ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাঙালি মুসলমানের ধর্ম কি কোনোভাবেই আক্রান্ত

এর আগের একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে, গত ১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় ঘটে যাওয়া ঘটনার আগের বাংলাদেশ আর তার পরের বাংলাদেশ আসলে কোনো ভাবেই এক নয়। যেমন এক নয় ’৭৫-এর ১৫ই আগস্টের আগের বাংলাদেশ আর তার পরের বাংলাদেশ। আমার সে লেখা পাঠ করে যারা গালাগাল দিয়েছিলেন তাদের মূল কথা ছিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার পরে বাংলাদেশ কেন বদলে গেছে, তার কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই কেন আমি এরকম একটি উপসংহার টেনেছিলাম।

আজকেও সে ব্যাখ্যা দেবো না, কারণ, ১৫ই আগস্টের পরে বাংলাদেশের জাতীয়/রাজনৈতিক/সামাজিক/ব্যক্তিগত সকল সমীকরণই বদলে গিয়েছিল, উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করেছিল বাংলাদেশ- এই বোধ আসলে তৈরি করে দেওয়ার মতো নয়, এই বোধ তৈরি হওয়ার কথা মানুষের ভেতর। সেটি ব্যাপকভাবে হয়নি, একথা সত্য। না হওয়ার কারণ নানাবিধ, প্রথমত. রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে বদলে ফেলা হয়েছিল এবং সাধারণ্যের নাগালের বাইরে নিয়ে আসা হয়েছিল রাজনীতিকে। একটি নতুন শ্রেণির জন্ম দেয়া হয়েছিল যাদেরকে অর্থ উপার্জনের সুযোগ দিয়ে ঢাকার বাইরে ঢাকার আধিপত্য বজায় রাখার কারবার শুরু হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক-ব্যবসায়ী শ্রেণি তৈরি হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থের প্রয়োজনটি তারা মিটিয়ে থাকে আর বিনিময়ে তারা সরকারের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে ফুলে-ফেঁপে বেড়ে ওঠে। এটা কেবল বাংলাদেশের সংস্কৃতি নয়, খোদ আমেরিকার মতো দেশ যাকে গণতন্ত্রের “কারখানা” বলে লোকে ভুল করে সেখানেও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে ফান্ড গঠন করা হয় তা দিয়ে কয়েকটি বাংলাদেশ কেনা যায়।

যেমন ধরুন, হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনী ফান্ড-এর দিকে তাকিয়ে দেখুন, প্রায় বিলিওনেরও ওপরে এই অর্থ কী কাজে ব্যয় হবে? নির্বাচনে। কারা দিয়েছেন এই অর্থ? বিভিন্ন মাল্টি ন্যাশনাল থেকে শুরু করে এনজিও-নেতারা পর্যন্ত টাকা ঢেলেছেন হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনী ফান্ডে (সেখানে আমাদের শান্তির দূত-এর নামও আছে অর্থদাতাদের তালিকায়)। কী চান তারা? কেন অর্থ দিলেন? যেনো হিলারি ক্লিনটন নির্বাচিত হয়ে এলে তাদেরকে সুযোগ-সুবিধা করে দিতে পারেন, এইতো? বাংলাদেশ গরীব বলে ভোটারদের সরাসরি অর্থ দিয়ে কেনা যায় কিন্তু আমেরিকার মতো ধনী দেশের জনগণকে সরাসরি কেনা যায় কিনা তা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ নির্বাচনী-ফান্ড দিয়ে আসলে প্রকারান্তরে ভোটই কেনা হয়, তারপরও আমরা বলি যে, গণতন্ত্র টিকে আছে কেবল আমেরিকায় আর ব্রিটেনে। বিস্ময়কর, নয়?

দুঃখিত মূল আলোচনা থেকে সরে যাওয়ার জন্য। বাংলাদেশে আমরা এখন একটি বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। এই বিপর্যয় যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের তুলনায় কোনো অংশেই কম নয়। কারণ, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের লড়াইকে আমরা যেদিন থেকে “ধর্মযুদ্ধ” হিসেবে একপ্রকার মেনে নিতে শুরু করেছি সেদিন থেকেই এই বিপর্যয়ের মধ্যে আমরা পড়েছি। এর অনেকটা আমাদের জাতীয় ভুলের কারণে, অনেকটা আমাদের জাতীয় দ্বি-মুখী চরিত্রের কারণে এবং জাতীয়ভাবেই আমাদের ভেতর তীব্র দেশপ্রেমের অভাবের কারণে। যে বাকশাল কার্যকরই হয়নি, সেই বাকশাল-এর জন্য বঙ্গবন্ধুকে দোষী করে আমরা সেনা শাসকের হাতে “বহুদলীয় গণতন্ত্র” ফিরিয়ে আনার কৃতিত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকি অথচ আমরা এটুকু বুঝতে ব্যর্থ হই যে, এই বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে সেনা শাসক আসলে স্বাধীনতা-বিরোধী, রাজাকার, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিকে বাংলাদেশে স্থায়ীত্ব দেন। যে কোনো হত্যাকাণ্ডকে পাপ ও অপরাধ হিসেবে মেনে নেওয়ার স্বাভাবিক ও স্বতঃসিদ্ধ প্রবণতাকে আমরা এড়িয়ে গিয়ে এলোমেলো প্রশ্ন দিয়ে হত্যাকাণ্ডকে বৈধ করার চেষ্টা করি। এই প্রবণতা সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা থেকে শুরু করে, সেনাবাহিনীর ভেতর অকাতরে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, সেনা শাসককে হত্যা হয়ে আজকের জঙ্গীদের হাতে ঘটা হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেও সমান সত্য।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল কেন? কতিপয় বিপথগামী সেনা সদস্য তাকে হত্যা করে কারণ বঙ্গবন্ধুর ছেলে এক সেনা কর্মকর্তার স্ত্রীকে অপমান করেছিলেন!! যে কর্নেল তাহের জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতায় বসালেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেশকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিলেন, সেনা আদালতে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে তাকে হত্যা করা হলো কেন? পাছে তাকেও ক্ষমতার ভাগ দিতে হয় আর জিয়া ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন। আজকে জঙ্গীরা আদৌ জঙ্গী কিনা তা নিয়ে দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে যখন প্রশ্ন তোলা হয়, যখন বলা হয় যে, একাত্তরকে ভুলে যেতে কিংবা দলটির নেত্রী যখন একাত্তরে নিহত বাঙালির সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তখন আমাদের জাতীয় চরিত্র ভেঙে খান খান হয়ে যায়, একেকটি খণ্ডাংশ একেকটি ভয়ঙ্কর মুখোশ হয়ে আমাদের দিকেই ছুঁড়ে দেয় বিদ্রূপের হাসি এবং শেষ পর্যন্ত জাতি হিসেবে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হই চরমভাবে।

ধরুন যে বিপর্যয়কাল আমরা এই মুহূর্তে অতিক্রম করছি তা কি এড়ানো যেতো? অবশ্যই যেতো। ইতিহাসে এরকম বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে যাওয়া জাতির উদাহরণ আমাদের সামনেই রয়েছে। এমনকি বাঙালির ফেলে আসা খোলস পাকিস্তানের দিকে তাকান, দেখবেন, পাকিস্তান ঠিক এভাবেই জাতীয় ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন তুলে জাতিকে বিভ্রান্ত করে এগিয়েছে এবং এখন এসে তার মাশুল দিচ্ছে। ভুল ইতিহাস শিখিয়েছে সন্তানদের পাকিস্তান, এই ভূখণ্ড যে এক সময় অন্য ধর্মের মানুষের ছিল এবং আরব থেকে ইসলাম এসে এই ভূখণ্ডে শেকড় গেড়েছে এই সত্যকে আড়াল করে ইতিহাস রচনা করে একটা ফাঁপা শক্তিমত্তার গল্প শোনানো হয়েছে। এমনকি হাস্যকর সংখ্যার ঘোরসওয়ার নিয়ে “কাফেরদের” হাত থেকে ভূখণ্ড দখলের যে ইতিহাস আমাদের পড়ানো হয়েছে তার নেতিবাচক প্রভাব জাতির ওপর পড়বে না, এটা যারা মনে করেন, তাদের সত্যি সত্যিই অসুস্থ বলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। এখানে কোনো সম্মিলনের গল্প কেউ শোনান নাই কোনোদিন, কেবল বিচ্ছিন্নতার গল্পই আমরা জানি বা জেনেছি। ভারতবর্ষের মতো বিশাল ভূখণ্ড বিচ্ছিন্ন হতে হতে কতগুলো দেশ তৈরি হয়েছে এবং তাতেও শেষ হয়নি, যে কোনো মুহূর্তে পাকিস্তান ভেঙে নতুন টুকরো হলো বলে আর পাকিস্তান এখনও স্বপ্ন দেখে (এমনকি বাঙালি মুসলমানের মধ্যে এই স্বপ্নবাজদের সংখ্যা কম নেই) যে কোনো ভাবেই হোক ভারতকেও ভেঙে টুকরো টুকরো করার। অপরদিকে বাঙালি মুসলমানের বিখ্যাত সন্তানদের কেউ কেউ আবার ভারতবর্ষের মানচিত্রে একটি “খ্রীস্টান-প্রধান” রাষ্ট্র বানানোর কথাও আড়ে-ঠেড়ে বলে থাকেন। প্রশ্ন হলো, এই ক্রমশঃ বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রবণতার শেষ কোথায়? বা কে এই দায়িত্ব নেবেন? কাউকে দেখতে পান কোথাও? আমি অন্ততঃ পাইনে।

তবে একটি ভালো প্রবণতার কথা বলতেই হচ্ছে, তা হলো, ১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে যে নারকীয় ঘটনা ঘটেছে তারপর থেকে হলেও আমরা এর শেকড় খোঁজার চেষ্টা করছি কেউ কেউ। হয়তো এই পুরো বিস্ফোরণের ভেতর একমাত্র ইতিবাচক দিক এটাই। যে কোনো ভয়ঙ্কর ঘটনার পরে মানুষ প্রথমে থমকে যায়, তারপর দিকবিদ্বিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটোছুটি করে এবং তারপর পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে ঘটনার পরম্পরা ও কারণ অনুসন্ধানে ব্রতী হয়, বাঙালিও হয়তো সে কাজটি শুরু করেছে। অন্ততঃ প্রশ্নতো উঠতে শুরু করেছে সর্বত্র যে, কেন এই মানুষ খুন করে ধর্মরক্ষায় তরুণরা চাপাতি/বন্দুক হাতে নেমেছে? আর ধর্ম কখন, কোথায় কী ভাবে আক্রান্ত হলো? কার দ্বারাই বা আক্রান্ত হলো যে ধর্মকে রক্ষার জন্য আজকে চাপাতি/বন্দুক হাতে মানুষ হত্যায় নামতে হলো? মানুষ বড় নাকি ধর্ম বড়? মানুষের জন্য ধর্ম নাকি ধর্মের মতো চিন্তার ভেতর থাকা একটি আকারহীন বিষয়ের জন্যই মানুষের সৃষ্টি? এসব বিষয় যতোই আলোচিত হবে ততোই যে মঙ্গলের তাতো বলার অপেক্ষা রাখে না।

সবচেয়ে যে বড় প্রশ্নটি এই মুহূর্তে আমাদের সমবেত স্বরে উচ্চারণ করা প্রয়োজন তাহলো, বাঙালি মুসলমানের ধর্মবিশ্বাস কি আসলেই আক্রান্ত? নাকি উল্টো বাঙালি মুসলমান অন্যের ধর্মবিশ্বাসকে আক্রমণ করে তাদেরকে এদেশ ছাড়া করায় নেমেছে? যে মুসলমান মসজিদে কিংবা ঘরে বসে তার ধর্ম পালন করছেন তার বিশ্বাস কি কোনো ভাবেই আক্রান্ত নাকি রাষ্ট্র তাকে, কেবলমাত্র তাকেই নিরাপত্তা দিতে চতুর্পায়ে খাড়া হয়ে আছে? পক্ষান্তরে আক্রান্ত অমুসলিম কিংবা অবিশ্বাসীদের পাশে রাষ্ট্র কেন দাঁড়াচ্ছে না? কেন তাদেরকে চাপাতির মুখে ঠেলে দিয়েও রাষ্ট্র নিজের দায় অস্বীকার করে বলতে চাইছে যে, কারো ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দিলে তার দায় রাষ্ট্র নেবে না? তার মানে কেবল কি মুসলমানের ধর্মবিশ্বাসই বিশ্বাস, আর বাকিদের বিশ্বাসের কোনো মূল্যই নেই? এরকম হাজারো প্রশ্ন তোলা সম্ভব, তাতে লেখার কলেবর বৃদ্ধি ছাড়া নতুন কোনো ফল হবে না কারণ এসব প্রশ্ন এ লেখার পাঠকমাত্রেরই মনে উদয় হওয়ার কথা। কিন্তু হচ্ছে না কেন? সে কারণটা অনুসন্ধানই এখন সবার আগে প্রয়োজন।

যে কথা বলছিলাম, যেহেতু বাঙালি মুসলমানের ধর্মবিশ্বাস সকল দিক দিয়েই নিরাপদ ও রাষ্ট্রের দ্বারা, সংবিধানের দ্বারা, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারাও সুরক্ষিত সেহেতু এই জঙ্গীবাদ যে বাঙালি মুসলমানের ধর্মরক্ষার জন্য নয় সেটা বলাই বাহুল্য। তাহলে তাদের লক্ষ্য কি? কেউ যদি এখনও তাদের বক্তব্য না শুনে থাকেন তাহলে এখানে আবারও উল্লেখ করছি, তারা আসলে এখন রাষ্ট্র ক্ষমতার দখল চায় এবং মজার ব্যাপার হলো, তারা মানুষের শাসন চায় না, চায় আল্লাহর শাসন।

অতএব, এই সত্য আমাদের স্বীকার করে নেওয়া উচিত যে, যারা আমরা বলতে চাইছি যে, দেশে গণতন্ত্র নাই বলে এই জঙ্গীদের উত্থান ঘটেছে, তারা আসলে একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে সামনে এগুচ্ছি। আর রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলই যে তাদের উদ্দেশ্য, যেরকমটি আফগানিস্তানে হয়েছিল কিংবা পাকিস্তানে হওয়ার চেষ্টা চলছে কিংবা ধরুন, সিরিয়া ও ইরাকের একাংশ জুড়ে আইস-এর রাষ্ট্র, সকল ক্ষেত্রেই কিন্তু আল্লাহর শাসন কায়েম করার ধুয়া তুলে রক্তপাত ঘটিয়ে শাসনক্ষমতা দখল করে শেষ পর্যন্ত শাসনকর্তা কিন্তু সেই মানুষই এবং সেই রক্তপিপাসু, বিকৃতমনা মানুষগুলো কী ভাবে শাসন করছে তা কি আমাদের কারো অজানা? গলা কেটে মানুষ হত্যা, বিকৃত নারীভোগ আর নির্যাতন এবং অস্ত্র ও অর্থের বলে মধ্যযুগীয় বর্বরতার প্রচলন ছাড়া এইসব শাসনব্যবস্থার কোনো ভালো দিক কি এখনও কারো নজরে পড়েছে? আমার পড়েনি অন্তত। বাংলাদেশ যে পথে এগুচ্ছে তাতে এই জঙ্গীবাদীদের যদি সুযোগ সৃষ্টি হয় রাষ্ট্র-শাসনের তাহলে এদেশের অবস্থা আজকের সিরিয়া বা ইরাকের চেয়ে ভালো কিছু হবে এমন যারা ভাবছেন, তারা আসলেই বোকা কিংবা শয়তান-চালাক। গত সপ্তাহের লেখাটির সমাপ্তি এভাবেই টানতে চেয়েছিলাম। আশাকরি, ব্যাখ্যাটা দিতে পেরেছি আমি।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

বাঙালি মুসলমানের ধর্ম কি কোনোভাবেই আক্রান্ত

আপডেট টাইম : ০৬:০৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩ অগাস্ট ২০১৬

এর আগের একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলাম যে, গত ১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় ঘটে যাওয়া ঘটনার আগের বাংলাদেশ আর তার পরের বাংলাদেশ আসলে কোনো ভাবেই এক নয়। যেমন এক নয় ’৭৫-এর ১৫ই আগস্টের আগের বাংলাদেশ আর তার পরের বাংলাদেশ। আমার সে লেখা পাঠ করে যারা গালাগাল দিয়েছিলেন তাদের মূল কথা ছিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার পরে বাংলাদেশ কেন বদলে গেছে, তার কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই কেন আমি এরকম একটি উপসংহার টেনেছিলাম।

আজকেও সে ব্যাখ্যা দেবো না, কারণ, ১৫ই আগস্টের পরে বাংলাদেশের জাতীয়/রাজনৈতিক/সামাজিক/ব্যক্তিগত সকল সমীকরণই বদলে গিয়েছিল, উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করেছিল বাংলাদেশ- এই বোধ আসলে তৈরি করে দেওয়ার মতো নয়, এই বোধ তৈরি হওয়ার কথা মানুষের ভেতর। সেটি ব্যাপকভাবে হয়নি, একথা সত্য। না হওয়ার কারণ নানাবিধ, প্রথমত. রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে বদলে ফেলা হয়েছিল এবং সাধারণ্যের নাগালের বাইরে নিয়ে আসা হয়েছিল রাজনীতিকে। একটি নতুন শ্রেণির জন্ম দেয়া হয়েছিল যাদেরকে অর্থ উপার্জনের সুযোগ দিয়ে ঢাকার বাইরে ঢাকার আধিপত্য বজায় রাখার কারবার শুরু হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক-ব্যবসায়ী শ্রেণি তৈরি হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থের প্রয়োজনটি তারা মিটিয়ে থাকে আর বিনিময়ে তারা সরকারের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে ফুলে-ফেঁপে বেড়ে ওঠে। এটা কেবল বাংলাদেশের সংস্কৃতি নয়, খোদ আমেরিকার মতো দেশ যাকে গণতন্ত্রের “কারখানা” বলে লোকে ভুল করে সেখানেও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে ফান্ড গঠন করা হয় তা দিয়ে কয়েকটি বাংলাদেশ কেনা যায়।

যেমন ধরুন, হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনী ফান্ড-এর দিকে তাকিয়ে দেখুন, প্রায় বিলিওনেরও ওপরে এই অর্থ কী কাজে ব্যয় হবে? নির্বাচনে। কারা দিয়েছেন এই অর্থ? বিভিন্ন মাল্টি ন্যাশনাল থেকে শুরু করে এনজিও-নেতারা পর্যন্ত টাকা ঢেলেছেন হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনী ফান্ডে (সেখানে আমাদের শান্তির দূত-এর নামও আছে অর্থদাতাদের তালিকায়)। কী চান তারা? কেন অর্থ দিলেন? যেনো হিলারি ক্লিনটন নির্বাচিত হয়ে এলে তাদেরকে সুযোগ-সুবিধা করে দিতে পারেন, এইতো? বাংলাদেশ গরীব বলে ভোটারদের সরাসরি অর্থ দিয়ে কেনা যায় কিন্তু আমেরিকার মতো ধনী দেশের জনগণকে সরাসরি কেনা যায় কিনা তা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ নির্বাচনী-ফান্ড দিয়ে আসলে প্রকারান্তরে ভোটই কেনা হয়, তারপরও আমরা বলি যে, গণতন্ত্র টিকে আছে কেবল আমেরিকায় আর ব্রিটেনে। বিস্ময়কর, নয়?

দুঃখিত মূল আলোচনা থেকে সরে যাওয়ার জন্য। বাংলাদেশে আমরা এখন একটি বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। এই বিপর্যয় যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের তুলনায় কোনো অংশেই কম নয়। কারণ, রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের লড়াইকে আমরা যেদিন থেকে “ধর্মযুদ্ধ” হিসেবে একপ্রকার মেনে নিতে শুরু করেছি সেদিন থেকেই এই বিপর্যয়ের মধ্যে আমরা পড়েছি। এর অনেকটা আমাদের জাতীয় ভুলের কারণে, অনেকটা আমাদের জাতীয় দ্বি-মুখী চরিত্রের কারণে এবং জাতীয়ভাবেই আমাদের ভেতর তীব্র দেশপ্রেমের অভাবের কারণে। যে বাকশাল কার্যকরই হয়নি, সেই বাকশাল-এর জন্য বঙ্গবন্ধুকে দোষী করে আমরা সেনা শাসকের হাতে “বহুদলীয় গণতন্ত্র” ফিরিয়ে আনার কৃতিত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকি অথচ আমরা এটুকু বুঝতে ব্যর্থ হই যে, এই বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে সেনা শাসক আসলে স্বাধীনতা-বিরোধী, রাজাকার, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিকে বাংলাদেশে স্থায়ীত্ব দেন। যে কোনো হত্যাকাণ্ডকে পাপ ও অপরাধ হিসেবে মেনে নেওয়ার স্বাভাবিক ও স্বতঃসিদ্ধ প্রবণতাকে আমরা এড়িয়ে গিয়ে এলোমেলো প্রশ্ন দিয়ে হত্যাকাণ্ডকে বৈধ করার চেষ্টা করি। এই প্রবণতা সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা থেকে শুরু করে, সেনাবাহিনীর ভেতর অকাতরে মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, সেনা শাসককে হত্যা হয়ে আজকের জঙ্গীদের হাতে ঘটা হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেও সমান সত্য।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল কেন? কতিপয় বিপথগামী সেনা সদস্য তাকে হত্যা করে কারণ বঙ্গবন্ধুর ছেলে এক সেনা কর্মকর্তার স্ত্রীকে অপমান করেছিলেন!! যে কর্নেল তাহের জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতায় বসালেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দেশকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিলেন, সেনা আদালতে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে তাকে হত্যা করা হলো কেন? পাছে তাকেও ক্ষমতার ভাগ দিতে হয় আর জিয়া ক্ষমতাহীন হয়ে পড়েন। আজকে জঙ্গীরা আদৌ জঙ্গী কিনা তা নিয়ে দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে যখন প্রশ্ন তোলা হয়, যখন বলা হয় যে, একাত্তরকে ভুলে যেতে কিংবা দলটির নেত্রী যখন একাত্তরে নিহত বাঙালির সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তখন আমাদের জাতীয় চরিত্র ভেঙে খান খান হয়ে যায়, একেকটি খণ্ডাংশ একেকটি ভয়ঙ্কর মুখোশ হয়ে আমাদের দিকেই ছুঁড়ে দেয় বিদ্রূপের হাসি এবং শেষ পর্যন্ত জাতি হিসেবে আমরাই ক্ষতিগ্রস্ত হই চরমভাবে।

ধরুন যে বিপর্যয়কাল আমরা এই মুহূর্তে অতিক্রম করছি তা কি এড়ানো যেতো? অবশ্যই যেতো। ইতিহাসে এরকম বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে যাওয়া জাতির উদাহরণ আমাদের সামনেই রয়েছে। এমনকি বাঙালির ফেলে আসা খোলস পাকিস্তানের দিকে তাকান, দেখবেন, পাকিস্তান ঠিক এভাবেই জাতীয় ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন তুলে জাতিকে বিভ্রান্ত করে এগিয়েছে এবং এখন এসে তার মাশুল দিচ্ছে। ভুল ইতিহাস শিখিয়েছে সন্তানদের পাকিস্তান, এই ভূখণ্ড যে এক সময় অন্য ধর্মের মানুষের ছিল এবং আরব থেকে ইসলাম এসে এই ভূখণ্ডে শেকড় গেড়েছে এই সত্যকে আড়াল করে ইতিহাস রচনা করে একটা ফাঁপা শক্তিমত্তার গল্প শোনানো হয়েছে। এমনকি হাস্যকর সংখ্যার ঘোরসওয়ার নিয়ে “কাফেরদের” হাত থেকে ভূখণ্ড দখলের যে ইতিহাস আমাদের পড়ানো হয়েছে তার নেতিবাচক প্রভাব জাতির ওপর পড়বে না, এটা যারা মনে করেন, তাদের সত্যি সত্যিই অসুস্থ বলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। এখানে কোনো সম্মিলনের গল্প কেউ শোনান নাই কোনোদিন, কেবল বিচ্ছিন্নতার গল্পই আমরা জানি বা জেনেছি। ভারতবর্ষের মতো বিশাল ভূখণ্ড বিচ্ছিন্ন হতে হতে কতগুলো দেশ তৈরি হয়েছে এবং তাতেও শেষ হয়নি, যে কোনো মুহূর্তে পাকিস্তান ভেঙে নতুন টুকরো হলো বলে আর পাকিস্তান এখনও স্বপ্ন দেখে (এমনকি বাঙালি মুসলমানের মধ্যে এই স্বপ্নবাজদের সংখ্যা কম নেই) যে কোনো ভাবেই হোক ভারতকেও ভেঙে টুকরো টুকরো করার। অপরদিকে বাঙালি মুসলমানের বিখ্যাত সন্তানদের কেউ কেউ আবার ভারতবর্ষের মানচিত্রে একটি “খ্রীস্টান-প্রধান” রাষ্ট্র বানানোর কথাও আড়ে-ঠেড়ে বলে থাকেন। প্রশ্ন হলো, এই ক্রমশঃ বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রবণতার শেষ কোথায়? বা কে এই দায়িত্ব নেবেন? কাউকে দেখতে পান কোথাও? আমি অন্ততঃ পাইনে।

তবে একটি ভালো প্রবণতার কথা বলতেই হচ্ছে, তা হলো, ১ জুলাই গুলশানের হোলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে যে নারকীয় ঘটনা ঘটেছে তারপর থেকে হলেও আমরা এর শেকড় খোঁজার চেষ্টা করছি কেউ কেউ। হয়তো এই পুরো বিস্ফোরণের ভেতর একমাত্র ইতিবাচক দিক এটাই। যে কোনো ভয়ঙ্কর ঘটনার পরে মানুষ প্রথমে থমকে যায়, তারপর দিকবিদ্বিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটোছুটি করে এবং তারপর পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে ঘটনার পরম্পরা ও কারণ অনুসন্ধানে ব্রতী হয়, বাঙালিও হয়তো সে কাজটি শুরু করেছে। অন্ততঃ প্রশ্নতো উঠতে শুরু করেছে সর্বত্র যে, কেন এই মানুষ খুন করে ধর্মরক্ষায় তরুণরা চাপাতি/বন্দুক হাতে নেমেছে? আর ধর্ম কখন, কোথায় কী ভাবে আক্রান্ত হলো? কার দ্বারাই বা আক্রান্ত হলো যে ধর্মকে রক্ষার জন্য আজকে চাপাতি/বন্দুক হাতে মানুষ হত্যায় নামতে হলো? মানুষ বড় নাকি ধর্ম বড়? মানুষের জন্য ধর্ম নাকি ধর্মের মতো চিন্তার ভেতর থাকা একটি আকারহীন বিষয়ের জন্যই মানুষের সৃষ্টি? এসব বিষয় যতোই আলোচিত হবে ততোই যে মঙ্গলের তাতো বলার অপেক্ষা রাখে না।

সবচেয়ে যে বড় প্রশ্নটি এই মুহূর্তে আমাদের সমবেত স্বরে উচ্চারণ করা প্রয়োজন তাহলো, বাঙালি মুসলমানের ধর্মবিশ্বাস কি আসলেই আক্রান্ত? নাকি উল্টো বাঙালি মুসলমান অন্যের ধর্মবিশ্বাসকে আক্রমণ করে তাদেরকে এদেশ ছাড়া করায় নেমেছে? যে মুসলমান মসজিদে কিংবা ঘরে বসে তার ধর্ম পালন করছেন তার বিশ্বাস কি কোনো ভাবেই আক্রান্ত নাকি রাষ্ট্র তাকে, কেবলমাত্র তাকেই নিরাপত্তা দিতে চতুর্পায়ে খাড়া হয়ে আছে? পক্ষান্তরে আক্রান্ত অমুসলিম কিংবা অবিশ্বাসীদের পাশে রাষ্ট্র কেন দাঁড়াচ্ছে না? কেন তাদেরকে চাপাতির মুখে ঠেলে দিয়েও রাষ্ট্র নিজের দায় অস্বীকার করে বলতে চাইছে যে, কারো ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দিলে তার দায় রাষ্ট্র নেবে না? তার মানে কেবল কি মুসলমানের ধর্মবিশ্বাসই বিশ্বাস, আর বাকিদের বিশ্বাসের কোনো মূল্যই নেই? এরকম হাজারো প্রশ্ন তোলা সম্ভব, তাতে লেখার কলেবর বৃদ্ধি ছাড়া নতুন কোনো ফল হবে না কারণ এসব প্রশ্ন এ লেখার পাঠকমাত্রেরই মনে উদয় হওয়ার কথা। কিন্তু হচ্ছে না কেন? সে কারণটা অনুসন্ধানই এখন সবার আগে প্রয়োজন।

যে কথা বলছিলাম, যেহেতু বাঙালি মুসলমানের ধর্মবিশ্বাস সকল দিক দিয়েই নিরাপদ ও রাষ্ট্রের দ্বারা, সংবিধানের দ্বারা, এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারাও সুরক্ষিত সেহেতু এই জঙ্গীবাদ যে বাঙালি মুসলমানের ধর্মরক্ষার জন্য নয় সেটা বলাই বাহুল্য। তাহলে তাদের লক্ষ্য কি? কেউ যদি এখনও তাদের বক্তব্য না শুনে থাকেন তাহলে এখানে আবারও উল্লেখ করছি, তারা আসলে এখন রাষ্ট্র ক্ষমতার দখল চায় এবং মজার ব্যাপার হলো, তারা মানুষের শাসন চায় না, চায় আল্লাহর শাসন।

অতএব, এই সত্য আমাদের স্বীকার করে নেওয়া উচিত যে, যারা আমরা বলতে চাইছি যে, দেশে গণতন্ত্র নাই বলে এই জঙ্গীদের উত্থান ঘটেছে, তারা আসলে একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে সামনে এগুচ্ছি। আর রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলই যে তাদের উদ্দেশ্য, যেরকমটি আফগানিস্তানে হয়েছিল কিংবা পাকিস্তানে হওয়ার চেষ্টা চলছে কিংবা ধরুন, সিরিয়া ও ইরাকের একাংশ জুড়ে আইস-এর রাষ্ট্র, সকল ক্ষেত্রেই কিন্তু আল্লাহর শাসন কায়েম করার ধুয়া তুলে রক্তপাত ঘটিয়ে শাসনক্ষমতা দখল করে শেষ পর্যন্ত শাসনকর্তা কিন্তু সেই মানুষই এবং সেই রক্তপিপাসু, বিকৃতমনা মানুষগুলো কী ভাবে শাসন করছে তা কি আমাদের কারো অজানা? গলা কেটে মানুষ হত্যা, বিকৃত নারীভোগ আর নির্যাতন এবং অস্ত্র ও অর্থের বলে মধ্যযুগীয় বর্বরতার প্রচলন ছাড়া এইসব শাসনব্যবস্থার কোনো ভালো দিক কি এখনও কারো নজরে পড়েছে? আমার পড়েনি অন্তত। বাংলাদেশ যে পথে এগুচ্ছে তাতে এই জঙ্গীবাদীদের যদি সুযোগ সৃষ্টি হয় রাষ্ট্র-শাসনের তাহলে এদেশের অবস্থা আজকের সিরিয়া বা ইরাকের চেয়ে ভালো কিছু হবে এমন যারা ভাবছেন, তারা আসলেই বোকা কিংবা শয়তান-চালাক। গত সপ্তাহের লেখাটির সমাপ্তি এভাবেই টানতে চেয়েছিলাম। আশাকরি, ব্যাখ্যাটা দিতে পেরেছি আমি।