বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ শিক্ষকতা পেশাটির সঙ্গে অন্য কোনো পেশার মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কেবল জীবন-জীবিকার তাগিদেই নয়, ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’, ‘শিক্ষকতা একটি মহান পেশা’- প্রধানত এমনসব আপ্তবাক্যকে বুকে ধারণ করে বিগত শতকের আশির দশকের প্রথমার্ধে মফস্বলের একটি কলেজে তরুণ বয়সে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিই। নতুন শিক্ষক হিসেবে কলেজে ১০-১২ দিন ক্লাস নিয়ে কোনো এক ছুটির দিনে চলে যাই নেত্রকোনায়। নেত্রকোনা কলেজে আমার একজন প্রিয় শিক্ষক ছিলেন ইতিহাস বিভাগের জনাব হোসেন আলী (প্রয়াত)। কলেজের কাছেই স্যারের বাসা। প্রণাম করার পর স্যারকে জানালাম আমার শিক্ষকতায় যোগদানের খবরটি। শুনে সঙ্গে সঙ্গে তিনি যা বললেন তাতে আমার মনে তৈরি হল এক ধূম্রজালের। লক্ষ করলাম, স্যার আমার ‘সুখবর’টি জানার পর খুশিও হননি আবার বেজারও হলেন না। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে স্যার নিজেই বলতে শুরু করলেন, ‘শোনো, তোমার শিক্ষকতায় যোগদানের খবরে আমি খুশিই হয়েছি। তবে জেনে রেখো এবং মনে রাখতে চেষ্টা করো যে, শিক্ষকের চেয়ারটিতে আঠা লাগানো থাকে, কাঁঠালের আঠা। একবার যে এই চেয়ারটিতে বসে, সে আর তা থেকে সহজে উঠতে পারে না। অতএব যা ভাবার, এখনও সময় আছে, আগেভাগেই ভেবে নাও।’
উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রাবস্থায় শিক্ষকদের মধ্যে আমার বেশি যাতায়াত ছিল হোসেন আলী স্যারের বাসায়। এমনও হয়েছে যে, বই-খাতাসহ শহরের উপর দিয়ে আনুমানিক আড়াই কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে কলেজের কাছাকাছি গিয়ে দেখতাম স্যার বাসায় নেই। গ্রামের বাড়ি অথবা অন্য কোথাও দরকারি কাজে চলে গেছেন। অতএব যেভাবে যাওয়া, ঠিক সেভাবেই আমাকে ফিরে আসতে হতো। এমনই একদিন গিয়ে স্যারকে বাসায় পাইনি। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গলি দিয়ে কলেজ রোডে উঠব, ঠিক সেই মুহূর্তে স্যারের দেখা পেলাম। স্যারের ইশারায় অনুগামী হয়ে আবারও বাসায় যাই। ওই সময়ে কলেজে পশুপতি নামে চতুর্থ শ্রেণির একজন কর্মচারী ছিলেন। তার নামটি আমার জানা ছিল না, স্যারের ডাক শুনে জানতে পারি। আমি বসার কিছুক্ষণ পর পশুপতি এলেন কী একটা কাগজ অথবা নোটিশ হাতে নিয়ে। উভয়ের মধ্যে কথার এক ফাঁকে স্যার বললেন, ‘পশুপতি, গম শেষ হয়ে গেছে? তোমরা আমাকেও কিছু গম দিও।’ এমন কথোপকথনের পর পশুপতি চলে গেলেন। সে বছর (১৯৭৬) কলেজের আশপাশের নিজস্ব জমিগুলোতে গমের চাষ করা হয়। ফলনও হয় খুব ভালো। পশুপতি চলে যাওয়ার পর হোসেন আলী স্যার কথা প্রসঙ্গে বললেন, ‘বর্তমানে কলেজের যে আয়, তাতে মাত্র ১৪ দিনের বেতন নিতে পারি আমরা শিক্ষক-কর্মচারীরা। বাকিটা সামাল দিতে বেশ হিমশিম খেতে হয়।’ স্যারের কথাগুলো মনে এমনই দাগ কাটে যে তা কোনোদিনই বোধকরি আমি ভুলতে পারব না।
যা হোক, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক দৈন্যদশার এমন সব বাস্তবতা জেনে-বুঝেই আমার শিক্ষকতায় আসা। আজ থেকে ৩৬ বছর আগে ১৯৮৪ সালে সেই যে যোগদান ও মনোনিবেশ; নানা চড়াই-উতরাই ও ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে একদম লেগে থাকা। অবশেষে অবসর গ্রহণ ৩০ অক্টোবর ২০১৯। একই কলেজে টানা ৩৫ বছর ৭ মাস ২৬ দিনের শিক্ষকতা। এ দীর্ঘ সময়ে সরকারি-বেসরকারি আর কোনো বিভাগ, দফতর বা অন্যত্র চাকরি পাওয়ার আশায় কখনও আবেদনটি পর্যন্ত করিনি।
১৯৮৪ থেকে ২০২০ সাল। মাঝে ৩৬ বছরের ব্যবধান। ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে কখনও কেউ আমার কাছে শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে আমি কিছুটা বিব্রত বোধ করি। যাপিত জীবনের স্মৃতি মন্থনে মনোযোগী হই। এমএ পরীক্ষার ফল প্রকাশ এবং কলেজে নিযুক্তির মধ্যবর্তী দুই মাস ঢাকায় একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেছি। কিছুটা আনন্দদায়ক হলেও বেশ পরিশ্রমের কাজ, বেতন-ভাতা সবসুদ্ধ ১৬০০ টাকার মতো। এইচএসসি পাস করে ইতিহাস বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই শিক্ষকতা আমার জীবনের ধ্যান-জ্ঞান হয়ে উঠেছিল। কলেজে চাকরির পরীক্ষার সময় নিয়োগ বোর্ডের সভাপতি স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার দেবাশিস নাগ আমার কাছে জানতে চান- কলেজে কম টাকা মাইনের চাকরি, সংস্থার বেশি মাইনে ও সুন্দর ভবিষ্যৎ বাদ দিয়ে শিক্ষকতায় আমি থাকব কিনা [সে সময় একজন প্রভাষককে ৭৫০ টাকা বেতন-স্কেল অনুযায়ী অর্ধেক, অর্থাৎ ৩৭৫ টাকা কলেজ থেকে এবং প্রতি তিন মাস অন্তর ২৪৩০ টাকা (মাস হিসেবে ৮১০ টাকা) সরকারি কোষাগার থেকে দেয়া হতো]। বোর্ডের সামনে এমন প্রশ্নের জবাব দিতে আমাকে একটুও ইতস্তত করতে হয়নি। বলেছিলাম, ‘ওইসব চাকরিতে টাকা আছে, ভালো ভবিষ্যৎও থাকতে পারে; কিন্তু আমি মনে করি কোনো প্রাণ নেই। আর শিক্ষকতা পেশায় টাকা বা সুযোগ-সুবিধা যাই থাকুক না কেন, এতে প্রাণ আছে। আর এ কারণে আমি এখানেই থাকতে আগ্রহী।’
শিক্ষকতার মতো একটি মহান পেশায় সম্পৃক্ত থাকতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করি। কলেজ ও সরকারি কোষাগার থেকে শুরুতে মোট ১২০০ আর ফেরার সময় ৪৮ হাজার টাকা বেতন-ভাতা উত্তোলন করেছি। মাঝে কত রকমের টানাপোড়েনের স্মৃতি! কেবল আমি নই বা আমার কলেজ নয়, এমন অগণিত শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান বলতে গেলে একই তালে পথ হেঁটে চলেছেন। এমনও হয়েছে যে, মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর কলেজ থেকে বেতন-ভাতার সংস্থান না থাকায় কোনো টাকাই পাওয়া যায়নি। এখন আর সে পরিস্থিতি নেই। তবে আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আগের তুলনায় ধাপে ধাপে অভাবনীয় পরিমাণে বাড়লেও নানা কারণে শিক্ষকতা পেশাটিতে প্রাণ ও সম্মান যে আজ অনেকটাই অস্তমিত তা প্রমাণের কোনো অবকাশ আছে বলে মনে করি না।
বিমল সরকার : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক