান ও সাবেক এমপিকে ঘিরে।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে এলাকার উন্নয়ন, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ সরকারের সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মনোযোগ দেন ছলিম উদ্দিন। পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলেন। সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দীন তরফদার বলেন, আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছিলাম। বর্তমানে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য। সম্প্রতি মহাদেবপুর উপজেলা সম্মেলনে আমাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। বদলগাছী-মহাদেবপুর উপজেলায় অনেক উন্নয়ন কাজ হয়েছে। অনেক কাজ চলমান রয়েছে। আমি আশাবাদী মনোনয়নও পাবো এবং এই আসনে জয়ীও হবো ইন্শাআল্লাহ।
নওগাঁ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য সাবেক এমপি ও বর্তমান বিএমডিএ’র চেয়ারম্যান আলহাজ ড. আকরাম হোসেন চৌধুরী বলেন, আমি সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করতে চাই। এর পিছনে যে শ্রম দিতে হয় তা আমি দিয়ে থাকি। আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমি অবশ্যই মনোনয়ন পাবো। নেত্রী যেভাবে চাইবেন সেভাবেই কাজ করবো। বর্তমানে বিএমডিএ’র চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার নেত্রীই আমাকে দিয়েছেন। তবে নেত্রী যাকেই নৌকা তুলে দিবেন তাকে জয়ী করতে কাজ করবো।
এছাড়া এ আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশায় গত জোট সরকারের আমলে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) এর রাজশাহীর সেচ প্রকল্পের কৃষক বিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দালনকারী নেতা ডা. জাহাঙ্গীর আলম আনছারী ও বদলগাছী থানা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও সাবেক সচিব মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক এলাকায় গণসংযোগ, সভা, সেমিনার ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় এবং কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।
বিএনপি: এই আসনটি বিএনপির দখলে ছিল ২০০৮ সাল পর্যন্ত। ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে সাবেক ডেপুটি স্পিকার আখতার হামিদ সিদ্দিকী চার বার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার সময় এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। উপজেলা সদরকে তিনি সৌন্দর্যমণ্ডিত করে প্রশংসাও পেয়েছিলেন ব্যাপক। তার তৈরি মহাদেবপুর সদরের গুরুত্বপূর্ণ দুটি মোড়ে ‘মাছ চত্বর’ ও ‘বক চত্বর’ এখনো পথিকের দৃষ্টি কাড়ে। এছাড়াও সড়কের মাঝে আইল্যান্ড করে তাতে সুশোভিত ফুল ও ফলের গাছ লাগিয়ে সৃজনশীল রুচির পরিচয় দিয়েছিলেন। এছাড়াও মহাদেবপর উপজেলার কেন্দ্রীয় মসজিদে দৃষ্টিনন্দন মিনার ও ফোয়ারা করে প্রশংসা পেয়েছিলেন। এছাড়া এলাকায় উন্নয়নে তাকে স্মরণ করার মতো অনেক কাজের সুবিধা এখনো সাধারণ মানুষ পাচ্ছেন।
তিনি গত বছর ১৯শে নভেম্বর ইন্তেকাল করেন। তার মৃত্যুর আগেই এই আসনের দুই উপজেলায় বিএনপির কোন্দল দেখা দেয়। একটিতে নেতৃত্ব দিতেন সাবেক ডেপুটি স্পিকার আখতার হামিদ সিদ্দিকী ও অপরটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা ও বদলগাছী উপজেলা বিএনপির সভাপতি ফজলে হুদা বাবুল। তবে আখতার হামিদ সিদ্দিকী মারা যাওয়ার পর মনোনয়ন নিয়ে দলে নতুন করে হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। তার অবর্তমানে এখন বদলগাছী উপজেলা বিএনপির সভাপতি ফজলে হুদা আকন্দ বাবুল, জেলা বিএনপির সদস্য রবিউল আলম বুলেট, বিএনপি নেতা আসফ কবির চৌধুরী এবং সাবেক ডেপুটি স্পিকারের ছেলে পারভেজ আরেফিন সিদ্দিকী জনি, কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক একেএম শফিকুল ইসলাম, মহাদেবপুর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুস ছাত্তার নান্নুসহ ৬ নেতা এখন মনোনয়ন প্রত্যাশী।
আখতার হামিদ সিদ্দিকীর মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে পারভেজ আরেফিন সিদ্দিকী জনি পিতার রাজনীতির হাল ধরেছেন। জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি, মহাদেবপুর উপজেলা যুবদলের সাবেক আহ্বায়ক ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সদস্য আরেফিন সিদ্দিকী জনি বাবার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে মানুষের কাছে আস্থাভাজন হতে চান। ইতিমধ্যেই রাজনীতির আলোচনায় উঠে এসেছেন তিনি। আরেফিন সিদ্দিকী জনি বলেন, বাবার জীবদ্দশায় তার সঙ্গে থেকে এলাকার উন্নয়নে সাধারণ মানুষের পাশে থেকে সহযোগিতা করে এসেছি। সেক্ষেত্রে বাবার এই উন্নয়নের ইমেজকে কাজে লাগিয়ে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক ও সাধারণ মানুষদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। আশাবাদী মনোনয়ন আমিই পাবো এবং খোয়ানো এই আসনটি উদ্ধার করতে সক্ষম হবো।
অপরদিকে অল্প সময়ে তিনি নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মনে ঠাঁই করে নেন। তিনি বলেন, আমি শুধু এলাকার মানুষের জন্য রাজনীতি করছি, ইতিমধ্যে ৫৭টি স্কুলে কম্পিউটার প্রদান, মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ প্রদানসহ দলীয় নেতা-কর্মীদের ছেলে-মেয়েদের লেখা-পড়া, বিয়ে ও অসুস্থ কর্মীদের সহযোগিতা করে আসছি। আমি বিদেশে থেকে যা আয় করি, তার সবটুকুই ব্যয় করি এলাকার জন্য। আমি স্বশরীরে এবং ফেসবুকে, হোয়াটস অ্যাপে বা ইমোতে দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে টেলিমনিটরিংয়ের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছি। আমি শতভাগ নিশ্চিত মনোনয়ন পেলে নির্বাচিত হবো।
বিএনপির দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী আলহাজ রবিউল আলম বুলেট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদারবখ্স হল শাখার ছাত্রদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক, বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মহাদেবপুর উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে জেলা বিএনপির সদস্য। তিনি ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করার পর পরই স্থানীয় রাজনীতিতে বৈষম্যের স্বীকার হন তিনি। রবিউল আলম বুলেট বলেন, প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও দলের সব কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে কাজ করে যাচ্ছি। এলাকাবাসী একজন ক্লিন ইমেজ প্রার্থী প্রত্যাশা করেন। আমি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম। আমি এলাকাবাসীর পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছি। গত বন্যায় আমি ব্যক্তিগতভাবে বন্যা দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছি। মনোনয়ন পেলে নির্বাচিত হবো এ বিষয়ে আমি শতভাগ আশাবাদী।
বিএনপির অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী আসফ কবির চৌধুরী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ১৯৯০ সালে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের নেতৃত্বে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। বর্তমানে তিনি ব্যবসায়ী। বিগত কয়েক বছর ধরে মসজিদ-মাদরাসায় সহযোগিতা, বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক ও বিএনপির দলীয় কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন।
আসফ করিব চৌধুরী বলেন, এমপি-মন্ত্রী হওয়া যায়, কিন্তু নেতা হওয়া কঠিন। নির্বাচনকে ঘিরে এলাকায় অনেক মৌসুমি পাখির আগমন ঘটেছে। আমি ক্লিন ইমেজের নেতৃত্ব গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বিএনপি এবার ৯০-এর গণআন্দোলনের তরুণ, ছাত্রদলের নেতাদের মূল রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চায়। সেক্ষেত্রে অবশ্যই দল অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আমার বিষয়টি বিবেচনা করবে।
এদিকে আর এক ছাত্র নেতা কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদ একেএম শফিকুল ইসলাম শফিক এলাকায় কাজ করে আসছেন। ইতিমধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে এলাকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছেন। তিনি বলেন, আমার কাছে দলটাই বড়, নিজের অবস্থান থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছি।
অপর দিকে মহাদেবপুর থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সাত্তার নান্নু বলেন, সাবেক ডেপুটি স্পিকারের পরিবার থেকে কেউ রাজনীতিতে না এলে তবেই তিনি মনোনয়ন চাইবেন। আর তার পরিবার থেকে কেউ এলে তিনিসহ মহাদেবপুর উপজেলা বিএনপির কমিটি তাকে সমর্থন করবেন।
এ আসনে এবার জাতীয় পার্টি থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব ও জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি অ্যাডভোকেট তোফাজ্জল হোসেনের মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে বলে স্থানীয় দলীয় সূত্র জানিয়েছে। ইতিমধ্যে তার পোস্টার ফেস্টুনে বিভিন্ন এলাকা ছেয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে অ্যাডভোকেট তোফাজ্জল হোসেন বলেন, আমি জাপার মনোনীত প্রার্থী। মহাজোট হলেও আমাকেই মনোনয়ন দেয়া হবে বলে আমি আশাবাদী। সে লক্ষ্যেই এলাকায় কাজ করে যাচ্ছি।
এছাড়া
এই আসনে বদলগাছীর বীর মুক্তিযোদ্ধা নওগাঁ জেলা জাসদ (ইনু)-এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওয়াজেদ আলী নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন বলে জানা গেছে। জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বদলগাছী উপজেলা সাবেক আমীর ও বর্তমান নওগাঁ জেলা জামায়াতের কর্মপরিষদ সদস্য মীর আবুল কালাম আজাদ নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন বলে শোনা যাচ্ছে। তবে জামায়াত ও জাসদের গণসংযোগ ও প্রচার-প্রচারণা লক্ষ্য করা যায়নি।
সূত্রঃ মানবজমিন