বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ এক মুহূর্তের আনন্দই আমার কাছে জীবনের অমূল্য সম্পদ। মেঘে মেঘে বেলা আমার অনেক হলো। দেখতে দেখতে জীবনের ৫৪ টি বসন্ত চলে গেল। কে কথা রাখলো, কে কথা রাখেনি সেটি বড় নয়।
আমি কথা কতটা রেখেছি, সময়কে কতটা গুরুত্ব দিয়েছি সেটাই কালের মহাকাব্যে লেখা না থাক, মানুষের মনে ঠাই পাক। জল জোছনার শহরে জন্মেছিলাম রবীন্দ্রনাথের হৃদয় নিয়ে। হতে পারতাম গ্রামীণ বাউল, কিংবা ক্ষয়ে যাওয়া হৃদয়ের কবি। বিশুদ্ধ প্রেমিক হতে এসেছিলাম, মানুষ হতে এসেছিলাম, কতটা হয়েছি মূল্যায়ন অনাগত প্রজন্মের হাতে থাকলো। ৫০ পর্যন্ত বয়স বাড়ে, তার পর নাকি কমে! অর্ধেক জীবন পার করেছি কবে! কবি নজরুলের অন্তহীন হাহাকার, অতৃপ্তি, দহন আর দ্রোহ নিয়ে।
আমিও মানুষ। অর্ধেক জীবনে মধুর ভুল আছে। কিছু ভুলের অনুশোচনা আছে। ঝড়ের গতিতে জীবনের গতি নিয়ে ৫৪ বছর পার করেছি। উথ্যান-পতন, সুখ-দুঃখ, আন্ন্দ-বেদনার মধুর কাব্যে মোড়ানো এই জীবনে কখনো জন্মদিন উৎসব হয়ে আসেনি। অনুজদের তাড়নায় নিজের আনন্দে মনের মানুষ, প্রেমের মানুষ, ভলোবাসার সজনদের নিয়ে ১২ নভেম্বর ২০১৩ সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত গুলশান ক্লাবে কথা, গান, আড্ডায় দারুণ কেটেছিলো ফিফটি ওয়ান। তাদের ফুলে ফুলে অভিষিক্ত ধণ্য হয়েছিলো আমার জীবন। কতোজোড়া চোখ ঈর্ষায় পুড়েছিলো!তবু এই ভালোবাসায়, এই স্নেহে, এই প্রেমে আমি মুগ্ধ অবিভুত হয়েছিলাম।
এক মনোবিজ্ঞানি বলেছিলেন, আমার হৃদয় স্পর্সকাতর এটি পুড়বে। আমার আপত্তি নেই মন পুড়িয়ে চুয়ান্নতে এসেছি, বাকিটা পথ মন পুড়লে পুড়ুক। আমি শুধু চাই একটি বিশুদ্ধ ও স্বাধীন প্রেমিক জীবন! সচল সক্রিয় চিন্তাশীল লেখক সত্তাদিয়েই সেটি যদি হয় ইবাদতের মতোই আশিক মন নিয়ে দেশ মানুষ ও তার জন্য, তবেই আমার জনম সার্থক। সেই পথ যদি হয় আরো ফিফটি তাহলেতো কথাই নেই। দাসের মৃত্যুর চেয়ে যদি হয় সাহসী মানুষের এবং জোছনা রজনীতে আল্লাহর কাছে এই শোকরিয়া ।
৫৪ বছর পার হলেও নিজেকে আমার কতটা হলো চেনা? তাকে বা তাহাদের কতটাই হলো জানা? মানুষের মনোজগত অন্বেষণে ৫৪ বছর কি আদৌ যথেষ্ট? এমন প্রশ্ন মনের দরজা-জানালায় কড়া নাড়ে বারেবার। দিনমান কত ভেবেছি আমি। এ জীবনে আমার ভাবনা ছাড়া কোন কাজ ছিল না। ফেলে আসা চঞ্চল শৈশব, দূরন্ত দস্যিপনায় কাটানো কৈশোরের কথা খুব মনে পড়ছে আমার। দস্যিপনার জন্য স্কুল ও বাড়িতে প্রচন্ড বেত্রাঘাতের শব্দগুলো আমার পিঠ থেকে বুক জুড়ে সওয়ার হয়েছে কতো। দূরন্তপনাকে যেমন আমি কখনো অপরাধ মনে করিনি তাই স্কুলের উগ্র শিক্ষক বা পারিবারিক কঠোর অভিভাবকের বেত্রাঘাতের সঙ্গে তাল লয় ছন্দ মিলিয়ে আওড়ানো ‘বল আর করবি না কখনো’ এমন প্রশ্নের মুখেও না বের হয়ে আসেনি আমার মুখ থেকে।
কখনো সখনো হাতের তালু রক্তাক্ত হয়েছে। শরীরে পড়েছে কালসিটে দাগ। সন্তানের নির্যাতন সইতে না পারার যন্ত্রনায় মমতাময়ী মা জায়নামাজে পড়ে মাথা ঠুকতেন। ছেলেটি তার কবে শান্ত সুবোধ বালক হয়ে যাবে। সেইসব দিনগুলোতে বা লতাগুল্মের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে ওঠা তারুণ্যের নানা বেদনাবোধ থেকে নেওয়া পাঠ আমার কখনো সইতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু কবির ভাষায় বলতে হয়- ‘আমার তো মেঘে মেঘে বেলা হল/বিকেল গড়িয়ে রাত্রি এল শেষ/তবু মেঘে মেঘে ঘোরা হল না শেষ/আকাশে আকাশে ওড়া হল শেষ।’ আগেই বলেছি আট ভাইবোনের সংসারে সেই সাদাকালো যুগে কখনো জন্মদিন উৎসব হয়ে আসেনি জীবনে।
পৃথিবীর মুখ আমি দেখেছি অন্তহীন দহন, বেদনা, অতৃপ্তি আর হাহাকার নিয়ে। একইসঙ্গে পৃথিবীর রূপ আমি উপভোগ করেছি স্বজনদের ভীড়ে নেপোলিয়ানের মতো যুদ্ধজয়ের আনন্দে। অথচ মনোজগত যখন বিমূর্ত চিত্রকল্পের মতো উঠে আসে হৃদয়ে তখন রক্ত ঝরে। কাউকে বলা হয়নি আমার সেই দূরন্ত কৈশোরের অমানবিক নির্যাতন শরীরে সয়ে গেলেও ৫৪ বছরের পরিণত বয়সে রাক্ষুসে মনের যত খিদের যন্ত্রনা সইবার ক্ষমতা একটুকুনও নেই। তবুও নিয়ম মেনে না মেনে নিয়মিত ওষুধ খাওয়া, মেরামত করা হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে রক্তক্ষরণ সয়েও ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে ঘুমে মগ্ন হওয়া, তারপর দেশের খবর, দশের খবর, বিদেশের খবর নেয়া।
সন্ধ্যাবেলা নিউজ মেকআপে মগ্ন হওয়া। আইডিয়া বিনিময়ের ভেতর দিয়ে প্রতিদিনের কাগজ নবায়ন করা। সব ঠিকঠাক মতো চলে। নদীর স্রোতের মতো সময় চলে যায়। তবুও আমার বোঝাপড়া শেষ হয় না। কবি আবুল হাসানের কবিতার বালিকার মতো আমারও খুব বেশি চাওয়া ছিল না। কিন্তু চাওয়াটুকু না পাওয়ার হিসেবের খাতায় বুকের ভেতর যন্ত্রনার মাকড়শার জাল অবিরাম বুনে যায়। একটি হৃদয় ঘড়ির কাটা ধরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়। যদি জীবনে সুযোগ পাই আমার জলজোছনার শহরে তোমাদের নিয়ে যাব আষাঢ়ে পূর্ণিমার রজনীতে। হাওড়ের উথাল-পাথাল ঢেউয়ের সঙ্গে ভরা পূর্ণিমা রাতের আছড়ে পড়া চাঁদের আলোয় জলজোছনার খেলায় মুগ্ধই হবে না আরও বেশি করে অনুভূত হবে মানুষের মনোজগত কত রহস্যময়।
চাঁদের সঙ্গে রহস্যময়তা যেমন জড়ানো, মুগ্ধতা যেমন ছড়ানো তেমনি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘কলঙ্কের প্রশস্থ পথ চন্দ্রেই শোভা পায়’। আমি একদিন তোমাদের জলজোছনার খেলা দেখাতে হাওড়ে নিয়ে যাব। জোছনার প্রেমে পড়লেই, হাওড়ের জলরাশির সঙ্গে শখ্যতা গড়ে উঠলেই আমার বুনো পাখির গান শোনা হয়ে যাবে। আমিও প্রেমজয়ী মাঝির মতো হাসন রাজার বজ্রা ভাসাব তোমার জন্য, তোমাদের জন্য। এই ডাক কেউ কি উপেক্ষা করতে পারে? এই ভালবাসার, এই প্রেমের আহ্বানে সাড়া না দিলে একটি জীবন কখনোই পূর্ণতা পাবে না। জীবনের পূর্ণতা পেতেই পৃথিবীতে এসেছিলাম।
৫৪ বছরে সেই পূর্ণতার অনেকটা পাওয়ার তৃপ্তি থাকলেও না পাওয়ার অন্তহীন দহনও রয়েছে তীব্র। ‘আমার বেলা যে যায় সাঁঝ বেলাতে’ রবীন্দ্রনাথের গানের মতোই হৃদয়তন্ত্রীতে সুরের লহরী ছড়িয়ে জীবনের বেলা বয়ে যাচ্ছে। অর্ধেক জীবন অতিক্রম করার সন্ধ্যায় কথা, গান ও আড্ডায় মনে হয়েছে আহা-রে ! জীবনটা কতোই না সুন্দর! কতোই না সুন্দর হতে পারত! আরও কত ভূবন জুড়ানো আনন্দ ছড়িয়ে জীবন কাটিয়ে দিতে পারতাম। মনে হয় প্রেমে প্রেমে আর আড্ডায় আড্ডায় এবং আনন্দবিহারে প্রকৃতির নৈস্বর্গের সঙ্গে মিতালী করে করে, সখ্যতা গড়ে গড়ে যদি জীবনটা কেটে যেত!
আড্ডার চেয়ে সুখ আর পৃথিবীতে কিছু নেই। মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি নতুন করে পৃথিবীতে আসতাম! প্রেমে প্রেমে বেলা পার করে দিতাম। যদি জীবন ফিরে পেতাম হাসন রাজার মতো রোজ নিশুতি রাতে জল জোছনার হাওরে বজরায় ভাসতাম অথবা বাউলের আশ্রমে আমিই হতাম মধ্যমনি। নাকি বোহেমিয়ানের জীবনটা বেছে নিয়ে শতভাগ বাউন্ডুলে?
কালের ভেলায় চড়ে যাচ্ছি আমি কত দূরে? অর্ধেক জীবন পার করার আনন্দ সন্ধ্যার আড্ডায় আড্ডায় সময় বেঁধেছিল সব স্বজনেরে। আহারে, যদি একশোতে পৌঁছতে পারতাম। সেঞ্চুরির আনন্দে সব স্বজনকে ডাক দিয়ে একটি উৎসবমুখর আনন্দ রজনী কাটাতাম। আড্ডার চেয়ে সুখ আর পৃথিবীতে নেই। তবে সেই আড্ডায় যদি থাকে প্রাণ আর মনের মানুষেরা!
পীর হাবিবুর রহমান
(লেখকের ফেসবুক স্টাট্যাস থেকে)