ঢাকা , বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ধর্ষকের আবার শ্রেণি কি

আফরিন জাহান :

অন্যের অনিষ্ট করে নিজের মনোবাসনা পূর্ণ করতে বাংলাদেশের ধর্ষকরা যে পিছিয়ে নেই সে কথাই বার বার আমাদের সামনে আসছে। কয়েকদিন আগেও আট বছর বয়সী নিষ্পাপ আয়েশা নামের এক শিশুকে বাবার সঙ্গে ট্রেনের নিচে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাঁচতে।

দেশে ধর্ষণসহ নারীদের যৌন হয়রানির ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও নারী ও শিশুরা দুর্বৃত্তের অস্ত্রের মুখে, প্রতারণা বা ফাঁদে পড়ে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হচ্ছে।

ধর্ষণ এখন কেবল বাংলাদেশেই নয় বিশ্বের এক ভয়ঙ্কর ব্যাধির নাম। নারী আজ কোথাও নিরাপদ নয়। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশি,বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক এমনকি নিজের বাবার কাছেও নারীর নিরাপত্তা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। প্রতিদিনই কারো না কারোর লালসার শিকার হতে হচ্ছে তাকে। নারী মানেই যেন যৌন হয়রানি, পুরুষের কামের বস্তু। নারী যে শুধু ভোগের নয় বরং সম্মানেরও সেই মানবিক বোধও দিন দিন ক্ষয়িষ্ণু হয়ে প্রায় শূন্যের কোটায় এসে পৌঁছেছে।

ধর্ষক সে যেই হোক না কেন তার নাম ধর্ষকই। তা হোক সে  কোনো ধনীর দুলাল কিংবা কোনো গামের্ন্টসকর্মী। এক্ষেত্রে তাদের বিশেষণের নীতিগত কোনো পার্থ্ক্য নেই। তবে এক্ষেত্রে আমাদের দেশে বিচার ব্যবস্থার কিছু পার্থ্ক্য দেখা যায়। যেমন গত ৫ এপ্রিল কুড়িগ্রামের রাজারহাট ইউনিয়নের ধর্ষিতা জোলেখা খাতুনের ধর্ষক লালমনিরহাটের আব্দুল্ল্যাহ ও তার মামাতো ভাই লিটনকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ অভিযান চালিয়ে আটক করতে পারলেও বনানীর ধনীর দুলাল ধর্ষকরা বাসায় অবস্থান করলেও পুলিশ তাদের খুঁজে পাচ্ছেন না। পুলিশের দেখেও না দেখার ভান করার কারণ কি এটা কেবল তারা এবং আপন জুয়েলার্সের কর্তা ব্যক্তিরাই বলতে পারবেন। ধনীর দুলাল এসব ধর্ষকরা অবশ্য  ধর্ষণের পরের বিষয়টি ধনকুবের বাবার হাতেই ছেড়ে দেন। আর এইসব বাবা নামের ঘৃণ্য ব্যক্তিরাও নিজ সন্তানের কুকর্ম ঢেকে রাখার রসদ খুঁজতে থাকেন যত্রতত্র। কারণ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রাজধানীর বনানীতে ঘটে যাওয়া ঘটনার ধর্ষক সাফাত আহমেদ ও সাদমান সাকিফ উভয়ের বাবাই বলেছে ধর্ষিতা কেন এতদিন পরে অভিযোগ করল? এখানে ন্যূনতম নীতিবোধ কিংবা বিবেক থাকলে একজন বাবার কি কথা বলা উচিত সেটা হয়তো এখনো এদের বোধগম্য হয়নি। এই বোধ অর্জন করতে হলে কখনো কখনো এমন একজন ধর্ষিতার বাবার আসনে বসতে হয়। এসব কুলাঙ্গার বাবার ঘৃণ্য ছেলেরা কেবল টাকা আর আভিজাত্যকে চিনতে শিখেছে নৈতিকতার শিক্ষাটা হয়তো পরিবার থেকে ছোটবেলায় তাদের দেয়া হয়নি। তাই তো ঘটনা ঘটার পরেও বাদীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টাও চালায় তারা।

বাংলাদেশে বর্তমান গবেষণায় ধর্ষণের যে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে তার একটি নমুনা দেখা যাক এবার। কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, আসকের ২০১৬ সালের পর্যালোচনামূলক এক প্রতিবেদনে  বলা হয়েছে, এ বছর নারী নির্যাতনের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি এর মাত্রা এবং ধরন ছিল ভয়াবহতা। ২০১৬ সালে নারী উত্ত্যক্ত, যৌন হয়রানি, নির্যাতন, হত্যা ও সালিশের মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা আগের যে কোনো বছরের চেয়ে বেশি ছিল। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৬ সালে ধর্ষণের শিকার হয় ৭২৪ জন নারী । এরমধ্যে ধর্ষণের পরে ৩৭ জনকে হত্যা করা হয় ও ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেন আটজন। সালিশ ও ফতোয়ার মাধ্যমে মোট ১২ জন নারী নির্যাতনের শিকার হন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যে আরো বলা হয়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯৩ জন নারী। এদের মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয় ২৬ জন। অন্যদিকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য মতে, চলতি বছরের এপ্রিলেই মোট ৮৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গণধর্ষণ হয়েছে ১৪টি এবং ধর্ষণ শেষে চারজনকে হত্যা করা হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে প্রমাণ না রাখতে এবং ভিকটিম যাতে ঘটনাটি কাউকে না জানায় তা নিশ্চিত করতে অপরাধীরা ভিকটিমকে নির্যাতন শেষে হত্যা করেছে। এমনকি নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যেটা বনানীর ঘটনায়ও করা হয়েছে। আবার প্রভাবশালীরা সালিশের নাম করে ভিকটিম ও তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকা দিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। আর এক্ষেত্রে আইনজীবীরা বলছেন, ধর্ষণের ঘটনায় বিচারের হার এতই কম যে, অপরাধীরা ধরেই নিয়েছে এমন অপরাধ করে পার পাওয়া সম্ভব।

আর হয়তো এ কারণেই ধর্ষিতা নারী শারীরিক ও মানসিকভাবেই শুধু নির্যাতিত হয় না বরং এটা তাদের সামাজিকতায়ও ভীষণভাবে আঘাত হানে তা সে যে পরিবার থেকেই আসুক না কেন।

আর যেসব ধর্ষকের পেশিবল যত বশি সে তত দ্রুত এসব আদালত, মামলা থেকে মুক্তি লাভ করে এবং বীরদর্পে হেঁটে বেড়ায়। হয়ত অর্থ ও ক্ষমতার দাপটে সে সামাজিকভাবে নিজেকে বড় ভাবে। আমরাও কেউ কেউ সব ভুলে  সমাজে তার অবস্থানের কথা ভেবে বাহবা দেই কিন্তু মনে রাখতে হবে ধর্ষক সে যে পরিবার থেকেই আসুক না কেন সে তো ধর্ষকই। তার আবার শ্রেণি কি?

লেখক: সাংবাদিক, সিনিয়র নিউজ রিপোর্টার, বাংলাদেশ টেলিভিশন

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

ধর্ষকের আবার শ্রেণি কি

আপডেট টাইম : ০২:০৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ মে ২০১৭

আফরিন জাহান :

অন্যের অনিষ্ট করে নিজের মনোবাসনা পূর্ণ করতে বাংলাদেশের ধর্ষকরা যে পিছিয়ে নেই সে কথাই বার বার আমাদের সামনে আসছে। কয়েকদিন আগেও আট বছর বয়সী নিষ্পাপ আয়েশা নামের এক শিশুকে বাবার সঙ্গে ট্রেনের নিচে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাঁচতে।

দেশে ধর্ষণসহ নারীদের যৌন হয়রানির ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও নারী ও শিশুরা দুর্বৃত্তের অস্ত্রের মুখে, প্রতারণা বা ফাঁদে পড়ে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হচ্ছে।

ধর্ষণ এখন কেবল বাংলাদেশেই নয় বিশ্বের এক ভয়ঙ্কর ব্যাধির নাম। নারী আজ কোথাও নিরাপদ নয়। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশি,বন্ধু-বান্ধব, শিক্ষক এমনকি নিজের বাবার কাছেও নারীর নিরাপত্তা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। প্রতিদিনই কারো না কারোর লালসার শিকার হতে হচ্ছে তাকে। নারী মানেই যেন যৌন হয়রানি, পুরুষের কামের বস্তু। নারী যে শুধু ভোগের নয় বরং সম্মানেরও সেই মানবিক বোধও দিন দিন ক্ষয়িষ্ণু হয়ে প্রায় শূন্যের কোটায় এসে পৌঁছেছে।

ধর্ষক সে যেই হোক না কেন তার নাম ধর্ষকই। তা হোক সে  কোনো ধনীর দুলাল কিংবা কোনো গামের্ন্টসকর্মী। এক্ষেত্রে তাদের বিশেষণের নীতিগত কোনো পার্থ্ক্য নেই। তবে এক্ষেত্রে আমাদের দেশে বিচার ব্যবস্থার কিছু পার্থ্ক্য দেখা যায়। যেমন গত ৫ এপ্রিল কুড়িগ্রামের রাজারহাট ইউনিয়নের ধর্ষিতা জোলেখা খাতুনের ধর্ষক লালমনিরহাটের আব্দুল্ল্যাহ ও তার মামাতো ভাই লিটনকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ অভিযান চালিয়ে আটক করতে পারলেও বনানীর ধনীর দুলাল ধর্ষকরা বাসায় অবস্থান করলেও পুলিশ তাদের খুঁজে পাচ্ছেন না। পুলিশের দেখেও না দেখার ভান করার কারণ কি এটা কেবল তারা এবং আপন জুয়েলার্সের কর্তা ব্যক্তিরাই বলতে পারবেন। ধনীর দুলাল এসব ধর্ষকরা অবশ্য  ধর্ষণের পরের বিষয়টি ধনকুবের বাবার হাতেই ছেড়ে দেন। আর এইসব বাবা নামের ঘৃণ্য ব্যক্তিরাও নিজ সন্তানের কুকর্ম ঢেকে রাখার রসদ খুঁজতে থাকেন যত্রতত্র। কারণ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রাজধানীর বনানীতে ঘটে যাওয়া ঘটনার ধর্ষক সাফাত আহমেদ ও সাদমান সাকিফ উভয়ের বাবাই বলেছে ধর্ষিতা কেন এতদিন পরে অভিযোগ করল? এখানে ন্যূনতম নীতিবোধ কিংবা বিবেক থাকলে একজন বাবার কি কথা বলা উচিত সেটা হয়তো এখনো এদের বোধগম্য হয়নি। এই বোধ অর্জন করতে হলে কখনো কখনো এমন একজন ধর্ষিতার বাবার আসনে বসতে হয়। এসব কুলাঙ্গার বাবার ঘৃণ্য ছেলেরা কেবল টাকা আর আভিজাত্যকে চিনতে শিখেছে নৈতিকতার শিক্ষাটা হয়তো পরিবার থেকে ছোটবেলায় তাদের দেয়া হয়নি। তাই তো ঘটনা ঘটার পরেও বাদীকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলার চেষ্টাও চালায় তারা।

বাংলাদেশে বর্তমান গবেষণায় ধর্ষণের যে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে তার একটি নমুনা দেখা যাক এবার। কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, আসকের ২০১৬ সালের পর্যালোচনামূলক এক প্রতিবেদনে  বলা হয়েছে, এ বছর নারী নির্যাতনের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি এর মাত্রা এবং ধরন ছিল ভয়াবহতা। ২০১৬ সালে নারী উত্ত্যক্ত, যৌন হয়রানি, নির্যাতন, হত্যা ও সালিশের মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা আগের যে কোনো বছরের চেয়ে বেশি ছিল। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৬ সালে ধর্ষণের শিকার হয় ৭২৪ জন নারী । এরমধ্যে ধর্ষণের পরে ৩৭ জনকে হত্যা করা হয় ও ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেন আটজন। সালিশ ও ফতোয়ার মাধ্যমে মোট ১২ জন নারী নির্যাতনের শিকার হন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যে আরো বলা হয়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯৩ জন নারী। এদের মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয় ২৬ জন। অন্যদিকে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য মতে, চলতি বছরের এপ্রিলেই মোট ৮৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গণধর্ষণ হয়েছে ১৪টি এবং ধর্ষণ শেষে চারজনকে হত্যা করা হয়েছে।

এ ক্ষেত্রে প্রমাণ না রাখতে এবং ভিকটিম যাতে ঘটনাটি কাউকে না জানায় তা নিশ্চিত করতে অপরাধীরা ভিকটিমকে নির্যাতন শেষে হত্যা করেছে। এমনকি নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে প্রতিনিয়ত। যেটা বনানীর ঘটনায়ও করা হয়েছে। আবার প্রভাবশালীরা সালিশের নাম করে ভিকটিম ও তার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকা দিয়ে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। আর এক্ষেত্রে আইনজীবীরা বলছেন, ধর্ষণের ঘটনায় বিচারের হার এতই কম যে, অপরাধীরা ধরেই নিয়েছে এমন অপরাধ করে পার পাওয়া সম্ভব।

আর হয়তো এ কারণেই ধর্ষিতা নারী শারীরিক ও মানসিকভাবেই শুধু নির্যাতিত হয় না বরং এটা তাদের সামাজিকতায়ও ভীষণভাবে আঘাত হানে তা সে যে পরিবার থেকেই আসুক না কেন।

আর যেসব ধর্ষকের পেশিবল যত বশি সে তত দ্রুত এসব আদালত, মামলা থেকে মুক্তি লাভ করে এবং বীরদর্পে হেঁটে বেড়ায়। হয়ত অর্থ ও ক্ষমতার দাপটে সে সামাজিকভাবে নিজেকে বড় ভাবে। আমরাও কেউ কেউ সব ভুলে  সমাজে তার অবস্থানের কথা ভেবে বাহবা দেই কিন্তু মনে রাখতে হবে ধর্ষক সে যে পরিবার থেকেই আসুক না কেন সে তো ধর্ষকই। তার আবার শ্রেণি কি?

লেখক: সাংবাদিক, সিনিয়র নিউজ রিপোর্টার, বাংলাদেশ টেলিভিশন