ঢাকা , শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অকাল বন্যায় বিপর্যস্ত হাওরের অর্থনীতি

হাওর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি জেলা-সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রায় ৮ লাখ হেক্টর জমি নিয়ে হাওর অঞ্চল। প্রায় ২৪ লাখ কৃষক ও সাধারণ মানুষ হাওর অঞ্চলের বাসিন্দা। বর্ষায় অথৈ পানি, পাহাড় সমান ঢেউ ও ইঞ্জিনচালিত নৌকার ছলছল শব্দে মুখরিত থাকে হাওর অঞ্চল। এই ছয় মাস হাওরে কোনো ফসল ফলে না। এ সময় হাওরবাসী মাছ ধরা, মাছ বিক্রি ও হাঁস পালন করে কোনো রকমে বেঁচে থাকেন। বোরো ধানই হাওরবাসীর একমাত্র ভরসা। বর্ষায় হাওরে যে পলি পড়ে, সেই উর্বর পলি মাটিই ধানের উত্পাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। পুরো হাওর অঞ্চলে ধানের উত্পাদন হয় প্রায় ৫৫ লাখ টন। যে বছর বোরো ধান ভালো হয়, সে বছর হাওরবাসীর আনন্দের সীমা থাকে না। বোরো ধান কাটার পর শুরু হয়ে যায় বিয়ে-শাদি, যাত্রা, পালাগানসহ নানা রকমের উত্সব। ধানের মৌসুমে দেশের দূর-দূরান্ত থেকে শত শত ব্যবসায়ী এসে কোটি কোটি টাকার ধান কিনে নিয়ে যান। এছাড়া ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য উত্তরাঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহ থেকে হাজার হাজার কৃষি শ্রমিক আসে হাওর এলাকায়। তাদের এক থেকে দেড় মাসের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয় হাওরে উত্পাদিত বোরো ধান, যখন দেশের অন্য স্থানে কৃষি শ্রমিকদের কোনো কাজই থাকে না। হাওরে এবার আগাম বন্যা জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষত সৃষ্টি করেছে বলে জানিয়েছে হাওর নিয়ে কাজ করা ৩৫টি আন্তর্জাতিক দেশীয় সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত হাওর অ্যাডভোকেসি প্লাটফর্ম। সরকারের কাছ থেকে নেওয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি বলেছে, মোট ক্ষতির পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বন্যায় নষ্ট হওয়া ১০ লাখ টন চাল, ২ হাজার টন মাছ ও ১১ হাজার ৩০৫ টন গো-খাদ্যের বাজারমূল্য ধরে এ হিসাব বের করেছেন তারা। এসব ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের পর সুনামগঞ্জের পাকনা ও শনির হাওরের আরও প্রায় ৪২ হাজার একর বোরো ধানের জমি তলিয়ে গেছে প্রবল বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে। দীর্ঘ ২৫ দিন আপ্রাণ চেষ্টা করেও হাওরবাসী ওই দুটি হাওরের ধান রক্ষা করতে পারেননি। হাওর অ্যাডভোকেসি প্লাটফর্মের তথ্য অনুযায়ী ধানে মোট ক্ষতি হয়েছে ৪ হাজার ৩৯১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সিলেটে ৪৫০ কোটি, সুনামগঞ্জে ১ হাজার ৯০৫ কোটি, হবিগঞ্জে ৬৬১ কোটি, নেত্রকোনায় ৪৬৩ কোটি, মৌলভীবাজারে ২৪৬ কোটি, কিশোরগঞ্জে ৬০০ কোটি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ৪ কোটি টাকা। মত্স্য ও পশুপালন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, হাওরে পানি দূষণে প্রায় ৪১ কোটি টাকার ১ হাজার ২৭৬ টন মাছ মারা গেছে। এছাড়া মারা গেছে ৩ হাজার ৮৪৪টি হাঁস। ধান গাছ পচে পানিতে অক্সিজেন একেবারে কমে যাওয়া এবং অ্যামোনিয়া ও অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে মাছ মারা যায়। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাব থেকে জানা যায়, হাওর এলাকায় ৩ লাখ ৩০ হাজার পরিবারের ২ লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে ৬টি উপজেলার ৫৫টি ইউনিয়নের ১৮ হাজার ২০৫টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। অকাল বন্যার কারণে ধান নষ্ট হওয়ার জন্য গৃহপালিত পশুপাখির খাদ্যের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে হাওর অঞ্চলে। এ কারণে পানির দামে বিক্রি হচ্ছে গরু, ছাগল, ভেড়া ও হাঁস-মুরগি। অনেক এলাকায় বন্যার পানিতে নিমজ্জিত দূষিত ঘাস খেয়ে গরু-ছাগল মারা যাওয়ারও খবর পাওয়া যাচ্ছে। হাওর এলাকার একমাত্র ফসল বোরো ধান নষ্ট হওয়ার কারণে নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জসহ উপদ্রুত এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যে চরম মন্দাভাব বিরাজ করছে। ইতোমধ্যে জামা-কাপড়, শাড়ি, গয়না, জুতা, ইলেকট্রনিক পণ্য বিক্রি শতকরা ৪০ থেকে ৬০ ভাগ কমে গেছে। ওষুধের মতো অত্যাবশ্যক পণ্যের বিক্রিও কমে গেছে। ওষুধ ব্যবসায়ীরা বলেছেন, মানুষ সর্দি-কাশি, মাথা ব্যথা, গ্যাস্ট্রিক ইত্যাদির ওষুধ আগের তুলনায় কম কিনছেন। এছাড়া হোটেল, রেস্তোরাঁ, মিষ্টি, কনফেকশনারি ও ফলের দোকানে বিক্রি কমে গেছে অস্বাভাবিকভাবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্য কীভাবে চলে? এটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে হাওর এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের রেয়াতি সুদে ঋণ দিতে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত ঋণ আদায় স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে। জারিকৃত নির্দেশনায় বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, হাওরে অকাল বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে হাওরের মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বিশুদ্ধ পানি ও জরুরি ওষুধ নিয়ে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক আরও জানিয়েছে, ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষিঋণ দিতে হবে। সহজ কিস্তি নিয়ে ঋণ নিয়মিত করতে হবে এবং রবিশস্য ও আমদানি বিকল্প ফসলে রেয়াতি হারে সুদে ঋণ দেওয়া বাড়াতে হবে। এছাড়া চাইলে ব্যাংকগুলোর ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারবে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা যাতে প্রকৃত চাহিদা মোতাবেক যথাসময় নতুন ঋণ সুবিধা গ্রহণ করতে পারেন এবং ঋণ পেতে কোনো হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়টি নিবিড়ভাবে তদারকি করতে হবে। অন্যদিকে যেসব কৃষকের নামে সার্টিফিকেট মামলা আছে তাদের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে এবং নতুন করে কোনো মামলা দায়ের না করতে বলা হয়েছে। তফসিলি ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহীতারা সামান্য স্বস্তি পেলেও এনজিও এবং মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চসুদে ঋণগ্রহীতা কৃষকরা রয়েছেন বড় দুশ্চিন্তায়। দুর্গত এলাকায় এনজিওর কিস্তি আদায় স্থগিত রাখতে বিভিন্ন নাগরিক ফোরাম থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে। এনজিও এবং বেসরকারি ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত কৃষকের এই বিপদের দিনে শুধু কিস্তি আদায় স্থগিত রাখাই নয়, বিপন্ন মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সহায়ক কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসা। ১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় এনজিওগুলো যেভাবে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল এবারও তারা সেরকম ভূমিকা পালন করবে বলে দেশবাসীর প্রত্যাশা। অন্যদিকে দাদন ব্যবসায়ী ও সুদখোর ব্যবসায়ীরা যাতে এ দুঃসময়ে দুর্গত মানুষের ওপর জোর-জবরদস্তি করতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের। হাওরের উন্মুক্ত জলাশয়ে সবার মাছ ধরার অধিকার দেওয়া, হাওর দূষণের প্রকৃত কারণ নির্ণয় এবং বাঁধ নির্মাণে জড়িত দুর্নীতিবাজদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। গত বছর ১ কোটি ৯০ লাখ টন বোরো ধান উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হলেও উত্পাদন হয়েছিল ১ কোটি ৮৯ লাখ ৩৭ হাজার টন। অতিবৃষ্টির কারণে দেশের বিভিন্ন জেলায় মসুর, খেসারি, পেঁয়াজ, রসুন ও মরিচসহ নানা ধরনের রবিশস্য পানিতে বিনষ্ট হয়েছে। সরকারি ভাষ্য মতে, অকাল বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে ২ লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে, যেখান থেকে ৬ লাখ টন চাল পাওয়া যেত। এতে দেশে কোনো খাদ্যঘাটতি হবে না। তবে হাওর অঞ্চলের মানুষের খাদ্যাভাব দেখা দেওয়ার শঙ্কা থেকেই যায়। তাদের পুনর্বাসনে সরকারের সহযোগিতা আরও জোরদার করতে হবে। হাওরের কৃষি, অর্থনীতি, যোগাযোগ, অবকাঠামো, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও শিল্প-সংস্কৃতি দেশের অন্য অঞ্চল থেকে ভিন্ন ধরনের। বন্যার পানি চলে গেলে বিভিন্ন হাওরের তলানিতে প্রচুর ছোট মাছ, শামুক ও ঝিনুক পাওয়া যায়। হাওরের পানিতে প্রচুর সহজলভ্য প্রাকৃতিক খাবার ও বিচরণক্ষেত্র থাকার কারণে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে হাঁস পালন। ডিম উত্পাদন ছাড়াও হাওরে শিল্প হিসেবে শুঁটকি মাছ তৈরির রয়েছে এক বিপুল সম্ভাবনা। তাছাড়া হাওরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে লাভজনক পর্যটন শিল্প। এতে হাওর অঞ্চলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও দুর্যোগ মোকাবেলার পথ প্রশস্ত হবে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

অকাল বন্যায় বিপর্যস্ত হাওরের অর্থনীতি

আপডেট টাইম : ০২:৫৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ মে ২০১৭

হাওর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি জেলা-সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রায় ৮ লাখ হেক্টর জমি নিয়ে হাওর অঞ্চল। প্রায় ২৪ লাখ কৃষক ও সাধারণ মানুষ হাওর অঞ্চলের বাসিন্দা। বর্ষায় অথৈ পানি, পাহাড় সমান ঢেউ ও ইঞ্জিনচালিত নৌকার ছলছল শব্দে মুখরিত থাকে হাওর অঞ্চল। এই ছয় মাস হাওরে কোনো ফসল ফলে না। এ সময় হাওরবাসী মাছ ধরা, মাছ বিক্রি ও হাঁস পালন করে কোনো রকমে বেঁচে থাকেন। বোরো ধানই হাওরবাসীর একমাত্র ভরসা। বর্ষায় হাওরে যে পলি পড়ে, সেই উর্বর পলি মাটিই ধানের উত্পাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। পুরো হাওর অঞ্চলে ধানের উত্পাদন হয় প্রায় ৫৫ লাখ টন। যে বছর বোরো ধান ভালো হয়, সে বছর হাওরবাসীর আনন্দের সীমা থাকে না। বোরো ধান কাটার পর শুরু হয়ে যায় বিয়ে-শাদি, যাত্রা, পালাগানসহ নানা রকমের উত্সব। ধানের মৌসুমে দেশের দূর-দূরান্ত থেকে শত শত ব্যবসায়ী এসে কোটি কোটি টাকার ধান কিনে নিয়ে যান। এছাড়া ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য উত্তরাঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহ থেকে হাজার হাজার কৃষি শ্রমিক আসে হাওর এলাকায়। তাদের এক থেকে দেড় মাসের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয় হাওরে উত্পাদিত বোরো ধান, যখন দেশের অন্য স্থানে কৃষি শ্রমিকদের কোনো কাজই থাকে না। হাওরে এবার আগাম বন্যা জাতীয় অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষত সৃষ্টি করেছে বলে জানিয়েছে হাওর নিয়ে কাজ করা ৩৫টি আন্তর্জাতিক দেশীয় সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত হাওর অ্যাডভোকেসি প্লাটফর্ম। সরকারের কাছ থেকে নেওয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি বলেছে, মোট ক্ষতির পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বন্যায় নষ্ট হওয়া ১০ লাখ টন চাল, ২ হাজার টন মাছ ও ১১ হাজার ৩০৫ টন গো-খাদ্যের বাজারমূল্য ধরে এ হিসাব বের করেছেন তারা। এসব ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের পর সুনামগঞ্জের পাকনা ও শনির হাওরের আরও প্রায় ৪২ হাজার একর বোরো ধানের জমি তলিয়ে গেছে প্রবল বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে। দীর্ঘ ২৫ দিন আপ্রাণ চেষ্টা করেও হাওরবাসী ওই দুটি হাওরের ধান রক্ষা করতে পারেননি। হাওর অ্যাডভোকেসি প্লাটফর্মের তথ্য অনুযায়ী ধানে মোট ক্ষতি হয়েছে ৪ হাজার ৩৯১ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সিলেটে ৪৫০ কোটি, সুনামগঞ্জে ১ হাজার ৯০৫ কোটি, হবিগঞ্জে ৬৬১ কোটি, নেত্রকোনায় ৪৬৩ কোটি, মৌলভীবাজারে ২৪৬ কোটি, কিশোরগঞ্জে ৬০০ কোটি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ৪ কোটি টাকা। মত্স্য ও পশুপালন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, হাওরে পানি দূষণে প্রায় ৪১ কোটি টাকার ১ হাজার ২৭৬ টন মাছ মারা গেছে। এছাড়া মারা গেছে ৩ হাজার ৮৪৪টি হাঁস। ধান গাছ পচে পানিতে অক্সিজেন একেবারে কমে যাওয়া এবং অ্যামোনিয়া ও অ্যাসিডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণে মাছ মারা যায়। দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাব থেকে জানা যায়, হাওর এলাকায় ৩ লাখ ৩০ হাজার পরিবারের ২ লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে ৬টি উপজেলার ৫৫টি ইউনিয়নের ১৮ হাজার ২০৫টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। অকাল বন্যার কারণে ধান নষ্ট হওয়ার জন্য গৃহপালিত পশুপাখির খাদ্যের তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে হাওর অঞ্চলে। এ কারণে পানির দামে বিক্রি হচ্ছে গরু, ছাগল, ভেড়া ও হাঁস-মুরগি। অনেক এলাকায় বন্যার পানিতে নিমজ্জিত দূষিত ঘাস খেয়ে গরু-ছাগল মারা যাওয়ারও খবর পাওয়া যাচ্ছে। হাওর এলাকার একমাত্র ফসল বোরো ধান নষ্ট হওয়ার কারণে নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জসহ উপদ্রুত এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যে চরম মন্দাভাব বিরাজ করছে। ইতোমধ্যে জামা-কাপড়, শাড়ি, গয়না, জুতা, ইলেকট্রনিক পণ্য বিক্রি শতকরা ৪০ থেকে ৬০ ভাগ কমে গেছে। ওষুধের মতো অত্যাবশ্যক পণ্যের বিক্রিও কমে গেছে। ওষুধ ব্যবসায়ীরা বলেছেন, মানুষ সর্দি-কাশি, মাথা ব্যথা, গ্যাস্ট্রিক ইত্যাদির ওষুধ আগের তুলনায় কম কিনছেন। এছাড়া হোটেল, রেস্তোরাঁ, মিষ্টি, কনফেকশনারি ও ফলের দোকানে বিক্রি কমে গেছে অস্বাভাবিকভাবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্য কীভাবে চলে? এটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে হাওর এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছে। সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের রেয়াতি সুদে ঋণ দিতে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত ঋণ আদায় স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে। জারিকৃত নির্দেশনায় বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, হাওরে অকাল বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে হাওরের মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বিশুদ্ধ পানি ও জরুরি ওষুধ নিয়ে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক আরও জানিয়েছে, ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কৃষিঋণ দিতে হবে। সহজ কিস্তি নিয়ে ঋণ নিয়মিত করতে হবে এবং রবিশস্য ও আমদানি বিকল্প ফসলে রেয়াতি হারে সুদে ঋণ দেওয়া বাড়াতে হবে। এছাড়া চাইলে ব্যাংকগুলোর ঋণ পুনঃতফসিল করতে পারবে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা যাতে প্রকৃত চাহিদা মোতাবেক যথাসময় নতুন ঋণ সুবিধা গ্রহণ করতে পারেন এবং ঋণ পেতে কোনো হয়রানির শিকার না হন, সে বিষয়টি নিবিড়ভাবে তদারকি করতে হবে। অন্যদিকে যেসব কৃষকের নামে সার্টিফিকেট মামলা আছে তাদের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম স্থগিত রাখতে বলা হয়েছে এবং নতুন করে কোনো মামলা দায়ের না করতে বলা হয়েছে। তফসিলি ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহীতারা সামান্য স্বস্তি পেলেও এনজিও এবং মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চসুদে ঋণগ্রহীতা কৃষকরা রয়েছেন বড় দুশ্চিন্তায়। দুর্গত এলাকায় এনজিওর কিস্তি আদায় স্থগিত রাখতে বিভিন্ন নাগরিক ফোরাম থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে। এনজিও এবং বেসরকারি ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত কৃষকের এই বিপদের দিনে শুধু কিস্তি আদায় স্থগিত রাখাই নয়, বিপন্ন মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সহায়ক কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসা। ১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় এনজিওগুলো যেভাবে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল এবারও তারা সেরকম ভূমিকা পালন করবে বলে দেশবাসীর প্রত্যাশা। অন্যদিকে দাদন ব্যবসায়ী ও সুদখোর ব্যবসায়ীরা যাতে এ দুঃসময়ে দুর্গত মানুষের ওপর জোর-জবরদস্তি করতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের। হাওরের উন্মুক্ত জলাশয়ে সবার মাছ ধরার অধিকার দেওয়া, হাওর দূষণের প্রকৃত কারণ নির্ণয় এবং বাঁধ নির্মাণে জড়িত দুর্নীতিবাজদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। গত বছর ১ কোটি ৯০ লাখ টন বোরো ধান উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হলেও উত্পাদন হয়েছিল ১ কোটি ৮৯ লাখ ৩৭ হাজার টন। অতিবৃষ্টির কারণে দেশের বিভিন্ন জেলায় মসুর, খেসারি, পেঁয়াজ, রসুন ও মরিচসহ নানা ধরনের রবিশস্য পানিতে বিনষ্ট হয়েছে। সরকারি ভাষ্য মতে, অকাল বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে ২ লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে, যেখান থেকে ৬ লাখ টন চাল পাওয়া যেত। এতে দেশে কোনো খাদ্যঘাটতি হবে না। তবে হাওর অঞ্চলের মানুষের খাদ্যাভাব দেখা দেওয়ার শঙ্কা থেকেই যায়। তাদের পুনর্বাসনে সরকারের সহযোগিতা আরও জোরদার করতে হবে। হাওরের কৃষি, অর্থনীতি, যোগাযোগ, অবকাঠামো, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও শিল্প-সংস্কৃতি দেশের অন্য অঞ্চল থেকে ভিন্ন ধরনের। বন্যার পানি চলে গেলে বিভিন্ন হাওরের তলানিতে প্রচুর ছোট মাছ, শামুক ও ঝিনুক পাওয়া যায়। হাওরের পানিতে প্রচুর সহজলভ্য প্রাকৃতিক খাবার ও বিচরণক্ষেত্র থাকার কারণে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে হাঁস পালন। ডিম উত্পাদন ছাড়াও হাওরে শিল্প হিসেবে শুঁটকি মাছ তৈরির রয়েছে এক বিপুল সম্ভাবনা। তাছাড়া হাওরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারে লাভজনক পর্যটন শিল্প। এতে হাওর অঞ্চলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন ও দুর্যোগ মোকাবেলার পথ প্রশস্ত হবে।