ঢাকা , মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ওদের বিল মিটিয়ে দিন

সে মেলা দিন আগের কথা। মফস্বলে একটা ছোট কাগজ সম্পাদনা করি। পাশাপাশি কবিতা লিখি। মুছি। মাঝে মাঝে দৈনিকের সাহিত্য পাতায় সেগুলো ছাপাও হয়। তাতে গর্ব হয় আমার। কষ্ট হয় আব্বার। ভাবেন, ‘আহা রে, ছেলেটা গোল্লায় গেল!’

আব্বার কষ্ট ক্রমশ আক্ষেপ, সেখান থেকে রাগে মোচড় নিতে দেরি হলো না। আমিও ‘রেখো মা দাসেরে মনে…’ বলে বেরোলাম। পকেটে শ পাঁচেক টাকা। ঢাকায় এসে উঠলাম। প্রথমে ‘কবিতীর্থ’ আজিজ মার্কেটে। সেখান থেকে কাজীপাড়ায় দুই বন্ধুর একান্নবর্তী দেড় রুমের বাসায়। তাঁদের একজন কবি। একজন ছবি আঁকে। সে বাসায় রান্না-টান্না হয় না। রেস্তোরাঁ থেকে তিনজন গিয়ে খেয়ে আসি। বেকার বন্ধুর খাবারের টাকা ওরাই দেয়।

দিন পনেরো পরে ওই দুই বন্ধু কী একটা কাজে ঢাকার বাইরে গেল। ওই দিনই তাদের ফেরার কথা। কিন্তু ফিরল না। পরদিনও না। তারপরের দিনও না। এদিকে আমার পকেট ফাঁকা। পরিচিত কেউ নেই। ঘরে চাল-ডালও নেই। যথাসময়ে ক্ষুধা বাড়তে লাগল। পানি খেতে লাগলাম। এতে তাৎক্ষণিকভাবে মাথার ঝিমঝিম ভাবটা চলে যায়। কিন্তু বার দু-এক বাথরুমে যাওয়ার পর সেই ভাবটা চাগাড় দিয়ে ওঠে। ঝিমঝিম ভাবটা শেষ পর্যন্ত একটা ঘোর তৈরি করে।

একবার ভাবি মতিঝিলে যাই। সেখানে এক বড় ভাই থাকে। তার কাছ থেকে কিছু টাকা নেই। পরক্ষণে মনে হলো, নাহ্! কারও কাছে টাকাপয়সা চাইব না। দেখা যাক কতক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারি। আমি ক্ষুধার স্বরূপ দেখতে চাই।

প্রায় ৪৮ ঘণ্টা একটানা পেটে দানা না পড়ার পর আমি ক্ষুধার স্বরূপ দেখা শুরু করলাম। মাঝে মাঝে মনে হয় ঘুম আসছে। আসলে সেটা ছিল এক অদ্ভুত স্বপ্নালু ঘোর। সম্ভবত অজ্ঞান হওয়ার খুব কাছের অনুভূতি। এই সময়টাতে চোখের সামনে কিছুক্ষণ পরপর ছোট ছোট আলো জ্বলতে দেখা যায়। সম্ভবত এটাই ‘সরষে ফুল’।

অনেকে দিনে উপোস থেকে ক্ষুধার কষ্ট উপলব্ধির চেষ্টা করেন। কেননা তাঁরা জানেন, সন্ধ্যা হওয়ার পর খাবারের ব্যবস্থা আছে, তাঁরা কি ক্ষুধার জ্বালা বুঝবেন?

যাক গে, গল্পে ফেরত আসি। এই সময়টাতে আমার একটা অধিভৌতিক বোধ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমি যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছি। কালের গলিত গর্ভে বিলীয়মান সময়ের মতো ধীরে ধীরে আমি ডুবে যাচ্ছি। ডুবে যাচ্ছি…ডুবে যাচ্ছি…ডুবে…ডুবে…।

এই ঘোরের মধ্যেই হঠাৎ মনে হলো, কয়েকটা কাগজে তো আমার বেশ কিছু কবিতা ছাপা হয়েছে। তারা নাকি বিল দেয়। গিয়ে দেখাই যাক না!

বহু কষ্টে উঠে এক টাকা ভাড়ায় একটা লোকাল বাস চেপে প্রচারসংখ্যায় সবচেয়ে এগিয়ে থাকা একটা দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদকের রুমে গেলাম। নাম বলার পর তিনি চিনলেন। লেখক সম্মানীর কথা বলার পর তিনি বললেন, ‘অ্যাকাউন্ট সেকশনে যান, বিল রেডি আছে’। দুই–তিনটা কবিতার বিল হিসেবে মোট যদ্দুর মনে পড়ে নয় শ টাকা আমার হাতে তুলে দেওয়া হলো। টাকাটা হাতে নেওয়ার পর খেয়াল করলাম, শরীরে এখন আর আগের মতো অবসন্ন ভাব নেই। প্রথমে এক প্যাকেট দামি সিগারেট কিনে একটা ভালো রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম।

মুরগির ঝালফ্রাই অর্ডার দিলাম। খেতে গিয়ে দেখলাম, খিদে একেবারেই নেই। আমি খেতে পারছি না। খাবারের গন্ধে বমি আসছে।

আমি খাবার ফেলে বাইরে এসে সিগারেট ধরালাম। আকণ্ঠ চৈত্রেও আপাদমস্তক শিহরণে কেঁপে মনে মনে বললাম, ‘পরম করুণাময়! ক্ষুধা নামক এই ঘাতকের স্বরূপ দেখানোর জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। এই ভাগ্য সবার হয় না। ক্ষুধার স্বরূপ তুমি আর কাউকে দেখিয়ো না।’

কিন্তু না, আমার দোয়া কবুল হয়নি। গোটা হাওরাঞ্চল এখন ক্ষুধার স্বরূপ দেখার সামনে দাঁড়িয়ে।

৩৫টি আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত সংগঠন হাওর অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্ম (হ্যাপ) বলছে, সেখানকার ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছুঁয়ে যাবে। হ্যাপ বলছে, সেখানকার ৯০ লাখ মানুষ খাদ্যঝুঁকিতে পড়েছে। এক পরিবারে পাঁচজন করে সদস্য হিসাব করলে ১৮ লাখ পরিবার তীব্র সংকটের মুখে।

সরকার বলছে, খাদ্যসংকট সেখানে নেই। পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হচ্ছে। কিন্তু মাঠপর্যায় থেকে খবর আসছে, পোয়াতি আর প্রসূতি ধানখেত ডুবে গেছে। হাওরবাসীর আয় রোজগারের সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। দিনমজুর নেওয়ার মতো অবস্থাও এখন অনেকেরই নেই।

ফসল ডুবেছে। সেই ফসল পচে হোক বা অন্য কোনো কারণে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী মরে সাফ হচ্ছে। খাবারের অভাবে মানুষের মতো গবাদিপশু এবং হাঁসমুরগিও আমার কবিজীবনের মতো করালগ্রাসী ক্ষুধার স্বরূপ দেখতে শুরু করেছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই হাওরের মানুষ, পশু, পাখি, উদ্ভিদ—সবাই ক্ষুধাক্লিষ্ট এক স্বপ্নালু ঘোরের মধ্যে যাবে।

কিন্তু কখনো কি ভেবেছি এই সব কৃষক, এই সব শ্রমিক, এই সব ভুখা পশু-পাখি-উদ্ভিদকুলই কালের এক একজন মহাকবি? ‘বাংলাদেশ’ নামক মহাকালের দৈনিকের অ্যাকাউন্টস সেকশনে তাদের কত অযুত নিযুত কবিতার বিল বাকি পড়ে আছে, সে কথা কি আমরা একবারও ভেবেছি?

ভাববার সময় কম। বাংলাদেশের সরকার এবং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি প্রবাসী ভাইবোনেরা সবাই এ মুহূর্তে ‘বাংলাদেশ’—দৈনিকের ‘অ্যাকাউন্টস সেকশন’। মাননীয় ‘অ্যাকাউন্টস সেকশন’, প্লিজ, হাওরের ‘কবিদের’ বকেয়া বিল মিটিয়ে দিন। এই কবিরা ক্ষুধার স্বরূপ দেখতে শুরু করেছে। ক্ষুধার স্বরূপ বড় হিংস্র। ওদের বিল মিটিয়ে দিন।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

ওদের বিল মিটিয়ে দিন

আপডেট টাইম : ০৪:০৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ মে ২০১৭

সে মেলা দিন আগের কথা। মফস্বলে একটা ছোট কাগজ সম্পাদনা করি। পাশাপাশি কবিতা লিখি। মুছি। মাঝে মাঝে দৈনিকের সাহিত্য পাতায় সেগুলো ছাপাও হয়। তাতে গর্ব হয় আমার। কষ্ট হয় আব্বার। ভাবেন, ‘আহা রে, ছেলেটা গোল্লায় গেল!’

আব্বার কষ্ট ক্রমশ আক্ষেপ, সেখান থেকে রাগে মোচড় নিতে দেরি হলো না। আমিও ‘রেখো মা দাসেরে মনে…’ বলে বেরোলাম। পকেটে শ পাঁচেক টাকা। ঢাকায় এসে উঠলাম। প্রথমে ‘কবিতীর্থ’ আজিজ মার্কেটে। সেখান থেকে কাজীপাড়ায় দুই বন্ধুর একান্নবর্তী দেড় রুমের বাসায়। তাঁদের একজন কবি। একজন ছবি আঁকে। সে বাসায় রান্না-টান্না হয় না। রেস্তোরাঁ থেকে তিনজন গিয়ে খেয়ে আসি। বেকার বন্ধুর খাবারের টাকা ওরাই দেয়।

দিন পনেরো পরে ওই দুই বন্ধু কী একটা কাজে ঢাকার বাইরে গেল। ওই দিনই তাদের ফেরার কথা। কিন্তু ফিরল না। পরদিনও না। তারপরের দিনও না। এদিকে আমার পকেট ফাঁকা। পরিচিত কেউ নেই। ঘরে চাল-ডালও নেই। যথাসময়ে ক্ষুধা বাড়তে লাগল। পানি খেতে লাগলাম। এতে তাৎক্ষণিকভাবে মাথার ঝিমঝিম ভাবটা চলে যায়। কিন্তু বার দু-এক বাথরুমে যাওয়ার পর সেই ভাবটা চাগাড় দিয়ে ওঠে। ঝিমঝিম ভাবটা শেষ পর্যন্ত একটা ঘোর তৈরি করে।

একবার ভাবি মতিঝিলে যাই। সেখানে এক বড় ভাই থাকে। তার কাছ থেকে কিছু টাকা নেই। পরক্ষণে মনে হলো, নাহ্! কারও কাছে টাকাপয়সা চাইব না। দেখা যাক কতক্ষণ না খেয়ে থাকতে পারি। আমি ক্ষুধার স্বরূপ দেখতে চাই।

প্রায় ৪৮ ঘণ্টা একটানা পেটে দানা না পড়ার পর আমি ক্ষুধার স্বরূপ দেখা শুরু করলাম। মাঝে মাঝে মনে হয় ঘুম আসছে। আসলে সেটা ছিল এক অদ্ভুত স্বপ্নালু ঘোর। সম্ভবত অজ্ঞান হওয়ার খুব কাছের অনুভূতি। এই সময়টাতে চোখের সামনে কিছুক্ষণ পরপর ছোট ছোট আলো জ্বলতে দেখা যায়। সম্ভবত এটাই ‘সরষে ফুল’।

অনেকে দিনে উপোস থেকে ক্ষুধার কষ্ট উপলব্ধির চেষ্টা করেন। কেননা তাঁরা জানেন, সন্ধ্যা হওয়ার পর খাবারের ব্যবস্থা আছে, তাঁরা কি ক্ষুধার জ্বালা বুঝবেন?

যাক গে, গল্পে ফেরত আসি। এই সময়টাতে আমার একটা অধিভৌতিক বোধ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমি যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছি। কালের গলিত গর্ভে বিলীয়মান সময়ের মতো ধীরে ধীরে আমি ডুবে যাচ্ছি। ডুবে যাচ্ছি…ডুবে যাচ্ছি…ডুবে…ডুবে…।

এই ঘোরের মধ্যেই হঠাৎ মনে হলো, কয়েকটা কাগজে তো আমার বেশ কিছু কবিতা ছাপা হয়েছে। তারা নাকি বিল দেয়। গিয়ে দেখাই যাক না!

বহু কষ্টে উঠে এক টাকা ভাড়ায় একটা লোকাল বাস চেপে প্রচারসংখ্যায় সবচেয়ে এগিয়ে থাকা একটা দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদকের রুমে গেলাম। নাম বলার পর তিনি চিনলেন। লেখক সম্মানীর কথা বলার পর তিনি বললেন, ‘অ্যাকাউন্ট সেকশনে যান, বিল রেডি আছে’। দুই–তিনটা কবিতার বিল হিসেবে মোট যদ্দুর মনে পড়ে নয় শ টাকা আমার হাতে তুলে দেওয়া হলো। টাকাটা হাতে নেওয়ার পর খেয়াল করলাম, শরীরে এখন আর আগের মতো অবসন্ন ভাব নেই। প্রথমে এক প্যাকেট দামি সিগারেট কিনে একটা ভালো রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম।

মুরগির ঝালফ্রাই অর্ডার দিলাম। খেতে গিয়ে দেখলাম, খিদে একেবারেই নেই। আমি খেতে পারছি না। খাবারের গন্ধে বমি আসছে।

আমি খাবার ফেলে বাইরে এসে সিগারেট ধরালাম। আকণ্ঠ চৈত্রেও আপাদমস্তক শিহরণে কেঁপে মনে মনে বললাম, ‘পরম করুণাময়! ক্ষুধা নামক এই ঘাতকের স্বরূপ দেখানোর জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। এই ভাগ্য সবার হয় না। ক্ষুধার স্বরূপ তুমি আর কাউকে দেখিয়ো না।’

কিন্তু না, আমার দোয়া কবুল হয়নি। গোটা হাওরাঞ্চল এখন ক্ষুধার স্বরূপ দেখার সামনে দাঁড়িয়ে।

৩৫টি আন্তর্জাতিক ও দেশীয় সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত সংগঠন হাওর অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্ম (হ্যাপ) বলছে, সেখানকার ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছুঁয়ে যাবে। হ্যাপ বলছে, সেখানকার ৯০ লাখ মানুষ খাদ্যঝুঁকিতে পড়েছে। এক পরিবারে পাঁচজন করে সদস্য হিসাব করলে ১৮ লাখ পরিবার তীব্র সংকটের মুখে।

সরকার বলছে, খাদ্যসংকট সেখানে নেই। পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হচ্ছে। কিন্তু মাঠপর্যায় থেকে খবর আসছে, পোয়াতি আর প্রসূতি ধানখেত ডুবে গেছে। হাওরবাসীর আয় রোজগারের সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। দিনমজুর নেওয়ার মতো অবস্থাও এখন অনেকেরই নেই।

ফসল ডুবেছে। সেই ফসল পচে হোক বা অন্য কোনো কারণে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী মরে সাফ হচ্ছে। খাবারের অভাবে মানুষের মতো গবাদিপশু এবং হাঁসমুরগিও আমার কবিজীবনের মতো করালগ্রাসী ক্ষুধার স্বরূপ দেখতে শুরু করেছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই হাওরের মানুষ, পশু, পাখি, উদ্ভিদ—সবাই ক্ষুধাক্লিষ্ট এক স্বপ্নালু ঘোরের মধ্যে যাবে।

কিন্তু কখনো কি ভেবেছি এই সব কৃষক, এই সব শ্রমিক, এই সব ভুখা পশু-পাখি-উদ্ভিদকুলই কালের এক একজন মহাকবি? ‘বাংলাদেশ’ নামক মহাকালের দৈনিকের অ্যাকাউন্টস সেকশনে তাদের কত অযুত নিযুত কবিতার বিল বাকি পড়ে আছে, সে কথা কি আমরা একবারও ভেবেছি?

ভাববার সময় কম। বাংলাদেশের সরকার এবং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি প্রবাসী ভাইবোনেরা সবাই এ মুহূর্তে ‘বাংলাদেশ’—দৈনিকের ‘অ্যাকাউন্টস সেকশন’। মাননীয় ‘অ্যাকাউন্টস সেকশন’, প্লিজ, হাওরের ‘কবিদের’ বকেয়া বিল মিটিয়ে দিন। এই কবিরা ক্ষুধার স্বরূপ দেখতে শুরু করেছে। ক্ষুধার স্বরূপ বড় হিংস্র। ওদের বিল মিটিয়ে দিন।