জাকির হোসাইনঃ সোনারঙা পাকা ধান এখন দ্যুতি ছড়াচ্ছে বিস্তীর্ণ হাওরে। ধানের ম-ম গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে পুরা হাওর জুড়ে চারদিকে। এ সৌরভ স্পর্শ করছে কৃষকের মনে। কিন্তু গত বছর বৈশাখের প্রথম সময়ের দিনগুলো এমন ছিল না। সর্বনাশা বর্ষণ হাওরের বাঁধ ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সব পাকা ও আধাপাকা ধান। এর সঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কৃষকের স্বপ্ন।
ধান হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন হাওরের হাজার হাজার কৃষক। এবারও সেই শঙ্কা, সেই ভয় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের। কারণ, হাওরের অনেক স্থানে বাঁধ নির্মাণ এখনও শেষ হয়নি। কোথাও কোথাও বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতিরও খবর পাওয়া গেছে। তারপরও হাওরের কৃষকরা নতুন করে স্বপ্নের জাল বুনেছেন। শুরু করেছেন ধান কাটা। মুখে ফুটেছে হাসি।
কিশোরগঞ্জ : জেলার ১৩টি উপজেলায় বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। কৃষি শ্রমিকরা ধান কাটতে হাওরে এসে জড়ো হয়েছেন। হাওর ও নদীর পাড় ঘেঁষে অস্থায়ী ঘর (জিরাতি বা বাথান) নির্মাণ করে কৃষি শ্রমিকরা ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ করছেন। চলছে ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। তবে ধানের দাম না থাকায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন কৃষি শ্রমিকরা। কারণ, জমির মালিকের মন ভালো না থাকলে তাদেরও সুখ নেই।
বাম্পার ফলন হলে আনন্দে শ্রমিকদের তিনবেলা ভালো খাবার দেওয়া হয়। এ বছর এমন হচ্ছে না। কৃষকের চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখে শ্রমিকদের আনন্দের হাসিও মিলিয়ে গেছে। কিশোরগঞ্জ জেলা হাওর অঞ্চলসহ সারা জেলায় এবার মোট এক লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা থেকে চাল পাওয়া যাবে ৬ লাখ ৩৮ হাজার ৮৩০ টন।
হাওরের কৃষকরা জানান, কোনো বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে আগামী ২০ দিনের মধ্যে ৯০ ভাগ ধান তাদের ঘরে তুলতে পারবেন। গত বছর তার ১০ একর বোরো জমির সব ধান চৈত্রের বন্যায় ভেসে গিয়ে তাকে সর্বস্বান্ত করেছে। এবার বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ১০ একর জমিতে চাষাবাদ করেছেন। এরমধ্যে ৫ একর জমিতে বিআর-২৮ ধান ইতিমধ্যে গোলায় তুলতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু বাজারে প্রতি মণ ধানের দাম ৬৭০ থেকে ৭০০ টাকা। অথচ উৎপাদন খরচই হয়েছে গড়ে ৮৫০ টাকা বর্গা ও প্রান্তিক চাষিদের অবস্থা আরও খারাপ। তাদের সারা বছরের খোরাকি মেটাতে ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে কৃষকরা আগামী চার দিনের মধ্যে সরকারকে ধানের সঠিক মূল্য ঘোষণার দাবি জানান।
ইটনার : গত দুই বছর অকাল বন্যায় একমাত্র বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এবার বোরোর ভালো ফলন হওয়ায় হাওর অঞ্চলের কৃষকের চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক। এরই মধ্যে জেলার ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রামে হাওর অঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় ধান কাটা শুরু হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে পুরোদমে ধান কাটা শুরু হবে।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ও এর আগের বছর অসময়ে হাওরে পানি আসায় হাওর অঞ্চলের ফসল রক্ষাবাঁধ ভেঙে একমাত্র বোরো ফসল তলিয়ে যায়। এতে করে হাওর অঞ্চলের কৃষকরা একমাত্র ফসল হারিয়ে সর্বস্বান্ত হন। ইটনার কৃষক বলেন, আমাদের এলাকায় এবার ফসলের ফলন ভালোই হয়েছে। এ বছর আমি ও ২২ একর জমিতে বোরো আবাদ করেছিলাম। এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের ক্ষতি হয়নি। এবার ফসলের বাম্পার ফলন হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত ফসল ঘরে তুলতে পারলে কয়েক বছরের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। গ্রামের কৃষক ও মানবাধিকার নাট্য পরিষদ জেলা শাখার সভাপতি বলেন, আমরা কষ্ট করে ফসল আবাদ করেছি। কিন্তু ন্যায্য মূল্য পাই না। হাওর উন্নয়ন পরিষদ ইটনার সভাপতি বলেন, অন্য বছরের তুলনায় এবার বাঁধ সংস্কার কাজ অনেকটা ভালো হয়েছে। এ বছর ধানের ফলনও ভালো হয়েছে। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা না দিলে ফসলের বাম্পার ফলন হবে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় এ বছর এক লাখ ৮৪ হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রামসহ বিভিন্ন হাওর এলাকায় আবাদ করা হয়েছে ৪১ হাজার ১০ হেক্টর জমিতে, যা গত বছর ছিল প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর। ইটনা উপজেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে ফসলে ভরে যাবে। এলাকার কৃষকরা লাভবান হতে পারবেন। ইটনার উপজেলা কৃষক লীগের সভাপতি কৃষক জানান, অন্যান্য বছরের মতো এবার ধান কাটা-মাড়াইয়ে শ্রমিক সংকট দেখে দিয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
ছবিটি কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তোফিক এমপির ফেসবুক থেকে নেওয়া।