ঢাকা , শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাওরে বিপর্যয়: প্রকৃতির বৈরিতা এবং মনুষ্যসৃষ্ট কারণ

হাওর অধ্যুষিত সিলেট বিভাগের চারটি জেলা এবং নেত্রকোনো, কিশোরগঞ্জের ১৪২টি হাওরের ধান তলিয়ে গেছে, মাছে মড়ক লেগেছে, জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। সব মিলিয়ে হাওরাঞ্চলে দেখা দিয়েছে মহাবিপর্যয়। এখন পর্যন্ত পত্রপত্রিকার মাধ্যমে যে পরিসংখ্যান চিত্র পাওয়া গেছে তা হলো-প্রায় ৪ লাখ হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়েছে যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। প্রায় নিত্য পত্রপত্রিকায় হাওরাঞ্চলের যে চিত্র ফুটে উঠছে তা চরম উদ্বেগজনক। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি মনুষ্যসৃষ্ট কারণে এই বিপর্যয় চিত্র স্ফীত হয়ে উঠেছে। হাওরবাসীর ফসল একটা অর্থাৎ বোরো যা এ মৌসুমে তাদের গোলায় ওঠে। তারপর তাদের জীবিকার অন্যতম অবলম্বন মাছ। এই মাছেও মড়ক লেগে চরম সর্বনাশ হয়েছে। হাঁস মরেছে অসংখ্য। মোরগ-ছাগল-গবাদি পশুর ক্ষয়ক্ষতিও কম হয়নি। অর্থাৎ হাওরবাসীর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবার জো আর নেই। এক তথ্যে জানা গেছে, প্রায় ১১ হাজার টনের বেশি গোখাদ্য পচে গেছে। হাওরাঞ্চলে এখন আবার দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগব্যাধি। এক কথায় সব দিক দিয়ে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে হাওরবাসী। হাওরবাসীর কাছে হাঁস-মোরগ-ছাগল-গবাদি পশু সন্তানের মতো। এসব তাদের আয় রোজগারের অংশ। হাওরাঞ্চলে যে সংকট দেখা দিয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে না পারলে ওইসব এলাকায় শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে দারিদ্র্যের হার আরো বাড়বে, যা জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকট তৈরি করবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সর্বস্ব হারানো হাওরবাসীর পাশে সরকার দাঁড়িয়েছে এবং তাদের মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর জন্য যা যা করার তাই করে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের এই মহৎ প্রচেষ্টা অসাধু-দুর্নীতিবাজ-স্বেচ্ছাচারী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লোলুপ দৃষ্টির কারণে বিনষ্ট হবে না তো? আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা এসব ক্ষেত্রে খুব প্রীতিকর নয়। অতীতে সরকারের নানা প্রচেষ্টা-উদ্যোগ এদের কারণে ভেস্তে গেছে। ২৬ এপ্রিল ২০১৭ তারিখ একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে প্রকাশ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গাফিলতি আর বাঁধ নির্মাণকারী ঠিকাদারদের দুর্নীতি-ব্যর্থতার কারণে হাওরাঞ্চলে লাখ লাখ কৃষক পরিবার বিপন্ন-বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সর্বস্ব হারিয়ে তারা আজ পথে বসেছে। অসংখ্য মানুষের ঘরবাড়ি গেছে। ‘হাওরের দুর্গতি: ডুবিয়েছে পাউবো ও ঠিকাদার’-শিরোনামে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে-ঠিকাদারেরা হাওরের বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের দায়িত্ব পেয়ে তা সময়মতো ও সঠিকভাবে শেষ করেনি। ফলে ফসল রক্ষা বাঁধগুলো একে একে ভেঙে ফসলহানির মতো বিপর্যয় ঘটে গেছে। আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-হাওরে প্রকল্প বাস্তবায়ন না করেই টাকা আত্মসাৎ করেছে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলার শনির হাওরের বেহেলী ইউনিয়নের অংশে কম্পারমেন্টাল বাঁধ সংস্কারের নামে লোক দেখানো প্রকল্প দাখিল করে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। ইতোমধ্যে ওই প্রকল্পের সিংহভাগ টাকা নাকি সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাবানদের পকেটস্থ হয়ে গেছে!
বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এ কথা এখন স্পষ্ট করেই বলা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি এক শ্রেণীর দায়িত্বশীলের অসাধু-অনৈতিক-স্বেচ্ছাচারি ব্যক্তিদের কারণে হাওরাঞ্চলে সর্বনাশ ঘটেছে। এই সর্বনাশ শুধু কৃষকের ঘটেনি, এর বিরূপ ধাক্কা যে জাতীয় অর্থনীতিতে গিয়ে পড়বে তাও সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়। কারণ কৃষিনির্ভর অর্থনীতির আমাদের দেশে কৃষিজাত পণ্য হলো আমাদের অতীব মূল্যবান সম্পদ। যাদের কারণে এই মূল্যবান সম্পদের বিনাশের পথ প্রশস্ত হলো আর সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির চিত্র স্ফীত হয়ে উঠল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে নির্মোহ অবস্থান থেকে। ত্রাণমন্ত্রীসহ সরকারের দায়িত্বশীলরা ইতোমধ্যে এই অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন যে, হাওরে ক্ষতিগ্রস্ত কোনো কৃষক না খেয়ে মরবে না। তাছাড়া আগামী ফসল ওঠার আগ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের সব রকম সহায়তা দেয়া হবে। হাওরাঞ্চলে বর্ষাকালে মানুষের এমনিতেই কোনো কাজ থাকে না তার মধ্যে তাদের ওপর পড়েছে প্রকৃতি ও মনুষ্যসৃষ্ট ছোবল। বিদ্যমান পরিস্থিতির জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে এমন কথাও বলা হয়েছে সরকারের দায়িত্বশীলদের তরফে। আমরা আশা করব এটি শুধু কথার কথা হয়ে থাকবে না। এক্ষেত্রে অবশ্যই দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার চিত্র দাঁড় করানো আবশ্যক। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই হাওর রক্ষা বাঁধ। কিন্তু এই বাঁধ যদি সময়মতো সংস্কার-মেরামত না করা হয় তাহলে সরকারের কোটি কোটি টাকা বরাদ্দের মানে কি ব্যক্তি বা মহল বিশেষের উদর পূর্তির জন্য? কাজেই সরকারের উচিত এই লোভাতুরদের বিরুদ্ধে নির্মোহ অবস্থান থেকে ব্যবস্থা নেয়া।
হাওরাঞ্চলের মানুষের আরেক বিপদ হলো তাদের সিংহভাগ বন্দি দাদনের জালে। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে ভাটি বাংলার অধিকাংশ কৃষকের ঘরে হানা দেয় অভাব। বৈশাখের একমাত্র বোরো ফসল বছর পেরিয়ে আরেক বৈশাখ পার হতে চায় না। নতুন ফসল ঘরে তোলার আগেই কৃষকের ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানোর’ অবস্থা তৈরি হয়। আর এ সুযোগটিই লুফে নেয় দাদন ব্যবসায়ীরা। দালালদের মাধ্যমে তারা দু হাতে টাকা বিলিয়ে কিনে নেয় প্রান্তিক চাষিদের। হাজার টাকায় তিন মণ ধান দেয়ার শর্তে টাকা ছড়ানো হয়। একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে প্রকাশ, হাওরাঞ্চলে এভাবে দেয়া টাকার পরিমাণ প্রায় শত কোটি টাকা। এটা প্রায় প্রতি বছরের চিত্র। এর ব্যতিক্রম হয়নি এবারো। দাদনের ভারে নুইয়ে পড়া প্রান্তিক চাষিদের দিন কাটছে এখন মহাজনের দাদন আতঙ্কে। অভিযোগ আছে যে, দুর্যোগে মহাজনি ঋণ ও এনজিও ঋণের চাপে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। অন্যদিকে টাকা লগ্নি করে ফেরত না পাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে দাদন ব্যবসায়ীরা। আর মধ্যস্বত্বভোগী দালালরা মহাজনের টাকা মরিয়া হয়ে উঠেছে আদায়ের জন্য। মানুষকে এই রক্তচোষাদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। কোনো মধ্যস্বত্বভোগী যদি কৃষককে হয়রানি করে তাহলে তার বা তাদের বিরুদ্ধে নেয়া উচিত আইনানুগ ব্যবস্থা। হাওরবাসীর দুর্ভোগ কাটছে না। এমনিতেই নানা রকম ঝুঁকির মধ্যে তাদের বসবাস করতে হয়। এর মধ্যে নতুন এই বিপর্যয় মানুষকে আরো বেশি বিপন্ন-বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। সরকারের দায়িত্বশীলদের এসব ব্যাপারেই বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে, ব্যবস্থা নিতে হবে।
হাওর রক্ষা বাঁধ নিছক বাঁধ নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসংখ্য মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা। বিপন্ন-বিপর্যস্ত মানুষদের কল্যাণে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও যথাযথ বাস্তবায়নের পাশাপাশি কিভাবে এক ফসল থেকে বহু ফসলে হাওরাঞ্চলকে রূপান্তর করা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে কৃষি বিভাগকে। এখন তো ভাসমান পদ্ধতিতে অনেক কিছুই করা যায় এবং এমন দৃষ্টান্ত আমাদের সামনেই আছে। এত বিপুল সংখ্যক পরিবার পথে বসে যাওয়ার জন্য শুধু প্রকৃতিই দায়ী নয়। রাষ্ট্রপতি ইতোমধ্যে হাওরাঞ্চল পরিদর্শন করেছেন। প্রধানমন্ত্রীও যাচ্ছেন ওইসব বিপন্ন-বিপর্যস্তদের মাঝে। ওই সবহারা লাখ লাখ মানুষ হয়তো এসব কারণে বেঁচে থাকার নতুন স্বপ্ন দেখছে। তাদের স্বপ্ন বাঁচাতে হবে। তাদের স্বপ্ন বাঁচলে বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির চাকা গতিশীল হবে। তারাই আমাদের মেরুদণ্ড। তারা আমাদের বড় সম্পদ। এই সবহারাদের পাশে দাঁড়াতে হবে সর্বতো সহায়তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। কৃষকদের অভিসম্পাত নিশ্চয়ই তাদের ওপর থাকবে যাদের কারণে এত বড় সর্বনাশ ঘটেছে। এ মুহূর্তে অসহায় মানুষের সবচেয়ে প্রয়োজন প্রশাসনের সাহায্য-সহযোগিতা। পর্যাপ্ত ত্রাণের পাশাপাশি বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার জন্য এখন থেকেই কাজ শুরুর কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের আলামত দেশের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা প্রত্যক্ষ হয়ে উঠছে ক্রমাগত। প্রকৃতির বৈরী আচরণের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় হাওরাঞ্চলের মানুষের মাঝে যে হাহাকার বিরাজ করছে সার্বিক স্বার্থ ও প্রয়োজনে সব রকম পরিকল্পনা নিয়ে এর নিরসন ঘটাতে হবে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায় থেকেই বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। এই বিপর্যয় থেকে হাওরবাসীকে বাঁচাতে স্বল্পমেয়াদি কার্যক্রমের পাশাপাাশি মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও নিশ্চিত করা বাঞ্ছনীয়। অসময়ে এই আঘাতে হাওরাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। সেখানকার মানুষের দুঃখ-কষ্ট শহুরে চোখে কেউ বুঝতে পারবে না। তাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে তাদেরই কাজে লাগাতে হবে যাদের হাওরাঞ্চল সম্পর্কে ধারণা ও অভিজ্ঞতা রয়েছে। হাওর বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। এই মহাবিপর্যয় সরকার ও সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কাটবে কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই দৃষ্টান্তযোগ্য ব্যবস্থা নিতে হবে যারা প্রকৃতির বৈরী আচরণের পাশাপাশি নিজেরা নানাভাবে দায়ী।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

হাওরে বিপর্যয়: প্রকৃতির বৈরিতা এবং মনুষ্যসৃষ্ট কারণ

আপডেট টাইম : ০৫:৪৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৯ এপ্রিল ২০১৭

হাওর অধ্যুষিত সিলেট বিভাগের চারটি জেলা এবং নেত্রকোনো, কিশোরগঞ্জের ১৪২টি হাওরের ধান তলিয়ে গেছে, মাছে মড়ক লেগেছে, জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। সব মিলিয়ে হাওরাঞ্চলে দেখা দিয়েছে মহাবিপর্যয়। এখন পর্যন্ত পত্রপত্রিকার মাধ্যমে যে পরিসংখ্যান চিত্র পাওয়া গেছে তা হলো-প্রায় ৪ লাখ হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়েছে যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। প্রায় নিত্য পত্রপত্রিকায় হাওরাঞ্চলের যে চিত্র ফুটে উঠছে তা চরম উদ্বেগজনক। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি মনুষ্যসৃষ্ট কারণে এই বিপর্যয় চিত্র স্ফীত হয়ে উঠেছে। হাওরবাসীর ফসল একটা অর্থাৎ বোরো যা এ মৌসুমে তাদের গোলায় ওঠে। তারপর তাদের জীবিকার অন্যতম অবলম্বন মাছ। এই মাছেও মড়ক লেগে চরম সর্বনাশ হয়েছে। হাঁস মরেছে অসংখ্য। মোরগ-ছাগল-গবাদি পশুর ক্ষয়ক্ষতিও কম হয়নি। অর্থাৎ হাওরবাসীর মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াবার জো আর নেই। এক তথ্যে জানা গেছে, প্রায় ১১ হাজার টনের বেশি গোখাদ্য পচে গেছে। হাওরাঞ্চলে এখন আবার দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগব্যাধি। এক কথায় সব দিক দিয়ে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে হাওরবাসী। হাওরবাসীর কাছে হাঁস-মোরগ-ছাগল-গবাদি পশু সন্তানের মতো। এসব তাদের আয় রোজগারের অংশ। হাওরাঞ্চলে যে সংকট দেখা দিয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে না পারলে ওইসব এলাকায় শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে দারিদ্র্যের হার আরো বাড়বে, যা জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংকট তৈরি করবে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সর্বস্ব হারানো হাওরবাসীর পাশে সরকার দাঁড়িয়েছে এবং তাদের মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর জন্য যা যা করার তাই করে যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের এই মহৎ প্রচেষ্টা অসাধু-দুর্নীতিবাজ-স্বেচ্ছাচারী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লোলুপ দৃষ্টির কারণে বিনষ্ট হবে না তো? আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা এসব ক্ষেত্রে খুব প্রীতিকর নয়। অতীতে সরকারের নানা প্রচেষ্টা-উদ্যোগ এদের কারণে ভেস্তে গেছে। ২৬ এপ্রিল ২০১৭ তারিখ একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে প্রকাশ, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গাফিলতি আর বাঁধ নির্মাণকারী ঠিকাদারদের দুর্নীতি-ব্যর্থতার কারণে হাওরাঞ্চলে লাখ লাখ কৃষক পরিবার বিপন্ন-বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সর্বস্ব হারিয়ে তারা আজ পথে বসেছে। অসংখ্য মানুষের ঘরবাড়ি গেছে। ‘হাওরের দুর্গতি: ডুবিয়েছে পাউবো ও ঠিকাদার’-শিরোনামে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে-ঠিকাদারেরা হাওরের বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের দায়িত্ব পেয়ে তা সময়মতো ও সঠিকভাবে শেষ করেনি। ফলে ফসল রক্ষা বাঁধগুলো একে একে ভেঙে ফসলহানির মতো বিপর্যয় ঘটে গেছে। আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-হাওরে প্রকল্প বাস্তবায়ন না করেই টাকা আত্মসাৎ করেছে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা। সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলার শনির হাওরের বেহেলী ইউনিয়নের অংশে কম্পারমেন্টাল বাঁধ সংস্কারের নামে লোক দেখানো প্রকল্প দাখিল করে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। ইতোমধ্যে ওই প্রকল্পের সিংহভাগ টাকা নাকি সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাবানদের পকেটস্থ হয়ে গেছে!
বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এ কথা এখন স্পষ্ট করেই বলা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি এক শ্রেণীর দায়িত্বশীলের অসাধু-অনৈতিক-স্বেচ্ছাচারি ব্যক্তিদের কারণে হাওরাঞ্চলে সর্বনাশ ঘটেছে। এই সর্বনাশ শুধু কৃষকের ঘটেনি, এর বিরূপ ধাক্কা যে জাতীয় অর্থনীতিতে গিয়ে পড়বে তাও সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়। কারণ কৃষিনির্ভর অর্থনীতির আমাদের দেশে কৃষিজাত পণ্য হলো আমাদের অতীব মূল্যবান সম্পদ। যাদের কারণে এই মূল্যবান সম্পদের বিনাশের পথ প্রশস্ত হলো আর সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির চিত্র স্ফীত হয়ে উঠল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে নির্মোহ অবস্থান থেকে। ত্রাণমন্ত্রীসহ সরকারের দায়িত্বশীলরা ইতোমধ্যে এই অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন যে, হাওরে ক্ষতিগ্রস্ত কোনো কৃষক না খেয়ে মরবে না। তাছাড়া আগামী ফসল ওঠার আগ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের সব রকম সহায়তা দেয়া হবে। হাওরাঞ্চলে বর্ষাকালে মানুষের এমনিতেই কোনো কাজ থাকে না তার মধ্যে তাদের ওপর পড়েছে প্রকৃতি ও মনুষ্যসৃষ্ট ছোবল। বিদ্যমান পরিস্থিতির জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে এমন কথাও বলা হয়েছে সরকারের দায়িত্বশীলদের তরফে। আমরা আশা করব এটি শুধু কথার কথা হয়ে থাকবে না। এক্ষেত্রে অবশ্যই দৃষ্টান্তযোগ্য প্রতিকার চিত্র দাঁড় করানো আবশ্যক। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই হাওর রক্ষা বাঁধ। কিন্তু এই বাঁধ যদি সময়মতো সংস্কার-মেরামত না করা হয় তাহলে সরকারের কোটি কোটি টাকা বরাদ্দের মানে কি ব্যক্তি বা মহল বিশেষের উদর পূর্তির জন্য? কাজেই সরকারের উচিত এই লোভাতুরদের বিরুদ্ধে নির্মোহ অবস্থান থেকে ব্যবস্থা নেয়া।
হাওরাঞ্চলের মানুষের আরেক বিপদ হলো তাদের সিংহভাগ বন্দি দাদনের জালে। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে ভাটি বাংলার অধিকাংশ কৃষকের ঘরে হানা দেয় অভাব। বৈশাখের একমাত্র বোরো ফসল বছর পেরিয়ে আরেক বৈশাখ পার হতে চায় না। নতুন ফসল ঘরে তোলার আগেই কৃষকের ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানোর’ অবস্থা তৈরি হয়। আর এ সুযোগটিই লুফে নেয় দাদন ব্যবসায়ীরা। দালালদের মাধ্যমে তারা দু হাতে টাকা বিলিয়ে কিনে নেয় প্রান্তিক চাষিদের। হাজার টাকায় তিন মণ ধান দেয়ার শর্তে টাকা ছড়ানো হয়। একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে প্রকাশ, হাওরাঞ্চলে এভাবে দেয়া টাকার পরিমাণ প্রায় শত কোটি টাকা। এটা প্রায় প্রতি বছরের চিত্র। এর ব্যতিক্রম হয়নি এবারো। দাদনের ভারে নুইয়ে পড়া প্রান্তিক চাষিদের দিন কাটছে এখন মহাজনের দাদন আতঙ্কে। অভিযোগ আছে যে, দুর্যোগে মহাজনি ঋণ ও এনজিও ঋণের চাপে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। অন্যদিকে টাকা লগ্নি করে ফেরত না পাওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে দাদন ব্যবসায়ীরা। আর মধ্যস্বত্বভোগী দালালরা মহাজনের টাকা মরিয়া হয়ে উঠেছে আদায়ের জন্য। মানুষকে এই রক্তচোষাদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। কোনো মধ্যস্বত্বভোগী যদি কৃষককে হয়রানি করে তাহলে তার বা তাদের বিরুদ্ধে নেয়া উচিত আইনানুগ ব্যবস্থা। হাওরবাসীর দুর্ভোগ কাটছে না। এমনিতেই নানা রকম ঝুঁকির মধ্যে তাদের বসবাস করতে হয়। এর মধ্যে নতুন এই বিপর্যয় মানুষকে আরো বেশি বিপন্ন-বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। সরকারের দায়িত্বশীলদের এসব ব্যাপারেই বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে, ব্যবস্থা নিতে হবে।
হাওর রক্ষা বাঁধ নিছক বাঁধ নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসংখ্য মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা। বিপন্ন-বিপর্যস্ত মানুষদের কল্যাণে দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও যথাযথ বাস্তবায়নের পাশাপাশি কিভাবে এক ফসল থেকে বহু ফসলে হাওরাঞ্চলকে রূপান্তর করা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে কৃষি বিভাগকে। এখন তো ভাসমান পদ্ধতিতে অনেক কিছুই করা যায় এবং এমন দৃষ্টান্ত আমাদের সামনেই আছে। এত বিপুল সংখ্যক পরিবার পথে বসে যাওয়ার জন্য শুধু প্রকৃতিই দায়ী নয়। রাষ্ট্রপতি ইতোমধ্যে হাওরাঞ্চল পরিদর্শন করেছেন। প্রধানমন্ত্রীও যাচ্ছেন ওইসব বিপন্ন-বিপর্যস্তদের মাঝে। ওই সবহারা লাখ লাখ মানুষ হয়তো এসব কারণে বেঁচে থাকার নতুন স্বপ্ন দেখছে। তাদের স্বপ্ন বাঁচাতে হবে। তাদের স্বপ্ন বাঁচলে বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির চাকা গতিশীল হবে। তারাই আমাদের মেরুদণ্ড। তারা আমাদের বড় সম্পদ। এই সবহারাদের পাশে দাঁড়াতে হবে সর্বতো সহায়তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। কৃষকদের অভিসম্পাত নিশ্চয়ই তাদের ওপর থাকবে যাদের কারণে এত বড় সর্বনাশ ঘটেছে। এ মুহূর্তে অসহায় মানুষের সবচেয়ে প্রয়োজন প্রশাসনের সাহায্য-সহযোগিতা। পর্যাপ্ত ত্রাণের পাশাপাশি বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার জন্য এখন থেকেই কাজ শুরুর কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের আলামত দেশের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা প্রত্যক্ষ হয়ে উঠছে ক্রমাগত। প্রকৃতির বৈরী আচরণের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় হাওরাঞ্চলের মানুষের মাঝে যে হাহাকার বিরাজ করছে সার্বিক স্বার্থ ও প্রয়োজনে সব রকম পরিকল্পনা নিয়ে এর নিরসন ঘটাতে হবে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায় থেকেই বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। এই বিপর্যয় থেকে হাওরবাসীকে বাঁচাতে স্বল্পমেয়াদি কার্যক্রমের পাশাপাাশি মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও নিশ্চিত করা বাঞ্ছনীয়। অসময়ে এই আঘাতে হাওরাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। সেখানকার মানুষের দুঃখ-কষ্ট শহুরে চোখে কেউ বুঝতে পারবে না। তাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে তাদেরই কাজে লাগাতে হবে যাদের হাওরাঞ্চল সম্পর্কে ধারণা ও অভিজ্ঞতা রয়েছে। হাওর বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। এই মহাবিপর্যয় সরকার ও সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কাটবে কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই দৃষ্টান্তযোগ্য ব্যবস্থা নিতে হবে যারা প্রকৃতির বৈরী আচরণের পাশাপাশি নিজেরা নানাভাবে দায়ী।