বেশ কিছুদিন যাবত উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় আমাদের দিন কাটছে। আমার গ্রামের বাড়ি থেকে অনেকে ফোন করে কেঁদেকেটে তাদের দুর্দশার কথা বলছেন। হুতাশ প্রকাশ আর কষ্ট পাওয়া ছাড়া, ব্যক্তিগতভাবে দুয়েক জনকে সাহায্য করা ছাড়া আমরা তেমন কিছুই করতে পারছি না। সংবাদ মাধ্যমের অশেষ সহযোগিতায় আমরা দুর্যোগের খবর পাচ্ছি। আর মনে প্রাণে চাচ্ছি, ভালো কিছু একটা হোক। এ বছর হাওরবাসীর সকল স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়ে গেছে। দুর্যোগ যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না হাওরবাসীর। ধানের পর এবার মৎস্যভাণ্ডারখ্যাত সুনামগঞ্জের হাওর ও নদ-নদীতে মাছ মরে ভেসে উঠছে। ধান পচে এবং মাছ মরে নদী ও হাওরের পানি দূষণের কবলে পড়ে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। সোনালি ফসলের বুকে যখন বিশাল জলরাশির ঢেউ আর কৃষকের চোখের পানি একাকার, সব হারিয়ে কৃষকরা যখন নিঃস্ব; তখন তবুও তারা হাওরের বুকে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু হাওরে মরা মাছ ভাসতে দেখে তাদের স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় সাহায্য সস্থাগুলো আর সরকার সর্বতোভাবে পাশে থাকলে এ দুর্যোগ কাটাতে পারবে হাওরবাসী; আমরা তাই আশা করছি তেমন কিছু। কিন্তু এসবের মধ্যে সরকারের আমলাদের লাগামহীন বক্তব্য, বিভিন্ন সুবিধা-জনের রাজনীতি যখন সামনে আসে, তখন ভরসা করার জায়গা থাকে না।
সংবাদ মাধ্যমের কল্যাণে আমরা জানতে পেরেছি, সুনামগঞ্জের হাওরে ধান পঁচে হাওরের পানি নষ্ট হয়ে এখন পর্যন্ত ৫০ মেট্রিক টন মাছ মারা গেছে। বেশীর ভাগ হাওরে পানি এখনো দূষিত আছে। এর চেয়ে খারাপ সংবাদ আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু বুধবার রাতে জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় সচিব মহোদয় যে বক্তব্য দিয়েছেন তা বিবেচনাপূর্ণ নয়। পত্রিকা মারফত জানতে পেরেছি, সভায় অবজ্ঞার সুরে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল বলেন, কিসের দুর্গত এলাকা? সুনামগঞ্জে একটি ছাগলও তো মারা যায়নি। তিনি সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবিতে আন্দোলনকারীদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের কথা বলেছেন। এই আইনের ২২ ধারায় নাকি বলা হয়েছে, কোন এলাকার অর্ধেকের উপরে জনসংখ্যা মরে যাওয়ার পর ওই এলাকাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করতে হয়। সচিব মহোদয় এটা কোথায় পেয়েছেন আমি জানি না। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের ২২ ধারায় যা বলা আছে, তা হুবহু তুলে দিচ্ছি –
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২
২২।
(১) রাষ্ট্রপতি, স্বীয় বিবেচনায় বা ক্ষেত্রমত, উপ-ধারা (৩) এর অধীন সুপারিশ প্রাপ্তির পর, যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হন যে, দেশের কোন অঞ্চলে দুর্যোগের কোন ঘটনা ঘটিয়াছে যাহা মোকাবেলায় অতিরিক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং অধিকতর ক্ষয়ক্ষতি ও বিপর্যয় রোধে বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করা জরুরি ও আবশ্যক, তাহা হইলে সরকারি গেজেটে বিজ্ঞপ্তি জারির মাধ্যমে, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা হিসাবে ঘোষণা করিতে পারিবেন।
(২) কোন অঞ্চলে সংঘটিত মারাত্মক ধরণের কোন দুর্যোগ মোকাবেলায় অতিরিক্ত ব্যবস্থা গ্রহণসহ উক্ত দুর্যোগের অধিকতর ক্ষয়ক্ষতি ও বিপর্যয় রোধে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি ও আবশ্যক হইলে স্থানীয় পর্যায়ের কোন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি, গ্রুপ বা সংস্থা অবিলম্বে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার নিমিত্ত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সরকারের নিকট সুপারিশ পেশ করিতে পারিবে।
(৩) উপ-ধারা (২) এর অধীন কোন সুপারিশ প্রাপ্ত হইলে জেলা প্রশাসক অনতিবিলম্বে বিষয়টির যথার্থতা যাচাইপূর্বক উহার মতামতসহ সংশ্লিষ্ট সুপারিশ সরকারের নিকট প্রেরণ করিবেন এবং সরকার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় গ্রুপের সুপারিশ গ্রহণ করতঃ বিবেচ্য অঞ্চলকে দুর্গত এলকা ঘোষণার জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট সুপারিশ পেশ করিতে পারিবে।
(৪) এই ধারার অধীন দুর্গত এলাকা ঘোষণার বিজ্ঞপ্তি জারি করা হইলে উহার মেয়াদ অনধিক ২ (দুই) মাস পর্যন্ত বলবৎ থাকিবে যদি না উক্ত মেয়াদ অতিবাহিত হইবার পূর্বেই রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উহা হ্রাস, বৃদ্ধি বা প্রত্যাহার করা হয়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২ এর ২২ ধারার কোনো উপধারায় দুর্গত এলাকা ঘোষণা করতে অর্ধেকের বেশি মানুষ মারা যাওয়ার কোনো শর্তের কথা উল্লেখ নাই। তবুও সচিব দুর্গত এলাকা ঘোষণা করতে হলে সুনামগঞ্জের অর্ধেক মানুষ মরতে হবে বলে অপমানজনক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। এ কারণে সচিবের প্রতি আমার পরামর্শ থাকবে, দয়া করে একটু পড়াশোনা করুন। এই দেশ আপনাদের যেমন, আমাদেরও। জনসাধারণকে সাধারণ ভাববেন না। মনগড়া তথ্য দিবেন না। সুনামগঞ্জের দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে নিয়ে সচিবের মানহানিকর এবং কষ্টদায়ক বক্তব্যের আমি তীব্র নিন্দা জানাই। এবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের কিছু ধারা সচিবের পড়ার জন্য তুলে দিলাম।
এ আইনের ২৯ ধারায় বলা আছে, দুর্যোগ আক্রান্ত কোন ব্যক্তি, পরিবার বা জনগোষ্ঠীর নিকট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিষয়ে কোন অনিয়ম, গাফিলাতি বা অব্যবস্থাপনা পরিলক্ষিত হলে, তিনি বা তারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জাতীয় বা স্থানীয় পর্যায়ের কোন কমিটির নিকট অভিযোগ উত্থাপন করতে পারবেন এবং উক্ত কমিটি সংশ্লিষ্ট আবেদন প্রাপ্তির অনধিক ৩০(ত্রিশ) দিনের মধ্যে প্রয়োজনে তদন্তপূর্বক, সংশ্লিষ্ট অভিযোগ নিষ্পত্তি করবে। আবার এ আইনের ৩৭ ধারায় বলা আছে, কোন ব্যক্তি যদি সরকার, জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় গ্রুপ বা জেলা দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় গ্রুপ কর্তৃক প্রদত্ত নির্দেশাবলী ইচ্ছাকৃতভাবে অমান্য করেন বা ইচ্ছাকৃতভাবে পালন না করে্ন, তাহলে তিনি এই আইনের অধীন অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবেন এবং উক্ত অপসারণের জন্য তিনি অনূর্ধ্ব ১ (এক) বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অনধিক ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ৩৮ ধারায় আরো বলে হয়েছে, কোন ব্যক্তি বা সংস্থা যদি এই আইনের অধীন পরিচালিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম হতে সহায়তা বা সুবিধা প্রাপ্তির নিমিত্ত মিথ্যা, অসত্য বা ভিত্তিহীন দাবি উত্থাপন করেন, তাহলে তিনি এই আইনের অধীন অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবে এবং উক্ত অপসারণের জন্য তিনি অনূর্ধ্ব ১ (এক) বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অনধিক ১ (এক) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব হয়েও যিনি আইনগুলো জানেন না, আবার না জেনে আইনের ভুল ও মিথ্যা ব্যাখ্যা দিয়ে বেড়ান; তার জন্য কী সাজা হওয়া উচিত তা আইনে স্পষ্ট করে বলা নেই। তবে এ ধরনের মিথ্যাচার, অসত্য উপস্থাপন সম্পর্কে আইনে কিছু ধারা বর্ণিত আছে। সচিব শাহ কামাল হাওরবাসীর দাবি নিয়ে উপহাস করেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্দশাগ্রস্ত কৃষকদের দাবির প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ না করে কটাক্ষ করে মন্তব্য করেছেন। সচিব শাহ কামাল সরকারকে সুনামগঞ্জের কৃষকদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছেন। তিনি ভুল বলেছেন, তার উচিৎ ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চওয়া এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া।
(লেখক – গবেষক সদস্য, জাতীয় গ্রন্ত্রকেন্দ্র)