বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা! একের পর এক কী ঘটে যাচ্ছে দেশে! রাজনীতির বাইরে সমঝোতাহীন অস্থিরতা পর্দার অন্তরালে নানা ষড়যন্ত্রের আলামত নিয়ে পর্যবেক্ষক মহলের কত কথা। গণমাধ্যম যেন নিষ্প্রাণ, কোনো প্রশ্নের উত্তর নেই! মানুষের মুখে মুখে আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গুজবনির্ভর দলবাজিতে মত্ত পোর্টালগুলোতে ভিত্তিহীন গরম গরম যত খবর আর চরিত্র হনন চলছে।
সরকার এতদিন সর্বত্র যে একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল সেখানে প্রধান বিচারপতি দিয়ে যেন ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। প্রধান বিচারপতিকে যারা সেদিন ভালোভাবে গ্রহণ করেননি এখন তারা যেন নয়নের মণি বানিয়েছেন কেউবা মাথার তাজ। আর যারা গভীর আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে বিচারপতি শামসুদ্দীন মানিকের সব বক্তব্যকে, অভিযোগকে আমলে না নিয়ে উল্টো বিরক্ত হয়ে এস কে সিনহাকে প্রধান বিচারপতির আসনে বসিয়েছিলেন তারা যেন আজ গণশত্রুই নয়, দুর্নীতির বরপুত্র বানাতে চাইছেন। সাধারণ জনগণ বিভ্রান্ত, অস্থির অশান্ত সমাজ রাজনীতি। এমনকি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রপতির সার্চ কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে তাদের প্রস্তাব থেকে যে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছিলেন সেটিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি গ্রহণ না করলেও এতদিন পর এক সংলাপে আশার আলো দেখছে।
নির্বাচন কমিশনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসেই যে বক্তৃতা করেছেন তাতে বিএনপির জন্য সরাবন তহুরা ঢেলে দিয়েছেন। বিএনপির নেতা-কর্মীরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন। বিএনপির মন জয় করেছেন নিজেকে আস্থায় নিয়ে গেছেন। বিএনপিরও সব ক্ষোভ প্রশমিত হয়ে গেছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার হুদার বক্তব্যে আরেক দফা বিতর্কের ঝড় উঠেছে। হুদা বলেছেন, ‘বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেছিলেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীই নন, বিএনপি অনেক বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল, রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারা ক্ষমতায় থাকার সময় প্রাথমিক ও গণশিক্ষার উন্নয়নই করেনি, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষা চালু করে এবং র্যাব ও দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করে। ’
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থানের ভিতরে রক্তের সিঁড়িপথে মার্শাল ল ডিক্টেটর জিয়াউর রহমান পঁচাত্তরের খুনিদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন। বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে অসংখ্য সেনা অফিসারকে কোর্ট মার্শালের নামে হত্যা করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, তার মুক্তিদাতা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহের বীরউত্তমকে সামরিক আদালতে প্রহসনের বিচারে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম জাতীয় প্রচার মাধ্যমে নিষিদ্ধ করেছেন। আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের কারাগারে রেখেছেন দমন নির্যাতনে ফেলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের রক্তে লেখা বাহাত্তরের সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে পরিবর্তনই আনেননি একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসর সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তির জন্য রাজনীতির দুয়ার খুলে দিয়েছিলেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও তিনি একাত্তরের দালাল শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী, আবদুল আলীমের মতো যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী করেছিলেন। দক্ষিণপন্থি ডান ও অতিবিপ্লবী চীনাপন্থিদের নিয়ে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এমনকি একজন মার্শাল ল ডিক্টেটর হিসেবে তিনি প্রহসনের নির্বাচনে ভোটাররা কেন্দ্রে যাক আর নাই যাক হ্যাঁ-না গণভোট করে ১৯৭৭ সালের ৩০ মে নিজের বৈধতা ঘটিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। ১৯৭৮ সালে শাসরুদ্ধকর সামরিক আইন বহাল রেখে প্রহসনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ বরাবর অভিযোগ করে এসেছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। সর্বোচ্চ আদালত তাকে অবৈধ শাসক হিসেবে এবং তার শাসনামলকে অবৈধ বলে রায় দিয়েছে।
সেখানে একজন নিষ্ঠুর মিলিটারি ডিক্টেটরকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হুদা নিজের সাংবিধানিক পদবিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেননি, বিএনপির প্রতি এই সহানুভূতি ও সমর্থন প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে শপথ ভঙ্গ করেছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া রাজপথের আন্দোলনে উঠে আসা গণতন্ত্রের নেত্রী। গণরায়ে অভিষিক্ত দেশের দুবারের প্রধানমন্ত্রী প্রশ্নবিদ্ধ ভোটারবিহীন ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন যোগ করলে সাংবিধানিকভাবে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। বেগম খালেদা জিয়ার কথা বললে মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু আইয়ুব ইয়াহিয়ার পথ ধরে ক্ষমতায় আসা উচ্চাভিলাষী সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানকে গণতন্ত্রের প্রবক্তা বলে যখন মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত অফিসার কে এম নূরুল হুদা গুণকীর্তন করেন তখন মনে হয় কোথায় যেন মতলব রয়েছে। নাটাই যেন কোথায় কাজ করছে, পুতুল নাচের আসরে তিনি নাচছেন। গোটা দেশের মানুষের প্রত্যাশা আগামী জাতীয় নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হোক, নির্বাচন হোক অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। সেখানে নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে সেনাবাহিনী মোতায়েন, স্বচ্ছ ভোটার তালিকা প্রণয়ন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকা এবং সব দলের জন্য লেবেল প্লেয়িং ফিল্ডসহ নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার যেসব দাবি সংলাপে সব রাজনৈতিক দলই নয়; সমাজের বিশিষ্টজন থেকে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা প্রস্তাব করেছেন তা আমলে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জাতিকে উপহার দেওয়া। কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার সংলাপে বসে রাজনৈতিক বক্তব্য দানের মধ্য দিয়ে নিজেকেই বিতর্কিত করেননি, মানুষের প্রত্যাশার জায়গাটাকে ভেঙে দিয়েছেন।
বিএনপির সঙ্গে সংলাপের পরদিন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ ছিল। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাংগঠনিক শক্তি কতটা সেটি মানুষ জানে কিন্তু এই দলের যিনি সভাপতি তার নাম বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম। একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অকৃত্রিম বন্ধু ভারতের সাহায্য ছাড়াই দেশের অভ্যন্তরে তিনি কাদেরিয়া বাহিনী গঠন করেছিলেন। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে ভারতের ট্রেনিং ও অস্ত্র ছাড়া যে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করেছেন তার জন্য বিদেশি গণমাধ্যম তাকে বাঘা সিদ্দিকী বলে বীরত্বের মুকুট পরিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে দল এবং দেশের একদল বিশ্বাসঘাতক বিশ্ব মোড়লদের হত্যার নীলনকশায় যুক্ত হলেও এই কাদের সিদ্দিকী সেদিন আওয়ামী লীগের কোনো দায়িত্বশীল নেতা না হয়ে আরেক দফা জীবন নিয়ে বাজি খেলেছিলেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘটে যাওয়া রোমহর্ষক নৃশংস হত্যাকাণ্ডে শিশুসন্তানসহ বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার-পরিজনকে হত্যা করা হয়েছিল। সেই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সেই সময়ের ক্ষমতাসীন বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের বাঘা বাঘা নেতা থাকার পরও কোনো প্রতিরোধের ডাক দিতে পারেননি। কেউ বিশ্বাসঘাতকতা না করে জেলের অন্ধকারে জীবন দিয়েছেন, বাকিরা কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে জীবন কাটিয়েছেন। কিন্তু অসীম সাহসী বঙ্গবন্ধুর আদরের দুলাল যিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সন্তান বলে নিজেকে বিশ্বাস করেন ঠিক সেই বাঘা সিদ্দিকী খ্যাত বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন জাতীয় মুক্তিবাহিনীর ব্যানারে। তার সঙ্গে ১৭ হাজার মুজিব আদর্শের সন্তান তারুণ্যের সাহস নিয়ে যুক্ত হয়েছিলেন, ১১৮ জন জীবন দিয়েছিলেন। পাহাড়ে জঙ্গলে খেয়ে না খেয়ে পরবর্তীতে ভারতে নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছেন। সেই হত্যার প্রতিবাদে একজন আদর্শিক জাতির জনকের সন্তান হিসেবে কাদের সিদ্দিকী আজও মাংস খান না। আওয়ামী লীগের দুর্ভাগ্য ক্ষমতানির্ভর আজকের আওয়ামী লীগে সব পেশায় যতদূর চোখ যায় শুধু আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ। যেমন পঁচাত্তরের পর সারা দেশ হয়ে উঠেছিল সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের বিএনপি আর বিএনপি। কিন্তু আজকের আওয়ামী লীগে পিতৃহত্যার সেই সাহসী প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ঠাঁই হয়নি। আজকের আওয়ামী লীগে বিত্তশালী হাইব্রিড কাউয়াদের দৌরাত্ম্য দেখা যায়।
এসব কথা থাক। কাদের সিদ্দিকী সেনাশাসক জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা বলায় আড়াই ঘণ্টা সংলাপ করে বর্জনই করেননি প্রধান নির্বাচন কমিশনার নূরুল হুদার পদত্যাগ চেয়েছেন। বুধবার শাসক দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য কেউ কেউ বিএনপির আস্থা অর্জনের কৌশল বলে মন্তব্য করছেন কিন্তু কে কী বলছেন সেটি বড় কথা নয়, সাংবিধানিকভাবে কোনো দলের প্রতি তিনি এমন কথা বলতে পারেন না। এ যেন ভোটের আগেই বিএনপিকে সমর্থন দেওয়ার পরোক্ষ ক্যাম্পেইন করেছেন কে এম নূরুল হুদা। এ বক্তব্যের পর তার দায়িত্বে থাকার সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগ সংলাপে বসলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কী করবেন? তিনি কি আওয়ামী লীগের ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন রোজগার্ডেনে জন্ম নেওয়ার পর থেকে বাঙালি জাতির অধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও সুমহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে গৌরবময় ভূমিকা ও ইতিহাস সেটি তুলে ধরবেন। তিনি কি জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে সাফল্যের নেতৃত্বের অনন্য সাধারণ ভূমিকার গুণকীর্তন করবেন? সেনাশাসক জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা বলার মধ্যদিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক বক্তব্য বঙ্গবন্ধু একদলীয় বাকশাল গঠনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের কবর রচনা করেছিলেন সেই অভিযোগকেই স্বীকৃতি দেননি, যেখানে জাতীয় নির্বাচনের বড় অংশীদার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্য কোনো সমঝোতা গড়ে ওঠেনি সেখানে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্যের মধ্যদিয়ে এ সত্য উঠে এসেছে যে, এই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতাপূর্ণ নির্বাচন সম্ভব নয়।
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে যখন রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভের কর্ণধার করা হয় তখন আপিল বিভাগের অবসরে যাওয়া বিচারপতি শামসুদ্দীন মানিক চৌধুরী অনেক কথা বলেছিলেন। সরকারের অনেক রথী-মহারথী তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন; বিরক্ত হয়েছিলেন। এখন সরকার থেকে সুপ্রিম কোর্টের বিদায়ী রেজিস্ট্রারের বিবৃতি বলছে, মানিক অনেক কম বলেছিলেন। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ের মধ্যদিয়ে প্রধান বিচারপতি সিনহা নির্বাহী বিভাগে অগ্নিরোষের মুখে পতিত হন। তিনি চাননি বাহাত্তরের সংবিধান অনুযায়ী বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে থাক। সংসদ প্রদত্ত সংশোধনী বাতিল করেছিলেন সাতজন বিচারপতিকে নিয়ে। সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও সরকারের অগ্নিরোষের মুখে পড়েন তিনি। সংসদ থেকে রাজপথ শাসকদল ধুয়ে-মুছে ছেড়ে দিয়েছে প্রধান বিচারপতিকে। এর আগে আমরা অসংখ্যবার আদালত অবমাননার নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানিয়েছি। অনেক সিনিয়র সাংবাদিক ও সম্পাদককে আদালত তলবই করেনি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখেছে। আদালত অবমাননার অভিযোগে কিন্তু প্রধান বিচারপতি সিনহাকে রাজপথের সৈনিকরা ইচ্ছামতো তুলাধোনা করেছেন। বড় বড় নেতা-নেত্রী প্রেস ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে ভেংচি কেটে তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অগ্নিকন্যা থেকে পানিকন্যা হয়ে যাওয়া মতিয়া চৌধুরী তাদের শিরোমণি। এর মধ্যে শাসক গোষ্ঠীর চাপের মুখে পতিত প্রধান বিচারপতি ঈদুল আজহায় বঙ্গভবন থেকে গণভবন, রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়, অবকাশকালীন ছুটিতে গমন এবং মিয়ানমারের গণহত্যাকারী সামরিক জান্তার নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ শরণার্থীর ও বিশ্ব মানবতার প্রতি ডাক দিয়ে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়ানো; জাতিসংঘের অধিবেশনে গিয়ে উচ্চকণ্ঠে এ ইস্যুতে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার চেষ্টায় সিনহা ইস্যু তলানিতে পড়ে যায়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট অবকাশকালীন ছুটি শেষ হওয়ার শেষ দিন প্রধান বিচারপতির আকস্মিক রাষ্ট্রপতির কাছে এক মাসের ছুটির আবেদন ও তা মঞ্জুর হওয়া নিয়ে বিতর্কের ঝড় ওঠে।
বিএনপির অভিযোগ, জোর করে তাকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে, এমনকি তাকে গৃহবন্দী করে রাখার অভিযোগও এসেছে। কিন্তু প্রধান বিচারপতির ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সস্ত্রীক পূজায় যোগদান, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাসগুপ্ত ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী পূজা উদযাপন পরিষদের নেতা সুব্রত চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক প্রমাণ করে দেয় তিনি গৃহবন্দী নন। এর মধ্যে তিনি অস্ট্রেলিয়া চলে গেছেন। সস্ত্রীক ভিসা নিয়েছিলেন তিন বছরের। বিদায়কালে স্ত্রী যেতে পারেননি, অশ্রুজলে একজন বিদায় নিয়েছেন আরেকজন বিদায় দিয়েছেন। যাওয়ার আগে তিনি লিখিত বক্তব্য দিয়ে বলেছেন, তিনি সম্পুর্ণ সুস্থ আবার ফিরে আসবেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, তিনি ক্যান্সারের রোগী। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, তিনি গৃহবন্দী নন। এস কে সিনহা আরও বলেছেন, তার সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বোঝানো হয়েছে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, জীবনে তিনি মিথ্যা কথা বলেন না। কে সত্য কে মিথ্যা সময় নির্ধারণ করে দেবে? এ কথা সত্য গণমাধ্যম সব সত্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হয়েছে। গণমাধ্যম ব্যর্থ হলেও রাজনীতিবিদরা বিজয়ী হন; সফল হন আমরা সেটিই চাই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যারাই ষড়যন্ত্রের অংশীদার হয়েছেন তারা নিন্দিতই হননি, ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। যারা মরে গেছেন লজ্জা ও গ্লানি নিয়ে গেছেন। যারা বেঁচে আছেন এ করুণা ও গ্লানির জীবন। আমরা চাই রাজনীতিবিদদের হাতেই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব থাকবে। আমাদের ইতিহাস বলে দেয় অন্ধকার শক্তি জাতির জীবনে কখনই সুখ বয়ে আনেনি; কখনো স্বস্তি বয়ে আনেনি।
জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার প্রতি আকুল আবেদন— আপনি বলেছেন যতদিন বেঁচে আছেন গণতন্ত্রই চাইবেন। গণতন্ত্রের জন্য সব গণতান্ত্রিক শক্তির দরজা খুলে দিন। যদি কোনো ষড়যন্ত্র হয়ে থাকে সেই ষড়যন্ত্রের মুখোশ জাতির সামনে উন্মোচন করুন। আগামী জাতীয় নির্বাচন হতে পারে টার্নিং পয়েন্ট। যেখান দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্র সুসংহতই নয়, সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হতে পারে শক্তিশালী। একজন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে আপনারাই নিয়োগ দিয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনসহ ১১টি অভিযোগে অভিযুক্ত তিনি। রাষ্ট্রপতি ১১টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগসংবলিত দালিলিক তথ্যাদি হস্তান্তরের পর আপিল বিভাগের বিচারপতিরা বলেছিলেন তার সঙ্গে তারা আর কাজ করতে নারাজ। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, এ অভিযোগের পর তার আসনে বসা সুদূরপরাহত। আইনমন্ত্রী বলেছেন, এ অভিযোগের মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত তিনি আর চেয়ারে বসতে পারবেন না। দেশের জন্য সামনে আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আপনি ও তৃণমূল রাজনীতি থেকে উঠে আসা রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ জাতির সামনে খোলাসা করুন প্রধান বিচারপতি থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ঘিরে ষড়যন্ত্র রয়েছে কিনা? তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর দেওয়া নামের তালিকায় কে এম নূরুল হুদার নাম ছিল। বাঘা বাঘা নাম বাদ দিয়ে তাকেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার করা হলো? ২০০১ সালে বিএনপি তাকে জোরপূর্বক অবসরে পাঠিয়েছিল, আপনি ক্ষমতায় এসে তাকে রায়ের আলোকে সচিব মর্যাদায় অবসর দেন। এখন তিনি কেন সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের গুণকীর্তন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন? পর্দার অন্তরালে কোনো ষড়যন্ত্র ঘটে থাকলে তা জাতির সামনে উন্মোচনই নয়, সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্যদিয়ে প্রকৃত রাজনীতিবিদদের উত্থান ঘটুক আগামী সংসদে। এটিই আমাদের প্রত্যাশা। সিনহা চলে যাওয়ার পর কেন অনেক আগে জেনে যাওয়া ১১টি অভিযোগের নিরিখে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ হয়নি? এ প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে সব কথার শেষ কথা যত দুর্বলতাই থাক গণতন্ত্রই জাতির আরাধ্য সাধনা। গণতন্ত্রের বাইরে কোনো অন্ধকার সুড়ঙ্গে আমরা প্রবেশ করতে পারি না।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।