ঢাকা , শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নেমেসিস আমাদের ওপর ভর করেছে

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ একটি দৈনিক পত্রিকার খবরের শিরোনাম এবং এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ উদ্ধৃত করে শুরু করছি। খবরটি নিম্নরূপ : কাঁচা মরিচের কেজি ৩০০, শিম ২০০ টাকা : বরগুনার আমতলী ও তালতলী উপজেলায় সবজির দাম তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

অতিবৃষ্টিতে ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় সবজির গাছ পচে গেছে। চাহিদার তুলনায় জোগান কম হওয়ায় বাজারে সবজির প্রচুর সংকট দেখা দিয়েছে। এ সুবাদে ব্যবসায়ীরা তিন গুণ দামে সবজি বিক্রি করছে, আর ক্রেতারা কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। এদিকে সবজি চাষিদের সর্বনাশ। আমতলী উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, আমতলী ও তালতলী উপজেলায় এ বছর সবজির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭০০ হেক্টর। বছরের শুরুতে সবজির ভালো ফলন হয়েছিল। দামও ছিল ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে; কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অতিবর্ষণে জলাবদ্ধতার কারণে সবজিক্ষেত পচে তেমন ফসল পাওয়া যাচ্ছে না। বাজারে সবজির সংকট ও উত্তরাঞ্চল থেকে তেমন সবজি না আসায় দাম কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। জলাবদ্ধতায় সবজিক্ষেত তলিয়ে গাছ পচে যাওয়ায় চাষিদের ব্যাপক সর্বনাশ হয়েছে।কাউনিয়া গ্রামের কৃষক জামাল হোসেন জানান, ৩০ হাজার টাকা খরচ করে ৬৪ শতাংশ জমিতে সবজি চাষ করেছিলেন। কিন্তু বৃষ্টিতে ক্ষেতের সব গাছ পচে গেছে। তিনি আরো জানান, এ বছর ৩০ হাজার টাকাই লোকসান।

গতকাল শুক্রবার আমতলী, বাঁধঘাট ও তালুকদারবাজার ঘুরে দেখা গেছে, কাঁচা মরিচ ৩০০ টাকা, শিম ২০০, লালশাক ৭০-৮০, করলা ৬০-৭০, ঢেঁড়স ৬০-৭০, মিনা ৫০-৬০, বরবটি ৫০-৬০, মিষ্টি কুমড়া ৩৫-৪০, পটোল ৫০-৬০, রেহা ৪০-৫০ ও মুলা ৫০-৫৫ টাকা কেজিতে এবং এক কেজি ওজনের ছোট লাউ ৬০-৭০, দেড় কেজি ওজনের বড় লাউ ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বিজ্ঞানের এত উন্নতির পরও যে কয়েকটি বিষয়ে মানুষ আজও চরম অসহায় আবহাওয়া-জলবায়ু তার মধ্যে অন্যতম প্রধান। আরো কিছু দৈবদুর্বিপাক যেমন—ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, দাবানল, জলোচ্ছ্বাস, সুনামির ক্ষেত্রেও মানুষের বড় কিছু করার নেই। তারা বড়জোর ক্ষতির পরিমাণ কমানোর চেষ্টা করতে পারে। আজকের দিনেও এ কথা পুরোপুরি সত্য যে কৃষি উৎপাদন প্রায় সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতি তথা জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা-বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ত জোয়ার ফসল বিনষ্ট করে, কৃষকের সর্বনাশ করে। এসবের বিরুদ্ধে কোনো সুরক্ষা নেই বললেই চলে। কৃষক একে দুর্ভাগ্য হিসেবে মেনে নেয়।

এ বছর (২০১৭ সালে) প্রকৃতির রোষানলে পড়েছে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন। সেই মার্চ থেকে শুরু হয়েছে প্রকৃতির তাণ্ডব। প্রথমে আক্রান্ত হয় সুনামগঞ্জ জেলা। আগাম বন্যার আকস্মিক তোড়ে বিল-ঝিল, মাঠ-ঘাট সব তলিয়ে গেল। ভেসে গেল কুঁড়েঘর, টংঘর। ক্ষেতের ফসল ছিন্নভিন্ন হয়ে পানির নিচে পচে গেল। পানি বিষাক্ত হয়ে মাছ মরে গেল। সুনামগঞ্জের জমি একফসলি। সে ফসল নষ্ট হওয়ায় কৃষকের মাথায় হাত। তারা দিশাহারা। বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ফসল হারিয়ে শুধু কৃষকই সর্বস্বান্ত হলো না, দেশের মানুষ ও অর্থনীতি সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। বাজারে চালের সরবরাহ কমে যাওয়ায় চালের দাম বাড়তে শুরু করল। সুনামগঞ্জের ‘বাঁশফুল’ চালের দাম শেষ পর্যন্ত ৭০ টাকা কেজিতে গিয়ে ঠেকল, যা অন্যান্য বছর ৪০-৪৫ টাকার ওপরে ওঠেনি।

এবার মার্চ (২০১৭) থেকেই অল্পবিস্তর বৃষ্টি হচ্ছে। মে-জুন মাসে বৃষ্টির প্রকোপ বাড়তে থাকে। আমি একটি ছোট্ট প্লটে নিজ হাতে বা নিজের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরীক্ষামূলকভাবে চাষাবাদ করি। জুন মাস থেকে আমি প্লট পরিষ্কার করে মাটি কুপিয়ে চারা-বীজ রোপণ করার চেষ্টা করছি; কিন্তু পারছি না। বড়জোর দুই দিন একটু রোদ হয়। তার পরই বৃষ্টি। সব ধুয়ে-মুছে ভেসে যায়। বীজ গজায় না; ছোট চারাগাছ পচে যায়। অবশেষে রণেভঙ্গ দিয়ে চুপচাপ রয়েছি। নভেম্বর মাস থেকে হয়তো আবার কিছু করার চেষ্টা করব। দেখা যাক আবহাওয়ার অবস্থা কী হয়। আমার ধারণা, সব কৃষকের একই অবস্থা। বন্ধুবান্ধবের মধ্যে যাদের প্লটের অবস্থান একটু দূরে, তারা প্লটে যেতেই পারছে না। একদিকে বৃষ্টিবাদলা; অন্যদিকে রাস্তাঘাট খনাখন্দে ভরা, চলাচলের অনুপযোগী। এবার দেশের অনেক তরিতরকারির মাঠ বিরান হয়ে আছে। যদি আবহাওয়া অনুকূল থাকে, তবে নভেম্বর মাসের শেষ দিকে কিছু তরকারি বাজারে আসতে পারে। দৈবদুর্যোগে দেশে তরিতরকারির চাষাবাদ বিধ্বস্ত হয়েছে। আমাদের সর্বনাশ।

সুনামগঞ্জে বন্যার পর এলো পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ধস। প্রায় দেড় শ লোক মারা গেল। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর সদস্য চারজন। পাহাড়ি অঞ্চলে যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে রইল বেশ কয়েক দিন। যোগাযোগব্যবস্থা এখনো আগের পর্যায়ে এসেছে বলে মনে হয় না। অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে কেটেছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন। কারো কিছু করার ছিল না; সবই ছিল দৈবদুর্যোগ। সরকারি ত্রাণে হয়তো বা কিছুটা বিরান ক্ষুধা নিবৃত্ত হয়েছে। কিন্তু স্বজন হারানোর বেদনা, সম্পদ হারানোর বেদনা কিভাবে লাঘব হবে। এ যে লাগব হওয়ার নয়। সে দুঃখ আজও বয়ে বেড়াচ্ছে পার্বত্য এলাকার লোকজন। বয়ে বেড়াবে সারা জীবন।

পাহাড়ধসের পরই এলো উত্তরাঞ্চলে আকস্মিক বন্যা। যেসব জেলা-উপজেলায় আগে কখনো বন্যা দেখা যায়নি, সেসব স্থান আকস্মিক বন্যায় প্লাবিত হলো। এসব জেলার লোকজনের বন্যার প্রস্তুতি ছিল না, তাদের নৌকা ছিল না। তারা জানত না বন্যা মোকাবেলার জন্য কী করতে হয়। ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেল, ক্ষেতের ফসল বিনষ্ট হলো, পথঘাট জলনিমগ্ন হয়ে খানাখন্দে ভরে গেল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভেঙে গেল, বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারল না। দেশের শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফসল বিনষ্ট হওয়ায়, বানের পানিতে বাড়িঘর তলিয়ে যাওয়ায় নিম্ন-মধ্যম ও মধ্যম আয়ের সচ্ছল পরিবারও দুর্বিষহ অসচ্ছলতায় নিমজ্জিত হয়েছে।

এর সঙ্গে এসে যুক্ত হলো চিকুনগুনিয়া নামের এক নতুন আপদ। সাধারণ বাংলাদেশিরা এ নামের কোনো ব্যাধির সঙ্গে পরিচিত ছিল না। শব্দটিও তারা জানত না। দু-চারজন শিক্ষিত লোক শব্দটি জানলেও তারা এর যন্ত্রণাদায়ক প্রয়োগ শক্তি সম্পর্কে অবহিত ছিল না। এর উত্পত্তিস্থল যে তানজানিয়ায় এ কথা প্রায় কেউ জানত না বললেই চলে। এটিকে খারাপ মন্তব্যের সহায়ক শব্দ হিসেবে তারা দেখত। যেমন—কোনো সভা-সম্মেলনে অপরিচিত এক লোক হয়তো দৃষ্টিকটুভাবে মাতবরি করছে। তখন সামনে বসা উদ্যোক্তাদের কেউ মন্তব্য করে বসবে, ‘Who is this bloody chikungunya?’ ওই পর্যন্তই। রোগটি যে পুরো বাংলাদেশের জনগণকে এমন বিশ্রীভাবে ভোগাবে, তা তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। ব্যক্তির কর্মক্ষমতা ও উৎপাদন সংহারক যন্ত্রণাদায়ক রোগটি আক্রমণ করে বসল দেশের লাখ লাখ লোককে। উচ্চমাত্রার জ্বর ও গ্রন্থিসন্ধিতে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে কাতরাতে থাকল সবল-সতেজ কর্মক্ষম মানুষ। বলা হলো এক ধরনের মশা (এডিস মশা) এ রোগের মূল বাহন। এদের থেকে সতর্ক থাকতে হবে। প্রশ্ন হলো, কিভাবে সতর্ক থাকতে হবে? এর কোনো বাস্তবসম্মত উপায় পাওয়া গেল না। কর্মশক্তি হারিয়ে দুর্বিষহ যন্ত্রণা সহ্য করে দেশের মানুষ সময় কাটাল। আর এ সব কিছু ঘটল এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে। পুরো আপদটি ছিল মানুষের আয়ত্তের বাইরে। অপ্রতিরোধ্য দুর্ভাগ্য হিসেবে নাগরিকরা এটি মেনে নিল। ডেঙ্গুর প্রকোপও দেখা দিল একই সময়ে। দুইয়ে মিলে দেশের মানুষ এবং তাদের কর্মক্ষমতা ভীষণরূপে পর্যুদস্ত হলো।

কয়েক মাস ধরে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ অপরাধীদের নৃশংসতা সব সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। পারিবারিক পর্যায়ে যে ধরনের খুন, যৌনসন্ত্রাস ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে, তা বর্ণনা করতে গেলে গা রি রি করে ওঠে। মা-বাবা সন্তানকে খুন করছে, সন্তান মা-বাবাকে খুন, শিশুকে গুম করে মেরে ফেলছে, তার ওপর অমানবিক নিপীড়ন চালাচ্ছে। যে ঘটনা কল্পনা করা যায় না, বাস্তবে তা-ই ঘটছে। স্ত্রীকে খুন করে স্বামী তার পাশে ঘুমিয়ে ছিল। এসব দেখে এক কলামিস্ট লিখেছিলেন, ‘আমরা কি দলে দলে মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছি?’ রাজন হত্যা, রাকিব হত্যা, সাগর হত্যার মতো ডজন ডজন শিশু-কিশোর কিংবা তরুণীর হত্যা আমাদের রাগে-শোকে অন্ধ করে দেয়। আমরা ভাবি হয়েছেটা কী? আমরা কি পশুর স্তরে নেমে গেছি? মনে হয় পাপাচারের কোনো অদৃশ্য শক্তি আমাদের নিচে নামিয়ে নিচ্ছে। টেনেহিঁচড়ে, পাথর মেরে সমাজকে তছনছ করে দিচ্ছে। সব অপরাধ যেন আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ‘জেনেটিক’ সমস্যার কারণে এমন হচ্ছে। এরা যতটা অপরাধী, তার থেকে বেশি মানসিক রোগী। আমরা নিয়তিসৃষ্ট দুর্ভাগ্যের শিকার।

আমাদের দুর্ভাগ্যের ভারকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে মেয়র আনিসের আকস্মিক অসুস্থতা। ঢাকা মহানগরীকে দুই ভাগ করার ফলে মেয়র আনিস বলতে ঢাকা উত্তরের মেয়রকে বোঝায়। বহুদিন পর ঢাকা মহানগরের জন্য আমরা একজন আধুনিক, উদ্যোগী, বিপুল প্রাণশক্তির অধিকারী, যৌবনদীপ্ত, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বকে মেয়র হিসেবে পেয়েছিলাম। মেয়র নির্বাচন নিয়ে বহু প্রশ্ন থাকলেও আনিস সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। তিনি আমাদের ভাষা বুঝতেন, আমরাও সহজে তাঁর ভাষা বুঝতাম। ফলে নগরীর উন্নয়নমূলক আলোচনা, নাগরিকের কল্যাণ পরিকল্পনার বর্ণনা শেষ পর্যন্ত প্রাণবন্ত আড্ডায় রূপ নিত। আমরা মনের আনন্দে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। সেই আনিস হঠাৎ করে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বিদেশের হাসপাতালে বাকহীন ব্যক্তি হিসেবে শয্যাশায়ী হয়ে রইলেন। আমরা জানি না কবে তিনি সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন, নগর-নাগরিকের উন্নয়নে আবার কাজ শুরু করবেন। সবচেয়ে বড় কথা, আমরা জানি না, কেন এমন হলো। কেন এই দুর্ভাগ্য, এই সর্বনাশ আমাদের ওপর এসে পড়ল। এই বিপদের মুখে আমরা শুধু আল্লাহর কাছে কায়মনো বাক্যে আনিসের রোগ মুক্তির জন্য প্রার্থনা করতে পারি।

সব শেষে এলো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের দুর্যোগ। হঠাৎ করে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো আগস্টের শেষ সপ্তাহে শুরু করে মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চল থেকে লাখ লাখ নির্যাতিত, উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা আমাদের উখিয়া, টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ঢুকে পড়ল। নতুনভাবে ঢুকে পড়া রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখের কাছাকাছি। আগের বছরগুলোতে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। সব মিলিয়ে দেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১০-১১ লাখ। শূন্য আকাশ থেকে পড়া এই বিপদের জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত ছিল না। সমস্যাটি মিয়ানমারের। সে দেশের শাসকরা এককভাবে নিজেদের স্বৈরাচার ও অপপরিকল্পনা প্রয়োগ করে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নিধনের মাধ্যমে এ সমস্যা সৃষ্টি করেছে। তাদের নৃশংস আক্রমণে রোহিঙ্গারা বাস্তুচ্যুত হয়েছে। দুর্ভাগ্য, এর অভিঘাত এসে পড়েছে বাংলাদেশের ওপর। এত লোককে আশ্রয় দান এবং এদের ভরণ-পোষণ বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের প্রশাসন ও অর্থনীতির ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ছে। বড় কষ্টে আমরা তা সহ্য করছি। এ ভার আমরা কত দিন বইতে পারব, তা বলা মুশকিল। আমাদের কষ্টের ফিরিস্তি না বাড়িয়ে শুধু এটুকু বলা প্রাসঙ্গিক হবে যে এ সমস্যার উেস বাংলাদেশের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ভিন্ন দেশে সৃষ্ট সমস্যা দৈবদুর্বিপাকের মতো আকস্মিকভাবে প্রচণ্ড শক্তিতে আমাদের আঘাত করেছে। আমরা তাল-বেতাল।

ওপরের ঘটনাগুলো থেকে মনে হচ্ছে, এ বছর আমরা কোনো এক অপশক্তির কবলে পড়েছি। ধর্মীয় বিশ্বাস, পরাবাস্তবতায় বিশ্বাস, কুসংস্কার বোধে আমরা এ বিপদকে গজব, নেমেসিস, অভিশাপ, কুফা—এরূপ নানা শব্দ ব্যবহার করে প্রকাশ করতে পারি। আবার নানারূপে এর কার্যকারণ ব্যাখ্যা করতে পারি। তবে শেষ কথা হচ্ছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের এত উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও আমরা সব বিপদাপদের পূর্বাভাস এখনো নিখুঁতভাবে প্রক্ষেপণ করতে পারি না, দুর্যোগ এসে পড়লে প্রায়ই একে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ বা মোকাবেলা করতে পারি না। কোনো এক (অদৃষ্ট) মহাশক্তির কাছে আমরা নতি স্বীকার করি। তার কাছে আমরা আশ্রয় চাই।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

নেমেসিস আমাদের ওপর ভর করেছে

আপডেট টাইম : ০৬:৫১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ অক্টোবর ২০১৭

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ একটি দৈনিক পত্রিকার খবরের শিরোনাম এবং এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ উদ্ধৃত করে শুরু করছি। খবরটি নিম্নরূপ : কাঁচা মরিচের কেজি ৩০০, শিম ২০০ টাকা : বরগুনার আমতলী ও তালতলী উপজেলায় সবজির দাম তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

অতিবৃষ্টিতে ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় সবজির গাছ পচে গেছে। চাহিদার তুলনায় জোগান কম হওয়ায় বাজারে সবজির প্রচুর সংকট দেখা দিয়েছে। এ সুবাদে ব্যবসায়ীরা তিন গুণ দামে সবজি বিক্রি করছে, আর ক্রেতারা কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। এদিকে সবজি চাষিদের সর্বনাশ। আমতলী উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, আমতলী ও তালতলী উপজেলায় এ বছর সবজির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭০০ হেক্টর। বছরের শুরুতে সবজির ভালো ফলন হয়েছিল। দামও ছিল ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে; কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অতিবর্ষণে জলাবদ্ধতার কারণে সবজিক্ষেত পচে তেমন ফসল পাওয়া যাচ্ছে না। বাজারে সবজির সংকট ও উত্তরাঞ্চল থেকে তেমন সবজি না আসায় দাম কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। জলাবদ্ধতায় সবজিক্ষেত তলিয়ে গাছ পচে যাওয়ায় চাষিদের ব্যাপক সর্বনাশ হয়েছে।কাউনিয়া গ্রামের কৃষক জামাল হোসেন জানান, ৩০ হাজার টাকা খরচ করে ৬৪ শতাংশ জমিতে সবজি চাষ করেছিলেন। কিন্তু বৃষ্টিতে ক্ষেতের সব গাছ পচে গেছে। তিনি আরো জানান, এ বছর ৩০ হাজার টাকাই লোকসান।

গতকাল শুক্রবার আমতলী, বাঁধঘাট ও তালুকদারবাজার ঘুরে দেখা গেছে, কাঁচা মরিচ ৩০০ টাকা, শিম ২০০, লালশাক ৭০-৮০, করলা ৬০-৭০, ঢেঁড়স ৬০-৭০, মিনা ৫০-৬০, বরবটি ৫০-৬০, মিষ্টি কুমড়া ৩৫-৪০, পটোল ৫০-৬০, রেহা ৪০-৫০ ও মুলা ৫০-৫৫ টাকা কেজিতে এবং এক কেজি ওজনের ছোট লাউ ৬০-৭০, দেড় কেজি ওজনের বড় লাউ ৯০-১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বিজ্ঞানের এত উন্নতির পরও যে কয়েকটি বিষয়ে মানুষ আজও চরম অসহায় আবহাওয়া-জলবায়ু তার মধ্যে অন্যতম প্রধান। আরো কিছু দৈবদুর্বিপাক যেমন—ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত, দাবানল, জলোচ্ছ্বাস, সুনামির ক্ষেত্রেও মানুষের বড় কিছু করার নেই। তারা বড়জোর ক্ষতির পরিমাণ কমানোর চেষ্টা করতে পারে। আজকের দিনেও এ কথা পুরোপুরি সত্য যে কৃষি উৎপাদন প্রায় সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতি তথা জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা-বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ত জোয়ার ফসল বিনষ্ট করে, কৃষকের সর্বনাশ করে। এসবের বিরুদ্ধে কোনো সুরক্ষা নেই বললেই চলে। কৃষক একে দুর্ভাগ্য হিসেবে মেনে নেয়।

এ বছর (২০১৭ সালে) প্রকৃতির রোষানলে পড়েছে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন। সেই মার্চ থেকে শুরু হয়েছে প্রকৃতির তাণ্ডব। প্রথমে আক্রান্ত হয় সুনামগঞ্জ জেলা। আগাম বন্যার আকস্মিক তোড়ে বিল-ঝিল, মাঠ-ঘাট সব তলিয়ে গেল। ভেসে গেল কুঁড়েঘর, টংঘর। ক্ষেতের ফসল ছিন্নভিন্ন হয়ে পানির নিচে পচে গেল। পানি বিষাক্ত হয়ে মাছ মরে গেল। সুনামগঞ্জের জমি একফসলি। সে ফসল নষ্ট হওয়ায় কৃষকের মাথায় হাত। তারা দিশাহারা। বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ফসল হারিয়ে শুধু কৃষকই সর্বস্বান্ত হলো না, দেশের মানুষ ও অর্থনীতি সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। বাজারে চালের সরবরাহ কমে যাওয়ায় চালের দাম বাড়তে শুরু করল। সুনামগঞ্জের ‘বাঁশফুল’ চালের দাম শেষ পর্যন্ত ৭০ টাকা কেজিতে গিয়ে ঠেকল, যা অন্যান্য বছর ৪০-৪৫ টাকার ওপরে ওঠেনি।

এবার মার্চ (২০১৭) থেকেই অল্পবিস্তর বৃষ্টি হচ্ছে। মে-জুন মাসে বৃষ্টির প্রকোপ বাড়তে থাকে। আমি একটি ছোট্ট প্লটে নিজ হাতে বা নিজের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরীক্ষামূলকভাবে চাষাবাদ করি। জুন মাস থেকে আমি প্লট পরিষ্কার করে মাটি কুপিয়ে চারা-বীজ রোপণ করার চেষ্টা করছি; কিন্তু পারছি না। বড়জোর দুই দিন একটু রোদ হয়। তার পরই বৃষ্টি। সব ধুয়ে-মুছে ভেসে যায়। বীজ গজায় না; ছোট চারাগাছ পচে যায়। অবশেষে রণেভঙ্গ দিয়ে চুপচাপ রয়েছি। নভেম্বর মাস থেকে হয়তো আবার কিছু করার চেষ্টা করব। দেখা যাক আবহাওয়ার অবস্থা কী হয়। আমার ধারণা, সব কৃষকের একই অবস্থা। বন্ধুবান্ধবের মধ্যে যাদের প্লটের অবস্থান একটু দূরে, তারা প্লটে যেতেই পারছে না। একদিকে বৃষ্টিবাদলা; অন্যদিকে রাস্তাঘাট খনাখন্দে ভরা, চলাচলের অনুপযোগী। এবার দেশের অনেক তরিতরকারির মাঠ বিরান হয়ে আছে। যদি আবহাওয়া অনুকূল থাকে, তবে নভেম্বর মাসের শেষ দিকে কিছু তরকারি বাজারে আসতে পারে। দৈবদুর্যোগে দেশে তরিতরকারির চাষাবাদ বিধ্বস্ত হয়েছে। আমাদের সর্বনাশ।

সুনামগঞ্জে বন্যার পর এলো পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ধস। প্রায় দেড় শ লোক মারা গেল। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর সদস্য চারজন। পাহাড়ি অঞ্চলে যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে রইল বেশ কয়েক দিন। যোগাযোগব্যবস্থা এখনো আগের পর্যায়ে এসেছে বলে মনে হয় না। অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে কেটেছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন। কারো কিছু করার ছিল না; সবই ছিল দৈবদুর্যোগ। সরকারি ত্রাণে হয়তো বা কিছুটা বিরান ক্ষুধা নিবৃত্ত হয়েছে। কিন্তু স্বজন হারানোর বেদনা, সম্পদ হারানোর বেদনা কিভাবে লাঘব হবে। এ যে লাগব হওয়ার নয়। সে দুঃখ আজও বয়ে বেড়াচ্ছে পার্বত্য এলাকার লোকজন। বয়ে বেড়াবে সারা জীবন।

পাহাড়ধসের পরই এলো উত্তরাঞ্চলে আকস্মিক বন্যা। যেসব জেলা-উপজেলায় আগে কখনো বন্যা দেখা যায়নি, সেসব স্থান আকস্মিক বন্যায় প্লাবিত হলো। এসব জেলার লোকজনের বন্যার প্রস্তুতি ছিল না, তাদের নৌকা ছিল না। তারা জানত না বন্যা মোকাবেলার জন্য কী করতে হয়। ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেল, ক্ষেতের ফসল বিনষ্ট হলো, পথঘাট জলনিমগ্ন হয়ে খানাখন্দে ভরে গেল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভেঙে গেল, বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারল না। দেশের শস্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফসল বিনষ্ট হওয়ায়, বানের পানিতে বাড়িঘর তলিয়ে যাওয়ায় নিম্ন-মধ্যম ও মধ্যম আয়ের সচ্ছল পরিবারও দুর্বিষহ অসচ্ছলতায় নিমজ্জিত হয়েছে।

এর সঙ্গে এসে যুক্ত হলো চিকুনগুনিয়া নামের এক নতুন আপদ। সাধারণ বাংলাদেশিরা এ নামের কোনো ব্যাধির সঙ্গে পরিচিত ছিল না। শব্দটিও তারা জানত না। দু-চারজন শিক্ষিত লোক শব্দটি জানলেও তারা এর যন্ত্রণাদায়ক প্রয়োগ শক্তি সম্পর্কে অবহিত ছিল না। এর উত্পত্তিস্থল যে তানজানিয়ায় এ কথা প্রায় কেউ জানত না বললেই চলে। এটিকে খারাপ মন্তব্যের সহায়ক শব্দ হিসেবে তারা দেখত। যেমন—কোনো সভা-সম্মেলনে অপরিচিত এক লোক হয়তো দৃষ্টিকটুভাবে মাতবরি করছে। তখন সামনে বসা উদ্যোক্তাদের কেউ মন্তব্য করে বসবে, ‘Who is this bloody chikungunya?’ ওই পর্যন্তই। রোগটি যে পুরো বাংলাদেশের জনগণকে এমন বিশ্রীভাবে ভোগাবে, তা তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। ব্যক্তির কর্মক্ষমতা ও উৎপাদন সংহারক যন্ত্রণাদায়ক রোগটি আক্রমণ করে বসল দেশের লাখ লাখ লোককে। উচ্চমাত্রার জ্বর ও গ্রন্থিসন্ধিতে প্রচণ্ড ব্যথা নিয়ে কাতরাতে থাকল সবল-সতেজ কর্মক্ষম মানুষ। বলা হলো এক ধরনের মশা (এডিস মশা) এ রোগের মূল বাহন। এদের থেকে সতর্ক থাকতে হবে। প্রশ্ন হলো, কিভাবে সতর্ক থাকতে হবে? এর কোনো বাস্তবসম্মত উপায় পাওয়া গেল না। কর্মশক্তি হারিয়ে দুর্বিষহ যন্ত্রণা সহ্য করে দেশের মানুষ সময় কাটাল। আর এ সব কিছু ঘটল এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে। পুরো আপদটি ছিল মানুষের আয়ত্তের বাইরে। অপ্রতিরোধ্য দুর্ভাগ্য হিসেবে নাগরিকরা এটি মেনে নিল। ডেঙ্গুর প্রকোপও দেখা দিল একই সময়ে। দুইয়ে মিলে দেশের মানুষ এবং তাদের কর্মক্ষমতা ভীষণরূপে পর্যুদস্ত হলো।

কয়েক মাস ধরে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ অপরাধীদের নৃশংসতা সব সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। পারিবারিক পর্যায়ে যে ধরনের খুন, যৌনসন্ত্রাস ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে, তা বর্ণনা করতে গেলে গা রি রি করে ওঠে। মা-বাবা সন্তানকে খুন করছে, সন্তান মা-বাবাকে খুন, শিশুকে গুম করে মেরে ফেলছে, তার ওপর অমানবিক নিপীড়ন চালাচ্ছে। যে ঘটনা কল্পনা করা যায় না, বাস্তবে তা-ই ঘটছে। স্ত্রীকে খুন করে স্বামী তার পাশে ঘুমিয়ে ছিল। এসব দেখে এক কলামিস্ট লিখেছিলেন, ‘আমরা কি দলে দলে মানসিক রোগী হয়ে যাচ্ছি?’ রাজন হত্যা, রাকিব হত্যা, সাগর হত্যার মতো ডজন ডজন শিশু-কিশোর কিংবা তরুণীর হত্যা আমাদের রাগে-শোকে অন্ধ করে দেয়। আমরা ভাবি হয়েছেটা কী? আমরা কি পশুর স্তরে নেমে গেছি? মনে হয় পাপাচারের কোনো অদৃশ্য শক্তি আমাদের নিচে নামিয়ে নিচ্ছে। টেনেহিঁচড়ে, পাথর মেরে সমাজকে তছনছ করে দিচ্ছে। সব অপরাধ যেন আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ‘জেনেটিক’ সমস্যার কারণে এমন হচ্ছে। এরা যতটা অপরাধী, তার থেকে বেশি মানসিক রোগী। আমরা নিয়তিসৃষ্ট দুর্ভাগ্যের শিকার।

আমাদের দুর্ভাগ্যের ভারকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে মেয়র আনিসের আকস্মিক অসুস্থতা। ঢাকা মহানগরীকে দুই ভাগ করার ফলে মেয়র আনিস বলতে ঢাকা উত্তরের মেয়রকে বোঝায়। বহুদিন পর ঢাকা মহানগরের জন্য আমরা একজন আধুনিক, উদ্যোগী, বিপুল প্রাণশক্তির অধিকারী, যৌবনদীপ্ত, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বকে মেয়র হিসেবে পেয়েছিলাম। মেয়র নির্বাচন নিয়ে বহু প্রশ্ন থাকলেও আনিস সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। তিনি আমাদের ভাষা বুঝতেন, আমরাও সহজে তাঁর ভাষা বুঝতাম। ফলে নগরীর উন্নয়নমূলক আলোচনা, নাগরিকের কল্যাণ পরিকল্পনার বর্ণনা শেষ পর্যন্ত প্রাণবন্ত আড্ডায় রূপ নিত। আমরা মনের আনন্দে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। সেই আনিস হঠাৎ করে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে বিদেশের হাসপাতালে বাকহীন ব্যক্তি হিসেবে শয্যাশায়ী হয়ে রইলেন। আমরা জানি না কবে তিনি সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন, নগর-নাগরিকের উন্নয়নে আবার কাজ শুরু করবেন। সবচেয়ে বড় কথা, আমরা জানি না, কেন এমন হলো। কেন এই দুর্ভাগ্য, এই সর্বনাশ আমাদের ওপর এসে পড়ল। এই বিপদের মুখে আমরা শুধু আল্লাহর কাছে কায়মনো বাক্যে আনিসের রোগ মুক্তির জন্য প্রার্থনা করতে পারি।

সব শেষে এলো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের দুর্যোগ। হঠাৎ করে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো আগস্টের শেষ সপ্তাহে শুরু করে মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চল থেকে লাখ লাখ নির্যাতিত, উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা আমাদের উখিয়া, টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ঢুকে পড়ল। নতুনভাবে ঢুকে পড়া রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে পাঁচ লাখের কাছাকাছি। আগের বছরগুলোতে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। সব মিলিয়ে দেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১০-১১ লাখ। শূন্য আকাশ থেকে পড়া এই বিপদের জন্য বাংলাদেশ প্রস্তুত ছিল না। সমস্যাটি মিয়ানমারের। সে দেশের শাসকরা এককভাবে নিজেদের স্বৈরাচার ও অপপরিকল্পনা প্রয়োগ করে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নিধনের মাধ্যমে এ সমস্যা সৃষ্টি করেছে। তাদের নৃশংস আক্রমণে রোহিঙ্গারা বাস্তুচ্যুত হয়েছে। দুর্ভাগ্য, এর অভিঘাত এসে পড়েছে বাংলাদেশের ওপর। এত লোককে আশ্রয় দান এবং এদের ভরণ-পোষণ বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের প্রশাসন ও অর্থনীতির ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ছে। বড় কষ্টে আমরা তা সহ্য করছি। এ ভার আমরা কত দিন বইতে পারব, তা বলা মুশকিল। আমাদের কষ্টের ফিরিস্তি না বাড়িয়ে শুধু এটুকু বলা প্রাসঙ্গিক হবে যে এ সমস্যার উেস বাংলাদেশের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ভিন্ন দেশে সৃষ্ট সমস্যা দৈবদুর্বিপাকের মতো আকস্মিকভাবে প্রচণ্ড শক্তিতে আমাদের আঘাত করেছে। আমরা তাল-বেতাল।

ওপরের ঘটনাগুলো থেকে মনে হচ্ছে, এ বছর আমরা কোনো এক অপশক্তির কবলে পড়েছি। ধর্মীয় বিশ্বাস, পরাবাস্তবতায় বিশ্বাস, কুসংস্কার বোধে আমরা এ বিপদকে গজব, নেমেসিস, অভিশাপ, কুফা—এরূপ নানা শব্দ ব্যবহার করে প্রকাশ করতে পারি। আবার নানারূপে এর কার্যকারণ ব্যাখ্যা করতে পারি। তবে শেষ কথা হচ্ছে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের এত উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও আমরা সব বিপদাপদের পূর্বাভাস এখনো নিখুঁতভাবে প্রক্ষেপণ করতে পারি না, দুর্যোগ এসে পড়লে প্রায়ই একে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ বা মোকাবেলা করতে পারি না। কোনো এক (অদৃষ্ট) মহাশক্তির কাছে আমরা নতি স্বীকার করি। তার কাছে আমরা আশ্রয় চাই।