বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ জাতিরাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ইতিহাসে স্থান পায়, লিপিবদ্ধ থাকে এবং অনাগত প্রজন্ম ইতিহাসের পাতা ওল্টালে তার সন্ধান পায়। আবার আরো কিছু অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা থাকে, যেগুলো ইতিহাসের পাতায় তো থাকেই, একই সঙ্গে সব সময় প্রাসঙ্গিক হয়ে জাতিরাষ্ট্রকে পথ দেখায়।
বছরান্তে ওই ঘটনাগুলোর দিনক্ষণ ফিরে এলেই সমগ্র জাতি নতুন উদ্যমে উজ্জীবিত হয় এবং নানা রকম আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে সেদিনকে একটি বিশেষ দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। পুরনো দিনের স্মৃতিচারণাসহ সেই ঘটনার বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি, বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনীর জন্য সে রকমই একটি দিন সশস্ত্র বাহিনী দিবস, ২১ নভেম্বর। এই দিবসের বর্তমান প্রেক্ষাপটের কথা বলার আগে একাত্তরে সেদিন কী ঘটেছিল, দিনটি বাংলাদেশের জন্য কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, সে সম্পর্কে আমার নিজের কিছু বিশ্লেষণ প্রথমে তুলে ধরি। এক. একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২১ নভেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সর্বাত্মক সহায়তা ও সমর্থনে বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী প্রথমবারের মতো পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে আক্রমণের সূচনা করে। ওই আক্রমণের সাফল্যে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে সারা বিশ্বের রাষ্ট্র ও জনগণের কাছে দৃশ্যমান হয় আমাদের সশস্ত্র বাহিনী। দুই. মুজিবনগর সরকার, অর্থাৎ তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা দৃশ্যমান হয় এবং ভারত পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) দখল করে নিতে চায়—পাকিস্তানের এমন অপপ্রচার বিশ্বদরবারে অসার হয়ে পড়ে। তিন. ওই দিনের সফল অভিযানের ফলে বিশ্বের সব রাষ্ট্র ও মহলের কাছে স্পষ্ট বার্তা পৌঁছে যায়, বাংলাদেশ তার স্বাধীনতাযুদ্ধ নিজেরাই চালাতে সক্ষম এবং তার সেনাবাহিনী পৃথিবীর অন্য যেকোনো সেনাবাহিনীর সঙ্গে একই মর্যাদাপ্রাপ্তির যোগ্যতায় যোগ্য। চার. আক্রমণের ব্যাপক সাফল্য ওই সময়ে বিরাজমান চরম অনিশ্চয়তা ও দুর্দশাগ্রস্ত জাতির জন্য ছিল প্রচণ্ডভাবে নৈতিক মনোবল বাড়িয়ে দেওয়ার মোক্ষম দাওয়াই, বিশেষ করে তা প্রযোজ্য ছিল মাঠে যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। পাঁচ. এই ঘটনার ধারাবাহিকতায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সমমর্যাদার ভিত্তিতে উভয় দেশের সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠন করা হয় ভারত-বাংলাদেশ মিত্র বাহিনী বা ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনী। তখন বিরাজমান আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ভারত কর্তৃক এমন সামরিক স্বীকৃতি বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিযোদ্ধাদের মনে যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে এবং দুই বন্ধুপ্রতিম দেশের মধ্যে যে বিশ্বাসযোগ্যতার বন্ধন সৃষ্টি হয় তার গুরুত্ব ওই সময়ে ছিল অপরিসীম। ছয়. মিত্র বাহিনী গঠনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে ভারত আশ্বস্ত করে যে রাজনৈতিক স্বীকৃতি এখন শুধু সময়ের ব্যাপার, যা আসে ডিসেম্বরের ৬ তারিখে। সাত. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে দক্ষিণ এশিয়ায় অতিসত্বর একটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটতে যাচ্ছে। এর ফলে ৩ ডিসেম্বর সীমান্তের সব দিক থেকে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে, বিশেষ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের পক্ষে ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্মিলিত কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে তৎসময়ে পাকিস্তানের দোসর চীন ও যুক্তরাষ্ট্র বারবার চেষ্টা করেও বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি।
১৯৭১ সালের ২৪ অক্টোবর থেকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯ দিনের জন্য পশ্চিম ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। উদ্দেশ্য ছিল, পাকিস্তানি দখলদারি থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য ভারতের রাজনৈতিক ও সামরিক স্ট্যান্ডের পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টি করা। সফর শেষে দেশে ফিরে ১৫ নভেম্বর ইন্দিরা গান্ধী কংগ্রেস দলের কার্যকরী কমিটির সভায় ঘোষণা করেন। ওই সফরের একপর্যায়ে প্যারিসে এক সংবাদ সম্মেলনে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পূর্ব বাংলার চলমান সমস্যার একমাত্র সমাধান স্বাধীনতা, দূর বা অদূর ভবিষ্যতে এ স্বাধীনতা আসবেই (সূত্র : ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন, ৯ নভেম্বর ১৯৭১)। আট. যৌথ বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চারদিকের সীমান্ত দিয়ে আনুষ্ঠানিক আক্রমণ শুরু করে ডিসেম্বরের ৩ তারিখে। কিন্তু একটি দেশকে পুরোপুরি শত্রুমুক্ত করার এত বড় ও ব্যাপক বিস্তৃত অভিযানকে সফল করার জন্য দুই দেশের যৌথ বাহিনীর সদস্যের সর্বস্তরে যে সমন্বয় ও বোঝাপড়ার প্রয়োজন হয়, তা সম্ভব হয়েছিল সময়মতো যৌথ বাহিনী গঠনের মাধ্যমে, আর যৌথ বাহিনী গঠন করা সম্ভব হয়েছিল বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আবির্ভাবের ফলে। একাত্তরের ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনীর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু ও তার মাত্র ২৬ দিনের মাথায় স্বাধীনতা অর্জনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয় ধারাবাহিকভাবে পর্যায়ক্রমে, যার শুরু ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকে।
২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনীর আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বাহিনী তার নিজস্ব শক্তির মহিমায় প্রতিষ্ঠিত না হলে পরবর্তী সময় ভারতের অংশগ্রহণের পর এই যুদ্ধকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা বিশ্ববাসীর পক্ষে যেমন কঠিন হতো, তেমনি ভারতও সম্ভবত রাজনৈতিক ও সামরিক উভয়বিধ কারণে সর্বাত্মক সামরিক সাহায্য প্রদানের প্রশ্নে দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ত। সুতরাং ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর আত্মপ্রকাশ ছিল বাংলাদেশ ও ভারতের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক এবং সামরিক নেতৃত্বের সার্বিক পরিকল্পনার অংশবিশেষ, যার প্রেক্ষিত তৈরি করা হয় ধাপে ধাপে। একাত্তরের সেই গৌরবোজ্জ্বল যাত্রা থেকে ৪৬ বছরে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী আজ সমগ্র জাতির কাছে অত্যন্ত মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আমাদের সেনাবাহিনীর পেশাগত দক্ষতা এবং শৃঙ্খলার মান প্রশংসিত। জাতিসংঘসহ বিশ্বনেতাদের মুখে এখন বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর খ্যাতি ও সুনামের কথা উচ্চারিত হয়। বাংলাদেশ শান্তিরক্ষা মিশনের মডেল হিসেবে গণ্য হচ্ছে। নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয়, এনডিসি (ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ), স্টাফ কলেজ, এসআইএসটিসহ অবকাঠামোগতভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। আধুনিক সমরাস্ত্রসহ তিন বাহিনীর পরিধি বেড়েছে গত পাঁচ-সাত বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে। নৌবাহিনীতে যোগ হয়েছে সাবমেরিন। সেনাবাহিনী সব দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। প্রতিটি দেশের সেনাবাহিনীরই নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য থাকে। তবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাস যতটা গৌরবোজ্জ্বল, সে রকম উদাহরণ খুব কম দেশেরই আছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম মুক্তিযুদ্ধের সময়, যুদ্ধক্ষেত্রে। ফলে তার জন্ম বৈশিষ্ট্যের অন্যতম একটি দিক হলো জনসম্পৃক্ততা, অর্থাৎ দেশের সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সেই জন্মলগ্ন থেকে। জনগণের সঙ্গে যে বন্ধন, তা রক্তে গাঁথা। দেশকে শত্রুমুক্ত করার আমরণ লড়াইয়ে একই জায়গায়, একই মাটিতে এবং একসঙ্গে রক্ত ঝরেছে এ দেশের সাধারণ মানুষ ও সেনা সদস্যদের। সুতরাং একটি জনবান্ধব সেনাবাহিনী এ দেশের মানুষ সব সময় প্রত্যাশা করে। তবে সেনাবাহিনীর কাছ থেকে মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি সব সময় এক রকম ছিল না। বিশেষ করে স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় কিছু উচ্ছৃঙ্খল সেনা সদস্যের হাতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার কারণে মানুষ সেনাবাহিনী সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে থাকে। মানুষের ভাবনায় চলে আসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের আচরণ, যার বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ ২৩ বছর সংগ্রাম করেছে এবং একাত্তরে ৩০ লাখ জীবন বিসর্জন দিয়েছে। ১৯৭৫ সালের পর থেকে পর পর দুজন সেনাবাহিনীপ্রধানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল, সামরিক আইন জারি এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রাজনীতিতে সেনা সদস্যদের সম্পৃক্ততা মানুষ ভালো মনে গ্রহণ করেনি।
তবে ১৯৯১ সালে আবার গণতাান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরে আসার পর, ২০০৭-২০০৮ মেয়াদ ব্যতিরেকে সেনাবাহিনী তার পেশাগত ঐতিহ্য ও দক্ষতার দ্বারা মানুষের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। এই জায়গাটি ধরে রাখা খুবই জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের দর্শনের সঙ্গে সেনাবাহিনী তার জন্মলগ্ন থেকেই জড়িত। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রত্যেক সৈনিককে উজ্জীবিত করেছে। জয় বাংলা স্লোগান এবং জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ ছিল অফুরন্ত চেতনা শক্তির উৎস। সুতরাং আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর মনস্তাত্ত্বিকতায় ও সব কর্মকাণ্ডে মুক্তিযুদ্ধের দর্শন এবং আদর্শের প্রতিফলন থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক ও মানুষ সেটাই প্রত্যাশা করে। তবে দুঃখজনক হলেও বর্তমান বাস্তবতা এই যে দেশের বড় একটি রাজনৈতিক পক্ষ মুক্তিযুদ্ধের দর্শন ও আদর্শকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। পঁচাত্তরে জাতির জনকের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের দর্শনবিরোধী ওই রাজনৈতিক শক্তির পুনরুত্থান ও আবির্ভাব ঘটেছে। এই রাজনৈতিক গোষ্ঠী সব সময় সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়াতে চায় এবং বিতর্কের মধ্যে ফেলে নিজেদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়, যা সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র ও সশস্ত্র বাহিনীর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সাম্প্রতিক সময়ে তারা বিতর্ক তুলেছে বিচারিক ক্ষমতা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতো করে নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করতে হবে। এর ফলে বিচার বিভাগ ও পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর একটা রেষারেষি ও মনোমালিন্য সৃষ্টি হলে তা দেশের জন্য কতখানি ক্ষতিকর হবে, সেটা সবারই উপলব্ধি করা উচিত। তা ছাড়া সেনাবাহিনী কিছুদিনের জন্য পুলিশের মতো হয়ে গেলে তার বিরূপ প্রভাব সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ও পেশার জন্য কতখানি ক্ষতি করবে, সেটাও মনে রাখা দরকার। এ রকম প্রস্তাব ও কথা বিশ্বের কোথাও শোনা যায় না। এটা হলে সেনাবাহিনীর বিশেষত্ব বলতে আর কিছু থাকবে না। সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। রাষ্ট্র, দেশ ও সশস্ত্র বাহিনী সবার, সমগ্র জাতির সম্পদ। সুতরাং সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে বুকে ধারণ করে দেশমাতৃকার সেবায় সদা সর্বত্র অতন্দ্র প্রহরীর মতো জাগ্রত থাকবে, এটাই হোক সশস্ত্র বাহিনী দিবসের শপথ ও প্রতিজ্ঞা।
লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক