ঢাকা , রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সবটাই নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ  আর তিন দিন বাদেই ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। প্রচার-প্রচারণা দেখে মনে হচ্ছে ভোটারদের মাঝে উৎসাহের অভাব নেই। প্রার্থীদের সংখ্যা আমলে নিলে একে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে হবে সন্দেহ নেই। কিন্তু অংশগ্রহণমূলক মানেই ‘সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ’ নয়। ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়াজন। ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আর প্রয়োজন প্রচারের ক্ষেত্রে সব প্রার্থীর সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।

তবে এখন পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি মেয়র প্রার্থী বিএনপির তাবিথ আউয়ালের প্রচারণায় একবার হামলার ঘটনা ছাড়া আর কোনো বড় রকমের অশান্তির কথা শোনা যায়নি। যদিও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ নির্বাচনে ৪০ হাজার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত থাকবে, তারপরও সার্বিক নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ফিরে এসেছে বলে মনে হয় না। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নির্বাচনের প্রতি ভোটারদের এক ধরনের অনীহা জন্ম নিয়েছে। এ থেকে মুক্ত হওয়ার মতো কোনো উদাহরণ গত এক বছরে দেখতে পাইনি।

আমাদের সামনে সর্বশেষ অভিজ্ঞতা হিসেবে হাতে রয়েছে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় মোট ভোটারের সংখ্যা ৩১ লাখ ২ হাজার। তার মধ্যে ভোট পড়েছে ৯ লাখ ২৩ হাজার ২৬, যা শতাংশের হিসেবে ৩১.৫। ছোটবেলায় শুনেছি ক্লাসের পরীক্ষায় পাস মার্কস ৩৩ শতাংশ। ৩১ শতাংশ পেলে স্যার দয়া করে ২ মার্কস দিয়ে দিতেন- সেটাকে বলতাম ‘গ্রেস মার্কস’। সিইসি’র দয়া আছে কিন্তু গ্রেস মার্কস দেয়ার ক্ষমতা নেই। অতএব ফেল মার্কসই সই।

এ ৩১-কেও অনেকে বিশ্বাস করতে চান না, তাদের মত অনুযায়ী এ হার ২৮ শতাংশের বেশি নয়। তবে এ তর্কে না গিয়েও বলা যায়, ২৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ ছিল সর্বনিম্ন। এর আগে আরও চার সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হয়ে গেছে। রাজশাহীতে ভোট পড়েছিল ৭৮ শতাংশ, গাজীপুরে ৫৭ শতাংশ, খুলনায় ৬২ শতাংশ এবং সিলেটে ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ সবক’টিতেই ৫০ শতাংশের বেশি অংশগ্রহণ ছিল। আগামী দিনগুলোতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা আরও কমে যাবে বলে সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।

ভোটারদের এ অনাগ্রহের কারণ কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লু­র রহমান গত ২ মার্চ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘একদিকে এ নির্বাচনে কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। অন্যদিকে গত সাধারণ নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় জনগণের মনে হয়েছে, তারা ভোট দিল কী দিল না, তাতে ফলাফলের কিছু যাবে আসবে না। ক্ষমতাসীনরা যে ফল চায়, তা তারা কোনো না কোনোভাবে তৈরি করবে। তাই জনগণ নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।’

তার মানে হল, ভোটাররা নিজেদের গুরুত্বহীন মনে করছেন, অন্তত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখে। সরকারি তরফ থেকে প্রশ্নবিদ্ধ সেই নির্বাচনকে যতভাবেই ‘হালাল’ করার চেষ্টা হোক না কেন, খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মুখনিঃসৃত বাণীতে কিন্তু বিপরীত সুরটাই বাজতে শুনেছি। একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালায় প্রধান নির্বাচন কশিনার কেএম নুরুল হুদা বলেছেন, ‘সমাজের মধ্যে একটার পর একটা অনিয়ম অনুপ্রবেশ করে, আবার সেটি প্রতিহত করতে একটা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। আমরা এখন চিন্তা করছি, এগুলোর দরকার নেই। ইভিএম চালু করে দেব, তাহলে সেখানে আর রাতে বাক্সভর্তি করার সুযোগ থাকবে না’ (যুগান্তর, ০৯.০৩.২০১৯)।

হয়তো সে ভাবনা থেকেই এবারের নির্বাচন সম্পূর্ণ ইভিএম পদ্ধতিতে সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়া গেলেও বিএনপির প্রথম থেকেই আপত্তি। এটি আমাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা। আমরা সব বিষয়েই বড্ড বেশি একপেশে। যে কোনো প্রক্রিয়া-পদ্ধতিরই ভালোমন্দ থাকে; সে ভালোমন্দের তুলনামূলক বিচার করেই তা গ্রহণ-বর্জনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা পরীক্ষামূলকও হতে পারে। কিন্তু ষোল আনা ‘না’ কিংবা ষোল আনা ‘হ্যাঁ’র মধ্যে প্রকৃত নিষ্পত্তির সুযোগ নেই। তুলনামূলক আলোচনা হতে পারে।

প্রচলিত ব্যবস্থায় আমরা সাধারণত একটি গোপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যালট পেপারে মার্কার ওপর সিল দিয়ে ভাঁজ করে ব্যালট বাক্সে ফেলে দিই। এ রকম সবার ‘ফেলে’ দেয়া শেষ হলে, অর্থাৎ ভোটদান প্রক্রিয়া শেষ হলে নির্বাচন কর্মকর্তারা বিভিন্ন মার্কার এজেন্টদের সামনে সেই ভোট গণনা করে প্রাথমিক ফলাফল ঘোষণা করে থাকেন। ইভিএমের বেলায় অত কষ্টের বা সময়ক্ষেপণের প্রয়োজন হবে না। আপনি ভোটকেন্দ্রে আপনার নির্দিষ্ট বুথে ঢুকবেন, মেশিনের একটা বোতামে চাপ দেবেন- ব্যস কেল্লা ফতে, ভোটের কাজ শেষ।

প্রায় ৬৪টি মার্কায় ভোট দেয়ার অপশন থাকে আর মেশিনটির ভোট ধারণক্ষমতা সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি। একটা ভোট দিতে ১৫ সেকেন্ডের বেশি সময় লাগে না। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা একটা বোতাম চাপলে মেশিন চালু হয়ে যাবে। আপনি ভোট দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আপনার ভোটটি গ্রহণ করে মেশিন বন্ধ হয়ে যাবে। আপনি দ্বিতীয়বার ভোট দেয়ার সুযোগ পাবেন না। এমনকি আপনি যদি এক মার্কায় দিতে গিয়ে ভুল করে অন্য মার্কার বোতাম চেপে বসেন তাহলে মেশিন এবং প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কিছুই করার থাকবে না। সেভাবেই গণনা হয়ে যাবে। এতে করে একটি কেন্দ্রের ফলাফল আপনি ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পেয়ে যাবেন।

একে একে এর অনেক সুবিধার কথাই বলা যায়। খরচার কথাটাই ধরুন, ইভিএম ব্যবহার করলে একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন আজকের টাকায় দু’শ কোটি টাকার বেশি সাশ্রয় করতে পারবে। একটি মেশিন দিয়ে পাঁচ-ছয়টি নির্বাচন করা যাবে। বিদ্যুতের ব্যবহার তো লাগবেই; কিন্তু তা ১২ ভোল্টের একটি ব্যাটারিতেই হয়ে যাবে। সে কারণে আপনি ‘বৈদ্যুতিক শক’ থেকেও বেঁচে যাবেন। শুধু শহরে নয়, গ্রামগঞ্জেও ইভিএম ব্যবহারযোগ্য। কোনো ভোটারের ভোট নষ্ট হবে না এবং তা ১০ বছর ধরে মেমোরিতে নিরাপদে থাকবে। আমার কথা শুনে কারও মনে হতে পারে, আমি ইভিএমের ফেরি করে বেড়াচ্ছি। সবই ভালো দিক, তা সত্য নয়; এর নেতিবাচক দিকও আছে।

দলীয় প্রভাববলয় থেকে মুক্ত না হতে পারলে মহাবিপদ! ভোটগ্রহণ স্বাভাবিকভাবেই হল। কিন্তু আগে থেকে প্রোগ্রামিং করা থাকলে চূড়ান্তভাবে ক্লোজ-বাটন চেপে কোনো একটি মার্কায় অতিরিক্ত ৩০০-৪০০ ভোট যোগ করা সম্ভব। এখানে সততার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। ভোটকেন্দ্র দখলের ঘটনা এ দেশে নতুন কিছু নয়। সেক্ষেত্রে নির্বাচনী কর্মকর্তার স্বাক্ষর জোর করে আদায় করা হয়।

সে রকম ঘটনা যদি ঘটে, অর্থাৎ কেন্দ্র যদি নিয়ন্ত্রণে নেয়া যায় তাহলে প্রচলিত অবস্থায় যে কাজটি সমাধা করতে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে (সিল মারতে) সেটিই ইভিএমের বেলায় লাগবে এক ঘণ্টারও কম সময়। কিংবা নির্বাচন কর্মকর্তার স্মার্ট কার্ডের নকল তৈরি করেও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা সম্ভব। ২০১০ সালের আগস্টে একদল আইটি গবেষক ভারতের ভোটিং মেশিনকে জালিয়াতি প্রতিরোধে অক্ষম বলে মতামত দেয়। এ বিষয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেন আডিডা, পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাট ব্লেইজ এবং মাইক্রোসফ্ট বিশেষজ্ঞ জোস বেনালো ইভিএমের দুর্বলতার কথা জানান।

১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ইভিএম পদ্ধতি প্রথম চালু হলেও ক্রমে ক্রমে তা বিস্তার লাভ করতে শুরু করে। পরবর্তীকালে আইনগতভাবেই কানাডা, রাশিয়া, ফ্রান্স, জাপান, স্পেন, সুইডেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাসহ বহু দেশেই ইভিএমের ব্যবহার দেখা যায়। তবে গবেষকদের মতামত হল, ৮৭ শতাংশ রাষ্ট্রই এর যথাযথ প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের মতানুযায়ী এর জন্য মেশিন যতটা না দায়ী তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি দায়ী রাজনৈতিক উপাদানগুলো।

সুতরাং সফলতা-ব্যর্থতা সবটাই নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর, তা ইভিএমই হোক আর ব্যালট বাক্সই হোক। নির্বাচনের ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার মূল দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই; সেখানে বিএনপির করণীয় অতি সামান্য। অনেকেই মনে করেন, এ নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য একটি সুযোগ এনে দিতে পারে। দীর্ঘদিন একটি দল ক্ষমতায় থাকলে অনেক নেতিবাচক উপাদান পরিলক্ষিত হয়। সেক্ষেত্রে দলের নেতাকর্মীদের জনমুখী না হয়ে অর্থবিত্তমুখী হতে দেখা যায়। সে অবস্থা থেকে আওয়ামী লীগ দূরে নয়।

ঢাকা সিটি নির্বাচনে পরাজিত হলে সরকার পতনের কোনো আশঙ্কা নেই, কিন্তু সরকার নিরপেক্ষভাবে তার সমর্থনের মাত্রাটা বুঝতে সক্ষম হবে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হতে এখনও ৪ বছর বাকি। দলের যদি কোনো দুর্বল দিক থেকে থাকে, তাহলে তা আগামী ৪ বছরে শুধরে নেয়ার সুযোগ থাকবে। অপরদিকে নির্বাচনের ওপরও মানুষের আস্থা ফিরে আসবে। তাই ফলাফল যাই হোক না কেন, একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন করতে পারলে তা আওয়ামী লীগ ও গণতন্ত্র উভয়ের জন্যই শুভ কিছু বয়ে আনতে পারে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

সবটাই নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর

আপডেট টাইম : ০২:৪৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২০

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ  আর তিন দিন বাদেই ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। প্রচার-প্রচারণা দেখে মনে হচ্ছে ভোটারদের মাঝে উৎসাহের অভাব নেই। প্রার্থীদের সংখ্যা আমলে নিলে একে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে হবে সন্দেহ নেই। কিন্তু অংশগ্রহণমূলক মানেই ‘সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ’ নয়। ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়াজন। ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আর প্রয়োজন প্রচারের ক্ষেত্রে সব প্রার্থীর সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।

তবে এখন পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি মেয়র প্রার্থী বিএনপির তাবিথ আউয়ালের প্রচারণায় একবার হামলার ঘটনা ছাড়া আর কোনো বড় রকমের অশান্তির কথা শোনা যায়নি। যদিও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ নির্বাচনে ৪০ হাজার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত থাকবে, তারপরও সার্বিক নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা ফিরে এসেছে বলে মনে হয় না। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নির্বাচনের প্রতি ভোটারদের এক ধরনের অনীহা জন্ম নিয়েছে। এ থেকে মুক্ত হওয়ার মতো কোনো উদাহরণ গত এক বছরে দেখতে পাইনি।

আমাদের সামনে সর্বশেষ অভিজ্ঞতা হিসেবে হাতে রয়েছে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় মোট ভোটারের সংখ্যা ৩১ লাখ ২ হাজার। তার মধ্যে ভোট পড়েছে ৯ লাখ ২৩ হাজার ২৬, যা শতাংশের হিসেবে ৩১.৫। ছোটবেলায় শুনেছি ক্লাসের পরীক্ষায় পাস মার্কস ৩৩ শতাংশ। ৩১ শতাংশ পেলে স্যার দয়া করে ২ মার্কস দিয়ে দিতেন- সেটাকে বলতাম ‘গ্রেস মার্কস’। সিইসি’র দয়া আছে কিন্তু গ্রেস মার্কস দেয়ার ক্ষমতা নেই। অতএব ফেল মার্কসই সই।

এ ৩১-কেও অনেকে বিশ্বাস করতে চান না, তাদের মত অনুযায়ী এ হার ২৮ শতাংশের বেশি নয়। তবে এ তর্কে না গিয়েও বলা যায়, ২৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ ছিল সর্বনিম্ন। এর আগে আরও চার সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হয়ে গেছে। রাজশাহীতে ভোট পড়েছিল ৭৮ শতাংশ, গাজীপুরে ৫৭ শতাংশ, খুলনায় ৬২ শতাংশ এবং সিলেটে ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ সবক’টিতেই ৫০ শতাংশের বেশি অংশগ্রহণ ছিল। আগামী দিনগুলোতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা আরও কমে যাবে বলে সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।

ভোটারদের এ অনাগ্রহের কারণ কী? এমন প্রশ্নের উত্তরে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লু­র রহমান গত ২ মার্চ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘একদিকে এ নির্বাচনে কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। অন্যদিকে গত সাধারণ নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় জনগণের মনে হয়েছে, তারা ভোট দিল কী দিল না, তাতে ফলাফলের কিছু যাবে আসবে না। ক্ষমতাসীনরা যে ফল চায়, তা তারা কোনো না কোনোভাবে তৈরি করবে। তাই জনগণ নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।’

তার মানে হল, ভোটাররা নিজেদের গুরুত্বহীন মনে করছেন, অন্তত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখে। সরকারি তরফ থেকে প্রশ্নবিদ্ধ সেই নির্বাচনকে যতভাবেই ‘হালাল’ করার চেষ্টা হোক না কেন, খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের মুখনিঃসৃত বাণীতে কিন্তু বিপরীত সুরটাই বাজতে শুনেছি। একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালায় প্রধান নির্বাচন কশিনার কেএম নুরুল হুদা বলেছেন, ‘সমাজের মধ্যে একটার পর একটা অনিয়ম অনুপ্রবেশ করে, আবার সেটি প্রতিহত করতে একটা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। আমরা এখন চিন্তা করছি, এগুলোর দরকার নেই। ইভিএম চালু করে দেব, তাহলে সেখানে আর রাতে বাক্সভর্তি করার সুযোগ থাকবে না’ (যুগান্তর, ০৯.০৩.২০১৯)।

হয়তো সে ভাবনা থেকেই এবারের নির্বাচন সম্পূর্ণ ইভিএম পদ্ধতিতে সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়া গেলেও বিএনপির প্রথম থেকেই আপত্তি। এটি আমাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা। আমরা সব বিষয়েই বড্ড বেশি একপেশে। যে কোনো প্রক্রিয়া-পদ্ধতিরই ভালোমন্দ থাকে; সে ভালোমন্দের তুলনামূলক বিচার করেই তা গ্রহণ-বর্জনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা পরীক্ষামূলকও হতে পারে। কিন্তু ষোল আনা ‘না’ কিংবা ষোল আনা ‘হ্যাঁ’র মধ্যে প্রকৃত নিষ্পত্তির সুযোগ নেই। তুলনামূলক আলোচনা হতে পারে।

প্রচলিত ব্যবস্থায় আমরা সাধারণত একটি গোপন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যালট পেপারে মার্কার ওপর সিল দিয়ে ভাঁজ করে ব্যালট বাক্সে ফেলে দিই। এ রকম সবার ‘ফেলে’ দেয়া শেষ হলে, অর্থাৎ ভোটদান প্রক্রিয়া শেষ হলে নির্বাচন কর্মকর্তারা বিভিন্ন মার্কার এজেন্টদের সামনে সেই ভোট গণনা করে প্রাথমিক ফলাফল ঘোষণা করে থাকেন। ইভিএমের বেলায় অত কষ্টের বা সময়ক্ষেপণের প্রয়োজন হবে না। আপনি ভোটকেন্দ্রে আপনার নির্দিষ্ট বুথে ঢুকবেন, মেশিনের একটা বোতামে চাপ দেবেন- ব্যস কেল্লা ফতে, ভোটের কাজ শেষ।

প্রায় ৬৪টি মার্কায় ভোট দেয়ার অপশন থাকে আর মেশিনটির ভোট ধারণক্ষমতা সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি। একটা ভোট দিতে ১৫ সেকেন্ডের বেশি সময় লাগে না। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা একটা বোতাম চাপলে মেশিন চালু হয়ে যাবে। আপনি ভোট দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আপনার ভোটটি গ্রহণ করে মেশিন বন্ধ হয়ে যাবে। আপনি দ্বিতীয়বার ভোট দেয়ার সুযোগ পাবেন না। এমনকি আপনি যদি এক মার্কায় দিতে গিয়ে ভুল করে অন্য মার্কার বোতাম চেপে বসেন তাহলে মেশিন এবং প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কিছুই করার থাকবে না। সেভাবেই গণনা হয়ে যাবে। এতে করে একটি কেন্দ্রের ফলাফল আপনি ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পেয়ে যাবেন।

একে একে এর অনেক সুবিধার কথাই বলা যায়। খরচার কথাটাই ধরুন, ইভিএম ব্যবহার করলে একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন আজকের টাকায় দু’শ কোটি টাকার বেশি সাশ্রয় করতে পারবে। একটি মেশিন দিয়ে পাঁচ-ছয়টি নির্বাচন করা যাবে। বিদ্যুতের ব্যবহার তো লাগবেই; কিন্তু তা ১২ ভোল্টের একটি ব্যাটারিতেই হয়ে যাবে। সে কারণে আপনি ‘বৈদ্যুতিক শক’ থেকেও বেঁচে যাবেন। শুধু শহরে নয়, গ্রামগঞ্জেও ইভিএম ব্যবহারযোগ্য। কোনো ভোটারের ভোট নষ্ট হবে না এবং তা ১০ বছর ধরে মেমোরিতে নিরাপদে থাকবে। আমার কথা শুনে কারও মনে হতে পারে, আমি ইভিএমের ফেরি করে বেড়াচ্ছি। সবই ভালো দিক, তা সত্য নয়; এর নেতিবাচক দিকও আছে।

দলীয় প্রভাববলয় থেকে মুক্ত না হতে পারলে মহাবিপদ! ভোটগ্রহণ স্বাভাবিকভাবেই হল। কিন্তু আগে থেকে প্রোগ্রামিং করা থাকলে চূড়ান্তভাবে ক্লোজ-বাটন চেপে কোনো একটি মার্কায় অতিরিক্ত ৩০০-৪০০ ভোট যোগ করা সম্ভব। এখানে সততার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। ভোটকেন্দ্র দখলের ঘটনা এ দেশে নতুন কিছু নয়। সেক্ষেত্রে নির্বাচনী কর্মকর্তার স্বাক্ষর জোর করে আদায় করা হয়।

সে রকম ঘটনা যদি ঘটে, অর্থাৎ কেন্দ্র যদি নিয়ন্ত্রণে নেয়া যায় তাহলে প্রচলিত অবস্থায় যে কাজটি সমাধা করতে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে (সিল মারতে) সেটিই ইভিএমের বেলায় লাগবে এক ঘণ্টারও কম সময়। কিংবা নির্বাচন কর্মকর্তার স্মার্ট কার্ডের নকল তৈরি করেও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা সম্ভব। ২০১০ সালের আগস্টে একদল আইটি গবেষক ভারতের ভোটিং মেশিনকে জালিয়াতি প্রতিরোধে অক্ষম বলে মতামত দেয়। এ বিষয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেন আডিডা, পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাট ব্লেইজ এবং মাইক্রোসফ্ট বিশেষজ্ঞ জোস বেনালো ইভিএমের দুর্বলতার কথা জানান।

১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ইভিএম পদ্ধতি প্রথম চালু হলেও ক্রমে ক্রমে তা বিস্তার লাভ করতে শুরু করে। পরবর্তীকালে আইনগতভাবেই কানাডা, রাশিয়া, ফ্রান্স, জাপান, স্পেন, সুইডেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনাসহ বহু দেশেই ইভিএমের ব্যবহার দেখা যায়। তবে গবেষকদের মতামত হল, ৮৭ শতাংশ রাষ্ট্রই এর যথাযথ প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের মতানুযায়ী এর জন্য মেশিন যতটা না দায়ী তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি দায়ী রাজনৈতিক উপাদানগুলো।

সুতরাং সফলতা-ব্যর্থতা সবটাই নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর, তা ইভিএমই হোক আর ব্যালট বাক্সই হোক। নির্বাচনের ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার মূল দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই; সেখানে বিএনপির করণীয় অতি সামান্য। অনেকেই মনে করেন, এ নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য একটি সুযোগ এনে দিতে পারে। দীর্ঘদিন একটি দল ক্ষমতায় থাকলে অনেক নেতিবাচক উপাদান পরিলক্ষিত হয়। সেক্ষেত্রে দলের নেতাকর্মীদের জনমুখী না হয়ে অর্থবিত্তমুখী হতে দেখা যায়। সে অবস্থা থেকে আওয়ামী লীগ দূরে নয়।

ঢাকা সিটি নির্বাচনে পরাজিত হলে সরকার পতনের কোনো আশঙ্কা নেই, কিন্তু সরকার নিরপেক্ষভাবে তার সমর্থনের মাত্রাটা বুঝতে সক্ষম হবে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন হতে এখনও ৪ বছর বাকি। দলের যদি কোনো দুর্বল দিক থেকে থাকে, তাহলে তা আগামী ৪ বছরে শুধরে নেয়ার সুযোগ থাকবে। অপরদিকে নির্বাচনের ওপরও মানুষের আস্থা ফিরে আসবে। তাই ফলাফল যাই হোক না কেন, একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন করতে পারলে তা আওয়ামী লীগ ও গণতন্ত্র উভয়ের জন্যই শুভ কিছু বয়ে আনতে পারে।