জিয়াউর রহমান। একটি দেশজোড়া নাম। এ নাম একজন রাষ্ট্রপতির। এ নাম একজন মহান রাষ্ট্রনায়কের। মহান তিনি জীবনাদর্শে, চিন্তা-চেতনায়, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতায়। এ নাম একজন শক্তিধর ব্যক্তিত্বের, এক কারিশমাসমৃদ্ধ সমর নায়কের। এ নাম একজন অসীম সাহসী যোদ্ধার, জাতির এক কঠিন দুঃসময়ের চরম সংকটে মাতৃমুক্তি পণ করা এক সৈনিকের। এ নাম মুক্তিযুদ্ধের আওয়াজ দেওয়া এক ভেরি বাজিয়ের, জাতিকে অস্ত্র হাতে সশস্ত্র যুদ্ধে আহ্বানকারী এক রণডঙ্কা বাদকের। জিয়া একটি স্ফুলিঙ্গের নাম, যা সারা বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ পেইরীতে দাউদাউ করে দাবানল জ্বালিয়েছিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সেই ভয়াল কালরাতে যখন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা সরকার অপারেশন সার্চলাইট নামে পোড়ামাটির নীতি—জ্বালাও, পোড়াও, হত্যা করো (scorch earth policy- burn all, kill all, loot all) বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশজুড়ে গণহত্যা শুরু করে তখন চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবস্থিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান তাঁর সহযোদ্ধাদের বললেন, তোমাদের সিদ্ধান্ত তোমাদের কাছে; কিন্তু আমি আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। To be or not to be-র দোলাচলে আর নয়। I revolt। আমি বিদ্রোহ করলাম। সহযোদ্ধারা, রেজিমেন্টের সৈনিকরা সবাই তাঁর কথার প্রতিধ্বনি করে সমস্বরে বলে উঠলেন, আই নয় উই। We revolt। আমরা বিদ্রোহ করলাম। ২৭ মার্চ মেজর জিয়া কর্ণফুলী নদী অতিক্রম করে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র দখলে নিয়ে প্রথমে নিজ নামে, পরে তা সংশোধন করে জাতীয় শীর্ষ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে স্বাধীনতার ঘোষণাটি আবার উচ্চারণ করেন। তিনি দেশবাসীকে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে আহ্বান জানান। ইথারে ভেসে আসা তাঁর কণ্ঠের ঘোষণা পথে-প্রান্তরে, নগরে-বন্দরে বিস্তীর্ণ বাংলাদেশের কানায় কানায় ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। বাংলাদেশের (তখন) সাড়ে সাত কোটি মানুষ সবাই শুনেছিল। শুনেছিল বিশ্ববাসীও।
চট্টগ্রামে অবস্থানরত মেজর জিয়ার রেডিও ঘোষণা ও তাঁর নেতৃত্বে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া সব সেনা ছাউনির বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলো ও অন্যান্য বাঙালি সৈনিকের মধ্যে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঞ্চার করে। অনুপ্রাণিত করে, রোমাঞ্চিত করে। তারা অন্ধকারে দিশা পায়। ভ্রান্তি কাটিয়ে সঠিক দিকনির্দেশনা লাভ করে। ঢাকার অদূরবর্তী জয়দেবপুরে অবস্থানরত উপ-অধিনায়ক মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল, কুমিল্লা সেনা ছাউনিতে অবস্থানরত উপ-অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তেমনি ঝাঁপিয়ে পড়ে যশোর সেনানিবাসে অবস্থানরত প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং সৈয়দপুর সেনানিবাসে অবস্থানরত তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। এর পরের ইতিহাস রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের কঠিন ইতিহাস। রক্তের আখরে লেখা এক অনবদ্য গৌরবগাথা, এক বীর জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতার এক অমর আখ্যান। আর এ অগ্নি-আখ্যানের অগ্নিপুরুষ, অগ্নিপথের অগ্রযাত্রী মেজর জিয়াউর রহমান। মুক্তিযুদ্ধে আমরা জিয়াকে দেখেছি ক্লান্তিহীন যুদ্ধরত, সেক্টর অধিনায়ক রূপে, ফোর্স (বিগ্রেড) হিসেবে প্রথম গঠিত জেড ফোর্স কমান্ডার হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা দুর্দমনীয়, দুঃসাহসী ও অতুলনীয়। তাঁর সাহস, শৌর্য-বীর্য, রণদক্ষতা আর অধিনায়কোচিত ব্যক্তিত্ব গোটা মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের প্রত্যেক সৈনিককে অনুপ্রাণিত করেছিল, সাহস জুগিয়েছিল।
সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অদম্য স্পৃহাই জিয়াকে উদ্বুদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, বাঙালি এক পৃথক জাতিসত্তা এবং তা অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। গণতন্ত্রের পথ ধরে বাঙালি জাতি তার স্বীয় আসন করে নেবে বিশ্বসভায়। বাংলার কয়েক হাজার বছরের মহান সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে নতুন করে বিকশিত করে অর্থনৈতিকভাবে হবে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী। সোনার বাংলার হারিয়ে যাওয়া স্বর্ণযুগকে পুনরুদ্ধার করে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ জাতীয় ইতিহাসের মসিলিপ্ত এক মহাকলঙ্কিত দিন। সেদিন মধ্যরাতে এক হৃদয়বিদারক নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন স্বাধীনতার মহান নেতা, যিনি জাতিসত্তার জন্ম দিয়েছিলেন, উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন। তিনি সেই মহান নেতা, যিনি স্বাধীনতার সোনালি স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং গোটা জাতিকে দেখিয়েছিলেন। এক ঐন্দ্রজালিক শক্তিতে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। এই সেই নেতা, যিনি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে লক্ষ-নিযুত জনতার মধ্যে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ’ কী অদ্ভুত নিয়তি! কী বিচিত্র এ দেশ! দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডার সেলুকাসকে আড়াই হাজার বছর আগে এমনই বলেছিলেন। রক্তমাখা হাতে দলেরই এক অন্যতম নেতা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নেন আকস্মিক ও অতর্কিতে। সামরিক শাসন জারি হলো। গভীর এক অনিশ্চয়তা, এক মহা-অস্থিরতা নেমে এলো সারা দেশে। সেনাবাহিনীতেও এর অভিঘাতের ঢেউ আছড়ে পড়ল।
আমরা দেখেছি ১৯৭৫ সালের নভেম্বরের শুরুর দিনগুলোয় দেশে এক চরম নৈরাজ্য, নৈরাশ্য, এক সীমাহীন হতাশা, অস্থিতিশীলতা, নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিরতা গোটা জাতিকে সংকটাপন্ন করে তোলে। একটা ভয়ংকর ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেয়। দেশ তখন সম্পূর্ণ নেতৃত্বহীন। কোনো সরকার নেই। প্রশাসন নেই। কোনো যোগাযোগ নেই। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি বিশ্বরাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে কোথায় যেন ছিটকে পড়েছে। হারিয়ে গেছে। এমনই এক পটভূমিকায় ৭ নভেম্বরে দেশজুড়ে ঘটে সৈনিক-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থান। আর জেনারেল জিয়া সে অভ্যুত্থানের উত্তাল তরঙ্গমালায় উঠে আসেন জাতীয় নেতৃত্বের পাদপ্রদীপে এক মহাশূন্যতায়।
জিয়া দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, জনগণ ও একমাত্র জনগণই সব ক্ষমতার উৎস। তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে প্রথম যে কাজটিতে হাত দেন তা হলো সামরিক সরকারের পূর্ণ বেসামরিকীকরণ। তিনি সব রাজনৈতিক দলকে গণতন্ত্রচর্চার পূর্ণ সুযোগ সৃষ্টি করে দেন। জিয়া সেনাবাহিনী থেকে মেয়াদ পূরণের অনেক আগেই স্বেচ্ছায় পূর্ণ অবসরগ্রহণ করেন। গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে সমৃক্ত হওয়ার লক্ষ্যে তিনি নিজে রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তিনি বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জ, শহর-বন্দর, পথ-প্রান্তর বিরামহীনভাবে চষে বেড়ান। জনগণের সঙ্গে তাদেরই পরিবারের একজন হয়ে যান। তিনি শত শত মাইল হেঁটে গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে চলেন। মানুষের সুখ-দুঃখের কথা শোনেন। সাহস জোগান। মানুষ তাঁকে আপন করে নেয়। সমরনায়ক জিয়া নিজেকে নিষ্ঠার সঙ্গে তিলে তিলে নির্মাণ করেন নিখাদ, নিষ্কলুষ জনগণমন অধিনায়ক জিয়া করে। বৃহত্তর ক্যানভাসে জাতীয় পরিসরে রাষ্ট্রনায়ক জিয়া আরো অনেক মহান। মহত্ত্বর।
জিয়া গণতন্ত্রের প্রাণপুরুষ। আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি। তাঁর ছিল সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি। তিনি ছিলেন এক ভিশনারি এক স্বপ্নদ্রষ্টা। কবি কাজী নজরুল ইসলামকে তিনি জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়েছিলেন। জিয়া জাতিকে একটি সত্যিকার গণতন্ত্রের শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। আনতে চেয়েছিলেন অর্থনৈতিক মুক্তি।
জিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতার সময়কাল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত—মাত্র পাঁচ বছর বা তার একটু বেশি। এই স্বল্প সময়ে তিনি যুগান্তকারী সব বড় কাজ করে গেছেন। জিয়া জাতীয় জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে, প্রতিটি ক্ষেত্রে, প্রতিটি বিষয়ে একটি বড় রকমের ঝাঁকুনি দিয়ে গেছেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, নারী, শিশু—সব কিছুতেই একটা বিপ্লব ঘটিয়ে গেছেন। গোটা জাতিকে তিনি একাত্তরের মতো ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। একটি দৃঢ় জাতীয় সংহতি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত তাঁর মন-মনন। তাঁর চেতনা ও রাজনৈতিক দর্শন।
জিয়ার এক বড় অবদান তাঁর রচিত স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি। জিয়ার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, তাঁর দূরদৃষ্টি, তাঁর বৈপ্লবিক চেতনা, বিশ্বাস ও স্বাধীনচেতা দৃঢ় চরিত্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মহান গণচীনসহ কয়েকটি বড় দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করে। সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। ১৯৮০ সালের জুলাই মাসে জেনারেল জিয়া সস্ত্রীক গণচীন সফর করেন। আমি পেইচিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে সামরিক অ্যাটাশে হিসেবে মাত্র যোগদান করেছি। জেনারেল জিয়াকে চীনা সরকার, চীনা জনগণ অভূতপূর্ব সংবর্ধনা দেয়। বিপুলভাবে সম্মানিত করে। তিনি যখন যেখানে গেছেন, সীমাহীন মানুষের ভিড়। রাস্তার দুই ধারে ফুল হাতে কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা মংচিয়ালা মংচিয়ালা (বাংলাদেশ বাংলাদেশ) বলে চিৎকার করছে আর হাত নাড়ছে। তখন এক গর্বভরা বিচিত্র অনুভূতি আমার। মাও জে দংয়ের তিরোধানের পর তখন চীনের নেতৃত্বে চেয়ারম্যান হুয়া কুয় ফেং। আমার সুযোগ হয়েছিল শীর্ষ বৈঠকে উপস্থিত থাকার। আমি হুয়া কুয় ফেংকে উচ্ছ্বসিতভাবে জেনারেল জিয়ার প্রশংসা করতে শুনেছি। বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিশ্চয়তায় অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীনের পূর্ণ সহযোগিতার দৃঢ় আশ্বাস তিনি ব্যক্ত করেন। আমার মনে পড়ে, একটি হৃদয়গ্রাহী সফল সফর শেষে পেইচিং পুরনো বিমানবন্দরে (নতুন বিমানবন্দর তখনো নির্মিত হয়নি) বাংলাদেশ বিমানের এয়ারক্রাফটে বিদায়ী রাষ্ট্রপতি যখন আরোহণ করতে যাচ্ছেন, সামরিক আনুষ্ঠানিক পোশাক সজ্জিত আমি একটি চৌকস স্যালুট করি। তিনি হাত বাড়ালেন হ্যান্ডশেকের জন্য। আমার হাতে শক্ত করে চাপ দিলেন। পেইচিং বিমানবন্দরের টারমার্কে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রপতির সেই করমর্দনের স্পর্শ আমি আজও অনুভব করি। তিনি আমাকে বলেছিলেন ‘Mahbub, I am leaving, you will be here. China is our friend. China is a great country. Develop our relations, promote the friendship. Remember this is the country to which we look forward, this is the country in which we can fully trust.’ কে জানত জেনারেল জিয়ার সঙ্গে সেই হবে আমার শেষ সাক্ষাৎ! তাঁর বিদায়বেলার কথাগুলো এখনো আমি শুনতে পাই। আমার কানে অনুরণিত হয়।
বাংলাদেশের তদানীন্তন রাজনীতির বাস্তবতা জেনারেল জিয়াকে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে বাধ্য করে। তাঁর ছিল গণতন্ত্রের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস। সত্যিকারের গণতন্ত্রের চেতনায় তাড়িত হয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন, যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার প্রথম সুযোগেই তিনি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বাতিল করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন ঘটান। সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনেন। অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে তিনি কৃষি বিপ্লব ও শিল্পের বিকাশ ঘটান। জাতিকে একটি মর্যাদাশীল সম্মানজনক অবস্থানে দাঁড় করান।
জিয়ার শাসনকাল সংক্ষিপ্ত হলেও বাংলাদেশের ইতিহাসে এক সুবর্ণ যুগ। তিনি ১৯৭১ সালের মতো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। তিনি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি রচনা করেন। অতি কাছের শক্তিশালী গণচীনসহ অনেক বৃহৎ দেশ বাংলাদেশের প্রতি মৈত্রী ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতির অতি সম্মানীয় আসন অর্থনৈতিক পরাশক্তি জাপানকে নির্বাচনে পরাজিত করে বাংলাদেশ অর্জন করে। জিয়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে একত্র করে শান্তি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে সার্ক জোট গঠনে উদ্যোগ নেন। সার্ক এককভাবে জিয়ার চিন্তাপ্রসূত।
তখনো আমি পেইচিংয়ে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোরে আমার বাসার টেলিফোনটি অনবরত বেজে চলছিল। এত ভোরে কখনো কেউ কল দেয় না। বুকটা ধড়াস করে উঠল। ঢাকা থেকে হবে হয়তো কোনো দুঃসংবাদ! রিসিভার তুলতেই চীনা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ফরেন লিয়াজোঁ অফিসার কর্নেল সু চুইন ফিংয়ের পরিচিত গলা। ‘আপনি কি জানেন, আপনাদের রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াকে আজ গভীর রাতে চট্টগ্রামে হত্যা করা হয়েছে? কারা করেছে? কেন করেছে? তিনি আমাদের একজন খাঁটি বন্ধু ছিলেন…। ’ আমি স্তম্ভিত। আমি বাকরুদ্ধ। আমি বিদ্যুত্স্পৃষ্ট। কর্নেল সু ওদিক থেকে বলে চলেছেন, ‘ব্রিগেডিয়ার আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? ব্রিগেডিয়ার, আপনি কি আমাকে শুনছেন?…’ আমি নিশ্চুপ। আমি হতবাক। আমি নিথর।
আজ শহীদ জিয়ার সপ্তত্রিংশত্তম শাহাদাতবার্ষিকীতে তাঁকে গভীরভাবে স্মরণ করছি। আরাম-আয়েশ, বিলাসিতার বিপরীতে কঠোর কৃচ্ছ্রসাধিত জীবন তিনি যাপন করতেন। ব্যক্তিচরিত্রে কোনো অনৈতিকতা, ভ্রষ্টাচারিতা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি তাঁকে কখনোই এতটুকু স্পর্শ করতে পারেনি। এ যেন ব্রতচারী এক ঋষি কঠিন সাধনায় রত। হাজারো দৃষ্টান্ত আছে, যারা তাঁর সংস্পর্শে এসেছে, তাঁকে জেনেছে, অবাক হয়েছে। এও কি সম্ভব? একি মহাভারতের যুধিষ্ঠির, ইসলামের ইতিহাসের খলিফা? অনেক ঘটনা ভিড় করে স্মৃতিপটে আসছে। জেনারেল জিয়ার চরিত্রের সবচেয়ে বলিষ্ঠ দিক ছিল, তিনি স্তুতিবাক্য পছন্দ করতেন না। তিনি স্তাবকদের মুখের ওপর শাটআপ বলে দিতেন। জেনারেল জিয়ার পরিবারের সদস্যরা, তাঁর আত্মীয়স্বজন কখনো তাঁকে সরকারি কাজে এতটুকুও প্রভাবিত করতে পারেনি। স্বজনপ্রীতি কখনো তাঁকে স্পর্শ করেনি।
জেনারেল জিয়ার চরিত্রের এই বিশেষ দিকটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছিল। আজও যখন এ ঘটনা মনে পড়ে, তাঁর উদ্দেশে আমার ডান হাতটা অজান্তেই কপালে উঠে আসে। একটি চৌকস স্যালুট করে বসি। যেমনটি করেছিলাম পেইচিং বিমানবন্দরে তাঁর সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাতে।
জিয়াকে তাঁর মৃত্যুদিনে আমার হৃদয় উজাড় করা বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : সাবেক সেনাপ্রধান